#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
২৬.
মধু বসে আছে একটা টং দোকানের বাঁশের বেঞ্চে। ওর পাশেই গা ঘেঁষে বসে আছে ফুয়াদ। ওদের হাতে মাটির চায়ের কাপ। ওরা রিসোর্ট থেকে বের হয়েছিল তিনটা নাগাদ। ঢাকা পৌঁছাতে রাত পেরিয়ে ভোর হবে। লাঞ্চ করেই বের হয়েছে। কিন্তু তবুও দুই ঘন্টা যেতেই গাড়ি থামিয়ে ফুয়াদ ওদের সবাইকে নিয়ে একটা নির্জন নিরব রাস্তায় নেমেছে। এখানে ছোটো একটা চায়ের দোকানে আছে। সেখানেই এসেছে ওরা চারজন। মধুর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না ফুয়াদ এর সাথে বাইরে বের হওয়ার কিন্তু ফুয়াদের থ্রেট খেয়ে আসতে হয়েছে। গাড়ি থেকে নামার সময় মধু যখন দ্বিমত প্রকাশ করছিল তখন ফুয়াদ ওকে বলে উঠে,,” নেমে একটু শান্তির হাওয়া খাবে নাকি তোমার ভাইকে কল করে তোমায় তার হাতে ছেড়ে দিব।”
মধু ফুয়াদের মুখে নিজের ভাইয়ের কথা শুনে ওর মাথায় যেন বাজ পরে।
থতমত গলায় মধু বলল,,” মানে কি বলছেন?”
ফুয়াদ ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখেই বলল,,” ভাইয়ের ভয়ে যে কক্সবাজার থেকে পালিয়ে এলে। সেটা তো আমি জেনে গেছি সুইটহার্ট।”
মধু ভয়ার্ত চোখে তাকায় ফুয়াদের চোখের দিকে। ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগে।
” আপনি জানলেন কিভাবে? আমি তো এসব আপনাকে বলিনি।”
ফুয়াদ মধুর প্রশ্নে রহস্যময় হাসি দিল। মধু সেই হাসিতে কেঁপে উঠল। আর ভীত মুখে বাইরে বেরিয়ে এল। সন্ধ্যা লেগে যাবে একটু পরই। পাকা সড়কের পাশ দিয়ে অসংখ্য গাছ গাছালি, জঙ্গল। বাড়ি ঘর কিচ্ছুটি নাই। কেমন শুনশান, নীরবতা ছেয়ে গেছে রাস্তায়। সন্ধ্যায় এমন অদ্ভুত ভূতুরে টাইপের রাস্তা দেখে মজা লাগার বদলে মধু ভয়ে সিটিয়ে গেল।
মধু তিন্নির হাত ধরে বলল,” দোস্ত এটা কেমন রাস্তা রে মনে হচ্ছে এই রাস্তায় মানুষ খুন করে রাখে। কেমন টাইপের দেখতো এখানে কেউ নামে?”
তিন্নি ফোন বের করে ফটাফট ছবি তুলছে ওর কাজ দেখে মধুর আরো রাগ হলো। সাহিত্য আর ফুয়াদ আগে আগে হেঁটে চায়ের দোকানে বসে গেছে। একটা বয়স্ক লোক বসে আছে চায়ের দোকানে। মধু এই দোকান দেখে আরো টাস্কি খেল এমন শুনশান ভূতুড়ে রাস্তায় এই বয়স্ক লোকটা দোকান দিয়ে বসে আছে। এখানে চা খেতে আসবে কেন? চায়ের সাথে কলা ও পাউরুটি দেখা গেল আর কিছু নাই।
মধুর মনে হলো এটা ভূতের রাস্তা আর ভূতদের সর্দার এই বয়স্ক লোকটা। তার এই দোকানে মানুষ না আসলেও ভূতেরা ঠিকিই আসে। এসব চা খাবার হয়তো তাদের জন্য রাখা হয়েছে। ঘনঘন পলক ফেলে তাকিয়ে আছে দোকানের দিকে।
” চা ঠান্ডা শরবত হয়ে গেল সুইটহার্ট।” পাশ থেকে ফুয়াদের ফিসফিস আওয়াজ কানে আসতেই মধু চিন্তা ভষ্ঠ হলো। ও চায়ে এক চুমুক দিল। ও দেখল আসলেই চা একদমই ঠান্ডা হয়ে গেছে। ও এক চুমুক দিয়ে সেটা আর খাওয়ার ইচ্ছে বোধ করল না। ফেলে দিতে চাইল পাশ থেকে কেউ ছো মেরে ওর কাপ টেনে নিল। মধু রুষ্ট চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ সাহিত্যের সাথে কথা বলছে আর ভাবলেশহীন ভাবেই ওর ঠান্ডা চা এক চুমুক এ সাবাস করছে। মধু নাক ছিটকে তাকিয়ে রইল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ চায়ের কাপ দোকানি কে ফিরিয়ে দিয়ে এলে মধু বলল,” আমার এঁটো ঠান্ডা চা খেলেন কেন?”
