প্রেমোদ্দীপক পর্ব ২৯

0
807

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-২৮)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

হিমেল অপরাহ্ন। আসরের আযান পড়েছে সেই ক্ষণে। ওয়াক্ত শেষ হতে চলল বোধহয়। কবজির উপর পরে থাকা ডায়াল ঘড়িটায় সময় দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অভীক। বসার ঘর থেকে পা বাড়াল তাহিয়ার রুমের দিকে। অযু করে নামাযে দাঁড়াল।
তিনদিনের সফর শেষে আজই শহরের এসে পা রেখেছে ওরা। বাসায় এসে পৌঁছেছে মিনিট বিশেক আগে। তাহিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা অভীকের। কিন্তু মাহমুদা জামাতাকে খালি মুখে যেতে দিতে নারাজ। কড়া স্বরে বসতে বলে রান্নাঘরে ছুটেছেন নাস্তা বানাতে। তাহিয়া গেছে মাকে সাহায্য করতে, মাঝে এসে দেখে যাচ্ছে অভীককে।

নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে এলো তাহিয়া। অভীক সবে সালাম ফিরিয়েছে। তাহিয়া ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে আগাল অভীকের দিকে। টাইলস করা ফ্লোরে জায়নামায বিছানো। অভীক বসা জায়নামাযে। পরনে আসমানী রঙা পুলওভার, মাথায় সাদা টুপি। সদ্য অযু করা স্নিগ্ধ মুখে জিকির জপছে মৃদুশব্দে। ডানহাতের বৃদ্ধা আঙুলের ডগা দিয়ে তর্জনী আঙুলের কর গুনছে। অভীককে পরখ করে জায়নামাযের পাশে ফ্লোরে বসল তাহিয়া। অভীক বিড়বিড় করতে করতে চোখ রাখল ওর দিকে। ওকে বসতে দেখে ভ্রু নাড়িয়ে, ‘কী?’ জিজ্ঞেস করল।

তাহিয়ার পরনে মেরুন হুডি। পকেটে ছোটো একটা বক্স রাখা। হাতড়ে ওটা হাতে নিল। মুঠোবন্দি মরে সামনে এনে খুলল। অভীক ভ্রু কুঁচকাল। তাহিয়া অভীকের বাঁ হাত টেনে নিজের কোলে নিল। বক্সের ভেতর রূপা, ডায়মন্ড মিশেলের বয়েজ রিং। রিংটা তুলে অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল চোখের পলকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল অভীক।
নিজের হাতের দিকে তাকাল একবার, তারপর প্রশ্নবোধক চাহনিতে চাইল স্ত্রীর পানে।

প্রিয়তমের চোখের ভাষা বুঝে তাহিয়া উত্তর দিল,
‘ আমার নামের সিলমোহর। এবার কেউ হাত দেখে বলতে পারবে মানুষটা কারো ব্যক্তিগত। নজর দেয়ার সাহস পাবে না।’

অভীকের স্নিগ্ন মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।তাজবীহ পড়তে পড়তেই হাসল। তাজবীহ পড়া শেষ করে বলল,
‘ সিলমোহর না মারলে ও আমি আপনার নামেই লিখিত থাকব। নীল কাগজে জোড়া লাগানো বাধনের কথা মন, মুখ থেকে মোছা অসম্ভব। ‘

