প্রেম তরঙ্গ পর্ব ৭

0
1126

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৭

আজ আর আমাদের দু’বোনর নিজের বাড়িতে যাওয়া হলো না। বড় আম্মা রেখে দিলেন। ভয়াবহ বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। রাত নিঝুম হতে নিঝুম হচ্ছে। যদিও এবাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব পাঁচ মিনিটের মতো। আব্বুকে ফোন করেছিলো আম্মা। আমার সাথে কথা হলো। আব্বুও বলল বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন উপেক্ষা না করে এখানেই থেকে যেতে। মিলি আর আমি ভেজা কাপড় ছেড়ে বড় আম্মার শাড়ি পরে নিয়েছি। তীন ভাইয়ার সাথে দু একটা কথা এখন আমাদের খাবার টেবিলেই হচ্ছে। মিলি যখন তার দর্শনে গিয়েছিল তিনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন।

— কেমন আছেন ভাইয়া?

প্রথম বাঁকটা আমিই ফুটালাম তীন ভাইয়ার উদ্দেশ্যে। সে মাত্র চেয়ার টেনে বসেছিল। আমার নিকে নজর ফিরিয়ে অনবদ্য এক মুচকি হাসি হেঁসে বলল

— এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?

— ভালোই।

— ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা কবে হচ্ছে?

— এই মাসেই। কিন্তু দেবো না।

বড় আম্মা আমার প্লেটে ভাত দিচ্ছিলেন। মিলি আমার পাশে বসা ছিল আর তীন ভাইয়া আমার মুখোমুখি এক চেয়ারে। প্রত্যেকেই যেন আমার কথা শুনে শ্বাস প্রশ্বাস থমকে দিলো। মিলি উত্তেজিত কন্ঠে বলল

— আপু, মাথা ঠিক আছে তোর?

আমি বেশ স্বাভাবিক রইলাম। বড় আম্মাও প্রায় চেচিয়ে বলে উঠলেন

— তিথি, আবার কি ভূত ধরলো তোর। দেখ তোকে কিন্তু তোর মা বাবা মেডিকেলে পড়াতে চেয়েছিল। শুনিসনি। বললি তুই ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাবি না। কিন্তু তুই ঢাকাতেই পড়তে চাস। শেষে ভার্সিটিতে গেলি। এখন আবার এসব কি বলছিস?

— আমি পড়বো না ঢাকায়।

এটুকু বলার পরই শুরু হলো যেন এক নীরব ঝড়। আমি ভাতের প্লেট ছেড়ে উঠে পরলাম। কেউ কিছু বলল না। ক্রমে ক্রমে বুকের ব্যাথা তাজা হলো আমার। পাওয়া না-পাওয়ার স্মৃতি বুকের অলিগলিতে আনাগোনা করছে। যদি আমি পারতাম, তবে হাওয়া হয়ে বয়ে যেতাম তিতাসের কাছে। তার কর্ণকুহরে ঝঙ্কার তুলে বলতাম,

” আমি ভালো নেই তিতাস। ভালোবাসা আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছে না। ”

.
না খেয়ে উঠে আসায় কেউ আমায় পুনরায় খাওয়ার কথা বলল ন। তারা সকলেই চিন্তিত আমার উদ্ভট সিদ্ধান্তে। মিলিও চমকে গেছে বেশ করে। আমি বড় আম্মার রুমে শুয়ে আছি। ভেজা আঁখিতে অশ্রুমোচনের এক কালে হঠাৎ দরজার ওপাশ হতে ডেকে উুঠলো আমায় মিলি,

— আপুনি, বড় আব্বু ফোন করেছে। কথা বলবে তোর সাথে।

মিলির কন্ঠ কানে আসতেই হুট করে কৃত্রিম আচরণে জড়িয়ে পরতে হলো আমার। অতি সন্তর্পনে দুচোখ বন্ধ করে নিলাম ঘুমের বেশে। মুখ ফুটে কথা বলার দুঃসাহস আমার এই মুহূর্তে নেই। গলা জড়িয়ে যাবে। এই বড় আব্বুকে দেখলে আমার কান্না ভয়ঙ্কর হবে। চাইলেও আমি সামলে উঠতে পারবো না, চোখের পানি আটকানোর সাধ্য খুয়িয়ে ফেলবো।

