#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
১৮.
রাহীর পরীক্ষা শেষ হলো তাড়াতাড়িই। পরীক্ষা শেষে হঠাৎ করেই নাফিসা সমুদ্র কে নিয়ে পাত্রী দেখতে গিয়েছিল। সমুদ্রের সেকি রাগ। মিথ্যা বলে পাত্রী দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বাসায় এসে তার রাগের সম্মুখীন হয়েছিল সবাই। মধু প্রথম সমুদ্রের এমন রাগী রুপ দেখে হতভম্ব। এই মানুষটার এতো রাগ থাকতে পারে ও কল্পনাও করতে পারেনি।
” আমি হাজার বার বলেছি আমি বিয়ে করব না। মানে করব না। তবুও আমাকে না জানিয়ে পাত্রী দেখাতে নিয়ে গেলে কোন সাহসে? কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করোনি মা।” বলেই সমুদ্র ড্রয়িংরুমে থাকা সোফায় লাথি মেরে বসে।
মধু ও তিন্নি সমুদ্রের রাগী চেহারা দেখে সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল।
মধু ভয়ার্ত গলায় তিন্নি কে ফিসফিস করে বলল,,” দোস্ত সমুদ্র ভাইয়ের মতো শান্ত শিষ্ট মানুষ এমন রাগ দেখাতে পারে আমার জানা ছিল না।”
” ছেলে মানুষ আবার রাগ হীন হয় নাকি। সমুদ্র ভাইয়ের একমাত্র রাগ তার বিয়ে নিয়ে। বিয়ে নিয়ে তার ঘোর বিরোধীতা। বিয়ে কথা উঠলেই তিনি শান্ত থেকে অশান্ত হয়ে উঠে। ভাইয়ার রাগ দেখলে মনে হয় তাকে বিয়ে করতে নয় তাকে জমের দুয়ারে পাঠানো হবে তাই তিনি এমন রিয়েক্ট করে।”
মধু ভীতু গলায় বলল,,” আমিও বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু সেটা শুধু ওই সাফিন এর জন্য। আমার পছন্দের কাউকে পেলে আমি আরো আগেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতাম। তাই বলে এমন জীবনে বিয়ে করবোই না এমন মনোবাসনা হয়নি।”
” তুই এখন ভাইয়ের সাথে নিজেকে কম্পিয়ার করছিস নাকি।”
” ধুর না আমি বলছি তার বিয়েতে এতো আপত্তি কেন?”
” সেটা বড়রা আর ফুয়াদ ভাই জানে। আমরা ছোটরা এই বিষয়ে কিছুই জানি না।”
” ওরে আমার শিশু বাচ্চা রে। এখন তো মনে হচ্ছে ফুয়াদ এর থেকে সমুদ্র বেশি রাগী।”
” আমার কোন ভাই রাগী না দুজনেই শান্ত আর সৌখিন। সমুদ্র ভাই শুধু বিয়ের কথা উঠলে এমন করে দেখ নিজের রাগ নিজেই কনট্রোল করতে পারে না অসুস্থ হয়ে পরে। আর ফুয়াদ ভাই আরো শান্ত তিনি ভেতরে থেকে অনেক নরম কিন্তু উপরে শাসন করে। ভাই যতটুকু রাগ দেখায় তা আমাদের সঠিক পথে চলার জন্য। তিনি বন্ধুসুলভ আচরণ কম করে কিন্তু মন থেকে আমার সবাইকে অনেক ভালোবাসে। আমরা ভুল করলে রাগ দেখায় পরে নিজেই এসে রাগ ভাঙায়। রাহী আপু আর তার বন্ধুর সম্পর্কের কথা শুনে অনেক রাগারাগী করেছিল কেন জানিস এতো দিন তার থেকে আড়ালে রাখার জন্য পরে নিজেই ওদের সাথে মিটমাট করে রাহী আপুকে সেই রাগ দেখার জন্য উপহার স্বরূপ বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছে। আমাদের বড় ভাই মোশাররফ তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সময় কম দেয় পরিবারে। কিন্তু সমুদ্র ভাই আর ফুয়াদ ভাই আমাদের অনেক সময় দেয়। আমাদের সকল শখ পূরণ করেন। আমাদের একা কলেজ থেকে টিপে পাঠায় না। কিন্তু আমরা ফ্যামিলি ভাবে বছরে দুইবার টিপে যাই।”
” এমন একটা পরিবারের মেয়ে হলে নিজেকে সৌভাগ্যবতি ভাবতে পারতাম।” আফসোস স্বরে বলল মধু।
” মেয়ে না হতে পারলেও বউ কিন্তু হতেই পারিস।”
মধু চমকে তাকাল তিন্নির দিকে।
” কি বললি তুই?” সন্দেহ কন্ঠে সুধাল।
তিন্নি বলল,,” কিছু না।”
নাফিসা বেগম ছেলেকে শান্ত করতে চাইছে। সমুদ্র রাগে চিৎকার করল কতক্ষন তারপর হাঁপানি রোগীদের মতো সোফায় বসে রইল। নাফিসা গ্লাসে পানি এনে ছেলেকে খাইয়ে দিলেন তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মানে সমুদ্র কে শান্ত করার চেষ্টা আরকি।
” শান্ত হ বাবা আর কখনো তোকে বিয়ের জন্য জোর করব না। তুই তাও শান্ত হ।”
