#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______২৯
একখানা ভাঙাচোরা পুরনো খাটে লাল বেনারসি পড়ুয়া একটা মেয়ে বসে আছে পা তুলে। তার লম্বা কেশগুলো পুরোটাই বাঁধন হারা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে। মাথাটা নিচু করে থাকায় এলোকেশি গুলো তার মুখের একপাশটা প্রায় ঢেকে রেখেছে। মেয়েটাকে দেখতেই স্তব্ধ হলো রাদের হৃৎস্পন্দন। টানা দুটো দিন চোখের আড়ালে ছিলো মানুষটা। ঠিক কেমন ছিলো জানেনা। আদৌও ভালো ছিলো কিনা সে কথাও জানেনা।
—-“আহেন স্যার, আহেন। কই গো, গেলা কই? দেইখ্যা যাও গো?”
মোতালেব সাহেবের আমোদিত গলা ভেসে এলো ইলহামের কানে। অন্যমনস্ক দৃষ্টি জোড়া উপরে তুলতেই চমকে উঠলো রাদকে দেখে। ব্যাপার টা নিছক তার দুঃস্বপ্ন বলে কাটিয়ে দিতে চাইছে তার মন। কিন্তু মস্তিষ্ক ঠেসে ধরলো সত্যিটা দাবী করতে।
কুটিরে মোট একখানাই কক্ষ। এক কক্ষেই সকল জোগাড়। মোতালেব সাহেবের বিবি ঘরে ঢুকলেন পেছনের দরজা থেকে। আঁচলের কোনে হাত মুছতে মুছতে ব্যস্ত পদাচারণে হেঁটে এলেন। ঘরে নিজের স্বামী ব্যতীত দ্বিতীয় পুরুষের উপস্থিতিতে স্বভাব সুলভ মাথার ঘোমটা টা টেনে দিয়ে মুখে আঁচল চেপে দিলেন। স্বামীর পানে দৃষ্টি রেখে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন ‘কে?’
মোতালেব সাহেব ঠোঁটের কোনে হাসিটুকু প্রসারিত করে এগিয়ে গেলেন বউয়ের কাছে। রাদকে ইশারা করে পরক্ষনে ইলহামকে ইশারা করলেন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
—-“নতুন বউয়ের সোয়ামী।”
মহিলার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেলো। অবাক হওয়ার চেষ্টা করে সেও স্বামীর ন্যায় গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
—-“কি কইতাছো? এদদিন পর কইথেইক্যা আইলো?”
—-“এদদিন কই হইলো? মাত্র দুই দিন। তোমারে কাইলকা খবরের কাগজ পইড়া কি হুনাইলাম? নতুন বউরে নিয়া কেডা জানি নিখোঁজের বিজ্ঞাপন দিছে। ভুইলা গেছো?”
—-“ও হ হ! মনে পরছে,মনে পরছে।”
হঠাৎ মনে পড়ায় তার গলার স্বরটা বেশ জোরে শোনালে। তার কন্ঠে ঘোর কাটে রাদের। কিন্তু ইলহাম এখনোও ঘোরে ডুবে আছে। চারিপাশের কোনো বাহ্যিক শব্দ তার ঘোর কাটাতে সক্ষম হয়নি।
রাদ ধাপ ফেলে এগিয়ে গেলো ইলহামের দিকে। ইলহাম ভ/য় এবং জড়তায় বিছানার চাদর খামচে ধরে নড়েচড়ে বসতে লাগলো।
—-“স্যার? আপনেরা কথা কন। দুফরের খাওন কিন্তু না খাইয়ে যাইতে দিবাম না। খাইয়ে দাইয়ে ভরা পেটে রওনা হইয়েন।”
অমায়িক হেসে মোতালেব সাহেব কথাটা বলে প্রস্থান করলেন বউকে সঙ্গে করে। রাদ শুনেছে তাদের কথা। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মৃদু হাসলো। তারা চলে যেতেই পূণরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইলহামের পানে। ইলহামের অস্থিরতা দূর থেকেই টের পাচ্ছে রাদ। কিন্তু, তাতে এই মুহুর্তে তার কোনো ভাবাবেগ নেই।
ইলহামের পাশে চুপটি বসলো রাদ। কোনোরূপ কথা না বাড়িয়ে ইলহামের গুটিয়ে রাখা হাতটা টেনে মুঠোবন্দি করলো। ইলহাম বাঁধা দিতে চাইলে হাতের জোর বাড়িয়ে দিলো রাদ। প্রায় অনেক্ষন চুপটি করে বসে রইলো দু’জনেই। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তবে চোখে চোখে অনেক কথা! একজনের চোখে ঘৃ/না আর অন্যজনের চোখে একরাশ অসহায়ত্বতা। একজনের চোখে রাগ তো একজনের চোখে একরাশ দুঃখ। রাদ মাথা নীচু রেখে ইলহামের হাতটা বুকের সাথে চেপে রেখে হঠাৎ নীরবতা ঠেলে কেমন ভা/ঙা গলায় বলে উঠলো,
—-“আমার অপরাধ কি, সুইটহার্ট? আমি তোমাকে ভালোবাসি! এটাই কি আমার অপরাধ?”
