#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব__________২৬.
আশ্বিনের শেষ। শরৎের শেষ প্রহর বলা চলে। চারিপাশে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা বিরাজমান। না অত্যাধিক গরম, আর না অত্যাধিক ঠান্ডা। সকালের সতেজ নির্মল বাতাসে প্রান জুড়িয়ে আসার পালা সকলের। ছাদে, রাদের সাজানো-গোছানো গার্ডেনকে নিয়েই গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। ৯টা বেজে গেছে অনেক্ক্ষণ। রাদের হলুদিয়া পাখিকে নববধূর বেশে সাজিয়ে নিয়ে এলো অনন্যা। রাদ তার এই সাজে অভ্যস্ত নয়। তাই প্রথম দেখাতেই বেহুঁশ হওয়ার কায়দা। কেননা, সেই প্রথমবার যখন সে ইলহামকে দেখে এবং একই সাথে তাদের বিয়ে হয় তখন ইলহাম খুব সাধারণ সাজে ছিলো। আর আজ যে একেবারে হলুদ শাড়িতে মোড়ানো তার হলুদ পাখি।
রাদের এই এক নজরের দৃষ্টি সবার নজরেই এলো। যা দেখে ইলহাম লজ্জায় গাঁট হয়ে বসলেও বাকিরা হেসে কুঁদে বেশ মজা নিচ্ছে।
—-“ এ বাবা, ভাইয়া? তুমি কি সব দেখা একবারেই দেখে ফেলবে নাকি? বেচারিকে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু দাও অন্তত।”
অনন্যার কথাটা ঠিক শুনলোনা রাদ। কিন্তু ওদিকে হাসাহাসির রোল পড়ে গেলো। রাদের মুগ্ধদৃষ্টির এই স্থীর চাহনিতে ইলহাম নড়াচড়া টুকুও করতে পারছেনা।
—-“তোমার কথা ও শুনছে না। ওর মন এবং মনোযোগ দুটোই ভাবির প্রতি।”
হাসির রকমসকম থামলো না। প্রণয়ের কথায় তা আরও বেড়ে গেলো তরতর করে। ইলহাম আরও শক্ত হয়ে বসলো। লজ্জার বান তার নামে না ছুটলেও তার গায়েই বেশি লাগছে। কেননা সে মানুষটার ন্যায় লজ্জা খুইয়ে তাকে দেখতে পারছেনা।
—-“কি রে তোদের হলো? উফফ বাপু, তোদের এতো সাজগোজ যে করতে হয়! ওদিকে সময় থাকেনা। আর এদিকে তোদের সাজগোজ শেষ হয় না। আয় এবার?”
—-“বড় মা, তুমি এসব বুঝবেনা! তোমরা হলে ওল্ড ফ্যাশনের মানুষ। শুধু স্নো আর পাউডার দিয়েই তোমাদের বিয়ে হতো। আজকাল কি সেই যুগ আছে বলো?”
মান্নাত বেগমের কথার পিঠে বিজ্ঞ গলায় বলে উঠলো অনন্যা। মান্নাত বেগম জিনিসাদির জোগাড় করতে করতে একবার তাকালেন অনন্যার পানে। ব্যস্ত মুখে না সূচক মাথা নেড়ে বললেন,
—-“না রে মা! সত্যি মিল নেই সেই যুগের সাথে। তাই এতো বুঝে কুলোতে পারিনা তোদের নিয়ম, সাজগোজ। তা বলছি অনেক হয়েছে! এবার নিয়ে আয় ওদের দু’জনকে।”
অনন্যা হেসে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,
—-“আমরা এসে গেছি। এই যে তোমার বউমা।”
‘বউমা’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে পেছনে মুড়ে তাকালেন মান্নাত বেগম। হলুদ শাড়ি এবং কাঁচা ফুলের গহনায় ইলহামকে সাজিয়েছে অনন্যা। আধুনিকতার ছোঁয়া অর্থাৎ মেকাপ-সেকাপ নেই বললেই চলে। যা দেখতে বেশি মন কাড়লো তার। তিনি বলতে নিলেই তার মুখের কথা হরন করে নিয়ে বলে ওঠে অনন্যা,
—-“বউ মা পেয়েছো তোমার মনের মতোই, বড় মা। বিশ্বাস করো একটু মেকাপের ছোঁয়াও লাগাতে দিলোনা।”
মান্নাত বেগম মন জুড়ানো হাসি দিলেন। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ইলহামের গালে রাখলেন। হাসি মুখেই হাতটা কতক্ষণ চেপে রাখলেন ইলহামের গালে। এই তিন বছরে মেয়েটা একটুও বদলায়নি।
—-“রাদ বলেছিলো, ‘ইলহাম যতদিন না বলবে ততদিন এই বিয়ে হবেনা। আর ততদিন ইলহাম আমার মেয়ের মতো থাকবে।’ আজ কি এই পদবিটা সরিয়ে ফেলতে হবে আমায়?”
