#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
২২.
দুই ঘন্টা পর মধুর গায়ের জ্বর কমে এল। মধুর জ্বরের জন্য কেউ আর সূর্য ডোবা দেখতে গেল না। তা নিয়ে মিতুল খুব ঝামেলা করল। একজন অসুস্থ তাই সবাইকে কেন তার জন্য রুমে বসে থাকতে হবে। রাগে মিতুল কাঁপছে। যখন থেকে শুনতে পেয়েছে মধু অসুস্থ তখন থেকেই ও আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। আর একটা জিনিস ওর ভালো লেগেছে মধু অসুস্থ হয়েছে তার পর থেকে ফুয়াদ একবার ও ওর কাছে যায় নি। এতেই স্পষ্ট ওই থ্রাড ক্লাস মেয়ের জন্য ফুয়াদের কোন টান নাই। মিতুল খুশি ধরে না যেন।সেই খুশিতে ও সাজুগুজু করে আসলো। ফুয়াদ কে নিয়ে রাতে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে হাঁটবে। খুব ইচ্ছে করছে ফুয়াদের হাত ধরে হাঁটতে। ফুয়াদ বাদে সবাই দুঃখী মুখ করে বসে আছে। তার মানে ওকে বললেই রাজি হয়ে যাবে। মিতুল খুশি মনে ফুয়াদের রুমে নক করল।
মিতুল তখনো জানতো না ওর সাথে কি ঘটতে চলেছে।
ফুয়াদ দরজা খুলে মিতুল কে সেজে গুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।
মিতুল বলল,,” চলো আমরা দুজনে একটু একাকি ঘুরতে যাই।”
” মানে?”
” ওই বাইরের মেয়েটা একটু অসুস্থ হয়েছে তাতে সবাইকে কেন রুমে বসে থাকা লাগবে বলোতো। বেশি বাড়াবাড়ি।”
মিতুল নিজেও জানে না ও কাকে কি বলছে। সবাই ঘুরতে যেতে চেয়েছিল শুধু ফুয়াদের ধমক খেয়ে সবাই যাওয়া ক্যান্সেল করেছে।
ফুয়াদ রাগী স্বরে মিতুলকে বলল,,” এর আগেও তো এখানে এসেছো। কোনো জায়গা বা কিছুই দেখার বাকি নেই। একজন অসুস্থ তাকে রেখে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার এতো ইচ্ছে কেন? তোমার যেতে ইচ্ছে হলে তুমি যাও আমি কোথাও যাব না।”
মিতুলের হাসি খুশি মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। ও কিছু বলতে যাবে রুমের ভেতরে থেকে সাহিত্য বেরিয়ে এসে মিতুল কে বলল,,” তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে যেতে পারি। আমার ও রুমের ভেতরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
মিতুল কটমট চোখে তাকিয়ে আছে সাহিত্যের দিকে। ফুয়াদ সাহিত্যের কথা শুনে মিতুল কে উদ্দেশ্য করে বলল,,” হ্যা ওকেই নিয়ে যাও। আমি কোথাও যেতে পারব না। সাহিত্য তুই যা।”
সাহিত্য ভেতরে গিয়ে শার্ট পরিবর্তন করে এসে দাঁড়াল মিতুলের পাশে মিতুল বোকা চোখে একবার সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে গটগট করে রিসোর্ট এর বাইরে চলে এল।
ফুয়াদ কল দিল তিন্নি কে। তিন্নি মধুর থেকে সরে বেলকনিতে এসে ফোন রিসিভ করে ফিসফিস করে কথা বলল ওর সাথে। ফুয়াদ মধুর খোঁজ নিচ্ছে ফোন করে এ ছাড়া উপায় নাই। মধু যে ওর উপর রাগ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে ও জানে। মধুর সামনে গেলে ও আরো উত্তেজিত হয়ে পড়বে। রাগারাগী করবে। যেটা ও চায় না। এমনিতেই অসুস্থ এই অবস্থায় আর রাগারাগী করিয়ে কষ্ট দিতে চায় না ফুয়াদ। ফুয়াদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপতে লাগল। ওর ফোনে একটা ভিডিও আসতেই ও লাফিয়ে ওঠে বসল। প্রান্ত পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ এ ভিডিও। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রমেশচন্দ্র একটা মেয়ে নিয়ে সাগরের পাড়ে ঘেঁষে হাঁটতে। ফুয়াদ তাড়াতাড়ি ট্রি শার্ট একটান দিয়ে খুলে মাথা ঢাকা জ্যাকেট পড়ে চোখ পর্যন্ত ঠেকে সেদিকে ছুটল। সমুদ্রের সাথে দেখা হয়ে গেল মধু ও তিন্নির রুমের সামনে।
সমুদ্র ফুয়াদ কে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল,,” কোথায় যাচ্ছিস এতো তাড়াহুড়ো করে?”
” এসে বলছি। মধু এখন কেমন আছে?”