রাদের চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিলো ইলহামের উত্তপ্ত হস্তদ্বয়। ইলহাম কেমন করে কেঁপে উঠল। বড্ড বেশি অবাক হলো রাদ কাঁদছে ভেবে। আচ্ছা? পুরুষ কি এতো সহজে কাঁদতে পারে? পুরুষের কান্না কি এতো সহজ হতে পারে? পারেনা তো! একদম পারেনা।
রাদ বুঝতে পারলো তার দ্বারা আর সম্ভব হচ্ছে না। আর একটু খানি দূরত্ব, তাকে মৃ//ত্যুর বুকে ঠেলে দিবে! কথাটা ভাবতেই যেন দম ব/ন্ধ হয়ে এলো তার। আকস্মিক ইলহামকে কাছে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে আরও অগুনিত চোখের জল বিসর্জন হয়ে গেলো। বুকটা হাহাকার করে কাঁদতে লাগলো। উন্মাদের ন্যায় নিজের পাঁজরের হাড়কে নিজের করে পাওয়ার তীব্র দাবী জানালো। কারন, সে আর পারবেনা এমন করে বেঁচে থাকতে।
কাঁদছে ইলহামও! রাদের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা জন্মেছে। কয়েকটা দিনেই মানুষটাকে ঠিক কতটা ভালোবেসে ফেলেছে তার সংজ্ঞা দিতে গেলে পেরিয়ে যাবে তার শতসহস্র বছর। হয়তো এর চেয়েও অত্যধিক। কিন্তু যখন মনে পড়তো, রাদের প্রথম ভালোবাসা অন্য কেউ! তখনই আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগতো না। একদম ইচ্ছে জাগতো না। হয়তো সেই প্রথম ভালোবাসার জন্যও ছিলো রাদের অতলস্পর্শ প্রচেষ্টা, পা/গলামি। সে মেনে নিতে পারছিলো না রাদের জীবনে ইলহাম ব্যতীত অন্য কেউ থাকতে পারে!
—-“আমাকে কেন ঠকালেন, রাদ? আমি তো আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সত্যিকারের ভালোবাসা হয়েছিলো আপনার প্রতি! তাহলে কেন ঠকালেন আমাকে? আমার কি অপরাধ ছিলো?”
কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে ইলহামের। কাতর কন্ঠে কথাগুলো বলতে ভীষণ ক/ষ্ট হচ্ছিলো তার।
ইলহামের প্রশ্নে থমকে যায় রাদ। এর জবাব কি দিবে সে? সে তো তাকে কোনোদিন ঠকায়নি। এই কথা কি করে বিশ্বাস করাবে ইলহামকে?