—-“না, মা। আমি যেমন তোমার মেয়ে ছিলাম তেমনই আছি। তবে হ্যাঁ, আমার আরেকটা নতুন পরিচয় হলো। মনে রেখো, এখন কিন্তু আমাকে এই দুই পরিচয়ে দুই ভাবে ভালোবেসতে হবে। আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি তোমার কাছ থেকে বউমার আদর নিবো আবার যখন ইচ্ছে হবে, মেয়ের আদর নিবো। পাবো তো?”
খুশিতে হৈহৈ করে উঠলেন মান্নাত বেগম।
—-“একশবার পাবে। আমি চাই আমার মেয়েটা সারাজীবন আমার কাছেই থাকুক। আদর-ভালোবাসা কোনো কিছুরই কমতি হবেনা।”
—-“সে কি! সব ভালোবাসা তুমি এমন করে একপক্ষে ঢেলে দিচ্ছো মা? এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না বলে দিলাম!”
রাদের অভিযোগের সুরে বলা কথাটা ভেসে এলো এদিকটাতে। পরিপ্রেক্ষিতে পাশ ফিরে তাকালো সবাই। মান্নাত বেগম হাসতে লাগলেন। ইলহাম রাদকে দেখিয়ে মান্নাত বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-“মা সব সময় আমাকেই বেশি ভালোবাসতো। অতএব ভালোবাসা সব এই পক্ষেই ছিলো মশাই!”
রাদ নাক ফুলিয়ে বলল,
—-“বললেই হলো নাকি? আমি কি তবে মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে?”
—-“হতেও পারেন।”
ফোঁড়ন কেটে বলল ইলহাম। রাদ মেকি রা/গের সহিত তাকালো। এক ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বললো। যা ইলহাম খুব সহজেই ধরে ফেললো। সুতরাং এখন যেন রাদকে রা/গিয়ে তোলাটাই তার আসল কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। তাই মুচকি হেসে মান্নাত বেগমকে আরও ভালো করে জড়িয় ধরে বলে উঠলো,
—-“আশ্চর্য, এমন করে তাকানোর কি হলো হু? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, মা নিজ মুখে বললে তো বিশ্বাস করবেন? ওয়েট.. মা? তুমিই বলে দাও তো, যে তুমি উনাকে কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলো?”
অনন্যা এবং প্রণয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো। আরও অনেক লোকজন। সবাই নব বর-বধূর মিষ্টি ঝগড়া দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। মান্নাত বেগমও হাসছেন বাকিদের ন্যায়। তার বারবার মনে পড়ছে সেই তিনবছর পূর্বের কথা। ঠিক যেন সেই পুরনো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।
—-“ও মা? বলো না প্লিজ!”