” আগের থেকে বেটার বলছে বাইরে ঘুরতে যাবে।”
” এই অবস্থায়?”
” হুম মেয়ের গায়ে জোর আছে। রেডি হচ্ছে।”
” তাহলে নিয়ে আসো। আমি যাচ্ছি।”
” আরে শোন ছোটো,
ফুয়াদ আর শুনল না চলে গেছে।
রাহী আর নাঈম ও যখনি শুনতে পেয়েছে মধু ঘুরতে যেতে চায় তখনই দুজন চলে গেছে। রয়ে গেছে তিন্নি, মধু ও সমুদ্র। সমুদ্র ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। মধুর গায়ের তাপমাত্রা এখন কম থাকলেও শরীর ব্যথা আছে। দূর্বল ও লাগছে। ডিনারে বেশি খেতে পারেনি। মুখ তিতা হয়ে আছে। তবু কষ্ট করে একটু খেয়েই ঔষধ খেয়েছে। আসলে নিজেকে সুস্থ করার চেষ্টা। নাহলে মধুর চোখের কাটা হচ্ছে ঔষধ একটু ও পছন্দ করে না। কিন্তু আজ খেয়েছে নিজ থেকেই বেড়াতে আসা বৃথা হবে সেটা ও চায় না কোন ভাবেই।
মধু লম্বা হাতার কামিজ পড়েছে। সুতি ওরনা দেখে যাতে গায়ে জড়ানো যায়। হিজাবের মতো করে ওরনা দিয়ে মাথা ও শরীর ডেকে নিয়েছে যাতে বাতাস কম লাগে। সুতি পাতলা কাপড়ের পোশাকে কতটাই বা শীত কমে? বাইরে শীতল বাতাস ওর গায়ের কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শীতের মাত্রা এ জন্য তীব্র থেকে তীব্রতর লাগছে। মধু কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিন জোড়া পা ধপাধপ শব্দ করে হাঁটছে। মধু হাত গুটিয়ে ওরনার ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে। সমুদ্র, তিন্নি ও মধু সাগরের কাছাকাছি এসেই দেখতে পেল মিতুল আর সাহিত্য ঘুরছে। নাঈম আর রাহী কে দেখা গেল না। মিতুল সমুদ্র কে দেখতেই কাছে ডাকল। সমুদ্র সেদিকে এগিয়ে গেল। তিন্নি আর মধু কে আসতে বলল।
তিন্নি বলল,,” ভাইয়া তুমি যাও আমরা এদিকেই আছি।”
সমুদ্র মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” এতো জড়োসড়ো হয়ে আছো কেন? খারাপ লাগছে নাকি?”
মধু মলিন মুখে বলল,,” না ভালোই লাগছে।”
” মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে। আফসোস করছো এখানে এসে। এখন দাঁড়িয়ে থাকতেও ক্লান্ত লাগছে।”
” একদমই না। আমি ঠিক আছি। ঘুরা ঘুরি করলে আমি একদম ঠিক হয়ে যায়। এসব অসুখ আমায় কাবু করতেই পারে না।”
মধু মুখে এতো যুক্তি দিলেও সমুদ্রের বলা কথাটি সত্য। এখানে এসে আফসোস হচ্ছে কেন এলো। এখন ওর শরীর যে খারাপ লাগছে মাথা ঘুরছে। শীতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কিন্তু তিন্নি কে বলতে ইচ্ছে করছে না কেন জানি মনে হচ্ছে ওকে বললেই ফুয়াদ এর কানে চলে যাবে কথাটা।
মধু দেখল তিন্নি ফোনে মগ্ন ও এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ফাহাদের খোঁজ করল। সন্ধ্যায় অনেক সময় ফাহাদ ওর কাছে বসে ছিল। ছেলেটা ভারি দুষ্টু ওকে মৌমাছি বলে রাগ উঠায়। প্রচুর রাগ ওর উপর হয়। কারণটা ফুয়াদ ও জানে। ফুয়াদের জন্য ওদের উপর রাগ করার কারণ নেই তবুও হয় কেন জানে না মধু। মধু তিন্নি কে রেখেই একাই ঢেউ আসা পাড় ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। খারাপ লাগলেও পরিবেশটা মনোমুগ্ধকর। ওর শরীর অসুস্থ না থাকলে এই সময়টা চির স্মরণীয় হয়ে থাকত। কিন্তু এখন বিতৃষ্ণা লাগছে। কোন সৌন্দর্য ওকে টানতে পারছে না হাঁটতে ও ইচ্ছে করছে না মন চাচ্ছে এখানেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরতে।
মধু তিন্নির কাছে গিয়ে বলতে চাইল, ফিরে যাওয়ার কথা। ও পা বাড়াল তিন্নির দিকে। হঠাৎ একটা পুরুষালী হাত মধু কাঁধ জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে মধুকে মিশিয়ে নিল। মধুর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। শীতল শরীরটা কারো বুকে আশ্রয় পেয়ে উষ্ণ হয়ে উঠল। মধুর ওরনার উপর দিয়েই লোকটা কাঁধ চেপে ধরেছে। মধু ছটফট করছে তার বাহুডোরে থেকে ছুটতে। মাথা উঁচু করে লোকটার মুখমন্ডল না দেখলেও মধু লোকটার পারফিউম এর ঘ্রাণ পেয়েই তাকে চিনে ফেলেছে। চোখ মুখ শক্ত করে পা থামিয়ে দিয়েছে।
” ছাড়ুন আমাকে।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল মধু।
ফুয়াদ মধুর কথা শুনল। মধুর কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে মধুর সামনে এসে দাঁড়াল। মধু মাথা তুলছে না। ওর দৃষ্টি নিচের দিকে। ফুয়াদ অসুস্থতায় মধুর লাল হওয়া মুখশ্রীর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
” দাঁড়িয়ে থাকতে পারছো না ঠিক মতো। এই শরীর নিয়ে বাইরে বের না হলে কি ভালো হতো না।”
” আমার ভালো নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”
ফুয়াদ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,,” তোমার ভালো আমি দেখব না তো কে দেখবে?”
