#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ৩০
আজ রাদ-ইলহামের বিয়ের একমাস হতে চললো। এই এক মাসে এক কথায় হাসতে ভুলেছে ইলহাম। হাসে না,কাঁদে না,কম কথা বলে.. সব মিলিয়ে এক পা*থ*রে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাদ বার কয়েক বেলী এবং আকাশের সঙ্গে ইলহামের সমস্যা টা নিয়ে কথা বলেছে। এমনকি নাম-করা শহরের বড় বড় কয়েক জন ডাক্তারের পরামর্শও নিয়েছে। সবার একই কথা,’সব কিছু মনে করাতে গিয়ে ওর লাইফটা রি//স্ক না বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ।’ বেশি চাপ পড়লে ব্রেন অ/কে/জো হয়ে পড়ার সম্ভবনা বেশি। যদি সবটা ইলহামের নিজের থেকেই মনে পড়ে, সেটাই ওর আর সবার জন্য মঙ্গলকর।
জীবন চলছে রঙ বিহীন, ধোঁয়াশাময়। সারাদিন একা ঘরে থেকে ইলহামের একটাই ভাবনা, “রাদের প্রথম ভালোবাসা দেখতে কেমন? রাদ তাকে এ-বাড়িতে কেন নিয়ে আসেনা? কারোর সাথে পরিচয় করানোর বেলায় কেন শুধু তাকেই ” আমার ওয়াইফ” বলে আখ্যায়িত করে? মেয়েটাকে এতো ভালোবাসে অথচ একদিক থেকে ভাবতে গেলে রাদ মেয়েটার সঙ্গে অ/ন্যা/য় করছে। যে অ/ন্যা/য়ে/র কোনো ক্ষমা হয়না।
—-“ভাবি? চিলেকোঠার ঘরটা তুমি পরিস্কার করবার কয়েছিলা। পরিস্কার করা হয়ে গেছে। অনেক পুরানা বই-পত্র পাইছি। খালাম্মারে কইলাম, খালাম্মা কইলো ফালায় দিতে। তুমি কি কও?”
—-“সে কি! ফালাবে কেন? বই পত্র পুরোনো হলেই ফালাতে হবে? তুমি রেখে আসো। আমি দেখে মাকে জানাবো।”
—-“আইচ্ছা।”
শিরিন কোমরে বাঁধা ওড়নার পাড়টা খুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে চলে গেলো। ইলহাম শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে সবে। ভেজা চুলগুলোতে একটা গামছা পেঁচিয়ে পরনের কচুপাতা রঙের টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়িটা ঠিক করলো। কুঁচি ধরে, আঁচল টা ভালোভাবে এঁটে দিলো কাঁধে। মাঝখান থেকে ভাজ তুলে আরেকটা পার্ট তুলে দিলো কাঁধে। গোসলের পর মুখটা দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে। এটা রাদই বলে তাকে। কথাটা মনে পড়তে হঠাৎ তাচ্ছিল্য হলো নিজের প্রতি। চোখের ল্যাপ্টানো কাজল তুলে নতুন করে কাজল পড়লো। কপালে লাল রঙের ছোট্ট একটা টিপ পড়ে নিজেকে একবার দেখলো আয়নায়। বিয়ের পর থেকে নিয়ম করেই শাড়ি পড়া হয়। অবশ্য রাদেরও কড়া হু/কুম।
—-“মামী আমি আছছি।”
হাতে একটা পুতুল আর একটা লাল কাপড় নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নিঝুম। ইলহাম আয়না থেকেই বরাবর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিঝুমের প্রতি।
—-“ঝুম পাখি আসছে?”
নিঝুম উপর নীচ করে মাথা নাড়ে। গোলগাল চোখ জোড়া আশেপাশে ঘুরতে লাগে। কিছু খুঁজছে দেখে ইলহাম পূণরায় বলে ওঠে,
—-“কি খোঁজে ঝুমপাখি?”
—-“মামা নাই?”
—-“না পাখি। মামা তো অফিসে। তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার কাছে এসো। আমি রেডি হচ্ছি।”
—-“তুমি কোথায় যাও মামী?”