‘ নীল কাগজটা তো আর সবাইকে দেখাতে পারব না। তাই কোন চিহ্ন রাখা অবশ্যম্ভাবী। তোমাকে দেখতে সিঙ্গেল সিঙ্গেল লাগে, আমার ভালো লাগে না । বিবাহিত মানুষ, বিবাহিত লাগতে হবে। সবাইকে জানতে হবে, তোমার যে ঘরে বউ আছে। নাহলে কেউ নজর দিলে? আমি সহ্য করতে পারব না।’
কেমন দৃঢ় গলা তাহিয়ার। অভীক শব্দ করে হেসে ফেলল। এক হাতে আগলে নিল প্রিয়তমাকে। তারপর কপালে চুমু খেল। প্রসন্ন গলায় বলল,
‘ হাজার মানুষের নজর ডিঙিয়ে আমার নজর একজনের উপরই যাবে। যে আমার জন্য বৈধ, যার বিচরণ আমার সবখানে। সে ছাড়া অন্য কেউ নজর দিয়ে বিশেষ লাভ করতে পারবে না। সে দিলে ভিন্ন ব্যাপার। ‘
অর্থবহ হাসল অভীক। তাহিয়াও হাসল,
‘সেই ভিন্ন ব্যাপার আর অভিন্ন রইল কই?’

অভীক উত্তরে কী যেন বলল তাহিয়ার কানে কাছে মুখ নিয়ে। লজ্জায় লাল হলো তাহিয়া। অভীক সেই লজ্জারাঙা মুখ পানে চেয়ে রইল। দোয়া পড়ে ফুঁ দিল। আল্লাহ প্রিয় মানুষটাকে সবসময় সুখী করুক, হাসিখুশি রাখুক। লজ্জার মাত্রা এড়াতে বলল,
‘ এটাও টিফিনের টাকায়?’

‘ না। রিংটা বাগদানের। মা আপনার জন্য কিনেছিলেন। বাগদান হয়নি, আপনার রিং রয়ে গেছে আলমারিতে। আমার হাতের রিং দেখে মাই বললেন, রিংটা পরাতে। আমারও মনে হলো, সিলমোহরের সময়টা আজ হলে মন্দ হয় না। শুভক্ষণে দেরি করতে নেই ভেবে কাল বিলম্ব করে এনে পরিয়ে দিলাম। খুলবেন না।’

অভীক হেসে বলল, ‘প্রশ্নই আসে না।’

তাহিয়া খুশি হলো। অভীকের হাতের সাথে নিজের হাত রেখে দেখল, ক্যামরাবন্দী করল। কত পাগলামী ওর। অভীক দেখে গেল, হেসে গেল। মোনাজাতে দু’হাত তুলে প্রিয়তমার জন্য দোয়া করল। নাস্তা করে অভীক চলে গেল।

রাতের খাবার খেয়ে ল্যাপটপ হাতে সোফায় গিয়ে বসেছে অভীক। অবসর সময়টা ফেসবুকিং করে পার করে ও। নিউজফিড স্ক্রল করতেই চমকপ্রদ একটা পোস্ট সামনে এলো।
পোস্টটা ‘তাহিয়া তারান্নুম’ নামক একাউন্ট থেকে এসেছে। সেখানে ট্যাগ, ম্যানশন দুটোই করা হয়েছে। পোস্টটা মূলত, একটা ছবি। ছবিতে এক জোড়া হাত দেখা যাচ্ছে, একটা নারী হাত, অন্যটা পুরুষের হাত। পুরুষের হাতটা নারীর হাত ধরে আছে। দুই হাতের অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে রূপালী রিং। ছবির ক্যাপশনে লেখা,
‘ বন্ধন বেঁধেছে নীল কাগজে
সীলমোহর পড়েছে অনামিকাতে
অনুরক্তির সংস্পর্শে বসন্ত নেমেছে হিয়াতে
কান ভারি সুখের গুঞ্জনে
মুগ্ধতার রংতুলি চোখের ক্যানভাসে
মাতল জীবন প্রেমোদ্দীপকে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন অর্ধাঙ্গের আগমনে।’
[©আফিয়া আপ্পিতা]

ক্যাপশনটা পড়তে গিয়েই অভীকের চোখে ভর করল একরাশ বিস্ময়, মুগ্ধতা। ঝাকে ঝাকে আনন্দ পাখির দল উড়ে এসে বসল পরক্ষণেই। অভীক ভ্রু উঁচাল। ঠোঁটের কোণে নজরকাড়া হাসির বিচরণ।

সেই ক্ষণে বসার ঘরে উপস্থিত হলো অবনী। গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাবার বাড়িতে উঠেছে। বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাইকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। ভেতরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ তোর চেহারার অবস্থা তো সুবিধার না। ঘটনা কী অভী?’

