প্রেম পিয়াসী পর্ব ২২

0
515

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
পর্ব________২২.

ইলহাম ডুকরে কেঁদে ওঠে। রাদ আর তাকায় না ওর দিকে। কোনো এক তীক্ষ্ণ অবহেলার প্রগাঢ় আবরণ লেপ্টে পড়ে ইলহামের আহত হৃদয়ে।

রাদ রি/ভ/ল/বা/র চালাতে উদ্যত হয় অন্তুর কপালে। ইলহাম ভ/য়ে তার কাছে ঘেঁষে না। অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে মুখ চাপে। ঠিক এমন মুহুর্তে প্রতিধ্বনিত হয় অন্তুর শেষ বি/ষা/ক্ত বানী,

—-“আ..আমার সাথে রাত কাটিয়েছে তোর ইলহাম! কেবল একবারই নয়! অনেক বার। আ..আ..আই সয়্যার ভাই!”

বিকট এক শব্দে পূণরায় কেঁপে ওঠে নিস্তব্ধ রজনী! রাদ সত্যি গু//লি চালায়। তবে ভাগ্যক্রমে সেটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় অদৃশ্যপটে। ইলহাম ভ/য়ে/র সর্বোচ্চ সীমাকে লঙ্ঘন করে দু’হাতে দুই কানকে আবদ্ধ করে। ধড়ফড় করে ওঠে তার হৃদপিণ্ড। এক্ষনি ছিটকে বেরিয়ে এলো বলে। খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো বিধায় দেখা হলো না, গু/লি/টা আসলেই বিদ্ধ করলো কিনা অন্তুকে।

অন্তু ভাঙা স্বরে চেঁচায়। শুনতে পেয়েছিলো ইলহাম। তারপর সবটা নিস্তব্ধ। ঠিক তখনই ঠাস করে কারোর গালে চড় পড়ার মতো শব্দ ভেসে এলো। ইলহাম চমকে উঠে চোখ জোড়া মেলে ধরতেই প্রকাশ্যে ভাসে মান্নাত বেগমের রা/গে গমগম করা মুখখানা। ইলহামের মনে পড়েনা মান্নাত বেগমকে এর পূর্বে কখনোও এমন র/ক্তি/ম মুখশ্রীতে দেখেছে কিনা। এটা ভাবাও অনেকটা অবাক করা বিষয় যে মান্নাত বেগম মানুষটা কোনো কারনে রা/গ/তে পারেন। সেই তিনি রে/গে কাকে চড় বসালেন?

ইলহাম দেখতে পেলো ঝুঁকে থাকা মাথাটা উঠাতে উঠাতে গালে হাত রাখলো রাদ। অর্থাৎ মান্নাত বেগমের রা/গে/র বহিঃপ্রকাশ নিজের সন্তানের প্রতিই হয়েছে।

আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন রাজিয়া বেগম। পেছনে এলেন মিলাদ সাহেবও। প্রত্যেকের মুখে মৃ//ত্যু ভয়ের কালো আবরণ। ছেলেকে ম/র/তে ম/র/তে বাঁচাতে পারার এক প্রকার স্বস্তিও। তবে তার চেয়েও যে ভ/য়/টা/ই প্রখর।

—-“পাগল হয়ে গেছিস তুই? এক্ষনি কি করতে যাচ্ছিলিস? নিজের ভাইকে মা/র/বি তুই? এতো বড় গু/ন্ডা হয়েছিস!!”

মান্নাত বেগম রা/গে দিশেহারা প্রায়। ছেলেকে এই মুহুর্তে ঠিক কি বলে শাসন করা উচিৎ জানা নেই তার। আক্ষেপে যে ম//রে যেতে ইচ্ছে করছে তার। এই শিক্ষা দিয়েছিলো ছেলেকে? হায় আফসোস!

—-“বল!! চুপ করে আছিস কেন? কেন মা/র/তে গেলি নিজের ভাইকে? সেটাও এই.. এই অ/স্ত্র তুলে! হে প্রভু, এমন দিন দেখার পূর্বে কেন আমাকে নিলেন না আপনি?”

মান্নাত বেগমের চোখ জোড়া টলমল করতে লাগলো। দূরে সেই পূর্বের আকারেই পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই আছে ইলহাম। বারে বারে ডুকরে কাঁদছে। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেলো!

—-“কথা বলিস না কেন? কথা বল! কথা বল বলছি? বল, কেন করলি এমন? কি কারন? বল আমাকে..”

