#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_________২৫.
প্রভাতের একফালি মিষ্টি রোদ ঘরময় বিচরণ করতে নড়েচড়ে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো ইলহাম। রাদ স্নিগ্ধ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আজ তাদের গায়ে হলুদ। এই তো আর তিনঘণ্টা বাদে। অর্থাৎ ঠিক সকাল ৯টায়। এখন বাজে ৬টা। ইলহামের মুখের উপর পড়ে থাকা অগোছালো চুল গুলো বাধ্য প্রেমিকের ন্যায় হাত এগিয়ে সরিয়ে দিলো রাদ। দ্বিতীয় বার বিয়ে করার কথা কখনোও ভাবেনি সে। মানুষ যা ভাবে তা কখনোও সত্যি হয়না। অথচ যা ভাবনাতেও থাকেনা কোনোদিন, সেই ঘটনা গুলোই ক্রমাগত রিপিট হতে থাকে। অবশ্য রাদের এতে কোনো আফসোস নেই। বরং আলাদা একটা তৃপ্তি আছে। কেননা, ইলহাম নিজ থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে। তার প্রতি তার পবিত্র অনুভূতির টান সময় নিয়ে হলেও বুঝতে পেরেছে। এটাই বা কম কিসে? মানুষের গোটা জীবনটা আনন্দে, উচ্ছাসে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য এটুকু পাওনাও অনেক বেশি।
রাদ কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু প্রসারিত করে। এগিয়ে গিয়ে ইলহামের ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসার ছোট্ট একটা পরশ এঁকে দেয়। অতঃপর চোখ বুঁজে টেনে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাসের বিসর্জন দিয়ে ভাবে অতীতের কথা,
তখন কি ইলহামের বয়স টা ১৮এর গন্ডিতে এসেছিলো? মনেমনে প্রশ্ন করে রাদ। ফের নিজেই জবাব দেয়। না সূচক মাথা নেড়ে আনমনেই বলে ওঠে,”নাহ্! তখন আমার প্রিয়দর্শিনী কেবল ১৭। বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলো। কত প্যাঁচালো ভাবে এই মেয়েটাকে জোর করে তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।”
ভাবে আর হাসে রাদ। সে এক ইতিহাসই বটে। ঐ সতেরো বছর বয়সেও ইলহামের ম্যাচিউরিটি ছিলো বিশের উপরে। তাদের বিয়েটা অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা হলেও সবটা একদম নিখুঁত হাতে সামলেছিলো সে। নিজের স্বামীকে বসিয়েছিলো সর্বোচ্চ আসনে। আর মাকে-; অর্থাৎ মান্নাত বেগম ছিলো তার নয়নের মনি। ছোট বেলায় মা-কে হারিয়ে সদাসর্বদা মামীর অ*ত্যা*চা*র, নি*পী*ড়*ন সহ্য করে এসে হঠাৎ এমন অমায়িক একজন মা পাবে, সেটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো ওর কাছে। রাদকে সবসময় বলতো, “আপনি আরও আগে কেন এলেন না আমার জীবনে?”
রাদ তার কথার জবাবে হাসতো। তার হাসিতে এক নাম না জানা সুখের ঠিকানা পেতো ইলহাম। তখন আর নিজেকে ধরে রাখা সহজগম্য হতো না। রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সবটা উজাড় করে দিতো প্রিয় মানুষটার প্রতি। একবার কথায় কথায় রাদ জানতে পারে ইলহামের মা একজন বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ছিলেন। নাম,যশ, খ্যাতি কোনো কিছুরই অভাব চিলো না তার। কিন্তু হঠাৎ, মিডিয়া পাড়া থেকে এমন একজন মানুষ হারিয়ে গেলো যার একটা নিউজমাত্র হলোনা! ব্যাপারটা সন্দেহ জনক। কিন্তু, এই নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখা ইলহামের একার জন্য সহজ ছিলোনা। অনেকবার চেষ্টা করলেও এই রহস্যের র’টা অব্দি ছুঁতে পারেনি সে। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রাদ হাল ছাড়ার লোক ছিলোনা। এই রহস্য তাকে উদঘাটন করতেই হবে। তাই ইলহামের থেকে মোটামোটি আকারে অনেক কথাই জেনেছিলো রাদ। যার মধ্যে সবচেয়ে সন্দেহজনক ব্যাপার ছিলো, ইলহামের বাবার সাথে তার মায়ের কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। কোনো এক কারনে এই সম্পর্কের ফাটল ধরেছিলো। যা আর কোনোদিন কেউ ঠিক করে নেওয়ার মিনিমাম চেষ্টাটুকুও করেনি।
