প্রেম পিয়াসী পর্ব ৩৯

0
558

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________৩৯.

ছাদে সবাই ইলহামের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে এসে হাজির হলো সকলের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। লেভেন্ডার কালারটা হয়তো সবার উপরই ভীষণ মানায়। কিন্তু সেই দিক থেকে বিবেচনা করা দেখা গেলো, এই রঙে ইলহামকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে। ওর হাঁটু অব্দি চুল গুলো ইতিমধ্যে যেন আরও কয়েকগুন লম্বা হয়ে গেছে। হাঁটু থেকে বেশ খানিকটা নীচে নেমেছে। চুলগুলো খোলাই রেখেছে আজ। মুখে প্রসাধনীর কোনোরূপ ব্যবহার হয়নি। কেবল একটা পাথরের টিপ আর সামান্য লিপবাম। দু’হাতে স্বর্ণের দুটো মোটা বালা। মান্নাত বেগমের দেওয়া উপহার। গলায় ছোট্ট একটা লকেট। নাকে ছোট্ট পাথরের নসপিন। কানেও পাথরের একজোড়া দুল। নিজ হাতে ওকে সাজিয়ে দিয়েছে রাদ। ওর এই সামান্য সাজই মন কাঁড়লো সকলের।

—-” ওমা! দেখি দেখি.. কি সুন্দর লাগছেরে তোকে!”

উপমার আমোদিত গলাটা ভেসে এলো সামনে থেকে। ইলহামের দৃষ্টি সেদিক পানেই ছিলো। মুখে চমৎকার হাসি লেপ্টে আছে। উপমা এসে ওকে আলিঙ্গন করলো কোমল ভাবে। অতঃপর ওকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বলল,

—-” মাশা-আল্লাহ। ভীষণ মিষ্টি লাগছে তোকে। কারোর নজর না লাগে!”

সবার মুগ্ধ দৃষ্টি ইলহামকে ঘিরে। সবাই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রশংসা করতে আজ কেউ আলসেমি করেনি। সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ যখন ইলহামের প্রশংসায় মুখরিত, তখন আড়াল থেকে কেউ একজন তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের জোয়ার ঠেলে দিতে ব্যস্ত। অন্তু চায়না ওর এই খারাপ লাগা গুলোকে কোনো ভাবে প্রশ্রয় দিতে। তবুও কোনো এক অদ্ভুত কারনে, নিজের খারাপ লাগা গুলোকে চাইলেও আবদ্ধ রাখতে পারেনা।

—-” কি হয়েছে আপনার? মুখটা কেমন শুঁকনো লাগছে! সব ঠিকাছে তো?”

একটু সামনের দাঁড়িয়ে ছিলো মিমি। সেও দূর থেকে ঐ মায়াবী মেয়েটাকে দেখছিলো। হঠাৎ অন্তুর দিকে চোখ পড়তেই চিন্তা ভর করলো। সবার মুখে হাসি, কেবল উনার মুখেই মলিনতার ছাপ! কেন?

—-” ইয়াহ ইয়াহ! আই এম ফাইন।”

—-” উঁহু! দেখে তো মনে হচ্ছে না। সত্যি করে বলুন তো?”

—-” সত্যি বলতে কিছু নেই মিমি। আপনার সঙ্গে একজনের পরিচয় করাবো বলে ছিলাম। সে এসে গেছে। আসুন।”

এটুকু বলেই সামনে এগিয়ে গেলো অন্তু। মিমিকে আর দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ করার ফুরসত দিলোনা। মিমি আর কথা বাড়ালোনা। সেও পিছু পিছু গেলো অন্তুর।

রাদ ইলহামকে বসালো একটা চেয়ারে। অতঃপর কিছু মুখে তোলার আগে অল্প কিছু জুস খেতে দিলো। সেটাই ও খাচ্ছে আপাতত বাচ্চাদের মতো করে।

—-” ভাই, তোর চয়েজ আছে বলতে হবে। ভীষণ মানিয়েছে ইলহামকে এই ড্রেসটাতে।”

অন্তুর কথায় মিষ্টি হাসলো ইলহাম। রাদ ইলহামের তৃপ্তিময় হাসিতে প্রশান্তির হাসি দিলো। মাথা নেড়ে বলল,

—-” টেনশনে ছিলাম বল? ওর পছন্দ হয় কিনা!”

—-” তুই চুজ করবি আর তোর বউয়ের পছন্দ হবেনা। ইম্পসিবল। বাই দ্য ওয়ে, দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।”

এই বলে অন্তু মিমির দিকে ইশারা করে দেখতে বলল রাদকে। রাদ মিমিকে ইতিপূর্বে দেখেনি। আজই প্রথম। ঘাড়টা হাল্কা বাঁকা করে একজন সুন্দরী নারীকে অন্তুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাদ চোখ সরু করে তাকালো। অতঃপর নাকি সুরে বলল,

—-” এতো কিউট মেয়েটাকে পটালি কেমন করে?”

রাদের এহেম প্রশ্নে বিষম খেলো অন্তু। পটালো মানে? রাদ কি ভাবছে? ও কি ওর নতুন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে রাদের পরিচয় করাতে এনেছে? ও গড!

