প্রেম পিয়াসী পর্ব ২৭

0
514

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________২৭.

রাতের অন্ধকারগুলো কেমন ঘাপটি মে//রে আছে ঝোপঝাড়ে। ইলহামের এলোমেলো পদক্ষেপ উদ্দেশ্য হীন পথে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বিয়ের সাজে সজ্জিত তার সর্বাঙ্গ। লাল বেনারসিতে মুড়ে আছে শরীর। গলায়,কানে, হাতে স্বর্ণের অলংকার গুলো ঝিলিক তুলছে ক্ষণেক্ষণে। ঠিক যখন ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলো এসে পড়ছে তারউপর। বুকের উপর ভারী এক পাথর চেপে আছে! বারবার বুক ফেটে কান্না আসছে এই ভেবে, “রাদ তাকে এই ভাবে ঠকাতে পারলো?” এখনোও সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! মনে হচ্ছে তার চোখ তাকে ধোকা দিচ্ছে।

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে তার চোখ তাকে সত্যি ধোঁকা দিয়েছে। তবে আজ নয়, বরং গত তিনমাস ধরে। রাদের তার প্রতি গভীর ভালোবাসা, তাকে কাছে পাওয়ার জন্য ম/রি/য়া হয়ে থাকা.. সবটাই তার চোখের ধোঁকা ছিলো। তার নিজের চোখ, নিজের মন খুব ভয়ানক রকমের ধোঁকা দিয়েছে তাকে।

হাঁটতে হাঁটতে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ে ইলহামের ক্লান্ত পা জোড়া। স্থবির হয়ে যায় তার সমস্ত অনুভূতিগুলো। আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে ভেতরটা। ওমনি পা জোড়া ভে//ঙে আসতে চায়। দাঁড়িয়ে থাকাও এখন দুঃসাধ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে বয়ে চলা তীব্র ঝড় গুলো উপচে আসতে চায় বারবার। আর সহ্য করতে পারেনা ইলহাম। হাঁটু মুড়ে ধপ করে বসে পড়ে খোলা প্রান্তরে। দূর-দূরান্তে একটা মানবের পদচিহ্ন অব্দি নেই। হ্যাঁ, ঠিক এমনই একটা নির্জন জায়গা খুঁজছিলো সে। যেখানে একদম একা, নিরিবিলি নিজের সঙ্গে নিজের দুঃখ গুলোকে ভাগ করতে পারবে।

»রাত সাড়ে আটটা। অনন্যার জোড়াজুড়ি এবং জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল মুহুর্তটা স্বরন করে রাখার খাতিরে অল্পস্বল্প মেকাপ দিয়েছে ইলহাম। তাছাড়া লাল বেনারসির সাথে মিল করে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক পড়েছে। মাথার টিকলিটা বরাবর দুই আঙ্গুল জায়গা রেখে কপালে লাল টিপটা লাগাতে লাগাতে অনন্যা মুগ্ধতা নিয়ে মুচকি হাসলো।

—-“ভাইয়ার পছন্দকে লাখো-কোটি সালাম ভাবি। একেই বোধহয় বলে জহরীর চোখ। ভাইয়া সত্যি বড় ভাগ্য করে তোমায় খুঁজে পেয়েছে। নয়তো এমন লক্ষি-পুতুলের মতো বউ সবার কপালে কিন্তু হয়না।”

ইলহাম নতজানু হয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। মাথার ঘোমটা টানার চেষ্টা করে বলল,

—-“আমি এটা মানিনা। আমার মনে হয়, আমিই ভাগ্য করে পেয়েছি তাকে। নয়তো, আমার মতো এমন একটা পো/ড়াকপালির ভাগ্যে এতো ভালোবাসা কি করে জুটলো?”

বলে মলিন হাসলো ইলহাম। অনন্যার মুখটা কালো হয়ে এলো। কিন্তু মন খারাপ মনে রাখলো না। উত্তরের ঝাপটা হাওয়া এসে মন খারাপ গুলো শুষে নিয়ে গেলো যেন। দুঃখ ভুলে আমোদিত গলায় বলে উঠলো,

—-“জানো ভাবি, আমার ভীষণ হিং//সে হয়.. আবার একরাশ মুগ্ধতায় মনটা বিগলিত হয়ে যায়। আমি মাঝেমাঝে অবাক হই, ভাইয়া তোমায় যে কি পরিমাণ ভালোবাসে! যাকে বলে ভ/য়া/ন/ক!”

