#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৫.
দেখতে দেখতে ৮মাস পেরিয়ে গেলো কোনো এক বসন্তের ন্যায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন হলো। এখন না গরম না ঠান্ডা। মাঝেমাঝে তুমুল বর্ষন। এরই মাঝে খবর ছড়ালো ইলহামের প্রেগন্যান্সির সাত মাস শুরু হয়েছে।
রাদের পরিবারে এখন দুঃখ নামের জিনিসটি একদম নেই বললেই চলে। আছে কেবল সুখ, সুখ আর সুখ। আরেকটু খানি সুখের আবির্ভাব হয়েছে ইলহামের মা হওয়ার খুশিতে। আজ ইলহামের প্রেগন্যান্সির সাত মাসের খুশিতে আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন মান্নাত বেগম। ইলহামেরও মায়ের ইচ্ছেতে সম্পূর্ণ মত আছে। বাদ বাকি সবাই হ্যাঁ বলে সম্মতি দিলে রাদও সম্মতি দেয় অবশেষে। কেননা, তার লোকজনের গ্যাদারিং এ ভীষন আপত্তি এই মুহুর্তে। সে চেয়েছিলো ইলহামের প্রেগন্যান্সির এমন একটা স্টেজে সে একটু নিরিবিলি থাকুক। পুরো সময়টা নিজের জন্য বরাদ্দ করুক। নিজের বাচ্চার জন্য নিজেকে স্থির রাখুক। বেশি দৌড়ঝাঁপ, কাজবাজ ওর জন্য ঠিক নয়। এমনিতেই সুযোগ পেলে কাজ করতে শুরু করে দেয়। কারোর কথা শুনেনা। এমনকি রাদের কথাও নয়। তবে শেষ অব্দি সবার অনুরোধে সেও রাজি হয়ে গেলো।
১২টা বাজতেই সকল আত্মীয়স্বজনরা আসা শুরু করে দিয়েছে। রাদের চাচা-চাচিও এসেছে। সঙ্গে অন্তু, অনন্যা আর প্রণয়। রাদের চাচা-চাচি অর্থাৎ রাজিয়া এবং মিলাদ পূর্বের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছে। অবশ্য এর পেছনে তাদের ছেলে অন্তুর অবদান। দিনে দিনে অন্তুর মাঝে যে পরিবর্তন তারা দেখেছিলো তাতে বাধ্য হয়েছিলো রাদের উপর থেকে সমস্ত রা/গ অভিযোগ সরিয়ে নিতে। অবশ্য তাদের রাগ এবং অভিযোগের আসলে কোনো কারনই আর খুঁজে পায়নি তারা। মেয়েজামাই সুখে আছে, ছেলেও তার কাজ নিয়ে দিব্যি দিন পার করছে। তাহলে আর কিসের দুঃখ তাদের।
—-” ব্রো?”
অন্তু হাস্যজ্বল মুখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে ঝাপটে ধরলো রাদকে। রাদ মুচকি হেসে ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
—-” কেমন আছিস?”
—-” ভালো। তোরা?”
—-” আমরাও ভালো। ওদিকের খবর কি?”
রাদ শেষোক্ত প্রশ্নটা একটু চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো অন্তুকে। অন্তুকে রাদকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ টিপে বলল,
—-” প্ল্যান সাকসেসফুল।”
—-” কিসের প্ল্যান সাকসেসফুল? তোরা কি ঘোল পাকাচ্ছিস আমার অগোচরে?”
বলতে বলতে এগিয়ে এলো প্রণয়। রাদ ওকে দেখে একবার চোরা চোখে তাকালো অন্তুর পানে। অন্তুও তাই। পরক্ষণে দু’জনেই বেমালুম ভুলে গেলো কিসের প্ল্যান সাকসেসফুল। কথার তাল ঘুরিয়ে শুরু করলো তিন বন্ধুর ফাজলামো। একই সঙ্গে শুরু হলো তাদের হাসাহাসি। হাসাহাসির মাঝেই এসে উপস্থিত হলো ইলহাম আর অনন্যা। তাদের মাঝে ভাগ বসাতে অনন্যা বলে উঠলো,
—-” আমাদের রেখে কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি? আমাদেরও একটু বলো!”
অনন্যার গলা পেয়ে তিনজনেই একসাথে পেছন মুড়ে তাকালো। অনন্যার পাশে ইলহামকে দেখে রাদের চোখে মুখে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। হাত বাড়িয়ে তার প্রিয়দর্শিনীকে কাছে টেনে এনে দাঁড় করালো। ফের অনন্যার উদ্দেশ্য বলল,
—-” হচ্ছিলো তোর বরের কথা। ও তোর প্রেমে পড়ার আগে আমাদের অলওয়েজ গান শোনাতো ও নাকি চারটা বিয়ে করবে। একটা ফরজ কাজ আদায় করা কত সওয়াব ভাব। এখন দেখছি, বেচারা একটা বিয়ে করেই হাঁপিয়ে উঠেছে। বলছে, তোকেই নাকি সামলাতে পারছে না। আবার চারটা বিয়ে কি করে সামলাবে!”