সমুদ্র টকটকে লাল চোখে মায়ের দিকে তাকাল তারপর উত্তর না দিয়েই উঠে দাঁড়াল। সে রুমে যাবে। তাকে এগিয়ে আসতেই দেখেই তিন্নি আর মধু সরে গেল রাস্তা থেকে। সমুদ্র কারো দিকে তাকাল না। সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। হাজার ডেকে ও কেউ সমুদ্র কে বের করতে পারল না। সন্ধ্যার পর ফুয়াদ আসলো ভাইয়ের খবর শুনে। ফুয়াদ দরজায় নক করতেই সমুদ্র দরজা খুলে দিল। মধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। এতো গুলো মানুষ দরজা খুলতে বলল খুলল না কিন্তু ফুয়াদ একবার ডাকতেই খুলে দিল। মধু পা টিপে টিপে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ভেতরে। সমুদ্র চুপ করে বসে আছে খাটে। ওর পাশেই ফুয়াদ বসে কিছু বলছে। সমুদ্রের হাতে একটি বিয়ারের বোতল ও কথা শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না একটু পর পর সেটাতেই চুমুক দিচ্ছে। রুমের অবস্থা দারুণ সুন্দর। ড্রেসিং টেবিলের জিনিস ও ফুলদানি অনেক জিনিস ভেঙে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাবারে মনে হচ্ছে টর্নেডো বয়ে গেছে রুমে।
ফুয়াদ রুম থেকেই চিৎকার করে কাজের খালাকে ডাকল। তিনি আসতেই তাকে রুম পরিস্কার করতে বলল। তিনি কাজে লেগে পড়ল।
মধু আলগাছে পালিয়ে এল সেখানে থেকে।
মধু রুমে এসে দেখল তিন্নি ব্যাগপ্যাক করছে। মধু কপাল কুঁচকে বলল,,” কিরে কোথাও যাবি নাকি?”
” তাড়াতাড়ি প্যাকিং কর সকাল সকাল আমরা সাজেকের উদ্দেশ্য রওনা হবো।”
” কিহ বলিস। এই অবস্থা বাসার। তাতে কেউ বেড়াতে যাবে?”
” কি অবস্থা আবার বাসার?”
” সমুদ্র ভাইয়ার কি অবস্থা জানিস না?”
” ধুর গাধী। ফুয়াদ ভাইয়া এসে পরেছে তার আর কি হবে। রাগ একটু পর, ডিনারে দেখতে পারবি কিছুই নাই। সব ঠান্ডা।”
” সত্যি?” অবাক গলায় বলল।
” ইয়েস এবার ব্যাগ প্যাক করে ফেল।”
” অদ্ভুত।”
” ফুয়াদ ভাইয়া অদ্ভুত সবাইকে সামলানো তার বা হাতের খেল।” গর্ব করে বলল তিন্নি।
” তোর ভাইকে নিয়ে কথা বলবি না লোকটা আমায় অনেক ধমকিয়েছে।” রাগ দেখিয়ে বলল মধু।
” আহারে বেচারি।” মধুর গাল টেনে বলল তিন্নি।
” আমি বেচারি না ।” তিন্নির হাত গাল থেকে সরিয়ে বলল।
” আচ্ছা মনা তুমি বেচারি না।”
মধু ডিনারে এসে দেখল সত্যি পরিবেশ ঠান্ডা সমুদ্র ও ফুয়াদ পাশাপাশি বসেছে আর খাচ্ছে। মধু ভাবল ঘন্টায় কি এমন হলো যে রাগ ঠান্ডা পানি হয়ে গেল।
ফাহাদ খাবার টেবিলে বসে আছে খাচ্ছে না। ও খাবে না বলে অনশন শুরু করবে ভাবছে। তার একমাত্র কারণ হলো আগামীকাল টিপে ওকে নেওয়া হবে না। কারণ ওর এসএসসি পরীক্ষার আর বেশি সময় নাই। আগের বার তিন্নি পরীক্ষা পর নানাবাড়ি গিয়ে টিপ মিস করেছিল তাই ফাহাদ অনেক টিটকারী করেছে ওকে। এবার তিন্নি ও সুযোগ ছাড়ল না। ওকে নিয়ে মজা নিতে লাগল। ও না খেয়েই চলে গেল নাফিসা খাবারের প্লেট হাতে ছেলের পেছনে ছুটল। তারপর ও ওকে খাওয়াতে পারল না। ওকে নিয়ে না গেলে ও না খেয়েই থাকবে বলে জানাল। তারপর রাজি হলো ওকে নিয়ে যাওয়া হবে।
” দোস্ত কখন সকাল হবে রে।” তিন্নি আর মধু শুয়ে ছিল। তিন্নি ঘুমটা কেবল লেগেছিল তখনি মধুর ধাক্কায় ওর সুন্দর ঘুমটা ভেঙে গেল।
তিন্নি প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,,” আমারে ঘুমাতে দে। ঘুম ধরলেই ডেকে উঠাস কেন। তুই ও ঘুমা অনেকটা পথ জার্নি করতে হবে।”
” আমার উত্তেজনায় ঘুম আসছে না।”
” তাইলে একাই জেগে বসে থাক। আমাকে ডাকবি না আর খবরদার।”
মধু উঠে বেলকনিতে বসে রইল তারপর আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। সারারাত না ঘুমিয়ে সকালের দিকেই ওর ঘুম গভীর হলো তাইতো ও জাগতে পারল না। তিন্নি ধাক্কা দিয়ে ওকে উঠাল। নির্ঘুম রাত পাড়ি দিয়ে এখন ওর চোখে রাজ্যের ঘুম।
ও ঘুমঘুম ঘোলা চোখে উঠে বসল।
” কিরে সারারাত তো না ঘুমিয়ে ছটফট করলি এখন ঘুমাচ্ছি যাবি না?”