ইলহামের ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয় বিমুগ্ধতায়। লজ্জায় লাল আবরণে নিমজ্জিত হয় মুখবিবর। রাদের ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয়না। তার ভালোবাসার একটাই নাম। প্রেম পিয়াসী। আকুল প্রেমে পিয়াসু সে। উন্মাদের ন্যায় তার ভালোবাসা।

—-“তোমাকে যে কতটা সুন্দর লাগছে ভাবি, আমিই তো চোখ ফেরাতে পারছিনা। ভাইয়া দেখলে যে কি করবে!”

কথাটা বলে মুখ টিপে হাসলো অনন্যা। বাহানা এমন যেন, সাজগোজের জিনিস গুলো গোছাতে সে মহা ব্যস্ত। ইলহাম চোখ জোড়া গোলাকার করে তাকালো ওর পানে। কিন্তু সেদিকে যেন ওর কোনো খেয়ালই নেই।

—-“অনু.. একটু শুনবে?”

পাশের ঘর থেকে ভেসে এলো প্রণয়ের গলা। অনন্যা একটা পালানোর পথ খুঁজে পেলো।

“যাই” (গলা উঁচিয়ে)

বলেই দৌড়ে গেলো। ইলহাম ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আপন মনেই হাসলো। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে মনেমনে বলল,

—-“কি আর করবে! নি/র্ঘা/ত অজ্ঞান!”

বলেই শব্দ করে হাসলো। নীচ থেকে বেশ কোলহল ভেসে আসছে। উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছে রাদের বন্ধুরা। সবার একটাই আক্ষেপ, রাদ তার নিজের বউকে দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে করে ফেললো, অথচ তারা এখনও একবারও বিয়ের পিড়িতে বসতে পারলোনা। ওদিকে প্রণয়টাও বিয়ে করে ফেললো। রাদের বেস্ট ফ্রেন্ড, আরশাদ! সেও তার ভবিষ্যত বউকে প্রপোজ করে ফেলেছে। একমাত্র তারাই পিছিয়ে আছে।

ইলহাম নিজের ঘরে বসেই তাদের হাসি-ঠাট্টা শুনতে পাচ্ছে। তবে, নীচু স্বরে বলা কথোপকথন গুলো কানে আসতে বেশ বাঁধা পাচ্ছে। ইলহাম সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ করলোনা। এক বুক দীর্ঘশ্বাস আওড়ে চোখ বুঁজে নিজের মায়ের অস্পষ্ট মুখখানা দেখতে চেষ্টা করলো। আজ তার জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিন। অথচ, মা কাছে নেই। কাছে নেই, কিন্তু দূরেও যে নেই। কোথাও নেই মা।

টুং করে এক শব্দ ভেসে উঠলো কানের পর্দায়। ইলহামের ঘোর কাটে সেই শব্দে। কিঞ্চিৎ চমকায় চোখের ঘন পল্লব গুলো। একাধারে বার কয়েক পলক পড়ে চোখের। পাশ ফিরে বিছানার উপর তলিয়ে থাকা ফোনটা হাতে উঠিয়ে আনতে আনতে আরও কয়েকবার একই শব্দ ভেসে ওঠে। ইলহামের কৌতূহল বেড়ে যায়। মনেমনে অদ্ভুত শিহরণ জাগে রাদের কথা ভেবে। বিয়ের কয়েক মুহুর্ত পূর্বেও বেশ কনফিডেন্স নিয়ে তাকে ম্যাসেজ করা মানুষটা রাদ ছাড়া কেউ হবেনা।

কিন্তু না! তার ভাবনা এবং অনুভূতি কোনোটিই সঠিক হলোনা। বরং উল্টো হলো। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ঠিক ২০+ ম্যাসেজ দেখা যাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ লিস্টে। ইলহামের হাস্যজ্বল মুখ খানা ছেপে যায় আঁধারে। গুমোট বাঁধে মন পুকুরে। অদ্ভুত এক অস্বস্তি দলা পাকিয়ে আসে ভেতরটায়। “কে?” ছোট্ট শব্দের এই প্রশ্নটি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে। উত্তর নেই। অধীর হয়ে উত্তরটা জানতে চায় ইলহাম। তাই কৌতূহল এবং অস্থিরতা দমাতেই স্ক্রিনে ট্যাপ করে ঢুকে পড়ে ইনবক্সে। একাধারে ২৫টি ছবি দেখাচ্ছে ওখানটায়। ইলহামের কুঁচকানো কপাল খানা আরও কুঁচকে পড়ে। বিনা বাঁধায় প্রথম ছবিতেই ট্যাপ করে ওপেন করে। কিন্তু ছবিটা ওপেন হতে হতে যা দৃশ্যমান হয়, তাতে এক মুহুর্তে ইলহামের দম আঁটকে ম//রে যাওয়াটা বেজায় সহজ করে তোলে। একের পর এক সেই একই ছবি। নিজের চোখকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নি/কৃ/ষ্ট বস্তু বলে দাবী করতে ইচ্ছে করে ইলহামের। কেন সে কৌতূহল নিয়ে এমন কিছু দেখতে গেলো। রাদের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কারণে মেয়েটার মুখটা ব্লার করা। নীচে লেখা, “আমি রাদের বউ। আমাদের বিগত তিনবছর পূর্বে বিয়ে হয়েছে।”