একই সাথে মিশমিশ, অর্থাৎ ইলহামের বেস্ট ফ্রেন্ড! যে মৃ//ত্যু//টাতেও একটা রহস্যের দানা বেঁধেছিলো রাদের মনে। যার সবটাই মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ছেড়ে দিলো রাদ। যার,কারন ছিলো ইলহামের সবটা ভুলে যাওয়া। তার সুখের সংসারে এক বি//ষাদের ছায়া নেমে এসেছিলো ইলহাম যখন সবটা ভুলে যায়। বড় বড় ডাক্তারদের পরামর্শ নিলেও এই শর্ট টার্ম মেমোরি লসের কোনো প্রোপার সলিউশন আজও অব্দি পায়নি রাদ। যার কাছেই ইলহামের এই রো/গ/টা সম্মন্ধে বলেছে সেই বলে দিয়েছে, “অপেক্ষা ব্যতীত আর কোনো সলিউশন নয়। উপরওয়ালা চাইলে ইলহামের আবারও মনে পড়বে সবটা। পাশাপাশি ইলহাম রিসেন্ট ঘটা সমস্তটা ভুলে যেতে পারে। “অপেক্ষা”। হ্যাঁ, গত দেড় বছর যাবত রাদ সেই অপেক্ষাটাই করে যাচ্ছে। এই আশায়, যদি ইলহামের সবটা মনে পড়ে যায়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা মিলল। লোকে বলে, অতীত আঁকড়ে বাঁচা যায় না। অথচ তার বেঁচে থাকার কারনটাই তার অতীত৷
—-“এ-কি! আপনি কখন এলেন? ৭টা কি বেজে গেল?”
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ইলহাম। রাদ তার এহেম লাফালাফিতে চমকে উঠলো আকস্মাৎ। চকমকানোর দরুন তার ভাবনাদের ছুটি মিললো। চমকানো দৃষ্টি অর্থাৎ,চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
ঘুমে ইলহামের চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। রাদ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে না সূচক মাথা নাড়লো। নির্লিপ্ত চাহনিতে বলল,
—-“৬টা বাজে। আরও এক ঘন্টা বাকি। তুমি ঘুমাও।”
—-“ধ্যাৎ! আপনি বসে আছেন আর আমি ঘুমাবো? তা কি হয়?”
রাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
—-“কেন হবেনা?”
ইলহাম বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
—-“হয় না ব্যাস হয়না। কেন হয়না, কেন হবেনা? এতো কথার উত্তর নেই।”
রাদ ইলহামের হাত ধরে আটকালো। যেতে দিবেনা, সেই উদ্দেশ্যেই বলল,
—-“এতো কিছু জানতে চাইনা। চুপটি করে বসো।”
—-“বসে কি হবে? আপনি তো কিছু খাননি বোধহয়। আপনাকে কিছু খাবার বানিয়ে দেই? ওদিকে কি এরেঞ্জমেন্ট শুরু হয়েছে? বাকিরা কি উঠে পড়েছে?”
একাধারে তার একাধিক প্রশ্ন শুনে কপাল চেপে মৃদু হাসলো রাদ। ঠোঁটের কোনে হাসিটুকু দীর্ঘময় করে বলল,
—-“আমি এখন কিছু খেতে চাইছিনা। এরেঞ্জমেন্ট অলরেডি অনেক্ষন আগেই শুরু হয়েছে। আর বাকিরাও উঠে পড়েছে। তাই তোমাকে আমার জন্য আলাদা করে কিছু বানাতে হবেনা। তুমি ফ্রেশ হয়ে এখানে চুপটি করে বসে থাকো। আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
—-“আপনি বানাবেন?”
—-“ইয়াহ। এনি ডাউট?”
—-“এই না!”
—-“কি না?”
—-“দেখুন, সকাল সকাল এসব পাগলামি ছাড়ুন। হাত-ফাত পুড়িয়ে ফেললে যাচ্ছে তাই হবে। আপনি বসুন। আমি যাচ্ছি।”
—-“বসতে বলেছি, চুপটি করে বসে থাকবে। এক পা নড়েছো তো..”
