#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা__মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____৩১.
আজ বৃহস্পতিবার। ব্যস্ত নগরীর সবচেয়ে চা/পযু/ক্ত দিন যাকে বলে। গাদাগাদা ফাইলের মধ্যে ডুবে থেকেও কাজের অন্ত করা যেন দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ঠিক একই ভাবে রাদেরও তাই। অফিসের সব কাজ শেষ করে বের হতে হতে রাত প্রায় ১টা বাজলো। আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ২টা ছুঁই ছুঁই। বাসার মেইন গেট খুললো নতুন কাজের লোক মকবুল। আগের ছেলেটা পালিয়েছে দু’দিন হলো। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু কোনোভাবে সে জানতে পেরেছে রাদ একজন মা/ফি/য়া। আর একজন মা/ফি/য়া/র বাড়িতে থেকে সে কিছুতেই নিজের জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি করতে দিবেনা। মা/ফি/য়া মানে সে খুব ভালো করেই জানে। ছোট বেলায় বাংলা ছায়াছবির প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক ছিলো। তাই ওসব মা/ফি/য়া কিংবা গু/ন্ডা কারোর ব্যাপারেই সে অবোধ নয়। তাই মা/ফি/য়া/র হাতে ম//রা//র পূর্বে বাক্সপেটরা গুছিয়ে পালিয়েছে। মা/ফি/য়া/দে/র এক আ/ঘা/তে/ই নাকি মানুষ কুপোকাত।
—-” ভাইজান, ভাবি আপনের আসার অপেক্ষা করতে করতে খাবার টেবিলেই ঘুমায় গেছে!”
মকবুল কথাটা বলতে বলতে গেট লাগালো। রাদ প্রচন্ড ক্লান্ত। যা তার হলদেটে চোখ জোড়া দেখেই বোঝা গেলো। তবে মকবুলের বলা কথাটা যেন ক্ষনিকের জন্য তার চোখ জোড়া সাদা করে ফেললো। কেননা, গত একমাসের ব্যবধানে সে এহেম চমকানো বানী শোনেনি। তার চাহনির মানে এমন ছিলো, যেন সে ভুল শুনেছে।
—-” তুমি ইলহামের কথা বলছো?”
নিজের কানকে অবিশ্বাস করে বড় চতুরতার সাথে কথাটা জিজ্ঞেস করলো রাদ। মকবুল মাথা ঝুঁকিয়ে উপর নীচ মাথা নেড়ে বলল,
—-” জে ভাইজান।”
মকবুলের দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তিতে রাদের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে উঠলো। পরনের মোটা ব্লেজারটা অনেক আগেই খুলে হাতে নিয়েছিলো সে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে শার্টের হাতা দুটো ফোল্ড করে উঠিয়ে রেখেছে বেশ খানিকটা। কেবল গলার টাইটা-ই বাকি ছিলো। তবে সেটার কথা আর মাথায় ছিলোনা। অন্যমনস্ক অবস্থায় টাই-টা লুজ করে রেখেছে। হাতে ধরে রাখা ব্লেজার আর ব্যাগটা মকবুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাদ দৌড়ে গেলো ডাইনিং এর দিকে। ইলহামের পরনে সকালের সেই কচুপাতা রঙের শাড়িটা। ডাইনিং টেবিলের উজ্জ্বল আলোয় রঙটা ঝেকে বসেছে ওর উপর। রাদ এসে দাঁড়ালো ইলহামের পেছনে। হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ইলহাম। মাথার পেছনের চাঁদ সমান বড় খোঁপাটা আগলা হয়ে ঝুলে আছে পিঠের উপর। দেখে মুচকি হাসলো রাদ। ধীর পায়ে এগোতে এগোতে ফের টাইয়ে হাত দিলো। টাই-টা আরেকটু লুজ করে ইলহামের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।
অতঃপর ডুব দিলো অতীতের পাতায়। ওদের যখন একদম নতুন নতুন বিয়ে হয়, তখন ইলহাম এমনটা করতো। খাবার টেবিলে বসে তার জন্য মধ্যরাত অব্দি অপেক্ষা করতো। আর অপেক্ষা করতে করতে ঠিক এভাবেই ঘুমিয়ে যেতো। অতঃপর রাদের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙতো তার। হঠাৎ সামনে রাদকে দেখে সে কি ভ/য়া/ন/ক লজ্জা। কান মুলে বলতো, ইচ্ছে করে ঘুমোয়নি!