রাদের কথায় অন্তু ফিক করে হেসে দিলো। এদিকে প্রণয় অসহায় মুখ করে তাকালো রাদের দিকে। সুযোগ বুঝে ফাঁ/সি/য়ে দিলো বেয়াদবটা। রাদ মিটমিট করে হাসছে। অনন্যা রা/গি চোখে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,
—-” আচ্ছা তাই নাকি? প্রথমত আপনার চারটা বিয়ে করার সখ ছুটাবো। এরপর আমাকেও সামলাতে শেখাবো। দাঁড়ান আপনি..”
এই বলে অনন্যা প্রণয়ের দিকে তেড়ে যেতেই প্রণয় ‘না’ বলে দিলো এক দৌড়। অনন্যাও ছুটলো তার পিছুপিছু। ওদের কান্ড দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো অন্তু আর রাদ। সঙ্গে তাল দিলো ইলহামও। হাসতে হাসতে হঠাৎ থেমে গেলো ইলহাম। ব্যা/থা/য় অদ্ভুত রকমের গো/ঙা/নি দিয়ে আচমকা রাদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলো রাদ আর অন্তু। দু’জনের মস্তিষ্কেই আ/ঘা/ত হানলো ইলহামের অবস্থা দেখে। তবে অন্তুর রিয়াক্ট করার পূর্বে রাদই রিয়াক্ট করতে পারলো। ভ/য়ার্ত গলায় ইলহামের বাহু আগলে নিয়ে বলল,
—-” কি হয়েছে ইলহাম! লেবার পে/ই/ন হচ্ছে?”
—-” ভাই, ওকে নিয়ে বসাতে হবে আগে! ফাস্ট।”
অন্তুর কথায় রাদের মস্তিষ্ক সতর্ক বার্তা পৌঁছালো তাকে। ইলহামকে সাবধানে নিয়ে বসালো সোফায়। ইলহাম তখনও গো/ঙি/য়ে যাচ্ছে। বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন শ্বাস উঠেছে। একই সঙ্গে দরদর করে ঘামছে। অন্তু আর কিছু না ভেবে চটজলদি পানি নিয়ে এলো। পানিটা হয়তো সে নিজেই খাইয়ে দিতো, কিন্তু তার পূর্বে নিজেকে সামলে নিয়ে পানিটা ধরিয়ে দিলো রাদের হাতে। বলল,
—-” পানিটা খাওয়া। আমি ডক্টর কল করছি। ওকে হসপিটালে নিতে হবে মনে হচ্ছে!”
—-” হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুই গাড়ি বের কর। আমি ওকে নিয়ে আসছি।”
দুই ভাইয়ের শোরগোলে ততক্ষণে সব মেহমানরা এসে জোট পাকিয়েছে। মান্নাত বেগম, রাজিয়া বেগম, নিহা, নিহার শাশুড়ী সবাই শোরগোল শুনে দৌড়ে এলেন। ইলহামের অবস্থা বেগতিক দেখে আঁ/তকে উঠলো সকলের প্রান। মান্নাত বেগম বসলেন ইলহামকে ধরে। রাদকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, হঠাৎ এতো ব্যা/থা উঠলো কেন ওর! এভাবে শ্বাস ফেলছে কেন! এখনও তো অনেক সময় বাকি ডেলিভারির। লক্ষন তো ভালো নয়।
রাদ মায়ের কথার কোনো জবাব দিতে না পারলেও মনের ভেতর একটা ভ/য় নিয়ে ইলহামকে নিয়ে বের হলো। অন্তু ড্রাইভিং সীটে বসে আছে প্রথম থেকেই। ইলহামকে নিয়ে রাদ গাড়িতে উঠলেই গাড়ি স্টার্ট দিবে সে। রাদ ইলহামকে নিয়ে একপাশ থেকে উঠলে অন্যপাশ থেকে উঠে বসে মান্নাত বেগমও। গাড়ি স্টার্ট দিলো অন্তু। চলতি পথে ব্যা/থা/র আরও বাড়াবাড়িতে জ্ঞা/ন হারালো ইলহাম। যার ফলশ্রুতি আরও বড় ধা/ক্কা লাগলো রাদের। কি হলো হঠাৎ তার ইলহামের! সবটা ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে যাবে তো! নাকি, কোনো দুঃ/সংবাদ অপেক্ষা করছে তাদের পথ চেয়ে।
ওটিতে নেওয়া হয়েছে ইলহামকে। বাইরে অপেক্ষা করছে তিনটি আ/তং/কি/ত প্রাণ। অন্তু, রাদ এবং মান্নাত বেগমের। একটু পরই এসে হাজির হলো অনন্যা, প্রণয় আর রাজিয়া বেগম। সবার মুখেই আ/তং/কের ছাপ। কি হবে এই ভেবে জানপ্রাণ বেরিয়ে আসছে সবার।