মিমি কঠিন আকারে লজ্জা পেলো। লজ্জায় ওর মাথাটা মিশে গেলো জমিনের দিকে। অন্তু নিজেকে কোনোমতে সামলাতে সামলাতে বলল,

—-” ক..কি যা-তা বলছিস! পটাবো কেন? উনি মিমি।

রাদ বুঝলো, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই লজ্জিত হেসে পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠে দাঁড়ালো। মাথা চুলকে মিমির উদ্দেশ্যে বলল,

—-” মিস মিমি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমরা ভাই, বন্ধুরা অলওয়েজ এমন করেই মজা করতে থাকি। সরি!”

—-” ইট’স ওকে। আমি মাইন্ড করিনি।”

মিমি লজ্জায় বারকয়েক নজর এদিক সেদিক করে কোনো মতে বলল কথাটা। রাদ স্মিত হেসে বলল,

—-” থ্যাংক্স। আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন প্লিজ।”

—-” ইট’স ওকে। আপনারা সবাই তো দাঁড়িয়েই আছেন।”

মিমির শেষোক্ত উক্তিকে ইলহাম বলে উঠলো,

—-” কই সবাই দাঁড়িয়ে আছে! আমিতো তো বসেই আছি।”

ইলহামের কথায় মিমি মুচকি হাসলো। বলল,

—-” আচ্ছা, তবে আমিও বসছি!”

এই বলে ইলহামের পাশের চেয়ারটায় বসলো মিমি। অন্তু ওদের দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

—-” বাহ্, পরিচয় করানোর পূর্বেই যে খাতির হয়ে গেলো। আচ্ছা, তবুও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইলহাম উনি হলো মিমি। আমার ফ্রেন্ড বলতে পারো। আর মিমি, ও হলো ইলহাম। আব.. সেদিন স্যারের অফিসে বসে যার কথা বলেছিলাম! এই সেই ইলহাম।”

অন্তুর কথায় মিমি কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। ও যেন নিজের কানে ভুল শুনেছে! কে ও? ইলহাম।

—-” স্যারের অফিসে আমাকে নিয়ে কি বলেছিলে অন্তু? তোমরা কি কলিগ?” ইলহাম কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন করলো।

এর জবাবে রাদ বলল,

—-” হ্যাঁ, কলিগই বলা যায়। কি বলিস ভাই?”

—-” হ্যাঁ, কলিগই আমরা।” বলল অন্তু।

—-” বাহ। তো আমার ব্যাপারে কি কথা বলেছিলে তোমার বন্ধুকে?”

ইলহাম কথাটা বলতে বলতে মিমির দিকে তাকালো। মিমি এখনও কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। যেন বাহ্যিক কোনো আলাপচারিতা ঢুকছে না ওর মাথায়। ও আছে এক ঘোরের দুনিয়ায়।

—-” আব.. তেমন কিছু নয়। আমাদের চ্যাম্প অর প্রিন্সেস আসার টপিক নিয়েই কথা হচ্ছিলো। তখন বলেছিলাম ইনফিউচারে পসিবল হলে ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিবো। দ্যাটস ইট।”

—-” হ্যাঁ, তা খুব ভালোই করেছো। আচ্ছা ভাই, বলো কি খাবে? ওদিকে রান্না তো শেষ পর্যায়ে বোধহয়। তার আগে একটু নাস্তা করা যাক?”

এই বলে ইলহাম উঠতে নিলে রাদ ওকে ধরে আঁটকায়। পূণরায় জায়গায় বসিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে,

—-” এই তুমি কোথায় উঠছো? বসো এখানে। নিজের জুসটা শেষ করো। আমি দেখছি।”

—-” সরি!”

রাদের রাগ দেখে ইলহাম দাঁত বের করে হেসে সরি বলল। সে ভুলেই গিয়েছিল তার শরীরের অবস্থা ঠিক নেই। যেটাই তার সবচেয়ে বড় সমস্যা।

—-” মিমি, আপনি কি নিবেন? কফি অর জুস?”

মিমি এখনও ঘোরে তলিয়ে আছে। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে ইলহামকে। এতক্ষণ ইলহাম সেটা খেয়াল না করলেও এবার করলো। অন্তুর ডাকে মিমির কোনো হেলদোল না দেখে পাশ ফিরে তাকালো ইলহাম। দু’জনের চোখাচোখি হলো তখন। ইলহাম স্মিত হেসে মিমির কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় ডাকলো। মিমি কাঁধে কারোর স্পর্শ পেতে খানিক চমকালো। ওর ঘোর কাটলো। তাই এতক্ষণ বুঝতে না পারা কথাগুলো পূণরায় জিজ্ঞেস করতে অন্তু আচমকা ওর হাত ধরে উঠিয়ে আনলো। ইলহাম এবং রাদের উদ্দেশ্যে বলল,

—-” ভাই, দু’মিনিট, আসছি।”

বলেই মিমিকে নিয়ে চলে গেলো অন্তু। রাদ স্বাভাবিক থাকলেও ইলহাম হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো ওদের যাওয়ার পানে। যা দেখে রাদ চোখ জোড়া সরু করে বসলো ইলহামের পাশ ঘেঁষে। হঠাৎ কেউ পাশ ঘেঁষে বসায় ইলহামের ঘোর কাটলো। পাশ ফিরে রাদকে দেখে আর কিছু বলল না। রাদ হয়তো বুঝতে পারছে ইলহামের মনের কৌতুহল। তাই নিজেই বলে উঠলো,

—-” কি, দেখে কি বুঝলে?”

