#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩০.
তিন্নি মধুর হাত ধরে বলল,,” একি তোর হাতে মেহেদি লাগল কি করে? সন্ধ্যায় দেওয়ার জন্য কত জোরাজুরি করলাম। তখন তো দিলি না। মাঝ রাতে মেহেদি দিয়ে হাত ভরিয়ে নিলি কীভাবে?”
মধু তিন্নির হাত থেকে নিজের হাত টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। সাবান দিয়ে দুই হাত ঢলতে লাগল। হাত ধুয়ে বেরিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তিন্নি আর রাহী শুয়েই ছিল। মধু রাহীর পাশে শুয়ে পড়ল।
রাহী মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” ভাইয়ার সাথে তোমার ঝগড়া হয়েছিল বলেই পালাতে পেরেছিলাম।”
মধু ড্রিম লাইটের আলোয় রাহীর দিকে তাকাল। রাহী তিন্নির পিঠে ধড়াম করে একটা কিল দিয়ে বলল,,” এই শয়তানি প্লান তোর ছিল তাই না।”
তিন্নি চিৎকার করে বলল,,” জি না এই প্লান ছিল মধুর। আমি তো ঘুমে ছিলাম।”
রাহী অবাক হয়ে তাকাল মধুর দিকে। মধু ঢোক গিলে বলল,,” সরি আপু আসলে একটু মজা করতে ইচ্ছে করছিলো তাই আরকি।”
রাহী বলল,’ শুধু মজা করতে ইচ্ছে করছিল নাকি ভাইয়ার সাথে প্রেম করার ইচ্ছে করছিল হ্যা।”
মধু চোখ মুখ কঠিন করে বলল,,” এমনটা হবে জানলে, এসব করার কথা চিন্তায় করতাম না।”
রাহী খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
” ভাইয়া তোমায় মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল?”
মধু উত্তর ছিল না। তিন্নি বলল,,” ভাইয়া মেহেদি দেওয়া শিখল কবে?”
রাহী বলল,,” শেখা লাগে নাকি? গার্লফ্রেন্ড কে ইমপ্রেস করতে একাই শেখা হয়ে যায় সব।”
দুই একটা কথা বলতে বলতে তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মধুর জন্য পরদিন কি চমক অপেক্ষা করছিল ও কল্পনাও করতে পারে নি। বিয়ের আনন্দ সব মাটি পরদিন হয়েছিল। পার্লার থেকে লোক এসে রাহী ও বাকিদের সাজিয়েছে। হলুদের সন্ধ্যায় সবাই ম্যাচিং এক রকম, একই রঙের শাড়ি পড়েছে। ফুলের গহনা। মধু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় তাজা ফুলের গাঁজরা পড়ছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে তিন্নি কানে ফুলের ঝুমকা পরছে। তিন্নি শাড়ি পরতে চাইছিল না। শাড়ি পড়লে ওকে নাকি মানায় না মোটা লাগে এজন্য ও শাড়ি পরা নিয়ে ঝামেলা করেছে। সবাই মিলে জোর করেই শাড়ি পরিয়েছে ওকে। শাড়ি পরার পর তিন্নি কে একটু মোটা লাগলেও সাজগোজ করার জন্য অনেক সুন্দর লাগছে। শ্যামবর্ণের মায়াবতী লাগছে যেন। মধু গাঁজরা একা সেট করতে পারল না। তিন্নিকে দিয়ে লাগালো। তারপর তিন্নিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে করিয়ে বলল,,” দোস্ত তোকে কত্ত সুন্দর লাগছে রে। তখন তো পরতে চাইছিলি না।”
তিন্নি আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,,” সুন্দর না ছাই। হাতির মতো মুটকি লাগছে।”
“চুপ মাইয়া। খালি বেশি কথা। আর একবার নিজেকে হাতি বললে মাইর খাবি আমার হাতে।”
মধু তিন্নির খোঁপায় গাঁজরা আটকে দিল।
” নাও পারফেক্ট আয় এবার কয়টা পিক তুলি।”
মধু ফোনের ক্যামেরা বের করে ফটাফট কয়টা সেলফি নিল।
কোমরের বিছা ঠিক করে দুই বান্ধবী বেরিয়ে এল। রাহী আর নাঈম কে সোফায় বসানো হয়েছে এখন হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হবে। দুই বান্ধবী সেখানে এসে উপস্থিত হলো। মিতুল রাহীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরা ম্যান ফটোশুট করছে। ভিডিও করছে।
সবাই হেসে হেসে পোজ দিচ্ছে। প্রথম বাবা মা হলুদ দিল। ফাহাদ কোথা থেকে দৌড়ে এসে মধু আর তিন্নির গালে হলুদ লাগিয়ে দিল। তিন্নি এক চিৎকার দিয়ে ওর পেছনে ছুটল আর মধু মুখে হাত দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। বর কনেকে হলুদ দেওয়ার আগেই ওর গাল হলুদে মাখামাখি হয়েছে গেল। মুখ বিকৃত করে মধু টিস্যু আনতে ছুটল। রাস্তায় দেখা হলো সমুদ্রের সাথে। তিনি ওকে দেখে হাহাহা করে হেসে উঠল। মধু দাঁত কিড়মিড় করে রুমে ফিরে এল।