ভেতর থেকে পুরোটাই ভে/ঙে পড়লেন মান্নাত বেগম। এলোপাতাড়ি মা/র/তে লাগলেন নিজের ছেলেকে। চ/ড়-আ/ঘা/ত কোনোটিই বাদ রাখছেন না। নিহা ছুটে আসে তাকে আটকাতে। রাদ মাথা নীচু করে নিথর হয়ে শুনতে লাগে মায়ের কথা। মায়ের চ/ড় থা/প্পড়েও মাথা তুলে একটা সামান্য কথা অব্দি বলে না সে। মূলত বলতে চায়না।

ইলহাম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। তার শরীর ক্রমশ ভে/ঙে পড়তে চাইছে। পা জোড়া থরথর করে কাঁপছে অনবরত। উপস্থিত জনগন কেবল মায়েরাই নন। বরং আরও অনেক মানুষ ভীড় করেছে এখানে। সবাই কেমন আঁড়চোখে দেখছে ইলহামকে। অনেকে কানাঘুঁষাও কম করছেনা। ইলহাম আর কোনো ভাবনায় না জড়িয়ে এক রকম পালিয়ে আসে সবার মাঝখান থেকে। সে জানে, হয়তো এক্ষনি একজোড়া কটাক্ষের হাত তাকে ইশারা করবে। কেমন, ঠেস মা/রা গলায় জানান দিবে, তার মতো নগন্য মানবের কারণেই এই ধরণীর যত অমঙ্গল।

ছাঁদে অনেক শোরগোল শোনা গেলো। যার শুরু হলেও শেষ হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা মেলেনি। সেদিন রাতেই নিজের বাড়ি ফিরে আসেন মান্নাত বেগম। ইলহাম তাদের সাথেই ফেরে। সারারাত আর দেখা মেলেনি রাদের। এমনকি টানা দুটো দিন নিখোঁজ সে। উপস্থিত হলো ঠিক অনন্যার রিসেপশনের দিন। অনুষ্ঠান শেষ করে যখন অনন্যাকে নিয়ে প্রণয় তার বাড়িতে উপস্থিত হলো, তাঁদের সঙ্গে রাদও ফিরলো। তবে প্রণয়ের বাড়ি থেকে নয়। বরং, অন্য কোথাও থেকে। যে ঠিকানা ইলহাম টানা দুটো দিনেও খুঁজে বের করতে পারেনি। ইলহামের ফোলা ফোলা গাল, চোখ, মুখ দেখে যে কেউ খুব সহজেই ধরতে পেরেছিলো সে এই দুটো দিন নিয়ম করে কেঁদেছে! কেবল একটা বার রাদের ফেরার আশায়। অথচ, চাঁদ মামা তার কুটিরে ফিরে গেলেও রাদের দেখা পাওয়াটা ডুমুরের ফুলের ন্যায় হয়ে উঠেছিলো। অবশেষে যখন বাস্তবেই রাদ ফিরে এলো তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না ইলহাম। এক ঘর লোকের সামনেই হায়া ভুলে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিলো, “কোথায় ছিলেন এই দুটো দিন? কতবার কল করেছি কোনো খবর রেখেছেন?”

আশ্চর্যজনক ভাবে রাদ তাকে এই আঙ্গুলও স্পর্শ করেনি। কেমন গম্ভীর মুখ করে বলেছে,”ছাড়ো। মানুষ দেখছে।”

ব্যস তারপর থেকে আবার লাপাত্তা। ইলহাম বোবা চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো রাদের দিকে। মানুষটা ঠিক কতটা বদলে গেছে এই দুটো দিনে, ভাবতেই হাজার বার ম/রে/ছে সে। কাঁদতে কাঁদতে পা/থ/র হয়েছে চোখ জোড়া। কতটা ভ/য়া/ন/ক ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে সে রাদকে! রাদ কি কিছুই বুঝতে পারেনা?

____________________________________________

রাত ১২টা বেজে ৪৫মিনিট। ইলহামের রুমের দরজাটা ভেজানো দেখে অনুমতি ব্যতীতই ভেতরে প্রবেশ করলো অনন্যা। ইলহাম আড়াআড়ি হয়ে এলোমেলো অবস্থায় শুয়ে আছে বিছানায়। তার অন্যমনস্ক ভাব বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে টের পায়নি অনন্যার আগমন। অনন্যা তাকে এমন ভাবে দেখে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চুপটি করে তার মাথার কাছে বসে আলতো ভঙ্গিতে হাত রাখলো মাথায়। ইলহাম কারোর ছোঁয়ায় চমকে উঠলো আকস্মিক। ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে এক কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অনন্যার পানে। তারপর হঠাৎ মিইয়ে পড়লো কৌতুহল নিহিত চোখজোড়া। অর্থাৎ, সে অন্য কাউকে আশা করেছিলো। অনন্যা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

—-“তুমি ঠিকাছো ভাবি?”

—-“ত্ তুমি এই সময়? (অনন্যার প্রশ্নে কয়েক মুহুর্ত থম মে/রে থেকে) হ্যাঁ। ঠিকাছি। কেন বলোতো?”

—-“ভাইয়ার সাথে সব কিছু ঠিকাছে তো?”

ইলহাম জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সেই হাসিটুকুও দীর্ঘময় হলোনা। ফ্যাকাসে হয়ে এক ধূসর বি/ষ/ন্ন/তা ছেয়ে গেলো মুখশ্রীতে। অনন্যা ঢের বুঝতে পারলো ইলহামের মনের অবস্থা। ইলহামকে কিছু বলতে না দিয়ে অনন্যা নিজেই বলে উঠলো আবার,

—-“কি হয়েছে ভাবি? আমাকেও বলা যায়না?”