—-” হুম? কি বুঝবো?”

—-” মিমিকে তোমার ভালো লাগেনি?” অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো রাদ।

ইলহাম রাদের প্রশ্ন শুনে দিগুন অবাক হলো। বলল,

—-” ভালো লাগবে মানে?”

—-” ইশশ বোকা মেয়ে! মিমিকে অন্তু লাইক করে। দেখে বুঝলে না? আর কখনোও শুনেছো অন্তু নিজের কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড কিংবা কলিগকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে? নিশ্চয়ই ঘটনা সিরিয়াস।”

রাদ কথাগুলো সম্পূর্ণ বানিয়ে বলছে। হয়তো মিমিকে নিয়ে ইলহামের কৌতূহল কমানোর জন্য। নাহলে, এই মুহুর্তে ইলহাম যদি সবটা জেনে যায় তবে সেটা পূণরায় ওর মেন্টাল স্ট্রেস বাড়িয়ে তুলবে। আর যেটাই ডক্টর বারবার বারন করে গেছেন। সবটা সামনে এলে ইলহামকে রাদ নিজেই সবটা বুঝিয়ে বলবে। এই মুহুর্তে আধো সত্যি নিয়ে ঘাটাঘাটি করা ইলহামের জন্য মৃ//ত্যু সমতূল্য হতে পারে।

মিমিকে নিয়ে একদম সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালো অন্তু। মিমি ওর কান্ড দেখে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল।

—-” আর ইউ ওকে?” চিন্তান্বিত মনে প্রশ্ন করলো অন্তু।

—-” এ্যাঁ?” বোকা গলায় বলে উঠলো মিমি।

অন্তু ওর হাতটা এখনোও ধরে আছে। কিছু না বলে হঠাৎ খানিকটা কাছে টেনে আনলো সে মিমিকে। মিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অন্তুর কান্ডে। ওর স্তব্ধ নেত্রজুগল আঁটকে গেলো অন্তুর ফর্সা মসৃণ মুখবিবরে।

—-” মিমি, কি হয়েছে আপনার?”

—-” ক..কি হবে!”

—-” বি নর্মাল। তাকান আমার দিকে? আপনার কি খারাপ লাগছে? অসুস্থ বোধ করছেন?”

—-” ন..না! আমি ঠিকাছি।”

—-” পানি খাবেন?”

—-” হ..হু!”

অন্তু এবার ওকে ছেড়ে দ্রুত চলে গেলো পানি আনতে। মিমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেন। ওর হার্টবিট এখনও ধরাক ধরাক করে বাজছে। অন্তু হঠাৎ করে ওকে এভাবে নিজের দিকে টেনে নিবে, কল্পনাতীত ছিলো ওর।

এক গ্লাস পানি এনে মিমির হাতে ধরিয়ে দিলো অন্তু। মিমি পানিটা খেয়ে শেষ করতে বলে ওঠে অন্তু,

—-” আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি!”

—-” কি কথা?”

—-” ইলহামের পুরনো কোনো কথা মনে নেই। ওর বাবাকে কিন্তু ও চিনেনা। ইভেন মায়ের মুখটাও ওর মনে আছে কিনা জানিনা আমরা। তাই আপনি হুট করে ওর সামনে এই মুহুর্তে কুহেলিকা ম্যামের টপিক নিয়ে কিছু বলবেন না প্লিজ। আমরা এই সমস্ত রহস্য ফাঁস করে তবেই ওকে সবটা জানাবো। এর পূর্বে নয়। কেমন?”

মিমির কাছে এবার পরিষ্কার হলো অন্তুর ওকে এমন করে টেনে আনার ব্যাপারটা। মিমি ভরসা দিলো অন্তুকে। বলল,

—-” ঠিকাছে। আমি এই টপিকে এক্ষনি ইলহামকে কিছু বলবনা।”

—-” থ্যাংক্স মিমি।”

—-” একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?”

—-” হ্যাঁ, করুন না?”

—-” আপনি কি ইলাহামকে ভালোবাসেন, অন্তু?”

অন্তু চমকে উঠলো। শূন্যদৃষ্টিতে তাকালো মিমির পানে। আচ্ছা, ও কি এতোই বোকা? নিজের অনুভূতি গুলো কি একদমই লুকাতে পারেনা লোকের সামনে? কি বিভ্রান্তি মুলক ঘটনা!

—-” ন..না তো! ইলহাম আমার খুব ভালো বন্ধু।”

—-” সত্যিই কি তাই?”

—-” হ্যাঁ। কেন?”

—-” না না। এমনি। ছাদে যাবেন না?”

—-” হ্যাঁ যাবো। কাম।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here