—-“ছাদে। তুমি যাবে?”
—-“ওক্কে।”
ইলহাম স্মিত হেসে বলে,
—-“ওক্কে। আসো।”
নিঝুমকে নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে আসে ইলহাম। মাসখানেক আগে দেখা ময়লার স্তুপ এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখতেই মনটা খুশি খুশি লাগলো ইলহামের। ধাপ ফেলে এগোলো বইয়ের পাহাড় করে রাখা জায়গাটায়। আগে বই গুলো দেখতে হবে। যদি কোনো কাজে না আসে তবে কোনো লাইব্রেরিতে রেখে আসা যাবে। ভাবতে ভাবতেই বই গুলো নিরীক্ষণের কাজে লেগে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে এগুলো রাদের ছোট বেলার বই। ক্লাস এইটের পর থেকে সকল বই আছে। দেখছে এবং একটা বস্তায় জমাট করছে। এগুলো সত্যি কোনো কাজে আসবেনা। বই গুলো ঘাঁটতে থাকার এক পর্যায়ে হঠাৎ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসের প্রতি দৃষ্টি আঁটকে গেলো ইলহামের। সেদিন চিলেকোঠায় একটা ডায়েরি পেয়েছিলো ইলহাম। সেই ডায়েরিটাই আবারও দেখতে পেয়ে মনটা বেজায় আনন্দ পেলো। উপুড় হয়ে থাকা ডায়েরিটা চটজলদি হাতে তুলে নিতে আনন্দ আরও দিগুণ হলো এই দেখে যে শিরিন তার কাজটা খুব নিখুঁত আকারেই করেছে। ডায়েরির কোথাও একটা ধুলোকনাও লেগে নেই।
ডায়েরিটা উল্টো পড়ে থাকায় ইলহাম ওভাবেই হাতে উঠিয়ে আনে। কতক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডায়েরিটা দেখতে দেখতে হঠাৎ ভাবলো, এটা কি কোনো ভাবে রাদের ডায়েরি? কথাটা ভাবতেই একঝাঁক কৌতূহল হৈ হৈ করে উঠলো বুকের ভেতর। তবে কি সে জানতে চলেছে রাদের প্রথম ভালোবাসার সম্পর্কে। কিন্তু না, ডায়েরিটা উল্টে তার বুকে নিজের নামটা দেখে যেন বিস্ময়ের পাহাড় চাপলো মাথায়। মোটা অক্ষরে লেখা,”আমি ইলহাম”। ইলহামের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এটা তার ডায়েরি? এটা তার ডায়েরি হলে এই বাড়িতে কেমন করে এলো? আর যতদূর তার মনে পড়ে, সে-তো কোনোদিন ডায়েরি লেখেনি!
হাজারও একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন ছুঁচোর মতো ছুটছে মস্তিষ্কে। মাথাটা আচমকাই কেমন ভার হয়ে উঠলো। শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় কেমন মড়মড় করা ভাব ছড়িয়ে পড়লো। অহেতুক প্রশ্নদের ভীড়ে অসহায় হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলাতে হবে৷ এমন করে অনুভূতিদের ভ/য়া/ন/ক রূপের সঞ্চালন ক্রমশ ঘটতে থাকলে ম//রে যাবে সে। চটজলদি ডায়েরির প্রথম পাতাটা খুলে সম্মুখে মেলে ধরতেই ভেসে উঠলো পরিচিত হাতের লেখা। ২০০৯ সাল। মোটা কালিতে সাল টা দেখে চোখ আঁটকে পড়লো ইলহামের। একটু নীচেই সুশ্রী হাতের লেখায় দেখতে পেলো,
—-“ আমার বাবা, মাকে ভীষণ মা//র//তো। তাই মা অনেকবার সু//ই//সা//ই//ড করতে চেয়েছিলো। কিন্তু করতে পারেনি। মা সবসময় বলতো, আমার জন্য নাকি মায়ের বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমি মায়ের বাঁচার একমাত্র কারন। মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। আমিও মাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। কিন্তু মাকে আমি আমার কাছে রেখে দিতে পারিনি। বাবা মাকে মে//রে ফেলেছে। রনো আঙ্কেল? মা বলতো আমার একটা রো//গ আছে। আমি নাকি কয়েকদিন পর পর কাউকে চিনতে পারিনা। তাই মা বলেছিলো, যদি কোনোদিন তার কিছু হয় আমি যেন একটা ডায়েরিতে লিখে রাখি। আমি জানিনা আমি আবার সবটা ভুলে যাবো কিনা। যদি তুমি এই ডায়েরিটা পাও তাহলে আমার মায়ের খু//নী//কে তুমি শা//স্তি দিও।”
ডায়েরির প্রথম পাতায় এরূপ কিছু লেখা পড়তে থমকে গেলো ইলহাম। তার মা-কে তার বাবা খু//ন করেছিলো? অথচ এই কথা সে ভুলে গেছে? আজ এতো গুলো বছরেও কেউ জানতে পারেনি তার মায়ের মৃ//ত্যু//র র/হ/স্য! কিন্তু বাবা মাকে কেন মা//র//তো? এর পেছনের কি কারন ছিলো? আর রনো আঙ্কেল কে? ওর জানা মতে এমন নামের কাউকে চিনেনা! কোনোদিন শোনেওনি!
