#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
২৪.
একদিন বিছানায় পরে থাকলে ও দ্বিতীয় দিন আর বিছানায় পরে থাকে নি মধু। ঘুরতে এসে রুমে বসে থাকবে একি হয় নাকি। ওর গায়ের জ্বর ও ছেড়েছে। জ্বর এই কমে এই বাড়ে। মধুর সকালে থেকে জ্বর নাই তাই ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতে লাগল সবাইকে। আজ অনেকেই ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। মধুর সাথে ফুয়াদ আর তিন্নি থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু মধু কে রেডি হয়ে বের হতে দেখে কারো আর রিসোর্ট এ থাকার দরকার পড়ল না। ফুয়াদ মধুকে বের হতে মানা ও করেছিল কিন্তু মধু এমন ভাব করেছে যেন ওর কথা ওর কানেই যায়নি। ফুয়াদ মধুর এমন উপেক্ষা জাস্ট সহ্য করতে পারছে না কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে।
সবাই হিমছড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মধু ফাহাদের সাথেই মিশে আছে। একমাত্র ওকে ধমকাতে ওর ভালো লাগছে। এতো বার ধমক দিয়েছে ভাবি ডাকার জন্য। ধমক দিলেই ফাহাদ কান ধরে সরি আপু বলে। আবার একটু পরেই ভাবি ডাকা শুরু হয়ে যায়।
হিমছড়ি যাওয়ার পথটি মধুর মারাত্মক পছন্দ হয়েছে। একপাশে বিস্তৃন্ন সমুদ্র আরেকপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি মাঝে পিচ ঢালা মেরিন ড্রাইভ।
হিমছড়ি থেকে ঘুরে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হিনানী বিচ যাওয়ার পথ ধরল। মাঝে মধু কে রেখে যাওয়ার কথা হয়েছিল ওর যদি খারাপ লেগে থাকে সেই জন্য। কিন্তু মধু ফিট আছে বলেছে।
” ঘুরা ঘুরি করলে মন ও শরীর দুটোই চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমাকে নিয়ে এতো টেনশন করার কিছু নাই আমি সুস্থ আছি।”
থেমে আবার ফুয়াদ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কারো এক্সটা কেয়ার আমার দরকার নাই।”
মধুর এমন কথায় ফুয়াদ ফুঁসে উঠে বলেছে,,” কেউ যেন আবার অজ্ঞান হয়ে আমার বাহুতে না পরে।”
মধু আগুন গরম চোখে ফিরিয়ে তাকাল ফুয়াদের দিকে। এতো গুলো মানুষের মাঝে আর তর্ক বাড়াল না। আর বাড়াতে ও চায় না।
ঘুরাঘুরি শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এল রিসোর্ট এ সবাই।
ডিনারের আগে আর কেউ বের হলো না রুমে থেকে। ডিনার শেষ করে সবাই আড্ডা জমালো। আজকের আড্ডায় মধু ও আছে। মধুর একপাশে তিন্নি আরেকপাশে ফাঁকা। ফুয়াদ আর সমুদ্র বাদে সবাই আছে। মধুর কেন জানি মনে হলো এই চেয়ারে ফুয়াদ বসবে। কিছুক্ষণ বাদেই দুজনে এসে উপস্থিত।
মধু সমুদ্রকে ডেকে উঠল,,” ভাইয়া এখানে বসবেন?”
সমুদ্র ফুয়াদের দিকে এক পলক তাকিয়ে বসে পড়ল। মধু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসল। ফুয়াদ মুখটা গম্ভীর করে মিতুলের পাশে গিয়ে বসল। পাশে বসতে না পারলেও মুখোমুখি বসেছে মধুর সাথে ফুয়াদ।
” সারাদিন ঘুরা ঘুরি করে এখন শরীরের কি অবস্থা?” সমুদ্র সুধাল মধুকে।
মধু হেসে উত্তর দিতে যাবে ওর কথা গলায় আটকে যায়। মুখের হাসিও নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়। মধু অনুভব করে ওর পায়ের উপর আরেকটা পায়ের উপস্থিতি। খামচে ধরেছে ওর পা তার পা দ্বারা। মধু রাগী চোখে তাকায় ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ সাহিত্যের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। মধু চোখ মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ ভুল করেও ওর দিকে তাকায় নি। সমুদ্র মধুর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আসায়। আর মধু ওকে বাদ দিয়ে ফুয়াদের দিকে শক্ত মুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র আর উত্তরের আসা করল না। মধু এখন উত্তর দেবার অবস্থাতেও নাই ও আছে রেগে আগুন হয়ে।
ফুয়াদ কথা বলতে বলতে সামনে তাকাতেই মধুর আগুন গরম দৃষ্টি দেখে বাঁকা হাসল। মধুর গা জ্বলে উঠল সেই হাসতে।
ফট করেই মধু দাঁড়িয়ে পড়ল আর বলল,,” আমি রুমে যাব।”
” এনি প্রবলেম?” সমুদ্র বলল।
মধু বলল,,” হ্যা মাথা ব্যথা করছে।”
মাথা ব্যথা শুনেই তিন্নি ওকে নিয়ে চলে গেল রুমে।
” এজন্য আজ বের হতে মানা করছিলাম।”
“আমার মাথা ব্যথা নাই।”
তিন্নি অবাক স্বরে বলল,,” মিথ্যা বললি কেন?”