আমি যখন কোনো সাড়াশব্দ দিতে নারাজ তখন মিলি খুবই শান্ত ভঙ্গিতে চলে গেলো। মুহূর্তেই যেন বুক আমার আরো এক মণ বেশি দুঃখ আপন করলো। এমন সময় দু’টো মানব মানবী আমার দুঃখগুলোকে মহাদুঃখে পরিণত করতে তোড়জোড় শুরু করে দিলো। ড্রইং রুম হতে ভেসে এলো মিলনান্তর কন্ঠের গান

” যদি থাকতে তুমি
বাঁচতে আমার লাগতো না কঠিন,
যদি থাকতে তুমি।
যদি থাকতে তুমি
কাটতো আমার দিনগুলো রঙ্গিন,
যদি থাকতে তুমি।
………………
এমন হবে কোনো দিন
আমি আগে ভাবিনি,
এমন হবে কোন দিন
আমি আগে ভাবিনি,
যে আমায় ছাড়া বাঁচতো না আজ
সে কেন বিলীন ?”

তীন ভাইয়ার গিটারের সুর আর কন্ঠের সুর মিলেমিশে তৈরি করলো আমার জন্য কষ্টের মন্ত্র। ক্ষণে ক্ষণে আবার যোগ হচ্ছে মিলির গলা। আরো অসহ্য, অসহনীয়। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে ওদের গানের আসর ভেঙে দেই। গিটারটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলি। বলি ওদের

” পৃথিবীতে এতো গান থাকতে এই গানটাই কেন গাইতে হবে তোদের? সবাই আমার পেছনে কেন পরে আছিস? কেউ ভালো না। ক্যারেনের মতো তোরাও আমায় কষ্ট দিচ্ছিস। তিতাসের মতো তোরাও আমায় বোঝার চেষ্টা করছিস না।”

কিন্তু বলা হবে না আমার। ভেবেই যেন আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম। আমার অজান্তেই আমি বিছানা ছেড়ে ঝট করে উঠে পরলাম। প্রায় দৌড়ে চলে গেলাম ড্রয়িং রুমে। বড় আম্মাকে দেখলাম না। তীন ভাইয়া আর মিলি বন্ধ চোখে মনের সমস্ত আবেগ ঢেলে গানে মত্ত। আমি ছুটে গিয়ে তাদের সম্মুখে দাড়িয়ে পরলাম। তীন ভাইয়ার উদ্দেশ্যে হুট করে উচ্চস্বরে বলে উঠলাম

— ভাইয়া, আমি বাড়িতে যাবো। আমাকে দিয়ে আসেন।

থেমে গেলো তাদের গানের সুর। দু’জোড়া চোখ বিস্ফোরিত হলো আমাকে ঘিরে। মনের সাথে তারা বহু আলাপচারিতা করলেও মুখে আনলো না একটা কথাও। তীন ভাইয়া বসা থেকে উঠে বললেন

— চলো…

— তিথি, তুই কিন্তু এখন থাপ্পড় খাবি। তোর হয়েছেটা কি শুনি? আবল তাবল কথাবার্তা বলছিস।…. এই তীন, তুই যাবি না। পরশু তোর ফ্লাইং আছে। জ্বর আসলে ফ্লাইং করবি কিভাবে? তিথি, তীন যাবে না। ওর কাল ঢাকা যেতে হবে। ক্রস কান্ট্রি ফ্লাইটের কোর্স করছে ও।

হঠাৎ করে বড় আম্মার আগমন আর এমন কথা। কিন্তু আমার মন টিকছে না। কেবলই মনে হচ্ছে তিতাস বুঝি ওর ভুল বুঝলো। মিলির ফোনে যদি ফোন দেয়? আমি ধরতে পারবো না? এটা কেমন কথা। আমার খুব ইচ্ছে করছে তিতাসের সাথে কথা বলতে।

— তাহলে আমি একাই যাবো। থাকো তোমরা।

কথাটা বলেই সদর দরজা খুলে আমি বেরিয়ে পরলাম। মিলিও আসছিলো আমার সাথে তবে তৎক্ষনাৎ বড় আম্মা তাকে টেনে ধরেছেন। আমার কানে ভেসে এলো উনার বিরক্তি কন্ঠ

— তুইও কি পাগল? এই বৃষ্টির মধ্যে দুইটাই কি অসুস্থ হওয়ার জন্য যাচ্ছিস? এই তীন… ঐ পাগলিকে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বাসায় দিয়ে আয়।