ইলহাম ডায়েরির পাতা উল্টালো। না, এই বিষয়ে আর কিচ্ছু লেখা নেই। ইলহাম ডায়েরি হাতে উঠে দাঁড়াল। তাকে উঠে যেতে দেখে নিঝুম বলল,
—-“কই যাও?”
—-“আ..আমি আসছি। ঝুমপাখি? তুমি এখন মায়ের কাছে যাও, কেমন?”
—-“ওক্কে।”
নিঝুম মাথা নেড়ে দৌড়ে চলে গেলো। ইলহামের পায়ের গতিটাও ঠিক ওমনই। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে এসে হাজির হলো। ভেতর থেকে রুমের দরজাটা লক করে মেঝেতেই বসে পড়লো ডায়েরিটা নিয়ে।
২০১৬’
মিশমিশ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। নামটা খুব সুন্দর। আমি ওকে সবসময়ই বলি। ও শুনে হাসে। আমার মায়ের চলে যাওয়ার পর মিশমিশই আমার দুনিয়া। মামীর থেকে শুনেছি আমার মা নাকি একটা রোড এ//ক্সি//ডে//ন্টে মা//রা যায়। কিন্তু এই ডায়েরির প্রথম পাতা তো অন্য কথা বলছে। আমার মায়ের মৃ//ত্যু//টা কোনো দূ//র্ঘ//ট//নায় হয়নি। এটা একটা সাজানো গোছানো পরিকল্পনা ছিলো। যে পরিকল্পনার সমাপ্তিতে ছিলো আমার মায়ের মৃ//ত্যু। আর যে খু//নী সে আমার বাবা। মিশমিশ বলে, আমাদের বন্ধুত্বের শুরুতেও নাকি আমি ওকে এই একই কথা বলতাম। কিন্তু, আমার কেন মনে নেই? আজ মিশমিশের মৃ//ত্যু বার্ষিকী। নিয়তি মিশমিশকেও আমার থেকে কেঁ/ড়ে নিলো। আমাকে আবারও নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। আমার বারবার মনে হয়, আমার মিশমিশকে কেউ মে//রে ফেলেছে। ঠিক মায়ের মতো। তাহলে কি আমার মিশমিশের মৃ//ত্যুর পেছনেও আমার বাবার হাত?’
ইলহামের হাত গলিয়ে পড়ে যায় ডায়েরিটা। বাবা’ এই ছোট্ট শব্দটিতে মানুষ একটা ভরসার জায়গা পায়। ভালোবাসা, ভরসা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কি না থাকে? কিন্তু তার তো মনেও পড়েনা এই নামটা। তার কারন কি? জানেনা সে। কেবল জানে, তার বাবা নামের মানুষটা তাকে চেনেনা। কোনোদিন চিনতো বলেও মনে হয় না। অবশ্য সেও তো চিনেনা তার বাবা-কে। তাহলে কি করে শাস্তি দিবে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড আর মায়ের খু//নী//কে//।
চলবে…