প্রেম পিয়াসী পর্ব ২৩

0
507

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব________২৩.

রাদ বাড়ি ফিরলো মধ্যরাতে। প্রতিদিন ইলহামের প্রতীক্ষার প্রহর না কাটলেও আজ যেন খুব দ্রুতই কেটে গেলো। কেননা, আজ আর কারোর পথ চেয়ে বসেনি ইলহাম। বরং ভোর হওয়ার তীব্র আকুতিতে গমগম করছিলো অন্তস্থল। রাতে যেমনটা ভেবেছিলো, ভোর হতে না হতে সেটাই করলো সে। প্রকৃতির বুক চিঁড়ে অন্ধকার তলিয়ে যেতেই ব্যাগ গুছিয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলো নিজের বাড়িতে। মামি ওকে দেখতেই মুখ ঝামটি দিয়ে বেশ কথা শুনালো। যা ছিলো এতোদিনের চেপে রাখা ক্ষো/ভে/র বহিঃপ্রকাশ। রাদ তাকে যা-তা বলে অপমান করেছে প্রতি পদক্ষেপে। তার কি শোধ মোটেও তুলবেনা! এসব কি আদৌও সম্ভব?

ওদিকে সকাল থেকে ইলহামকে খুঁজে না পাওয়ায় শোরগোল পড়ে গেলো বাড়িতে। রাদ সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের দিকে কেবল চোখ বুঁজেছিলো। এর মাঝেই কানে এলো, ইলহামকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” কথাটা শোনা মাত্রই আর কিছু শুনতে পায়নি কানে। যেন ঐ শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করার পর সে কানে কালা হয়ে গেছে। জমানো সমস্ত অভিমানের ছোট ছোট টুকরো গুলো কাচ ভাঙার ন্যায় কয়েক শত খন্ডে বিভক্ত হয়েছে। দিশেহারার ন্যায় ছুটে গেলো ইলহামের শূন্য ঘরে। না;ইলহাম নিজের ঘরে নেই। গার্ডেন, ছাদ, গোটা বাড়ি কোথাও নেই ইলহাম। মান্নাত বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। তার শরীর কিংবা মন কোনো কিছুতেই আর কুলোচ্ছেনা। এক বি/ষা/ক্ত তা/ড়/না মিশ্রিত অনুভূতি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে বিগত পনেরোটা বছর অব্দি। সেই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটা রোজকারের ন্যায় ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। স্যুট-বুট পড়া সর্বদাই একজন সম্মানিও বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। কিন্তু একদিন.. একদিন হঠাৎ সেই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটার তাজা র/ক্তে যবথব করা লা//শ বাড়ি এলো। তারপর থেকেই মান্নাত বেগম এক চাপা দীর্ঘশ্বাসকে পুঁজি করে বেঁচে আছেন এতোগুলো বছর। তার কাছে এই সংসারের কোনোকিছুরই মূল্য নেই কেবল রাদ ছাড়া। আর রাদের প্রাণভোমরা যেহেতু ইলহাম, তাই তিনি ছেলের মতোই একহাতে আগলে রেখেছিলেন দু’জনকে। কিন্তু এই একের পর এক ঘটনা গুলো ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে। পুরনো ক্ষ/ত গুলো আবারও তাজা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।

—-“ভাইয়া, ভাবির ফোনটা-তে রিং হচ্ছে!! কিন্তু কেউ তো তুলছেনা ফোনটা!”

অনন্যা নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দৌড়ে আসলো রাদের কাছে। বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল কথাটা। রাদ স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অনন্যার হাত থেকে ওর ফোনটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে একবুক আশা নিয়ে তাকায় ফোনটার দিকে। যেন, ইলহাম কল টা পিক করবে। কিন্তু সেগুড়ে বালি। বরাবরের মতোই ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেলো। বিষয়টা উপলব্ধি হতে রাদের বুক পাঁজরে এক বি/ষা/ক্ত ব্যাথা কামড়ে ধরলো। দম বন্ধ অনুভূতিগুলোও কি ভ/য়া/ন/ক হয়। নিরাশ হয়ে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাদ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকা গলাতে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে গলা ভেজানোর সাথে সাথে ভেতরের ভ/য় গুলোকেও গিলে খেলো। মনটা ছটফট করছে কেবল একটাই দুশ্চিন্তাতে। ইলহাম যেন ঠিক থাকে। কোনো ভাবেই যেন নিজের রা/গে/র কাছে হেরে গিয়ে ফের অন্তুর মিছে মায়ায় নিজেকে বিলীন না করে।

ঠিক এমন সময় শিরিন উপর থেকে গলা উচিয়ে আওয়াজ দিলো,

—-“খালাম্মা, এই ফোনডা ইলহাম আপার রুম থেইক্কা অনেক্ষন ধইরা বাজতাছে। মনে হয় ইলহাম আপার ফোন।”

কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে করতে বুক পাঁজরের বি/ষা/ক্ত ব্যা/থাটা আরও ভ/য়া/ন/ক রূপ নেয়। রাদ দু’হাতে পুরো মুখ একবার মালিশ করে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্যা শিরিন কে ফোনটা নিয়ে নীচে নামতে বলে। শিরিন ফোনটা নিয়ে নীচে এলে অনন্যা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ইলহামের ফোনটা। হ্যাঁ; শিরিন ঠিকই ধরেছে। এটা ইলহামেরই ফোন।

—-“ ভাইয়া? ভাবি রাগ করে তার বাসায় ফিরে যায়নি তো?”

কথাটা মন্দ বলেনি অনন্যা। অন্তুর দুঃশ্চিতায় রাদের মাথাতেই আসেনি কথাটা। অনন্যার মুখে কথাটা শুনতে দেরী হলেও রাদের বেরিয়ে যেতে দেরী নেই। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো রাদ। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কাঁপা কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করে।

এতো কিসের রাগ ওর? যে না বলে এভাবে হুট করে বাড়ি ফিরে গেলো? অনেকদিন কোনো শা/স/ন পায়নি তো, তাই এতো দুঃসাহস বেড়েছে। আজই ওর ডানা ছাটতে হবে। খুব বাড়-ও বেড়েছে।

ঘন্টা খানিক সময় পেরোতে একটা কালো গাড়ি বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে দেখা গেলো। ইলহাম অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুম সংলগ্ন ব্যালকনিতে। ভেতরটা ক্রমশ ডুকরে কেঁদে ম/র/ছে। বুকের পা পাশটা জুড়ে এক তীক্ষ্ণ ব্যা/থার প্রতিযোগিতা চলছে। যু//দ্ধ লেগেছে, ঠিক কতটা তীব্র য/ন্ত্র/ণা দিয়ে আহত করা যায় তার হৃদযন্ত্রটিকে। অবশ্য সফলও হচ্ছে। হা/হা/কার করা কান্না গুলো বারবার উপচে পড়তে চায় এই র//ক্ত/ক্ষ/র/ণের কাছে হার মেনে। তারা পাশ করেছে। এমনকি তাদের পাশের নাম্বারও দিতে চায় ইলহাম। সবাই একশোতে একশো।

কত-শত অবান্তর ভাবনাদের ছড়াছড়ি। ঠিক তখনই চোখ জোড়া চমকে উঠলো কাউকে দেখে। কালো গাড়িটার দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রাদ। রাদ নীচে দাঁড়িয়েই বেশ ভালো ভাবে দেখতে পেলো ইলহামকে। ওমনি চাপা রা/গ-ক্ষো/ভ গুলো রেরে করতে করতে যেন বেরিয়ে আসতে চাইলো। পারতো, নীচ থেকেই জাম্প করে চলে যেতো ইলহামের সম্মুখে।

ইলহামের চোখ জোড়া ভরাট হয়ে এলো রাদের আগমনে। সে তো প্রায় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো, রাদ হয়তো আর কোনোদিন তার মুখটাও দেখবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, রাদ তাকে ছাড়া সত্যি ভালো থাকতে পারবেনা। তার প্রেমে আকুল পিয়াসী রাদ। যেমনটা আজ সে নিজেকেও দাবী করতে পারবে। কারন সেও যে ভীষণ মায়ায় পড়েছে মানুষটার। ঐ র/ক্তি/ম চোখের, চাপা স্বরের। একরাশ তি/ক্ত/তা মিশ্রিত কন্ঠের। সমস্ত টাই এখন তাকে ক্রমশ টেনে নিচ্ছে রাদের কাছে। ভালোবেসে ফেলেছে সে রাদকে। কঠিন ভাবে।

পেছন থেকে কারোর অস্তিত্ব প্রগাঢ় ভাবে আলিঙ্গন করলো ইলহামের অন্তঃকরণকে। এক নাম না জানা অনুভূতি ক্রমবর্ধমান শিহরণের সৃষ্টি করছে তার সর্বাঙ্গে। মানুষ টা একটু একটু করে কাছে আসছে তার। এই তো, এক্ষনি হয়তো পরম আবেশে মিশিয়ে নিবে তাকে। আর ছাড়বেনা কোনোদিন। হারিয়ে ফেলার ভ/য় যে তাকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। বুকের ভেতরে তোলপাড় করা হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে ইলহাম। ঢিপ ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ করে ছন্দে ছন্দে তাল মিলিয়ে চলেছে তারা।