রাদ বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ইচ্ছে করছে আজও ঠিক একই ভাবে ঘুম ভা/ঙা/তে তার প্রিয়দর্শিনীর। কিন্তু, কেন যেন চেয়েও সে ইলহামকে কাছে টেনে নিতে পারছেনা। তাদের মাঝে এক অদৃশ্য দেওয়াল দু’জনকে দু’জনের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যে দূরত্ব কোনো মীরাক্কেলই পারে ঘুচিয়ে দিতে।
—-” ইলহাম! ইলহাম? এখানে ঘুমোচ্ছো কেন! ওঠো প্লিজ। রুমে গিয়ে ঘুমোবে। ওঠো?”
মৃদু স্বরে ডাকলো রাদ। কিন্তু ইলহামের কোনো হেলদোল নেই। সে বেঘোরে ঘুমচ্ছে। রাদ ওর এতো গভীর ঘুম দেখে মুচকি হাসলো। একদম ইচ্ছে করছেনা ওর ঘুম ভা/ঙা/তে। কি মায়াবী লাগছে মুখখানা। ইচ্ছে করছে ওকে বুকে আগলে নিয়ে সেও এখানে ঘুমিয়ে যাক। তবে এমন কিছুই করলোনা। বরং ইলহামকে অতি সাবধানে কোলে উঠিয়ে নিলো। ধীরপায়ে ওকে নিয়ে চলে এলো রুমে। আজ আর খাওয়া হবেনা। ইচ্ছেও করছেনা, আর পেটও ভরে আছে। ১১টার দিকে ডিনারের জন্য হালকা কিছু খাবার খেয়েছিলো সবাই। তখন রাদও খেয়েছে। তাই আজকের জন্য বাকি ডিনার স্কিপ করবে ভেবেই আরেকটু লেট করে ফিরেছে বাড়ি।
এদিকে ইলহামকে বিছানায় শুয়ে দিতে গেলে রাদ পড়ে ফ্যাসাদে। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে ওকে বিছানায় শুয়ে উঠে আসতে নিলে ইলহাম ঘুমের ঘোরেই টেনে ধরে রাদের হাত। রাদ ছাড়াতে গিয়েও ছাড়ায় না। ইলহাম গত এক মাসে ভীষণ পাল্টে গেছে। যা একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিয়েছে তাকে! তবে আজ কেন জানা নেই, রাদের মনটা অন্য কিছুর আভাস দিচ্ছে। মন বলছে, সবটা পূণরায় ঠিক হয়ে যাবে। আর অতি শীঘ্রই।
ইলহাম ঘুমের ঘোরে রাদের হাতটা ঝাপটা রেখে ওপাশ ফিরে গেলো। সে এখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এদিকে যে পৃথিবী এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে যাচ্ছে সে খবর তার নেই। হাতে টান খেয়ে রাদ ইলহামের অনেকটু কাছে চলে গেলো। ইচ্ছে না হলেও বাধ্য ছেলের মতো নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো ওর পাশে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে তার। কেমন অসার হয়ে আসার মতো। ভেতরে ভেতরে স্বল্প পরিমান ভ/য় হচ্ছে, যদি ইলহাম উঠে পড়ে? যদি তাকে এই অবস্থায় দেখে? ব্যাপারটা কিভাবে নিবে ভাবতেই অস্থির হচ্ছে মন। তবে তার ভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো ইলহাম,
—-“এতো উসখুস করছেন কেন? কাছে আসলে কি আপনার বউ রাগ করবে নাকি?”
রাদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এই মুহুর্তে ইলহামের কোনোরূপ কথাই সে আশা করেনি। ইলহাম তো বেঘোরে ঘুমচ্ছিলো! ঘটনা চক্রে সে এতোটাই চমকালো যে, ইলহাম তার হাতটা ছেড়ে দিতে সে বিছানা থেকে পড়ে গেলো মেঝেতে। তাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে আঁ/ত/কে উঠলো ইলহাম। লাফিয়ে উঠে বসলো শোয়া থেকে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে চটজলদি টেনে তুললো রাদকে। রাদের হকচকানো মুখশ্রী এখনোও বিরাজমান। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সে। ইলহাম এবার না পেরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,
—-” কি হয়েছে? ওমন করে কি দেখছেন!”
রাদ হাসফাস করা অবস্থায় ঢোক গেলে। কি হচ্ছে সবটাই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইলহাম রাদের অবস্থার আন্দাজ করে নিজের হাসি থামালো। শান্ত চাহনিতে রাদের ক্লান্ত মুখখানা একবার পরখ করে আস্তে করে নেমে এলো বিছানা ছেড়ে। রুম থেকে বের হতে হতে বলল,
—-” ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
এই বলে চলেও গেলো সে। কিন্তু রাদ এখনও স্থবির! স্তব্ধ তার মস্তিষ্ক! বি/কলাঙ্গ তার অনুভূতি। এখনোও ভেবে কুলাতে পারছেনা কি হচ্ছে।
আজ দুপুরের রান্না ইলহামই করেছে। বিশেষ করে রাদের পছন্দের সব খাবার। ডায়েরির পাতায় কেবল নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্কেই নয়, বরং নিজের বিয়ে এবং নিজের স্বামীর সম্মন্ধেও জেনেছে ইলহাম। গত তিনবছর আগে এই পরিবারেই বউ হয়ে এসেছিলো সে। রাদের সঙ্গে তার সংসার, খুনসুটি এমন নানাবিধ রচনা নিজেই লিখে রেখেছিলো। কেননা, ওর এই রোগের কথা আর কেউ না জানলেও ও খুব ভালো করেই জানতো। এমনকি এটাও জানতো যে, খুব শীঘ্রই হয়তো সে তার সব কিছু ভুলে যাবে। রাদকে, মান্নাত বেগমকে! কাউকেই হয়তো আর মনে থাকবেনা। আর আখেরে হলোও তাই। কথাগুলো ভাবতেই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় ওর। ওদের বিয়ের দিন ওকে পাঠানো সেই ছবি গুলোও যে ওর আর রাদেরই ছিলো। রাদ! মানুষটার কোনো অপরাধ না থাকা স্বত্বেও কতটা য/ন্ত্র/ণা সহ্য করেছে দিনের পর দিন। কোনোদিন এক ফোটা অভিযোগও যে করেনি মানুষটা।
ভাবতে ভাবতে চোখের কোন গলিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেলো অনায়াসে। অতঃপর আর সময় নষ্ট করলোনা। রাদের খাবার গুলো নিয়ে দ্রুত চলে গেলো রুমে।
রাদ ফ্রেশ হয়ে সবে বসলো বিছানায়। ঠিক তখনই খাবার হাতে রুমে ঢোকে ইলহাম। ইলহামকে দেখে অদ্ভুত করে তাকালো রাদ। কিন্তু ইলহামের মুখে স্বাভাবিক হাসি। যেন কিছু হয়নি। দুনিয়াও এপাশ ওপাশ হয়ে যায়নি। সবকিছু ঠিক আছে।
—-” পা তুলে বসুন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”
খাবার গুলো টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বললো ইলহাম। রাদ বাধ্য ছেলের ন্যায় বিছানায় পা তুলে বসলো। তা দেখে ইলহাম মুচকি হেসে প্লেটে রাদের সমস্ত পছন্দের খাবার গুলো এক এক করে তুলে দিয়ে বলল,
—-” আপনার পছন্দের মাছটা আজ পায়নি মকবুল ভাই। পায়নি বললে ভুল হবে, পেয়েছিলো। কিন্তু সাইজ অনুযায়ী একটু বেশিই ছোট। আর আপনি তো ছোট মাছ একদমই খেতে পারেন না! তাই আমি বললাম, কাল ভোর ভোর বাজারে গিয়ে নিয়ে আসতে।”
—-” প..পছন্দের মাছ! আমার পছন্দের মাছের কথা তুমি কি করে জানলে? মা বলেছে?”
