#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______১৩.
ইলহাম শুয়ে ছিলো নিজের ঘরে। এমন সময় দু’হাত ভর্তি এক গাদা খেলনা নিয়ে হাজির হয় নিঝুম। মন খারাপের সুরে বলে,
—-“মামি, মামি? আমার সাতে একটু খেলবে তুমি? জানো, আমার সাথে না কেউ খেলেনা। ছবাই ব্যস্ত।”
নিঝুমের বাচ্চা সুলভ কন্ঠে খুব মায়া হলো ইলহামের। শোয়া থেকে উঠে বসলো চটজলদি। হাতের ইশারায় কাছে ডেকে আদুরে কন্ঠে বলল,
—-“এ বাবা! সব্বাই ব্যস্ত? এই মিষ্টি পাখিটার সাথে কেউ খেলেনা?”
নিঝুম ঠোঁট উল্টে ফের মন খারাপের সুরে বলল,
—-“কেউ খেলেনা!”
—-“এটা কোনো কথা! কেউ খেলেনা এই মিষ্টি পাখিটার সাথে! আচ্ছা, কারোর খেলতে হবেনা। আমি আছি তো। আমি খেলবো। এসো।”
ইলহামের আদুরে কন্ঠে এক মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে নিঝুমের ঠোঁটের কোনে। সেই খুশিতে ইলহামের গলা জড়িয়ে চুমু খায় গালে। ইলহামও খুশি হয়ে তার গালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর আদুরে কন্ঠে বলে,
—-“আচ্ছা, আমার মিষ্টি পাখি কি খেলবে বলো? পুতুলের বিয়ে দিবে নাকি রান্না-বান্না করবে।”
নিঝুম উৎসাহ জোরেশোরে বলে উঠলো,
—-“পুতুলের বিয়ে।”
ইলহাম হেসে পড়লো।
—-“ওকে বাবা।”
“ভাবি আসবো?”
তাদের পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মাঝে উপস্থিত হলো অনন্যা। অনন্যাকে দেখে স্মিত হাসলো ইলহাম।
—-“অনন্যা? এসো।”
অনন্যা এসে বসলো ইলহামের পাশে। তার মুখটা ভীষণ শুঁকনো লাগছে। ইলহাম প্রথম দেখাতেই বুঝে নিলো। কিন্তু কিছু বলল না। মনে মনে চাইলো অনন্যা যেন নিজ থেকেই বলে তাকে। কিন্তু তেমন কিছুই বলল না অনন্যা।
—-“ভাবি, সামনের মোড়ে হাঁটতে যাবে? বিকেলের ওয়েদারটা জাস্ট ফাটাফাটি। আমার অনেক ইচ্ছে করছে একটু বেরোতে। কিন্তু একা যাবো ভেবে মা যেতে দিচ্ছে না।”
ইলহাম নিঝুমের পুতুল বিয়ে রেখে তাকালো অনন্যার পানে। না; অনন্যা স্বাভাবিক নয়। তার মনে কিছু একটা ঠিকই চেপে আছে। হয়তো সে বলতে চাচ্ছেনা। তাই ইলহামও আর তেমন ঘাটালো না তাকে। অনন্যা কথাটা যেমন স্বাভাবিক ভাবে বলল, সেও তেমন স্বাভাবিক ভাবেই নিলো।
—-“হ্যাঁ! যাওয়া যায়.. কিন্তু তোমার ভাইয়া যদি…”
—-“ভাইয়ার থেকে আমি পারমিশন নিয়ে নিবো। প্লিজ ভাবি চলো না!”
অনন্যার ব্যাকুল হৃদয় ধরাক করে উঠলো। যার দরুন ফট করে বলে উঠলো কথাটা। ইলহাম সন্দিহান নয়নে তাকালো। তবে পরক্ষণেই সন্দেহ চেপে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বলল,
—-“ঠিকাছে।”
অনন্যা যেন না চাইতেও আকাশের চাঁদ পেয়ে বসলো। আনন্দ তার উপচে পড়ছে। ইলহাম আর কিছু বলল না। সবটাই তীক্ষ্ণ নজরে দেখলো। অনন্যা শাড়ী সামলে এক প্রকার দৌড়ে বের হলো রুম থেকে। ইলহাম তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-“নিঝুম পাখি, চলো আমরা ঘুরে আসি। বাসায় ফিরে তারপর আমরা পুতুলের বিয়ে দিবো কেমন?”
নিঝুম ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে “ইয়েএএএ” বলে ফেটে পড়লো আনন্দে। তার মেয়ে পুতুলকে কোলে নিতে নিতে বলল,
—-“মামি, ওকে নিয়ে যাবো?”