” তোর খাটাশ ভাইয়ের জন্য।”
তিন্নি বলার মতো কিছুই পেল না।
মধু কে রুমে রেখে আবার ফিরে আসলো। মধুই পাঠিয়েছে ওকে। মধু একাই শুয়ে থাকবে বলেছে। মধু বিছানায় শুয়ে আছে ও জানে এখন ফুয়াদ আসবে ও চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে আছে। দশমিনিট পরেই দরজা খুলে ফুয়াদ আসলো ভেতরে। মধুর অগোচরে ফুয়াদ ওর খুব নিকটে থাকে মধু জানে। সব সময় ঘুমে থাকলেও আজ ঘুমে নাই ও। আজ ও জেগে ঘুমের ভান ধরে পরে থাকবে দেখবে এই শয়তান লোক কি করে।
ফুয়াদ এসে মধুকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে ঘুমিয়েছে কিনা।
মধুকে ভারি নিঃশ্বাস নিতে দেখে ওর মনে হলো মধু ঘুমিয়ে গেছে। ও ঠিক পনেরো মিনিট পর এসেছে। যদি সত্যি মাথা ব্যথা থাকে তাহলে রুমে এসেই ঘুমিয়ে যাবে আর যদি ওর জন্য এসে থাকে তাহলে ঘুমাবে না। ফুয়াদের মন বলছে মধু ঘুমায় নি ভারি নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুমের ভান করছে। ফুয়াদ মধুর পাশে গিয়ে বসল। মধুর নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ও নড়তে পারছে না এদিকে ফুয়াদ ওর গা ঘেঁষে বসেছে। আবার ওর মুখের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। ফুয়াদের তপ্ত নিঃশ্বাস ওর চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। মধু ঘুমের ভান করে আর পরে থাকতে পারছে না। সারা শরীর শিরশির করে কাঁপছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হার্ট এতো জোরে বিট করছে মনে হয় ফেটেই যাবে। ঢোক গিলছে মধু। ফুয়াদ ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল ফুয়াদ তারপর বলল,,” তুমি অভিনয়ে খুব কাঁচা সুইটহার্ট।”
মধু চোখ মেলল না। চোখ খিচে নিল আরো। নিস্তেজ শরীর নিয়েই পরে রইল। ও ধরা পরে গেছে কিন্তু তাও চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কপালে ফুয়াদের হাতের স্পর্শ পেতেই শক্ত হয়ে গেল ওর শরীর।
ঠোঁট কামড়ে ধরল দাঁত দ্বারা। চোখ মেলতে না পারলেও হাত নিয়ে ফুয়াদের হাত ধরে নিজের কাছে থেকে সরাতে চাইল। অদ্ভুত ভাবে মুখ দিয়ে কথা ও বের করতে পারল না। ফুয়াদ হাত সরিয়ে নিল না। মধুর হাত নিজের হাতের উপর থেকে সরিয়ে বলল,,” অসুস্থ তোমার সাথে রোমান্স করতে আসিনি। এসেছি হেল্প করতে।”
মধু মন চাইল চিৎকার করে বলতে আপনার হেল্প এর কোন প্রয়োজন নাই। এতোক্ষণ মাথা ব্যথা না করলেও এবার সত্যি মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ফুয়াদের উপস্থিতি মানেই শরীর অসুস্থ হওয়া।
ফুয়াদ খুব সুন্দর আলতো ভাবে কপালে আঙুল দিয়ে ম্যাসাজ করতে লাগল। মধুর খুব আরাম লাগতে শুরু করল। ঘুমানোর উদ্দেশ্য না থাকলেও এই আরামের কাছে হার মেনে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল।
মধু ঘুমিয়ে যেতেই ফুয়াদ কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। মধুর ছোট নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল। ঘুমের মধ্যে ও মধু ফুয়াদের স্পর্শে কেঁপে উঠল।
” তুমি খুব বোকা সুইটহার্ট। ঘুমাবেনা ভেবেও ঘুমিয়ে গেলে। তাও আমারি আদর খেয়ে।”
ঘুমন্ত মধুর মায়াবী মুখশ্রীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গালে হাত ঠেকিয়ে। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো বেহায়ার মতো চেয়ে আছে পলক ও ফেলতে চাইছে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ফুয়াদ উঠে দাঁড়াল। আর গটগট করে বেরিয়ে এল রুম থেকে। বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।
পরদিন মধু ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসল। ঘুমের আগে সেই ঘুমের ভান করে থাকা ও ফুয়াদের উপস্থিতির কথা মনে করল। পরে আর কিছুই মনে করতে পারল না। লোকটা জাদু জানে নাকি? সে আসার পর আর কিছুই মনে পরছে না কেন? আমি তো ঘুমাবো না ভেবেছিলাম তাহলে ঘুমিয়ে গেলাম কিভাবে? মধু বিছানায় বসে এসব ভাবছিল। রুমে আর কেউ নাই কোথায় আছে জানার জন্য এদিকে ওদিকে তাকাল। কাউকে নজরেই এল না। তখনি মিতুল এসে উপস্থিত হলো। মধু এক নজর চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। মিতুল এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,” মধু কি খবর কেমন আছো?”