অভীক ল্যাপটপটা বন্ধ করে বলল,
‘তোদের কাঁপা-কাঁপিরানী তার শর্ত ভঙ্গ করে বিয়ের কথা জানিয়ে দিয়েছে সবাইকে।’
কথাটা বলার সময় অভীকের চেহারায় যে উৎফুল্লতা খেলে গেল, তা দেখে অবনী আন্দাজ করে নিল, তাহিয়ার এই কাজটা তার ভাইকে ঠিক কতটা খুশি দিয়েছে। অবনী ভাইয়ের পাশে বসল। অভীকের কাধ চাপড়ে বলল,
‘ গ্রেট নিউজ। তবে, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বাদবাকি শর্তটাও ভেঙে যাবে খুব শীঘ্রই। ঘরের বউ ঘরে ফিরবে।’

‘ নো চান্স।’ উঠে দাঁড়াল অভীক। এখন একটা কল না করলেই নয়। অবনী ভ্রু কুঁচকাল, অভীক হেসে রুমের দিকে এগুতে এগুতে কল দিল কাঙ্খিত নাম্বারে। ফোনটা বোধহয় হাতেই ছিল। সাথে সাথেই রিসিভ হলো। অপাশ থেকে সুরেলা নারীকন্ঠটা ‘হ্যালো ‘ বলে উঠল। উত্তরে অভীক গভীর স্বরে আবৃত্তি করল,

‘ ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,
রাত জেগে পড়ার টেবিলে বসে আছো,
ঘুম আসছে না তোমার।
হঠাৎ করে,
ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম – ভালোবাসো?
তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি।

ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,
মাথার উপর তপ্ত রোদ,
বাহন পাওয়া যাচ্ছে না
এমন সময়,
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে যদি বলি-ভালোবাসো?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার দিকে তাকিয়ে
কাঁধে হাত দিয়ে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি

ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম
শতব্যস্ত হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো খুব অসুস্থ তুমি
জ্বরে কপাল পুড়ে যায়,
মুখে নেই রুচি, নেই কথা বলার অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?
নাকি তোমার গরম শ্বাস আমার শ্বাসে
বইয়ে দিয়ে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি।

ধরো সব ছেড়ে চলে গেছো কত দূরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছো
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-ভালবাস?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি।

যেখানেই যাও, যেভাবেই থাকো,
না থাকলেও দূর থেকে ধ্বনি তুলো
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
দূর থেকে শুনবো তোমার কন্ঠস্বর,
বুঝব তুমি আছো, তুমি আছো
ভালোবাসি, ভালোবাসি।

‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ এর ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ কবিতার কিছু অংশ এলোমেলো করে মনের মাধুরি মিশিয়ে আবৃত্তি করল অভীক। ফোনের অপাশে নিশ্চুপ বসে আছে তাহিয়া। হৃদসংযুক্ত মানুষের আবেগী স্বরে আবৃত্তি করা হৃদয়স্পর্শী কবিতায় ওর হৃদয়স্পন্দন বেড়ে গেছে। তাহিয়ার মনে হয় কাউকে ভালোবাসার জলে ডুবানোর জন্য অভীকের এই আবেগীয় স্বরে কবিতা আবৃত্তিই যথেষ্ট। তাহিয়া চোখ বন্ধ করে হেসে বলল,
‘ ভালোবাসা বলার নয়, অনুভবের। আমি বলব না, আমার লাজুক স্বরে ওই শব্দ বেরুবে না। গভীর চোখে তাকাব। তুমি নাহয় আমার চোখেই পড়ে নিও। ‘