—-“হ্যাঁ, নিশ্চিয়ই। তোমার পুতুলও ঘুরে আসবে। চলো।”
—-“ওক্কে।”
—-“ আচ্ছা নিঝুম সোনা, তোমার পুতুলের নামটাই তো জানা হলো না?”
—-“ওর নাম এঞ্জেল।”
—-“বাবাহ্, তাই?”
—-“হ্যাঁ।”
নিঝুম খিলখিল করে হাসতে হাসতে নাম জানালো তার পুতুলের। ইলহাম তার খুশিতে মুচকি হাসলো। তাকে এবং তার পুতুলকে পরিপাটি করে দিলো বাইরে যাওয়ার জন্য। ততক্ষণে রাদের থেকে অনুমতি নিয়ে এসে পড়লো অনন্যা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছে, এমন কন্ঠে বলল,
—-“ভাবি, ভাইয়া পারমিশন দিয়ে দিয়েছে।”
—-“ওকে। চলো তাহলে?”
—-“হ্যাঁ,প্লিজ।”
____________________________________________
সামনের মোড়ের কথা বলে অনেকটা পথ চলে এসেছে তারা। ইলহাম সবটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে কেবল। হঠাৎ করে বের হওয়ার পেছনে অনন্যার কোনো মতলব ঠিকই আছে। কিন্তু কি সেটা? সেটাই জানার জন্য নিশ্চুপ রইলো সে।
—-“ভাবি? ঐ দেখো ফুচকাওয়ালা! তোমরা এই এখানটায় দাঁড়াও! আমি নিয়ে আসি।”
ইলহাম মৃদু হেসে নিঝুমকে নিয়ে বসলো রাস্তার পাশের ছোট্ট বেঞ্চটিতে। নিঝুম বেরোতে পেরে মহা আনন্দিত। সে তার এঞ্জেলকে নিয়ে বিন্দাস সবটা উপভোগ করছে। কিন্তু ইলহাম পারছেনা। হঠাৎ করেই তার মনটা কেমন কু-ডাকছে। মনে হচ্ছে কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে।
ফুচকাওয়ালার বাহানায় ইলহামদের রেখে খানিকটা পথ চলে এলো অনন্যা। পেছন ফিরে তাকাচ্ছে আর দেখছে ইলহাম তাকে দেখে নিলো কিনা?
পেছন মুড়ে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে আকস্মিক কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে নীচে পরে যেতে নিলো ও। কিন্তু ভাগ্যক্রমে পরলো না। একজোড়া শক্ত বাঁধন তাকে বেঁধে নিলো নিজের সাথে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে অনন্যা খিঁচে চোখমুখ বন্ধ করে নিলো। তার হৃৎস্পন্দন তুমুল গতিতে বেড়ে গেলো হঠাৎ। না; পরে যাওয়ার ভয়ে নয়। প্রিয় কেউ সামনে উপস্থিত হওয়াতে। হৃৎস্পন্দনের গতি বেগে অনন্যা বুঝে নিলো, সে এসে গেছে। তাই চোখ মেলে তাকে এক পলক দেখার লোভে কোনো বিলম্ব হলো না। কাতর মনটা হাঁকডাক পেড়ে উঠলো মানুষটাকে দেখতে। হঠাৎ চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠলো। কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
—-“একবার তো ভেবেছিলাম, আপনি আসবেনই না প্রণয় ভাই!”
প্রণয় মলিন হাসলো। অনন্যাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। পিছিয়ে যেতে যেতে একপলক দেখলো অনন্যাকে৷ শাড়ী পড়ায় এক পরিপূর্ণ নারী লাগছে তাকে। এই তো বছর দুয়েক পূর্বের কথা। এক বৃষ্টির রাতে কাকভেজা হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো বন্ধুর বাসায়। সে রাতেই অনন্যাকে প্রথম দেখে সে। পরনের টপসটায় একদম বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখেছিলো সে। প্রথম দেখাতেই চোখ ঝলসে এসেছিলো তার। বড্ড মনঃপুত লাগছিলো তাকে। সেই বাচ্চা অনন্যার মাঝে আর আজকের অনন্যার মাঝে আকাশসম তফাৎ আজ। কথাটা ভাবতেই বুকের গলি পেরিয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাসের টান। নিজেকে আর নিমজ্জিত করলো না সেই অযাচিত ভাবনায়। যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।
প্রণয় আবার মলিন হাসলো। ঠোঁটের কোনে স্বভাব সুলভ হাসিটুকু এঁটে রেখেই বলল,
—-“তুমি ডাকলে আর আমি আসবো না! তা কখনোও হয়েছে?”