রাদের কড়া হুকুম। ইলহাম ঠোঁট উল্টে অসহায় মুখ করে তাকালো। রাদ গলল না ইলহামের ইমোশনাল ব্লা//ক//মে/ই/লে। বরং,মুখটা গম্ভীর রেখে বলল,
—-“কিপ সাইলেন্স। আই এ্যাম কামিং।”
এই বলে চলে গেলো রাদ। ইলহাম তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে স্মিত হাসলো। রাদের ভালোবাসা প্রকাশের এই ছোট্ট মাধ্যম গুলো একদম মনের মাঝে গেঁথে গেছে ইলহামের। না চাইতেও শত পাওয়া। এই অনুভূতি গুলোকেই হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি বলে আখ্যায়িত করেছেন গুনীমান্যিরা। সত্যি যে এই অনুভূতি গুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।
দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো ইলহাম। রাদ এখনও কফি নিয়ে আসেনি। হয়তো রান্নাঘর ফাঁকা নেই। তাই দেরি হবে বলে জানান দিচ্ছে তার অন্তঃকরণ। কিন্তু এই ঘরে একা থাকতেও যে ইচ্ছে করছেনা। তবে উপায় আর কি? রাদের হুকুম ভঙ্গ করে বের হওয়া তার সাধ্যের বাইরে।
—-“কফি ইজ রেডি।”
রাদের গলা পাওয়া গেলো। ইলহাম উচ্ছসিত মনে পেছন মুড়ে তাকালে দেখতে পেলো রাদ ট্রে হাতে রুমে ঢুকছে। ইলহাম এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো ট্রে-টা। রাদের হাঁপিয়ে ওঠা দেখে ইলহাম মুচকি হাসলো। যা দেখে রাদ বড়বড় দম ফেলে ইলহামের পিছু পিছু এগোলো। এক পর্যায়ে বলল,
—-“রান্না ঘরে তো দেখি পা ফেলারও জায়গা নেই। সরি ফর লেইট।”
ইলহাম পূর্বের ন্যায় হাসলো। একটা কফির মগ রাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-“জানতাম। আজ বাড়িতে বিয়ে বলে কথা। রান্নাঘর রান্নার দখলে থাকবে না তো কার দখলে থাকবে বলুন?”
—-“দিস ইজ ইওর’স। আ’ইম টেকিং মাইন।”
রাদ ইলহামের হাত ধরে কফিটা তার সম্মুখে ধরলো। কথাটা বলতে বলতে রাদ অন্যহাতে নিজের কফিটা তুলে তাকালো ইলহামের পানে। ইলহামের কফির মগের সাথে একটা ঠোকর লাগিয়ে বলল,
—-“আ’ইম নট প্রফেশনাল। মানিয়ে নিও প্লিজ।”
কথাটা বলে অসহায় মুখে হাসলো রাদ। অর্থাৎ সে কফিটা এতোটাও ভালো বানায়না। সুতরাং, খারাপ হলে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে।
ইলহাম জবাবে হেসে কফির মগে চুমুক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রিয়াকশন স্বরূপ তার দৃষ্টি খানা রসগোল্লার রূপ নিলো। রাদের অসহায় মুখখানা আরও অসহায় হয়ে উঠলো। বলল,
—-“ভালো হয়নি তাইনা? আই ন্যিউ দ্যাট!”
ইলহাম মুখের হাসির সাথে রিয়াকশনটাও একই ভাবে বজায় রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে বলল,
—-“আপনি এতো ভালো কফি বানাতে পারেন আগে সত্যি জানতাম না। তাহলে কিন্তু, কফি করার গুরুদায়িত্ব আমি আপনাকেই দিতাম।”
রাদের মুখ থেকে একটা কালো ছায়া সরে পড়লো যেন। অর্থাৎ, সে অবাক বনে গেলো ইলহামের কথায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করানোর সাথে সাথে নিজের জিহ্বাকেও টেস্ট নিতে বঞ্চিত করলো না। ইলহামের ন্যায় সেও চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ মেপে বলল,
—-“নট ব্যাড এক্টচুয়েলি।”
ইলহাম মৃদু হেসে জানায়,
—-“আজকের পর থেকে এই মহান দায়িত্বটি কিন্তু আপনার। মনে থাকবে?”
রাদ বেশ গর্বের সাথে বুক ফুলায়। বেজায় ভাব নিয়ে বলে,
—-“হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
চলবে___