ব্যস, আর কিছু পড়া হয়না ইলহামের। হাতের কেন্দ্র গলিয়ে ফোনটা পড়ে যায় মেঝেতে। বুকের ভেতরটা কেমন করতে থাকে ওর। মনে হয়, কেউ ক্রমাগত ছু/রি/কা/হত করে চলেছে! কেমন এক বি/ষা/ক্ত ব্যা/থা। দম বন্ধ হয়ে আসে ক্রমশ। কেমন অসহায় মনে হয় নিজেকে। বিরবির করে আওড়ায়, “এমন করে না ঠকালেও তো হতো!”«

—-“মাআআ..(চিৎকার করে) মা-গো! মা দেখতে পাচ্ছো তুমি? তুমি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে তোমার মেয়েটা আজও একা! মিশমিশ আর তুমি তো খুব শান্তিতেই আছো! একমাত্র অভাগী করলে আমায়!! তোমার মেয়েটাকে। কি এমন পাপ ছিলো আমার? তোমার মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ ছিলো আমার? বলো না মা? এটাই কি অ/ন্যা/য় হয়েছে? কিন্তু মা, এসবে যে আমার হাত ছিলো না! কারণ, উপরওয়ালা যে এটাই চেয়েছিলেন.. তাহলে আজ এমনটা কেন হলো? কেন হলো মা?”

চোখের বাঁধ আজ মানছে যেন। বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় তান্ডব হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। কেমন করে বাঁচবে এই অকিঞ্চিৎকর, অত্যল্প অনুভূতিগুলো নিয়ে! বাঁচার যে আর কোনো মানে রইলোনা। ঘৃ/না হচ্ছে নিজের প্রতি! কেন, একটু ভালো থাকার লোভ সামলাতে পারেনি।

____________________________________________

রাদের ফোনটা সেই তখন থেকে বেজেই চলেছে। সেদিকে তার হুঁশ নেই। গাড়ির গতি মাত্রাতিরিক্ত! অকেজ মস্তিষ্ক এবং র/ক্তা/ক্ত হাত জোড়া এদিক সেদিক স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কেবল একটা মানুষকেই খুঁজছে। আর সে হলো ইলহাম। গত দুই-ঘন্টা কম করে হলেও শ’মাইল পথ হন্যে হ’য়ে ঘুরেছে ইলহাম কে খোঁজার জন্য। কিন্তু কোথাও যে পেলোনা মেয়েটাকে।

কাজী সাহেবের আগমনে বর-কনেকে একসাথে হওয়ার অনুনয় জানানো হলে ইলহামকে নিখোঁজ বলে সম্মোধন করে অনন্যা। তার চোখ টলমল করছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা গুলো ঠিক দেখতে পাচ্ছিলো রাদ। একরাশ ভ/য় যে ওকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তা ওর কান্না-জড়ানো গলা শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো।

—-“ভ্ ভাবি কোথাও নেই ভাইয়া! গোটা বাড়ির এক কোনাও বাদ রাখিনি। কিন্তু ভাবি-কে কোথাও পাওয়া যায়নি।”

রাদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। বন্ধুদের সাথে হাসিতে মজে থাকা মনটা হঠাৎ দু’টুকরোতে পরিণত হলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলোনা সে। এটা কি আদৌও সম্ভব কখনোও? তার ইলহাম তাকে রেখে চলে গেলো?

বিকট শব্দে কেঁপে উঠল ধরণী। গাড়ির ব্রেকে কাজ করছিলোনা অনেক্ষন। অবশ্য সেদিকে রাদের খেয়াল ছিলোনা। আকস্মাৎ একটা গাড়িতে মুখোমুখি সং/ঘ/র্ষ হতে সে তার গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লো রোডের পাশে। হাত-পা কেটে জখম হওয়ার বাদ রাখেনি কোথাও! তবে তখনও তার হিতাহিত জ্ঞান নিতান্তই শূন্য। ঝাপসা চোখে তখনও ইলহামের মুখটাই ভেসে চলেছে অদৃষ্টে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here