” যাব কিন্তু খুব মাথা ব্যথা করছে।”
” এজন্য বলেছিলাম ঘুমা তুই কি সারারাত জেগে ছিলি?”
” হুম সকালের দিকেই ঘুম আসছে।”
” এবার কষ্ট করে উঠে হালকা কিছু খেয়ে রেডি হ।”
” আচ্ছা।”
তিন্নি ফ্রেস হয়ে এসেছে ঘড়িতে ছয়টা বাজে ওরা বের হবে সাতটায়। তিন্নি রা সবাই নিচে খাবার খাচ্ছে। সকালে কি আর ওতো খাবার খাওয়া যায় সবাই চা কফি ও সিদ্ধ ডিম ও পাউরুটি খেল।
সমুদ্র তিন্নি কে বলল,,” মধু কই।”
” ফ্রেস হচ্ছে অতিরিক্ত খুশিতেই ছটফট করেছে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এখন ঘুমের জন্য উঠতে পারছে না।”
তিন্নি রুমে এসে দেখল মধু আবার বিছানায় শুয়ে ঘুম। তিন্নি আবার ওকে টেনে উঠিয়ে বলল,,” তোকে রেখেই কিন্তু চলে যাবো তাড়াতাড়ি উঠ। ফ্রেস না হয়ে আবার শুয়ে পরেছিস কেন?”
মধু চোখের পাতা টেনে উঠল। সারারাত না ঘুমিয়ে কত বড়ো ভুল করেছে এখন বুঝতে পারছে। এলোমেলো পা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে লাগল চোখ বন্ধ করেই। তারপর চোখে মুখে বেশি করে পানি দিল। চোখ জ্বলছে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে আছে। ওভাবেই রুমে এসে আলমারি থেকে ড্রেস বের করল কাল সব ব্যাগে গুছিয়ে রেখেছিল নয়তো এখন আর কিছুই করতে পারত না। ড্রেস ও চয়েজ করেই রেখেছিল। এখন শুধু চেঞ্জ করে নিল। নীল টপস ও কালো লেডিস প্যান্ট গলায় নীল স্কাপ পেঁচিয়ে চুল আঁচড়ে ঝুঁকি করে নিল। মুখে পাউডার ও খাটে বসে পড়ল।
তিন্নি সাজতে ব্যস্ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ওকে বসতে দেখে বলল,,” নিচে গিয়ে কিছু খেয়ে নে।”
” এখন কিছু খেতে পারব না।”
” কিন্তু।
” প্লিজ জোর করিস না আমাকে আমার মতো থাকতে দে।”
মধু না খেয়েই বের হলো। ওরা মোট আটজন বের হলো।
মধু, তিন্নি ও ফাহাদ বসল পেছনে সামনে ফুয়াদ ড্রাইভ করছে পাশেই ওর এক বন্ধু নাম সাহিত্য। ফাহাদ কে না নিয়ে উপায় নাই বেচারা সারারাত কেঁদেছে। ফাহাদ বসেছে মাঝখানে দুই লেডিস দুই পাশে। ও মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আরেক গাড়িতে নাঈম ও রাহী, সামনে সমুদ্র ড্রাইভ করছে। মিতুল কে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না ফুয়াদ এর কিন্তু মায়ের জন্য ওকেও নিতে হবে। ওর বাসা থেকে নিয়ে যেতে হবে। ফুয়াদের গাড়িতে জায়গা নাই তাই সমুদ্র মিতুল কে নিয়ে যাবে।
মধু কিছুক্ষণ জেগে রইল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে আবার ওর চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিল।
ও জেগে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ঘুমিয়ে গেল। গাড়ি যেহেতু সোজা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাই ওর কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝেই রাস্তার বিট গুলোর জন্য দুই একটা ঝাঁকি খাচ্ছে তখন ওর সোজা মাথাটা হেলে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে মনে হলো ফাহাদ ওকে কিছু বলছে ও হু হা হয়তো করল। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
#চলবে…..