মধু আগুন গরম চোখে মাথা তুলে তাকাল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদের ঠোঁটের কোনে হাসি। ও তাকাতেই বলল,,” থ্যাংকিউ”
মধু চোখ ছোটো ছোটো করে কপাল কুঁচকে বলল,,” হোয়াই?”
“আই এ্যাম সো হ্যাপি। টু ডে ইউ হ্যাভ রিলাইজড মাই লাভ। এ্যান্ড ঢু ডে আই স্যাকসেস ইন এ টাচক দ্যাট আই হ্যাভ বিন ডুয়িং ফর এ লং টাইম।”
অত্যন্ত খুশি মুখে বলল ফুয়াদ। ওর চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে যেন। মধু ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না। বুঝতে ও চাইল না।
মধু বলল,,” আপনাকে বলেছিলাম না আমার আশেপাশে আসবেন না। আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন!”
ফুয়াদ বলল,,” আমি সব কথা শোনার মতো বাধ্য নই।”
মধু আর কথা বাড়াল না ফুয়াদ কে রেখে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। আর উচ্চ স্বরে বলল,,” আমার পেছনে একদম আসবে না। নাহলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
ফুয়াদ মধুর কথা শুনল না মধুর পেছনেই হাঁটতে লাগল। দেখতে পেল মধুর কাঁপুনি। সাথে মধুর এলোমেলো অগোছালো পায়ের কদম। যেকোনো সময় শরীর ছেড়ে দেবে। এই শরীর নিয়ে ও এতো তেজ?
” মধু স্টপ।”
মধু দাঁড়াল না ফুয়াদ না পেরে মধুর হাত ধরে ওকে আটকে দিল। মধু রাগে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু দূর্বলতা অনুভব করছে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে না। মাথা ব্যথা করছে। ফুয়াদ মধুর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,,” চলো রিসোর্ট এ ফিরে যাই। তোমার শরীর ঠিক নাই। এই অবস্থায় আর বের হবে না। তোমাকে কক্সবাজার ভালো করে না ঘুরিয়েই ফেরত যাব না আমরা। তুমি সুস্থ হও তারপর ঘুরাঘুরি হবে।”
মধুর মাথা অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। না চাইতে ও ফুয়াদের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগল। ফুয়াদ মধুর হাত স্পর্শ করেই ওর গায়ের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা টের পেয়েছে।
মধু কে এভাবে মাথা এলিয়ে দিতে দেখে চমকে উঠে। হাত বাড়িয়ে মধুর মসৃণ গালে হাত রেখে বলল,,” মধু আর ইউ ওকে?”
মধু জড়ানো গলায় বলল,,” খারাপ লাগছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আমাকে হোটেলে রুমে নিয়ে চলুন প্লিজ।”
মধুর চোখ বেয়ে গরম জল গড়িয়ে পড়ছে। ফুয়াদ মধুর শরীর দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিল। গরম শরীর বুকে জড়াতেই ফুয়াদের গরম লাগতে শুরু করল। মধু কে আরো দুই তিনবার ডেকে উঠল উত্তর নাই। ফুয়াদ একহাতে মধু কে ধরে রেখেই কাউকে কল করল। কিছু বলেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে মধুকে পাঁজকোলে তুলে হাঁটা ধরল। এই দৃশ্য সবটাই দেখল মিতুলের। ফুয়াদের কোলে মধু কে দেখেই ওর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। মিতুল ছুটে এসে কিছু বলতে চাইল ফুয়াদ কে কিন্তু ওকে আটকে দিল সমুদ্র।
সমুদ্র মিতুলের হাত ধরে আটকে দিয়েছে। মিতুল বিস্মিত চোখে তাকাল সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র ওকে শান্ত থাকতে বলল চোখের ইশারায়।
#চলবে…
( রিচেক করা হয়নি ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)