বলতে বলতে ইলহামের হাতজোড়া নিজের হাতে নিয়ে নিলো অনন্যা। পুরনো ক্ষ/ত/তে কেউ লাগাতার অ/স্ত্রা/ঘা/ত করলে যেমন অনুভূতি হয়, তার চেয়েও ভ/য়া/ন;ক তা;ড়;না হচ্ছে ইলহামের বুক পাঁজরে। কিছু বলতে পারলো না সে। ডুকরে কেঁদে উঠে জড়িয় ধরলো অনন্যাকে। অনন্যা হতবিহ্বল হয়ে গেলো ইলহামের কান্না দেখে। বোবা স্বরে বলে উঠলো,

—-“ভাবি!! ভাবি কাঁদছো কেন? আমাকে প্লিজ বলো ভাবি! আমি কিন্তু সত্যি কিছু বুঝতে পারছিনা। এই ভাবি?”

ইলহাম কান্না জড়ানো কন্ঠেই একের পর এক ঘটনা বর্ণনা করে গেলো অনন্যার কাছে। অন্তুর সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে থেকে শেষ অব্দি সবটা নিখুঁত ভাবে বলল। সবটা শুনে অনন্যাও বেশ খানিকটা সময় স্থীর হয়ে রইলো। তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তার নিজের ভাই? তার নিজের ভাই এতোটা নোং//রা!

—-“চোখ মুছো ভাবি। এখানে তোমার কি ভুল বলো তো? ভাইয়া হয়তো তোমার প্রতি একটু অভিমান করেছে। দেখবে দিন শেষে তোমার কাছেই আবার ফিরে আসবে। তুমি জানোনা, ভাইয়া তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসে!”

—-“না গো! উনি কোনো অভিমান করেননি। উনি সত্যি সত্যি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছেন! ব্ বিশ্বাস করো অনন্যা, আমি উনাকে সবটা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…”

ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে ইলহামের। না, এমন করে সত্যি থাকা যায়না! আর সে থাকবেও না। আর একটা দিনও থাকবে না এই বাড়িতে। কালই চলে যাবে। সত্যি বলতে ও যোগ্য নয় মানুষটার ভালোবাসার। ওর যোগ্যতা মামির অ/ত্যা/চা/রে দিনযাপন করা অব্দিই সীমাবদ্ধ।

—-“আমি কথা বলবো ভাইয়ার সাথে। এভাবে কেঁদো না প্লিজ ভাবি। দেখো আমার দিকে..(ইলহামের দু’গালে হাত রেখে)..খুব ভালোবাসো ভাইয়াকে, তাইনা?”

ইলহাম ফোপাঁতে ফোপাঁতে মাথা নুইয়ে নিলো। ভালোবাসবে? কোন যোগ্যতায় ভালোবাসবে মানুষটাকে? ওর যে কাউকে ভালোবাসারও যোগ্যতা নেই।

—-“বলেছো ভাইয়াকে?”

ইলহাম না বোধক মাথা নাড়ে। অর্থাৎ, কখনও বলেনি। অনন্যা মৃদু হাসে। গুনী ভঙ্গিতে ইলহামের দুচোখের জল মুছতে মুছতে বলে,

—-“জানাতে হবে তো ভাইয়াকে। নয়তো কি করে জানবে, কেউ একজন ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।”

ইলহামের বুক কাঁপে। হয়তো সে নিজের চেয়েও বেশি রাদকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসা কি আদৌও কোনোদিন খাটে তার সামনে! একদম খাটে না।

—-“একদম কাঁদবে না, ভাবি। দেখো তুমি কাঁদলে কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগে না। না জানি, ভাইয়া তোমার চোখের জল দেখলে কি করে। শোনো না, ভাবি? আমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলবো। তুমি এইসব নিয়ে আর একটুও মন খারাপ করে থাকবেনা। কেমন? তোমাকে কাঁদলে একদমই ভালোলাগেনা। সব সময় যেমন হাসিখুশি থাকো। ওমনই থাকবে হু? ভাইয়া বোধহয় বাসায় ফিরেছে। আমি দেখছি। কথা বলে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। কেমন?”

ইলহাম হ্যাঁ বা না কোনোরূপ জবাব আওড়ালোনা। কেবল নিশ্চুপ থেকে চোখের কোন মুছে চুপচাপ বসে রইলো। বুক ভরে তাজা দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা। আর কোনো স্বপ্ন সে নতুন করে দেখতে চায়না। কারন, ভাগ্য নামক জিনিসটায় সুখ বলতে একদমই কিচ্ছু নেই ওর। তাই স্বপ্ন দেখা তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো।

অনন্যা চলে গেলো রাদের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু রাদকে কোথাও পেলোনা। কয়েক মুহুর্তের জন্য বাসায় এলেও আবার কাজের বাহানায় বেরিয়ে গেছে রাদ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here