অভীক বয়ে চলা ভালো লাগা নিয়ে বলল,
‘তবে তাই হোক। সবাই তো বলে, আমরা না হয় অনুভব করেই জীবন পার করলাম। ‘

থেমে বলল,
‘শুনো, কাল থেকে একসাথে কলেজ যাব।’

‘স্যারের বউয়ের আপত্তি নেই।’

প্রেমোদ্দীপক কথোপকথন চলতে থাকল। রাত গভীর হলো, কথার সমাপ্তি টেনে কলের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ল তাহিয়া। ওর নিঃশ্বাসের গভীরতার শব্দ আন্দাজ করে হাসল অভীক, কাটল ফোন। ঘুম নামল ওর চোখে। নামল সূর্য পূর্বাকাশে। অভীক তাহিয়াকে গেইট থেকে গাড়িতে তুলে নিল। ক্যাম্পাসের পথ ধরে পাশাপাশি হেটে গেল দু’জন।

সাধারণত, কলেজ, ভার্সিটিতে একেক ডিপার্টমেন্ট একেকটা গ্রহের মতো। একটার সাথে অন্যটার কোন সংযোগ নেই। এক ডিপার্টমেন্টে ঝড় গেলে ও অন্য ডিপার্টমেন্ট অবধি খবর যায় না। এক ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টের পা অন্য ডিপার্টমেন্টে পড়েনা। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ছাড়া কেউ কাউকে চিনে ও না।
সবাই যে যার মতো থাকে। নেতিবাচক কোন ঘটনা ছাড়া কোন ঘটনায় পুরো কলেজে তোলপাড় বয়ে যায় না। অভীককের পরিচয়ের গন্ডি ওর ডিপার্টমেন্ট অবধি, তাহিয়ার ও তাই। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা ওদের চিনে না। গ্যালারিতে বসে থাকা হাজার ছাত্রছাত্রীদের কেউ ওদের চিনল না। বিশেষ নজর পড়ল না।

সিড়ির বেয়ে উঠতে উঠতে অভীক তাহিয়াকে সতর্ক করল ,
‘সবাই যেহেতু জেনে গিয়েছে এবার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হবে সবার। আমার ক্লাসে তোমার মুখভঙ্গি কেমন হবে পরখ করবে। নিজেকে সংযত রেখো। খেয়ালদের এদিক ওদিক ছেড়ে দিলে শেষে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখবে। আমাকে ডিস্ট্রেক করার চেষ্টা করবে না।’

কাধে ঝুলানো ব্যাগপ্যাক থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করল তাহিয়া। প্যাকেট ছিঁড়ে চকলেট বারে কামড় বসিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
‘ তোমাকে দেখলেই আমার খেয়াল এদিক ওদিক হয়। না চাইতে ও ডিস্ট্রেক করতে হয়। এক আধটুর অনুমতি দিতেই পারো তুমি। এতে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। ‘
অভীক ও বাঁকা হাঁসল,
‘ডিস্ট্রেক করার অপরাধে এক আধটু ধমক দেয়ার অধিকার তো রাখিই আমি। প্রয়োগ করলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না।’

তাহিয়া চোখ রাঙাল, ‘এতগুলো স্টুডেন্টের সামনে আমাকে ধমক দিলে আমি জীবনেও তোমার সাথে কথা বলব না।’

‘তুমি ধমক দেয়ার মতো কাজ না করলে দিব না। যতযাই হোক, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবন এক করব না আমি। ক্লাসটাইমে আমি তোমার শিক্ষক। সবকিছু আগের নিয়মে চলবে, বউ বলে কিছুর নড়বড় হবে না। ‘
অভীকের স্বরটাও দৃঢ়। তাহিয়া ভেংচি কাটল,
‘ ধমক দিলে সবাই তোমাকে খারাপ বলবে। স্টুডেন্টরা বলবে, শিক্ষকবর হিসেবে তাদের স্যার ভালো না। বউকে ধমকায় শুধু। ‘