” মধু মেশানো চা খেতে বড়ই টেস্টি। তাই মিস করতে মন চাইল না।”
মধু রাগে ফুঁসে উঠে দাঁড়াল। ফুয়াদ ওর রাগ দেখে নিজের হাসি কন্ট্রোল করতে পারল না। তিন্নির হাত ধরে টেনে গাড়ির দিকে যেতে লাগল মধু।
পেছনে থেকে ফুয়াদ চেঁচিয়ে বলে উঠল,,” মধুচা খেয়ে লোভ হয়ে গেল। এখন থেকে চিনি নয় মধু হবে চায়ের উপকরণ।”
সাহিত্য বলল,,” আমরা ও তাইলে মধুচা খাবো।”
ফুয়াদ ওর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,” এই চা শুধু আমার জন্য বরাদ্দ।”
তিন্নি ছবি তুলে রাহী কে পাঠিয়ে দিয়েছে। রাহী সেই ছবি দেখে হায়হুতাশ করছে। ওদের রেখে কেন ওরা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ঘুরছে। এসব শুনে মিতুল টান দিয়ে ফোন কেড়ে নেয়। তিন্নি অনেক গুলো ছবি পাঠিয়েছে। সেখানে একটা ছবি ফুয়াদ আর মধুর পাশাপাশি বসে আছে। সেটা দেখে ওর গা জ্বলে উঠল। ও আগুন চোখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিতুল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,,” গাড়ি থামাও।”
সমুদ্র আচমকা চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে বলল,,” কি হয়েছে?”
মিতুল গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলল,,” আমি এই গাড়িতে যাব না। আমি ফুয়াদের সাথে যাব।”
সমুদ্র সহ গাড়িতে থাকা বাকিরা চোখ বড়ো বড়ো করে বিষ্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকাল।
রাহী অবাক কন্ঠে বলল,,” তুমি কি পাগল হয়ে গেছ মাঝরাস্তায় নেমে বলছ এই গাড়িতে যাবে না। এখানে ফুয়াদ ভাইয়া কোথা থেকে আসবে?”
” ওরা আমাদের পরে রওনা দিয়েছে তার মানে এখনো এই রাস্তা পাড়ি দেয়নি। তাই আমি ওদের গাড়ির অপেক্ষা করব এখানে দাঁড়িয়ে।”
সমুদ্রের মেজাজ গরম হয়ে গেল। মিতুল ছেলেমানুষী কথা শুনে।
সমুদ্র শান্ত গলায় মিতুল কে বলল,,” মাঝরাস্তায় সিনক্রিয়েট করো না মিতুল। গাড়িতে এসে বসো। রাতের পথ এমনিতে বিপজ্জনক হয়ে থাকে আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”
মিতুল একগুঁয়েমি গলায় বলল,,” আমি যাব না বললাম তো। ওই মেয়েটার সাথে আমি ফুয়াদ কে কিছুতেই ফুর্তিতে থাকতে দেব না।”
সমুদ্র নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। মিতুল কে এক ধমক দিয়ে বসল। শান্ত শিষ্ট সমুদ্র কে আচমকা রাগতে দেখে মিতুল হতচকিয়ে গেল। এর আগে কখনো সমুদ্রের রাগের সম্মুখীন হয়নি ও প্রথম বার সমুদ্রকে রাগতে দেখে ও ভয়ে ঘামতে শুরু করে দিল। সুরসুর করে গাড়িতে উঠে বসল।
সমুদ্র কপালে আঙুল দিয়ে সাইড করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে পানি খেল এক ঢোক তারপর শান্ত চোখে তাকাল মিতুলের দিকে আর বলল,,” মিতুল তুমি বাচ্চা মেয়ে নও যে এমন পাগলামি করবে আর তোমার থেকে এমনটা আশা ও করিনা। তাই এমন বিহেভ করা বন্ধ করো। তুমি কি করতে চাও কি করতে দিবে না তা ঢাকা ব্যাক করে করিও। এখানে রাস্তায় সিনক্রিয়েট করো না। তুমি এখন আমার রেস্পনসিবিলিটি তাই তোমাকে বললেই আমি মাঝ রাস্তায় ফেলে যেতে পারব না। সরি।”
মিতুল আর রাগ জেদ দেখানোর সাহস পেল না।
সমুদ্রের রাগ দেখে ওর সব সাহস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মনে রাগ পুষে রাখলো।
তিন্নি মধুর হাত ছাড়িয়ে বলল,,” উফ মধু ওখানে বসে থাকতে কি ভালো লাগছিল টেনে আনলি কেন?”