—-“সুইটহার্ট, আমি তোমাকে ঠকায়নি। আমি তোমাকে কোনোদিন ঠকাতে পারিনা। কেবল এটুকু জেনে রাখো আমি আমার প্রিয় মানুষটিকে কোনোদিন ঠকাতে পারিনা।”
—-“কেন মিথ্যে বলছেন আপনি! আমি কিন্তু সব জেনে গেছি।”
রাদের বুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো ইলহাম। পরক্ষণেই কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো কথাটা। রাদ অসহায়ের ন্যায় তাকালো ইলহামের র/ক্তি/ম মুখশ্রীতে। ইলহাম যে বড্ড বেশি ক//ষ্ট পাচ্ছে, সেকথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা রাদের। কিন্তু যখন ও আসল সত্যিটা জানবে তখন যে এর চেয়েও ভ/য়া/ন/ক রকমের ক/ষ্ট পাবে। এখন এই ক/ষ্ট টুকু কেবল মানসিক, কিন্তু তখন কষ্ট গুলো হবে শারিরীক। পুরনো কথা মনে করাতে গিয়ে সে আর কোনো ক//ষ্ট দিতে চায়না এই অভাগী কে।
—-“আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন, রাদ! শুধু আপনি নন ও বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ আমায় মিথ্যে বলেছে। আমি জানিনা কেন? আমায় কি অপরাধে আপনারা প্রত্যেকটা মানুষ এতো বড় একটা শা//স্তি দিলেন? আমি সত্যি জানিনা।”
বলতে বলতে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো ইলহাম। রাদ দম ব/ন্ধ করে কয়েক মুহুর্তে বসে রইলো। জানেনা কি বলে মানাবে ইলহামকে। ঠিক কি বললে, ওর মনের ক্ষত গুলো ভরাট হবে।
—-“আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবং আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এর চেয়ে বড় সত্যি আর কি জানতে চাও তুমি?”
ইলহামের বুকের ভেতরটা অসহায়ের মতো হাহাকার করে ওঠে। কাতর কন্ঠে পূণরায় বলে,
—-“আপনি কি ঐ মেয়েটাকেও একই ভাবে ভালোবাসতেন, রাদ? আমি এই সত্যিটাও জানতে চাই। দয়া করে আমাকে মিথ্যে বলবেন না।”
—-“যদি আমি সত্যিটা বলে দেই, তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো? আমার সাথে সারাজীবন দ্বিধাহীন ভাবে বাঁচতে পারবে তো? কারন, সত্যি হোক কিংবা মিথ্যে.. আমি তোমাকে কোনো মূল্যেই নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবোনা, সুইটহার্ট। আমার যেকোনো মূল্যে শুধু তোমাকেই চাই। যেকোনো মূল্যে।”
ইলহাম ভেতর থেকে ভে/ঙে পড়ে রাদের উত্তর ভেবে। কেননা, সে এই টুকু তো নির্ঘাত বুঝে নিয়েছে রাদ তার প্রথম ভালোবাসাকেও ভ/য়ং/ক/র রকমের ভালোবাসে।
—-“থাকবো! সত্যিটা বললে থাকবো আমি।”
শূন্য অনুভূতিতে কথাটা বলে ইলহাম। কারণ, সে জানে রাদ ছাড়া তাকে মাথার উপর আশ্রয় দেওয়ার লোকটাও নেই এই দুনিয়াতে।
—-“হ্যাঁ, আমি তাকেও একই ভাবে ভালোবাসতাম। আজও বাসি আর সারাজীবন বাসবো। তোমাকে ছাড়া যেমন বাঁচা সম্ভব নয়, তাকে ছাড়া যে আরও নয়। আমাকে বাঁচতে হলে এই দুটো অস্তিত্বই চাই সুইটহার্ট।”
ইলহাম নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় রাদের পানে। ওর আর কিছু জানার নেই।
—-“ভালোবাসো আমায়?”
—-“খুব ভালোবাসি।”
—-“থাকবে সারাজীবন আমার হয়ে?”
ইলহাম তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
—-“আর কোনো পথ খোলা নেই।”
—-“অপশন নেই বলে থাকছো?”
ইলহাম না সূচক মাথা নাড়ে। জবাবে বলে,
—-“কথা দিয়েছি। তাই..”
ইলহামের গলার স্বর কেমন পাথর হয়ে আসে। এবারেও তা বুঝতে অসুবিধা হয়না রাদের। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,
“তোমার সমস্ত দুঃখ গুলোর অবসান একদিন ঠিক ঘটবে, সুইটহার্ট। কেবল সময়ের অপেক্ষা। একটু সয়ে যাও প্লিজ। আমি তোমার বেলাতে বরাবর স্বার্থপর। আমি পারবোনা, তোমার দুঃখ কমাতে তোমায় দূরে ঠেলে দিতে। আমার দ্বারা সম্ভব নয়। একদম সম্ভব নয়।”
চলবে