‘ সবাই এটাও বলবে ছাত্রীস্ত্রী হিসেবে তুমি ভালো না। স্বামীকে ডিস্ট্রেক করো, ফাঁকিবাজি করো।’ ঠোঁট চেপে হেসে বলল অভীক।
‘যত যাই হোক, তুমি আমাকে ধমকাবা না।’
‘তুমি আমাকে ডিস্ট্রেক করবে না। তাহলেই ধমকাব না।’

তৃতীয় তলায় চলে এসেছে ওরা। অভীক নিজেকে সংযত করে বলল,
‘ ডিপার্টমেন্ট সামনেই। উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। স্বাভাবিক থাকো। ‘

তাহিয়া ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘সময় এসেছে, জাঁদরেল হওয়ার। ভ্রু কুঁচকাও, জাঁদরেল মুখভঙ্গি করো। কুইক!’

অভীক মুখে গম্ভীরতা টানল। গম্ভীরমুখেই কৌতুক করল,
‘আমি তোমার শিক্ষক, সম্মান দিয়ে কথা বলো। ‘
‘আমি তোমার ছাত্রী। আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করো।’ কৌতুকের চেইন টানল তাহিয়া।

অভীক স্বরটাকে গম্ভীরতার আদলে নিল। পেশাগত গম্ভীরতা টেনে বলল,
‘মিস তাহিয়া, কিছু বলছিলেন আমায়?’

তাহিয়া মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘হজম হচ্ছে না, বাদ দাও।’
‘ ফাজিল!’ বিয়ের প্রথমদিকের সেই ভঙ্গিতে বলল অভীক। তাহিয়াও রাগের ভান করে বলল,
‘জাঁদরেল।’

ডিপার্টমেন্টের প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছল ওরা। অভীকের গায়ে ব্রাউন ব্লেজার। একটা বোতাম লাগানো। ব্লেজারের লাগানো বোতাম খুলে হালকা কেশে সামনের দিকে পা বাড়াল, পায়ের গতি কিঞ্চিৎ দ্রুত। ছাত্রছাত্রীদের সামনে শিক্ষকদের ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে হয়, এখন স্ত্রীর হাতে হাত রেখে ডিপার্টমেন্টে প্রবেশ করা দৃষ্টিকটু লাগবে। কারণ এটা ব্যক্তিগত নয়, পেশাগত স্থান।
তাহিয়া পিছনে পড়ে গেল। চকলেট মুখের সামনে ধরে কামড় বসিয়ে পায়ে পায়ে এগুলো।

ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী দাঁড়ানো। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে। বলা বাহুল্য, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু অভীক তাহিয়া।
গতকাল অভীককে ট্যাগ করা তাহিয়ার পোস্টটা অভীকের ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা ডিপার্টমেন্টে সিরিয়র ভাইয়েরা দেখে যায়। সেখান থেকে নেয়া স্ক্রিনশট চলে যায় ডিপার্টমেন্টের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে। ডিপার্টমেন্টের প্রতি ব্যাচ এবং সব ব্যাচের একসাথে কয়েকটি চ্যাটিং গ্রুপ থাকে। সেখানে শিক্ষকরা থাকেন না, শুধু ছাত্রছাত্রীরা থাকে। পড়ালেখার আলোচনার পাশাপাশি ডিপার্টমেন্ট কেন্দ্রিক সব ধরনের আলোচনা হয়ে থাকে। ওখানেই ঘটনা জানাজানি হলো। বিস্মিত হলো স্যারের বিয়ের কথায়। কৌতূহলী হয়ে ওদের একসাথে দেখতে জড়ো হলো। অনেকে কলেজ না আসার হলেও এসে গেল।