প্রণয়ের মায়া জড়ানো কন্ঠে বুক ফেটে কান্না এলো অনন্যার। আহত নয়নে তার পানে তাকিয়ে বলল,
—-“তাহলে কেন আমার কথায় আমায় একটু ভালোবাসতে পারলেন না প্রণয় ভাই! আপনি তো খুব ভালো করে জানেন, কতটা ভালোবাসি আমি আপনাকে!”
—-“অনু! তুমি বড় হয়েছো। পরিস্থিতি, পরিবেশ, পরিবার সবই বোঝো। তাহলে কেন বারবার ঐ একই কথা বলো? তুমি খুব ভালো করেই জানো, একটা চালচুলোহীন ছেলের হাতে তোমার মা কোনোদিন তোমাকে তুলে দিবেনা! আর রইলো বাকি অন্তুর কথা! আমি ওর ফ্রেন্ড বলেই যে ও আমার প্রতি এই টুকু উদার হবে তা কিন্তু নয়! এই ব্যাপারে তোমার পরিবারের যে কেউ কিছু ঘুনাক্ষরেও টের পাওয়া মানে নিজের হাতে নিজেকে গলা চেপে হ//ত্যা করা! তুমি কি তাই চাও? তুমি কি চাও, আমি সারাজীবনের জন্য তোমার শহর ছেড়ে অনেক.. অনেক দূরে হারিয়ে যাই?”
অনন্যা পারলোনা নিজেকে সামলে রাখতে। ভেতরের তীব্র বে/দ/না তাকে দিলো না স্থীর থাকতে। ডুকরে কেঁদে উঠে ঝাপটে ধরলো প্রণয়কে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। প্রণয় অনন্যার কান্না দেখে থমকে গেলো একরকম। কয়েক মুহুর্ত কেবল নিস্তব্ধতায় কাটলো। কিন্তু ক্ষনকালেই তার মস্তিষ্ক সতর্ক সাইরেন বাজালো। জানান দিলো, এই জায়গা মোটেও সেফ নয়। যে কেউ, যেকোনো ভাবে তাদের দু’জনকে একসাথে দেখে নিতে পারে। অতঃপর যার ভয় সে পাচ্ছে, সেটাই ঘটে যাবে। তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে অনন্যাকে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে। অনন্তর দু’পা পিছিয়ে পড়লো। দূরে সরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো হঠাৎ,
—-“পাগলামি করোনা, অনন্যা। এর ফল যে খুব একটা ভালো হবে না, জানো তুমি। তাহলে কেন এই পা/গলামি? তুমি কি জানো, শাড়িতে তোমায় কতটা ভ/য়াবহ সুন্দর লাগছে? কেউ বলেনি বুঝি? হবু বরকে দেখিয়েছো? সে দেখলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাতো!”
অনন্যা কেঁদেই যাচ্ছে। তার ক/ষ্টটা কেউ বুঝতেই চাইছে না। তার প্রিয় মানুষটিও নয়।
—-“যাও। বাসায় ফিরে যাও। অন্তু আমায় কল করেছিলো। কড়া হুকুম দিয়েছে, তোমার বিয়েতে যেন আসি! তুমি কি চাও? আসবো?”
—-“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমার সুন্দর এবং স্বরণীয়
মৃ/ত্যু/তে আমার প্রিয় মানুষ গুলো থাকবেনা সেটা কেমন করে হয় বলুন?”
—-“অনু!(মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে) আর একবার যদি এসব বাজে কথা বলো তবে…”
—-“তবে কি প্রণয় ভাই?”
—-“আমার কসম লাগে, অনু! দয়াকরে এসব চিন্তা মাথাতেও আনবেনা।”
—-“আনবোনা। তাতে কি আপনি আমার হবেন, প্রণয় ভাই?”
—-“পা/গলামি করো না অনু..”
—-“এটা পা/গলামি নয়, প্রণয় ভাই! এটা আমার দাবী!”
—-“অনু…”
অনন্যা হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো। বেশ কঠিন কঠিন কথা বলতে শিখেছে অনন্যা। মাসখানেক আগেও কিন্তু এমন ছিলোনা। তখনও সেই বাচ্চা মেয়েটা ছিলো। আজ হঠাৎ কত বড় মনে হচ্ছে।
—-“অনন্যা?”
পেছন থেকে ভেসে আসে ইলহামের গলা। অনন্যা চমকে ওঠে ইলহামের গলা পেয়ে। চমকায় প্রণয়ও। দু’জনেই ধরা পড়ার ভয়ে তটস্থ হয়ে যায়। ইলহাম নিঝুমকে নিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। একবার প্রণয়কে দেখে তো, একবার অনন্যাকে দেখে। আকস্মাৎ গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায়,
—-“কে উনি?”
#চলবে_______