মান্নাত বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
—-“হ্যাঁ রে বাবু, তোকে আমি সত্যি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম! ঐ যে তোর রহিম চাচা আছেন না? মোড়ের মাথায় সেকালে তার ছোট্ট একটা চায়ের দোকান ছিলো। একদিন তুমুল বর্ষনে বাড়ি ফেরা কালিন আমি আর তোর বাবা তোকে ঐ রহিম ভাইয়ের দোকানের সামনে থেকে কুড়িয়ে পাই।”
বলতে বলতে আরও শব্দ করে হেসে ওঠেন মান্নাত বেগম। রাদ চোখ মুখ ছোট করে কুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইলহামের পানে। এক পর্যায়ে, “দাঁড়াও হচ্ছে তোমার”— বলেই তেড়ে আসে রাদ। উপস্থিত জনগনের ফেটে পড়া হাসিতে ঝনঝন করে কাঁপছে গোটা ছাদ। রাদকে তেড়ে আসতে দেখে, ” মা বাঁচাও” বলে উল্টোদিকে দৌড়ে যায় ইলহাম। তার পিছু ছুটে রাদ। সবাই তাদের কান্ড দেখছে। অনেকেই হাসতে হাসতে বলাবলি করছে, “বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর এতো সুন্দর মিল আগে কোনোদিন দেখিনি।”।
ইলহাম দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটিতে। রাদ এখনও বেশ দূরে। ইলহাম দাঁড়িয়ে পড়ে এক কোনে আড়ালে। নিঃশ্বাস গুলো দলা পাকিয়ে ভারী হয়ে বিসর্জন হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে আশেপাশে তাকায় ইলহাম। ছাদে ওঠার আগেই পরে এই চিলেকোঠার ঘর। আজই প্রথম পদার্পণ ঘটে তার। দেখতে বেজায় অগোছালো। ইলহাম মনেমনে ঠিক করে, তাদের বিয়েটা হয়ে গেলে এই ঘরটাই হবে তার অবসর সময় কাটানোর ছোট্ট সর্গ। এখানে তার সকল উপন্যাসের বই গুলো দিয়ে ছোট্ট একটা লাইব্রেরি বানাবে। শিরিনকে বলবে কালই ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে।
চারিপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ইলহামের চোখ আঁটকে পড়ে ভাঙা আলমারির ভেতর অস্পষ্ট কোনো জিনিসের উপর। ইলহাম তীব্র কৌতুহল নিয়ে পা বাড়ায়। নীচে অজস্র ময়লার স্তুপ যেন। গুনে গুনে পা ফেলারও জায়গা নেই। তবুও সে পৌঁছে গেলো ভা/ঙা আলমারির সম্মুখ পানে। কেননা, এই অস্পষ্ট জিনিসটা দেখার অদম্য ইচ্ছেটা বড্ড জ্বা/লাচ্ছে তাকে। ময়লার পাহাড় জমেছে জিনিসটা উপর। ইলহাম হাত এগিয়ে জিনিসটা টেনে আনতে আনতে উপলব্ধি করলো, এটা একটা ডায়েরি। ডায়েরি টা হাতে নিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ময়লা গুলো নীচে ফেললো। ডায়েরির উপরে একটা নাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ময়লাগুলো এমন ভাবে সেঁটে আছে যে লেখাটা বোঝার উপায় নেই। তবুও হাত ময়লা করে ডায়েরি টা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো ইলহাম। ততক্ষণে রাদ এসে হাজির হয়েছে তার পেছনে। ঠোঁটের কোনে তার দুষ্টু হাসি।
ইলহাম স্বার্থক হয়েছে নামটা বের করতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরোনো ডায়েরি। কম হলেও আরও দশ বছরের পুরোনো। কিন্তু কার এটা?
”আমি ইলহ….”