টিস্যু নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল মুছতে লাগল। মেকাপ করে মুখ ভিন্ন কালার করে ফেলেছিল এখন হলুদ লেগে মুখের দুই গাল দুই কালার দেখা যাচ্ছে। কি বাজে লাগছে এখন দেখতে। মধু নাকের পাটা ফুলিয়ে ফাহাদ কে হলুদে গোসল করাবে প্রতিজ্ঞা করল। তারপর নিজের কসমেটিকস বের করে গালে মেকাপ করে দুই গাল একরকম করার চেষ্টা করতে লাগল।
মধু আয়নায় থেকে দেখতে পেল ফুয়াদ পেটে হাত গুজে পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। তার চোখের গাঢ় গভীর দৃষ্টি ওর দিকে। কিন্তু ওর মুখের দিকে না। মধু আয়নার ভেতরে দিয়েই ফুয়াদের চোখের দৃষ্টি বুঝার ট্রাই করছে। মধু শত চেষ্টা করেও ফুয়াদের দৃষ্টি বুঝতে পারল না। মনে হচ্ছে পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে পিঠে কি আছে লোকটা বেহায়ার মতো পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে কেন?
মধু চড়াও গলায় বলল,,” সমস্যা কি? আপনি এখানে কি করছেন?”
ফুয়াদ খুব সুন্দর করে ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দিল,,” তোমাকে দেখছি!”
মধু আয়নার দিকে পিঠ করে ফুয়াদের দিকে ঘুরে বলল,,”কি দেখছেন?”
ফুয়াদ ওর কথায় হাত পেটে থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আর ওর দিকে এক পা দুই পা করে এগুতে লাগে।
” কি আজব এগিয়ে আসছেন কেন? পিছিয়ে যান বলছি।”
ভয়ার্ত কন্ঠে বলল মধু। ফুয়াদ ওর ভীতু চাহনি দেখে পা থামিয়ে দেয়। আয়না ভেদ করে মধুর কাঁধের নিচে পিঠে থাকা তিলের দিকে নজর দেয়। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বলল,,” তোমার পিঠের কালো তিল টা খুবই আকর্ষণীয়। আই এ্যাম ক্রাশিত।”
মধু ফুয়াদের বেহায়াপনা কথা শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড়ো করে ঘাড় কাত করে আয়নার দিকে তাকায়। অনেক কষ্টে নিজের কালো তিলটা নিজেই দেখতে পায়। ব্লাউজ এর পেছনের গলা বড়ো হওয়ায় তিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মধু ঢোক গিলে ফুয়াদ কে নির্লজ্জ উপাধি দেয়।
ফুয়াদ আবার পা বাড়িয়েছে একদম মধুর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। মধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
” আমার সুইটহার্ট এর এতো সুন্দর তিল দেখার, ছোঁয়ার অধিকার শুধু আমার। এই অধিকার আমি আর কাউকে দিতে পারব না।”
বলেই ফুয়াদ একটানে মধুকে পেছনে ঘুরিয়ে ওর মাথার গাঁজরা খুলে নেয়। তারপর চুলের খোঁপা খুলে দেয়। অনেক কালো কিলিপ লাগানো ছিল। সেগুলো খোলার সময় মধু চুলে টান পেয়ে চোখ খিচে ঠোঁট কামড়ে ধরে ছিল দাঁত দিয়ে। ফুয়াদ আস্তে করে ওর খোঁপা খুলে চুল পিঠ ময়ে ছড়িয়ে দিল।
ফুয়াদ ফিসফিস করে মধুর কানে বলল,,” ইউ লুক সো হট সুইটহার্ট।”
বলেই আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করল না ফুয়াদ রুম ত্যাগ করল। মধু সেখানেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। ফুয়াদ চলে যেতেই ও শ্বাস নিতে পারল শান্তিতে। এতোক্ষণ ওর শ্বাস যেন আটকে ছিল।
তিন্নি মধু কে খোলা চুলে দেখে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগল। চুল কেন খুলেছে, কি হয়েছে ওর। মধু আশেপাশে তখন ফাহাদ কে খুলতে ব্যস্ত। ফাহাদ ওর মুখের বারোটা বাজিয়েছে। ও তার শোধ তুলবেই। রাহী আর নাঈম কে হলুদ দিয়ে এল দুই বান্ধবী। কেক কেউ কাটে নি তাই মধু গিয়ে কেক কাটল। রাহী আর নাঈম কে একটু খাইয়ে দিয়ে হাতে এক পিচ নিয়ে নিচে নেমে এল। ফাহাদ কে দূর থেকেই মধু কেক দেখিয়ে ডাকতে লাগল। খেতে পাগল ফাহাদ কেক দেখে লোভে পরে গেল।
ফাহাদ কে এগিয়ে আসতে দেখে বাম হাতের আড়ালে হলুদ লুকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল মধু। ফাহাদ কেক দেখে লোভ সামলাতে না পেরে দৌড়েই এল।
” মৌমাছি তুমি এতো ভালো।”
মধু শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,” চোখ বন্ধ করে হা করো খাইয়ে দেই।”
” চোখ বন্ধ করব কেন?”