ইলহাম ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
—-” মা কেন বলবে? আমি কি জানিনা নাকি!”
রাদ অবাক চোখে তাকায় ইলহামের পানে। চটজলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইলহামকে টেনে আনে নিজের কাছে। অসহায় কন্ঠে জানতে চায়,
—-“ম..মানে কি! তোমার কি তবে সবটা মনে পড়ে গেছে?”
রাদের কন্ঠে কেমন আকুলতা। ঢের বুঝতে পারে ইলহাম। ও ভেবেই অবাক হয়, কতটা ভাগ্য নিয়ে এই মানুষটার বউ হয়েছিলো ও। নয়তো দেড় বছরেও মানুষটা কখনোও জোর করে ওকে কিছু মনে করাতে যায়নি। কতটা সহ্যশক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে গেছে দিনের পর দিন।
—-” কি মনে পড়বে হু?”
—-” আমাকে! আমাদের দু’জনকে?”
—-” কি যে বলছেন না আপনি! আপনাকে কি আমি ভুলে গেছি নাকি?”
রাদ জবাব খুঁজে পায়না। সে ধরতে পারছেনা ইলহামের চতুরতা। কিছু যেন লুকাচ্ছে মেয়েটা।
—-” না! কিছু না।”
রাদ এখনও চায়না ইলহামের ব্রেনে কোনো প্রে/শার পড়ুক। যদি ওর অতীত মনে পড়ে যায় তাহলে ওর বর্তমান ভুলে যাওয়ার কথা। হয়তো সেটাই হয়েছে। হয়তো সেই মীরাক্কেলটি ঘটেছে। হয়তো তার প্রিয়দর্শিনীর অতীত মনে পড়েছে। আর ভুলেছে বর্তমান। তাই তো এতো কোমল হয়েছে সে তার প্রতি।
—-” এখনও দাঁড়িয়ে থাকবেন? খেতে বসবেন না? কত ক/ষ্ট করে রেঁধেছি জানেন? খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে। আপনার দেরী করে বাড়ি ফেরার অভ্যাসটা আর বদলালো না। আপনি জানেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। আর বরাবরের মতো চোখ খুলে দেখি, আমি বিছানায়। আপনি পারেনও বটে!”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে গেলো ইলহাম। রাদ পূর্বের দৃষ্টিতে এখনোও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইলহাম নিজের কাজে ব্যস্ত হতে গেলে রাদ ফের ওকে টেনে এনে দাঁড় করায় নিজের সামনে। বাহুজোড়া আগলে ধরে কেমন ক্লি/ষ্ট স্বরে আওড়ালো,
—-“আর কখনোও ছেড়ে যাবেনা তো আমাকে?”
রাদের প্রশ্নে ইলহামের ভেতরটা ডুকরে উঠলো। আর কতটা আ/ঘা/ত, আর কতটা অসহায়ত্বতা চেপে রাখবে মানুষটা। পারছেনা সহ্য করতে, পারছেনা প্রকাশ করতে। ভালোবাসার কাছে মানুষ কতটা অসহায় হয়।
ইলহাম নিজের অনুভূতি গুলো বুঝতে দিলোনা রাদকে। রাদের প্রশ্নের বিপরীতে পায়ের উপর ভর দিয়ে রাদের ঠোঁট জোড়ায় একটা গাঢ় পরশ আকলো ইলহাম। রাদ চোখ জোড়া বন্ধ করে অনুভব করলো সেই গভীর ছোঁয়া। ফের জবাব দিলো ইলহাম,
—-” জানিনা, কতদিন বেঁচে থাকবো এই পৃথিবীর বুকে। তবে, যতদিন বাঁচব কেবল এই মানুষটার বাহুডোরেই বাঁচব। অন্যথায়, কোথাও নয়।”
#চলবে_____
[ বিঃদ্রঃ অনেকেরই অভিযোগ ছিলো কেন রাদ সবটা বলে দেয়নি ইলহামকে। এতো ঢং করার কি আছে এই সব। আশা করি আজকের পর্ব পড়ে আর অভিযোগ থাকবেনা।]