” তোর ভাই আমার সাথে কেমন আচরণ করছিল দেখছিলি না।”
” চল প্লিজ ভাইয়ারা আসছে না চল ওখানে যাই।”
” তোর এতো যেতে ইচ্ছে করলে তুই যা। আমি যাব না। আমি এখানেই থাকব।”
” অন্ধকার হয়ে গেছে ভয় পাবি না?”
মধু ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,,” আমি তোর মতো ভীতুর ডিম না।”
” ওকে সাহসীর মা তুই থাক আমি যাই আরেক কাপ চা খেয়ে আসি। এখানকার বাতাস ভালো ঠান্ডা গরম গরম চা খেতে মজাই লাগছিল।”
তিন্নি আবার চলে গেল দোকানের দিকে। মধু একাই গাড়ির কাছে গিয়ে হেলান দিয়ে দাড়াল। ও ভেবেছিল তিন্নি যাবে না কিন্তু ফাজিল টা সত্যিই ওকে এখানে একা রেখে চলে গেল। কেমন জঙ্গল টাইপের জায়গা চারপাশে। রাত হওয়ার আগেই কেমন সন্ধ্যায় রাতের আঁধার নেমে এসেছে জায়গাটায়। অনেক সময় বাদে বাদে একটা করে গাড়ি ছুটে যায় এই রাস্তা দিয়ে। মধুর ভয় লাগতে শুরু করল। গাড়ি থেকে নামার সময় মধু ফোন রেখে এসেছিল। ও দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসবে ভাবল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে গা ছমছম করছে। ভয় লাগছে। ও তিন্নির সামনে যতই নিজেকে সাহসী দেখাক না কেন আসলে তো ও একটা ভীতু। মধু ঢোক গালে গাড়ির দরজা খোলার জন্য টান মারল কিন্তু গাড়ির দরজা এতো শক্ত যে খুলল না। কি অদ্ভুত ওর শরীরে কি জোর নাই ও দরজা কেন খুলতে পারছে না দুই হাত দিয়ে জোরে টেনে ধরল। টানতে লাগল গাড়ির দরজা একটু ও খুলল না। মধুর হাতের তালু ব্যথা হয়ে গেছে টানতে টানতে ও গাড়িতে হেলান দিয়ে হাতের তালু ঢলতে লাগল। গাড়ি কি লক করে গেছে নাকি? মধু এবার ভয় ভয় চোখে তাকাল চারপাশে কেমন যেন করে উঠল ওর মন। মন বলল এখানে হাজার শো ভূত ওকে মারতে উৎ পেতে আছে। হঠাৎ পাশের একটা জঙ্গল গাছের পাতার তলে কিছু নড়ে উঠল। ঝপঝপ শব্দ হলো যেন কিছু ওখানে লুকিয়ে আছে। মধু ভয়ার্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে ভয়ে ওর মুখের রক্ত গায়েব হয়ে গেছে। জঙ্গলের ভেতরে থেকে কিছু অন্ধকারে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখে ও ধ্যান জ্ঞান ভুলে চিৎকার করে আল্লাহ গো বলে এক দৌড় দিল দোকানের দিকে।
ফুয়াদ তিন্নির সাথে মধু কে আসতে না দেখে এগিয়ে আসছিল। তখনি মধু চিৎকার করে ওর দিকে ছুটে আসে আর ওকে জড়িয়ে ধরে। ফুয়াদ মধুর স্পর্শে থমকে যায়। মধু ভয় পেয়েছে ওর শরীরের কাঁপুনি দেখেই বুঝতে পারছে ফুয়াদ।
” তিন্নি বলল তুমি নাকি খুব সাহসী। সাহস দেখাতে একাই এখানে ছিলে। সাহস ফুরিয়ে গেল কি দেখে?” ফুয়াদ মধুকে ধরে নি মধুই ফুয়াদ কে শক্ত করে ধরে ভূত ভূত বলে চেঁচাচ্ছে।
” ভূত? আবার ভূত! এই তুমি ভূত ছাড়া কি আর কিছু দেখ না! পৃথিবীর সব ভূত বুঝি তোমার সামনে এসে উপস্থিত হয়?”