আমি ততক্ষণে সাত আট কদম ফেলে দূরে চলে এসেছি। অন্ধকার চারিপাশ। ক্ষণে ক্ষণে শুধু আকাশ ফালি দিয়ে এক চিলতে আলো এসে ঘুচে দিচ্ছে অন্ধকার। একটাসময় পেছন থেকে কেউ টর্চ ফেলল আমার পথে। ভূমিতে পতিত বৃষ্টির পানি ধবধবে আলোয় বেশ করে দেখা যাচ্ছে। আমার মন তখন আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভেবে নিলো, তিতাস অবশ্যই ফোন করেছিল। সে কখনো আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। কণাকে ও কখনো মানবে না। ভাবনার মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি যেন থেমে গেলো। আমার শরীর জুড়ে আর বাদলের জলের অস্তিত্ব ঠাহর করতে পারলাম না। কেমন যেন উদ্ভট, আকুলতা নিয়ে চলতি পথেই হঠাৎ নাকে ভেসে এলো সুগন্ধি। পাশ ফিরে তৎক্ষনাৎ চেয়ে দেখি তীন ভাইয়া। সে এক হাতে ছাতা ধরে রেখেছে আমার মাথার উপর। অন্যহাতে ধরেছে টর্চ। তারদেহ পুরোটা ছাতা ছেড়ে বাইরে। আমি ধরেই নিয়েছি পাগলের মতো তিতাস আমার জন্য উন্মাদ হয়ে ছুটে আসবে বা আসছে। তাই ফুরফুরে, আনন্দ চিত্তে হেঁসে উঠে আমি কাণ্ডজ্ঞান ভুলে তীন ভাইয়াকে টেনে ছাতার নিচে নিয়ে নিলাম। তাকে ফিসফিসিয়ে বললাম

— পাইলট স্যার, আপনি ছাতার বাইরে কেন? ভেতরে আসুন। আপনার জ্বর আসলে বড় আম্মা আমাকে আস্ত রাখবে না।

তীন ভাইয়া যেন তার অতি সুন্দর মুখে জুড়ে নিলো অস্বস্তি। নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বেচারা বেখেয়ালি মনে আচমকা প্রায় ধাপাস হচ্ছিলো। আমি তড়িঘড়ি করে তার হাত টেনে ধরে বাঁচিয়ে দিলাম। তবে টর্চটা বাচাতে পারলাম না। টর্চ ছিটকে পরলো পাশের পুকুরে। আমি হায় হায় করে উঠলাম। আকাশ তখন আবারও ঝলক দিলো আলো নিয়ে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখলাম তীন ভাইয়ার সুন্দর ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফুলে উঠেছে আফসোসে। সরু কচি পাতার মতো দীর্ঘ নয় আবার আকারে ছোট নয় এমন মোহে ফেলতে সক্ষম দুইটা চোখ পিটপিট করছে অপরাধবোধে। আমি বুঝলাম বেচারা আমার জন্য অসম্ভব অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু কেন? পূর্বে তো ভাইয়াই আমাকে সাইকেলে করে স্কুলে রেখে আসতো। তেজ, স্মার্টনেস তো তার অনেক বেশি। তারউপর পাঁচটা বছর বিদেশ থেকে পাইলটের দক্ষতা নিয়ে এলো। সেই ছেলে এমন?

— ভাইয়া, আমার মনে হয় কি, আপনি আকাশ দিয়ে চলতে চলতে মাটি দিয়ে চলা ভুলে গেছেন।

তীন ভাইয়া আমার কথার পিঠে প্রথম দফায় কেমনতর এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর হঠাৎই বললেন

— তুমি দূরে দূরে হাঁটো আমার থেকে।

ভাইয়ার কথা আমি কানে নিলাম না। উড়িয়ে দিলাম অহেতুক এক কথা ভেবে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে তার হাত থেকে ছাতা নিয়ে এতো লম্বা উনার মাথার ওপর ধরে নরম সুরে বললাম

— ভাইয়া আমার না প্লেনে ওঠার অনেক শখ। সেই ছোট বেলা থেকেই। আমার প্রিয় মানুষটার সাথে একদিন আকাশ পথে অনেক অনেক উড়বো। একটু উঠাবেন প্লেনে?

চলবে…..

( প্রতিদিনই অহরহ ভুল করি। গত পর্বে বেখাপ্পা লেভেলের একটা ভুল করেছি। তীনের মাকে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের স্টুডেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলাম 😒 অথচ ওখানে শুধু ছেলেরা পড়ে। অন্য একটা কলেজ ধরে নিয়েন 🥺)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here