” আরে করো না ফাহাদ। চোখ বন্ধ না করলে দেব না কিন্তু।”
ফাহাদ ভাবল কেক ই তো একটু চোখ বন্ধ করলে সমস্যা কি? ও চোখ বন্ধ করে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। মধু হলুদ ওয়ালা হাত বের করে কেক ও হলুদ দুই হাতে মাখিয়ে ফাহাদের দুই গালে ঘষে দেয়। ফাহাদ চিৎকার করে হা করা মুখ বন্ধ করে সামনে তাকায়। ততক্ষণে মধু কাজ কমপ্লিট করে দৌড়ে দিয়েছে।
ফাহাদ উল্টো পাল্টা হয়ে ওর পেছনে ছুটতে যায়। কিন্তু এবার মধুর কপাল ভালো তাই ওকে ধরতে পারে না।
মধু চোরের মতো মুখ করে ঘুরা ফেরা করছে। ফাহাদ ওকে খুঁজছে। ওর হাতে ধরা না পরার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরছে।
হঠাৎ একটা অপরিচিত মহিলা মধুর হাত টেনে ধরে।
মধু চমকে দাঁড়িয়ে পরে। মধু কপাল কুঁচকে হলুদ কাতান শাড়ি পরা গর্জিয়াস সাজের মোটা করে মহিলার দিকে তাকায়। ও একবার নিজের হাতের দিকে তো মহিলা টির মুখের দিকে তাকায় প্রশ্নতুক চোখে। আচমকা মহিলাটি ওর হাত টেনে ধরল কেন? ঢোক গিলে ও বলল,,” আন্টি কিছু বলবেন?”
মহিলাটি মনে করার চেষ্টা করছে। চিন্তিত মুখে কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ফট করেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,,” তুমি মেহেরিমা না?”
মধুর পিল চমকে উঠল। মহিলা টির কথা শুনে ওর চোখ দুটো বিষ্ময় এ বড়ো হয়ে গেল। ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগল। এই মহিলা ওর নাম জানল কি করে? এখানকার সবাই ওকে মধু বলেই চিনে। মধু বলছি সম্বোধন করে। এই মহিলা মেহেরিমা বলছে কেন? ও ভয়ে ঘামতে শুরু করে দিল। আঁতকে উঠা গলায় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।
মহিলাটি ফের বলল,,” তোমার বাবার নাম মাহতিম হোসেন তাই না?”
মধু ভয়ে এবার হার্ট এটাক করবে। বজ্রপাতের মতো চমকে উঠল মধু। তোতলানো গলায় বলল,,” আন্টি হাত ছাড়ুন।” মধু হাত ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। মহিলাটি কম যায় না। এতো শক্তি মধু তার হাতের বাঁধন থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারছে না।
উপায় না পেয়ে মধু মহিলাটি হাতে কামড় দিয়ে বসে। মহিলা টি চিৎকার করে হাতের বাঁধন আলগা করে দেয়। আর সাথে সাথে মধু ঝামটা দিয়ে নিজের হাত টেনে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর উল্টো ঘুরে এক দৌড়ে মহিলাটিকে ফেলে ছুটে পালিয়ে যায়। মহিলাটি অবাক হয়ে মধুর পালানো দেখল। তারপর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। হাতে দাঁতের দাগ বসে গেছে।
#চলবে….
( ঈদ আসলে সবারই ব্যস্ততা বাড়ে। লেখিকা বলে আমার কোন ব্যস্ততা নাই এমনটা ভাবা বন্ধ করুন। ঈদ কেমন কাটল সবার?)