মধু ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মিতুল দাঁত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে রইল।
মধু ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে দেখল মিতুল বিছানায় বসে আছে। ও আসতেই বলল,,” তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”
মধু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিতুল কিছু বলতে যাবে রাহী এসে উপস্থিত হলো রুমে। রাহী কে দেখে মিতুল চুপ করে গেল।
” মিতুল ভাবি তুমি এখানে?”
মিতুল বলল,,” তোমাকেই খুঁজতে আসছিলাম কোথায় ছিলে?”
” সমুদ্র ভাইয়ার কাছে। কিছু বলবে?”
” না এমনিতেই রুমে একা ভালো লাগছিল না তাই আসছিলাম।”
মধু ওদের দুজনকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এল। নিজেই একা হাঁটতে লাগল। নিচতলায় নেমে দাড়াতেই ওর চোখে পড়ল গেটের কাছে দাঁড়ানো একজনের উপর। ওর হাঁটু কেঁপে উঠল।
বজ্রপাতের মতো চমকে উঠেছে মানুষটাকে দেখে। ভয়ে মধুর সারা শরীর থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। মুখে হাত চেপে তাড়াতাড়ি পেছনে ঘুরে গেল। উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। ওর পা অবশ হয়ে আসছে। হাঁটতেই পারছে না কিন্তু ও প্রাণপনে চাচ্ছে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে। ভয়ে আর মধু হাঁটতে পারল না দুই সিঁড়িতে উঠেই বসে পড়ল। বসে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। ওর শরীর মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছে। ভয়ে ও নড়তে পারছে না। একটা মেয়ে তখন সিঁড়ি বেয়ে নামছিল ওকে ওভাবে বসে কাঁপতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,,” কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
মধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। মেয়েটা মধু কে ধরে উঠালো। তারপর ওকে ধরে নিয়ে যেতে লাগল রুমে। দূর থেকে সমুদ্র এই অবস্থায় মধু কে অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে এগিয়ে আসতে দেখে চমকে এগিয়ে আসলো।
” মধু কি হয়েছে তোমার?”
মধু কথা বলার মতো অবস্থায় নেই ও সমুদ্রের হাত জাপ্টে ধরে কাঁপতে লাগল। মেয়েটিকে সমুদ্র ধন্যবাদ বলে মধু কে রুমে এনে বিছানায় বসায়।
রাহী আর মিতুল ওর এই অবস্থায় থেকে চমকিত। সমুদ্র গ্লাসে পানি এনে মধুকে দিয়ে বলল,,” পানি খাও।”
মধু বাধ্য মেয়ের মতো পানি খেয়ে নেয়। সমুদ্র ওর সামনে বসে বলল,,” এবার বলো কি হয়েছে। এতো ভয় পেয়েছ কেন?”
মধু এখনো ভয়ে ঠুকরে উঠছে। সমুদ্র মধুর হাত ধরে বলল,,” আমরা সবাই আছি তোমার সাথে। নির্ভয়ে বলো। কি হয়েছে তোমার।”
মধু ভরসা পেল যেন। সমুদ্রের হাত আঁকড়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। ওর দু’চোখ বেয়ে অনগল জল গড়িয়ে পরতে লাগল। সমুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আচমকা এমন বিহেভ করার কারণ কি হতে পারে ভেবে শঙ্কিত হচ্ছে।
#চলবে……
( ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। লেট হওয়ার জন্য সরি। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই লেট হয়েছে। নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।)