ডায়েরির নামটা পুরোটা পড়া হলোনা ইলহামের। তার পূর্বেই কারোর হাতে হেঁচকা টান খেয়ে বেসামাল হয়ে সোজা এসে তার বুকে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় হ/তভ/ম্ব হয়ে গেলো ইলহাম। ভী/ত নয়নে উপরের দিকে তাকাতেই আরও ভড়কে গেলো। উনি কখন এলেন? কথাটা মনের ভেতর তোলপাড় শুরু করলো। পেছন থেকে ডায়েরিটা হাত থেকে পড়ে আবারও ময়লার জগতে হারিয়ে গেলো। অবশ্য সেদিকে ইলহামের খেয়াল নেই।
রাদ তার কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো,
—-“এবার কোথায় পালাবে হ্যাঁ? আমাকে ভেংচি কাটা? তোমার তো মজা হচ্ছে!”
ইলহামের মনে পড়লো, সে তখন বারবার রাদকে ভেংচি কাটছিলো। যার দরুণ, রাদ ইশারায় তাকে বলেছিলো “একবার হাতের কাছে পাই?”। অতঃপর সে মান্নাত বেগমকে উস্কাচ্ছিলো তাকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে সে কথা বলতে! কথাটা মনে পড়তেই অসহায় মুখ করে তাকালো ইলহাম। বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট উল্টে বলল,
—-“আ..আমি কিছু করিনি!”
—-“আচ্ছা? আপনি কিচ্ছু করেননি? আমি কি তবে ভুল দেখেছিলাম?”
ভাবুক হওয়ার ভান করে কথাটা বলল রাদ। ইলহাম তুমুল গতিতে উপর নীচ করে মাথা নেড়ে বলল,
—-“সত্যি! আমি কিচ্ছু করিনি। আমারও মনে হয় আপনি ভুল দেখেছেন!”
রাদ বাঁকা হেসে ইলহামকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে। ইলহাম পূর্বের চেয়েও অধিক অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। রাদের মাথায় শ/য়/তা/নি বুদ্ধিদের হাতছানি চলছে। সে ফট করে ইলহামের ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে ঠোঁট কামড়ে দিলো। ইলহাম অবাক হতে হতে তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিলো সে ব্যা/থা পেয়েছে। যার দরুন গোঙানির ন্যায় শব্দ করলো। রাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে এমন করে তাকালো যেন সে কিছু করেনি। ইলহাম ক্ষে/পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁটে হাত চেপে কাতর কন্ঠে বলল,
—-“এটা কি করলেন?”
রাদ সম্পূর্ণ অপারগ। কিছুই বুঝতে পারছেনা,এমন ভাব করে বলল,
—-“কি করলাম?”
—-“ক..কামড়..”
—-“এই মেয়ে কি বলছো এসব? এখনও আমাদের বিয়েই হয়নি। তার আগেই তুমি কা’ম/ড়া-কা’ম/ড়ি.. তওবা তওবা!”
নাটকীয় সুরে কথাগুলো এমন ভাবে বলল রাদ, ইলহাম রীতিমতো বোবা হয়ে রইলো! অসহায় মুখ করে চেয়ে থাকলেও আর কোনো কথা আওড়াতে পারলোনা। রাদ তার কান্ড দেখে মনেমনে হেসে উঠলো। আশেপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে ফিসফিস বলল,
—-“রাত অব্দি এটলিস্ট ওয়েট করো সুইটহার্ট। বিয়ে তো তোমাকেই করছি!”
ইলহামের বোবা দৃষ্টি এবার যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। রা/গে দাঁত খিটমিট করে বলল,
—-“কি বললেন আপনি? আপনাকে তো আমি…”
কথাটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই রাদ আলতো ছোঁয়ায় আলিঙ্গন করলো ইলহামের ওষ্ঠদয়। ইলহাম আবারও স্তব্ধ হয়ে পড়লো। রাদ এবার শব্দ করেই হাসলো। বলল,
—-“এতো তাড়া কিন্তু ভালো না বলে দিলাম।”
বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো রাদ। ইলহাম দাঁড়িয়ে রইলো বোবা হয়ে। মনে মনে দু’চারটে বকা বেশ রসকষ মিশিয়েই দিলো।
চলবে