ঠাস করে কসে একখানা চড় পড়তেই ইলহামের সমস্ত ভাবনাদের ইতি ঘটলো। ইলহাম আঁ/তকে উঠে গালে হাত চেপে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো র//ক্ত চক্ষুতে তাকিয়ে আছে রাদ। ইলহাম তৎক্ষনাৎ ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললো। তাতে রাদের ভাবাবেগ নিতান্তই শূন্য। তার র//ক্ত ঝলসানো চাহনি পূর্বের ন্যায়ই বিরাজমান। তাকে দেখে ইলহাম বুঝে নিলো আরেকটা চড় তার জন্য ঠিক অপেক্ষা করছে।

—-“এতো সাহস কে দিয়েছে তোকে? কার পারমিশনে বেরিয়েছিস বাড়ি থেকে! একদম ভুলে যাওয়ার ভান করবি না, রাদ তোকে ভালোবাসে। পা/গ/লের মতো ভালোবাসে। আগেও বাসতো। আজও বাসে। নিজের মনগড়া কিছু অনুমান নিয়ে আমাকে হার্ট করার রাইট তোকে কেউ দেয়নি!”

এটুকু বলে থামে রাদ। রাগে অভিমানে গৌর মুখখানা র/ক্তি/ম প্রভায় ছেয়ে গেছে তার। চোখজোড়ায় অনতিপূর্বেই ছোপ ছোপ র//ক্তে/র আবরণ। প্রগাঢ় লালে এখনি যেন ফেটে পড়বে মুখখানা। ইলহামের যে এবার সত্যি বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। ঠিক এই কথাগুলোই যে শুনতে চেয়েছিলো সে। তাহলে, তখন কেন বলেনি যখন সে শুনতে চাইতো? তখন কেন এমন করে ছুটে আসেনি যখন তার সঙ্গই সবচেয়ে বেশি কাম্য ছিলো? কেন ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছিলো, যখন এতো গভীর টান?

ইলহামের নিশ্চুপ ভঙ্গিমা রাদের রা/গে/র আগুনে ঘি ঢালে। রাদ দাঁতে দাঁত চেপে ইলহামের বাহুজোড়া শক্ত করে চেপে ধরে! রা/গের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অকেজো মস্তিষ্কে ইলহামকে টেনে আনে খুব কাছে। পা/গ/লের প্রলাপ বকতে বকতে সহসা ইলহামকে গভীর ছোঁয়ায় পরাস্ত করে নিজের কাছে। পাগলের ন্যায় এক বি/ষা/ক্ত অনুভূতি ছড়িয়ে দেয় ইলহামের অন্তঃকরণে, শরীরের অভ্যন্তরস্থে।

—-“কেন!! কেন আমায় এমন করে ভা/ঙ/ছো সুইটহার্ট? তুমি কি জানোনা, আমি তোমায় ছাড়া কতটা অসহায়?”

কপালে কপাল ঠেকিয়ে কাতর কন্ঠে নিজের অনুভূতি গুলো ব্যাক্ত করার বৃথা চেষ্টা করলো রাদ। ইলহাম চোখের জল বিসর্জন দিয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল,

—-“আপনি খুব খা/রা/প জানেন তো! নিজেই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন! এখন উল্টো অভিযোগ করা হচ্ছে।”

—-“আমি তোমাকে মোটেই দূরে সরিয়ে দেইনি তোমায়। হ্যাঁ, নিজেকে সামলেছি তোমার থেকে। আর যে কোনোভাবেই মায়া বাড়ানোর দুঃসাহস হচ্ছিলো না আমার। নিজের উপর ভয়নাক রা/গ হচ্ছিলো জানো? নিজের বোকামোর ফল নিজে ভোগ করেছি। এখানে কারোর হাত ছিলো না। আর তোমার তো একদমই নয়। ভেতরটা কেবল ছটফট করছিলো একটাবার তোমার কাছে ছুট্টে আসতে। কিন্তু আমি পারিনি। হয়তো.. নিজের করা কিছু বোকামোর ফল এটাই হওয়ার ছিলো। সব দো/ষ আমার, সুইটহার্ট। নয়তো অন্তু…”

এটুকু বলে থেমে গেলো রাদ। ইলহাম ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। রাদ ইলহামের কান্না দেখে অস্থির হয়ে উঠলো। দু’গালে আলতো করে হাত দিয়ে মুখটা উঁচিয়ে ধরলো।

—-“এই বোকা মেয়ে? কাঁদছো কেন হু?”

—-“রাদ? আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?”

ইলহামের শীতল প্রস্তাবে আকস্মিক জমে গেলো রাদ। তার দৃষ্টি খানা স্তব্ধ কুটিরে আঁটকে গেলো। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। অন্তঃকরণে কেউ চিৎকার পেড়ে বলল, “আমি ভুল শুনিনি।”

চলবে

[ বিঃদ্রঃ গঠন মূলক মন্তব্য ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here