হঠাৎ এর মাঝে আরেকটা দুঃ/সংবাদ এসে কড়া নাড়লো অন্তুর ফোনে। নাম্বারটা দেখে অন্তু চাইলেও কলটা কেটে দিতে পারলোনা। বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করে চলে গেলো অন্যপাশে। রাদ বসে আছে একটা চেয়ারে। হাঁটুতে ভর দিয়ে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে হাতে। প্রণয় আর অনন্যা বসে আছে তার দু’পাশে। প্রণয় বারবার তার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিচ্ছে। অনন্যা মন খারাপ করে তার একহাত জড়িয়ে বসে আছে। মান্নাত বেগম কান্না করছেন লাগাতার। রাজিয়া বেগম থেকেথেকে স্বান্তনা দিচ্ছে তাকে।
কথা শেষ করে অন্তু রাদকে ডেকে নিয়ে গেলো সবার আড়ালে। জরুরি কলটা অবশেষে এসেছে তার কাছে। কথাটা শুনতেই আরেকটা দুশ্চিন্তা মস্তিষ্কে গেঁথে বসলো রাদের। তাকে এক্ষনি যেতে হবে সেখানে। না গেলে না জানি আবার কবে পাবে এই সুযোগ।
—-” আমি ইলহামকে এই অবস্থায় ছেড়ে কি করে যাবো বল! ইলহামের পাশে এই মুহুর্তে থাকাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”
—-” আই নো দ্যাট রাদ। বাট, আর তো কোনো ওয়ে নেই। কি করবি বল?”
—-” একটা ওয়ে আছে। তুই চলে যা আমার হয়ে।”
—-” কিন্তু, উনি তো তোকে এ্যাপয়েনমেন্ট দিয়েছেন!”
—-” নো প্রবলেম। তুই গিয়ে বলবি, আমি একটা জরুরি কাজে আঁটকে পড়েছি। তাই তোকে পাঠিয়েছি। তুই আমার ভাই হোস। এটা বলার পর আই থিংক উনি আর কিছু ভাববেন না।”
—-” তুই আমাকে এতো বড় একটা দায়িত্ব দিচ্ছিস। আমি কি পারবো তোর বিশ্বাস রাখতে?”
—-” কেন পারবিনা। ভাই হোস তুই আমার। পর নাকি? আমার নিজের ভাই।”
অন্তু বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়ে। হওয়ারই কথা। একটা সময় ওদের যতটা ক্ষ/তি সে করেছে। সেই দিক থেকে ভেবে দেখলে রাদের উচিৎ তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। তবে তা না করে রাদ তাকে এতোটা আপন করে নিয়েছে। ভাবতেই অবাক হয়ে যায় সে।
—-” পারবিনা?”
প্রশ্ন করে রাদ। অন্তু জবাবে উত্তর না দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাইকে। সে পারবে। এটুকু আত্মবিশ্বাস তার নিজের প্রতি ছিলো। তবে তার জোর এখন আরও দিগুণ বেড়েছে রাদের ছোট্ট কথাটায়, “ভাই হোস তুই আমার। আমার নিজের ভাই।” কি অদ্ভুত এক টান ফিরে পেলো সে।
—-” চল যা। লেট করিসনা।”
—-” ওকে ভাই। আমাকে এদিকের খবর জানাস প্লিজ। আমি টেনশনে থাকবো।”
—-” শোন!”
অন্তু কথাটা বলে যেতে নিলে রাদ হঠাৎ পিছু ডাকে অন্তুকে। অন্তু দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন মুড়ে বলে,
—-” হ্যাঁ বল?”
রাদ দ্বিধাহীন গলায় প্রশ্ন করে,
—-” এখনোও খুব ভালোবাসিস ইলহামকে?”
রাদের প্রশ্নে অন্তুর মুখখানায় কেমন মেঘের ছায়া পড়ে। ফ্যাকাসে বিচূর্ণ চাহনিতে অন্তু জবাব দেয়,
—-” না ভাই। ভালোবাসি না।”
রাদ মুচকি হাসে। এককদম এগিয়ে এসে অন্তুর গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,
—-” যা। সাবধানে যাস। এদিকে সব খবর পেয়ে যাবি।”
অন্তু জোরপূর্বক হেসে রাদের হাতের উঠর হাত রেখে মুমূর্ষু গলায় বলে,
—-” ইলহাম তোকে ভীষণ ভালোবাসেরে। আমাকে নিয়ে অযথা নিজের ভালোবাসার প্রতি কনফিউশান বাড়াস না।”
এই বলে চলে গেলো অন্তু। রাদ ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে তেড়ে আসা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিলো। স্মিত হেসে আনমনে বলল,
—-” তুই সত্যিই অনেক বদলে গেছিস ভাই।”
#চলবে