মধু হাত উঁচিয়ে বলল,,” সত্যি ওখানে কিছু ছিল আমি দেখেছি।”
” রিয়েলি এই অন্ধকারে তুমি দেখেছ? কিভাবে আমি তো কিছুই দেখতে পারছি না।”
মধু ফুয়াদের বুকে থেকে মাথা তুলে বলল,,” দেখি নি কিন্তু শব্দ পেয়েছি। আপনি লাইট ধরে দেখুন।”
ফুয়াদ পকেটে থেকে ফোন বের করে ফ্লাশ জ্বালিয়ে সামনে ধরল। সামনেই গাড়ির সাথে লেপ্টে একটা সাদা ধবধবে পশমের বিড়াল ছানা বসে আছে। লাইটের আলোতে বিড়াল টা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়ালের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে সেই চোখ দেখে মধু আরেক চিৎকার দিয়ে ফুয়াদের বুকের শার্ট খামচে ধরে ওর বুকে সাথে আরো নিবিড় ভাবে মিশে যায়।
” ও গড, ওই তো ভূত বিড়াল রুপ নিয়ে আমাকে আক্রমন করতে আসছে।”
মধুর বোকা কথা শুনে ফুয়াদ কপাল কুঁচকে বলল,,” ওই কিউট বিড়াল ছানা তোমাকে আক্রমণ করবে? সিরিয়াসলি!”
” হ্যা দেখেন না কেমন সাদা আর চোখ কেমন জ্বলজ্বল উঠছে। ও মাই গড তাড়াতাড়ি এখানে থেকে চলুন ওটা আমাকে মেরে ফেলবে।”
” এইটুকু বিড়াল ছানা তোমাকে মেরে ফেলবে?”
মধু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,,” হ্যা।”
ফুয়াদ বলল,,” সুইটহার্ট ভয় পেলে তুমি এতো কাছে আসবে জানলে আমি নিজেই তোমায় ভয় দেখাতাম ভূত সেজে।”
মধুর ভয়ের মধ্যে ও রাগী চোখে তাকাল ফুয়াদ এর দিকে।
” আমার দূর্বলতার সুযোগ নিতে চাচ্ছেন।”
” সুযোগ তো তুমি নিচ্ছ। দেখ আমি কিন্তু তোমায় টাচ করিনি। উল্টো তুমি আমার একটু বেশিই কাছে চলে এসেছ।”
মধু খেয়াল করল ফুয়াদ ওকে সত্যি ধরেনি। ও নিজেই দুই হাতে ফুয়াদ কে ধরে রেখেছে। আর ফুয়াদ এক হাতে ফোন ও অন্যহাত শূন্য। ও লজ্জায় ফুয়াদের শার্ট ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
ফুয়াদ মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই আমিই তো।”
” আপনিই তো মানে কি? আপনি বলেই তো লজ্জা পাচ্ছি।”
” তাই! শুনেছি মেয়েরা ভালোবাসে যাকে তার কাছে লজ্জা পায়। তুমি কি আমায় ভালোবাসো?”
” নো নেভার।”
#চলবে…….
( ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)