ডিপার্টমেন্টের প্রবেশদ্বারে অভীককে দেখে সবার আলোচনা ইতি টানল। বিশেষ নজরটা পড়ল তখন। সবাই আগ্রহী চোখে তাকাল অভীকের পানে, পরপরই তার পেছনে আসা তাহিয়ার পানে। অভীক যথারীতি গম্ভীরমুখে অফিসরুমে ঢুকে গেল। তাহিয়া নির্বিকারচিত্তে চকলেট খেতে খেতে আসছে। ওরা এই দম্পত্তির প্রবেশভঙ্গি ভিন্ন আশা করেছিল, দুজনের মাঝে কোন যোগসূত্র না পেয়ে অবাক হলো।

সবার চাক্ষুষ চাহনি তাহিয়া বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলল। বিয়ের দিন বউয়ের দিকে যেভাবে মানুষ তাকিয়ে থাকে সেভাবে তাকিয়ে আছে সবাই।
এক মুহুর্তে জন্য ভুলে গিয়েছিল গতকাল রাতের স্ট্যাটাসের কথা। মনে হতেই ভ্রু নাড়াল। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আগাল। ধীরে পা বাড়াল সামনের দিকে। ওর নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে, দুই পাশে মানুষ দাঁড়ানো। সবার দৃষ্টি ওর দিকে।

মীরা শৈলী এগিয়ে এলো। মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘ আজকের ব্রেকিং নিউজ কী জানিস? লেকচারার অভীক আহমেদ বিয়ে করেছেন তারই ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তাহিয়া তারান্নুমকে। চারদিকে তোদের চর্চা চলছে। এত চর্চা হচ্ছে যে আমার মনে হচ্ছে, ঘটনা দেশ ছড়িয়ে বিদেশ গিয়ে পৌঁছেছে এতক্ষণে। ভয় হচ্ছে, কখন না আবার পুতিন ফোন দিয়ে বলে, অভীকের ছাত্রী বিয়ে করায় আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করছি। শীঘ্রই বিয়ের উপহার হিসেবে পরমাণু বোমা পাঠাব।
তুই তো আকাশে টিমটিমে জ্বলা তারা হয়ে গেছিস রে তাহিয়া।’

মীরার বলার ভঙ্গিতে তাহিয়া হেসে ফেলল। শৈলী বলল,
‘গত তিনদিন মিয়াবিবি কোথায় ছিলি? একজন কলেজে নাই, আরেকজন নেটওয়ার্কেই নেই। হানিমুন টানিমুনে গেলি না কি!’
‘ওদের গ্রামে গিয়েছিলাম।’
মীরা বলল, ‘হানিমুন না গ্রামিমুনের গেছে ওরা। ‘

ওদের কথার মাঝে মৌ এসে বলল,
‘তাহিয়া সবাই বলাবলি করছে অভীক স্যারের সাথে না কি তোর বিয়ে হয়েছে?’
তাহিয়া হেসে বলল,
‘সবাই যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই হয়েছে। স্যারের বউ আমি। ম্যাম বলবি। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।’

মৌ অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই আর স্যার…! কিভাবে কী!’
এক সিনিয়র আপু এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের লাভ ম্যারেজ?’

‘তোদের লাভস্টোরি শুনা। কীভাবে কী হলো?’
‘স্যার তোকে বকে না? ব্যক্তিগত জীবনে কেমন? ল্যাভ ম্যারেজ না এরেঞ্জ ম্যারেজ? ‘
‘আর মানুষ পেলি না? স্যারের মতো মানুষকে বিয়ে করলি? তোর জীবন শেষ। কী ভেবে করলি?’

হাজার কৌতুহলী প্রশ্ন এলো তাহিয়ার দিকে। তাহিয়া হাসল। কেবল একটা প্রশ্নের উত্তর দিল,
‘তোদের স্যারের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিঃসন্দেহে আমি ভাগ্যবতী। ‘

তারপর চলে গেল ক্লাসে। সবার কৌতুহল বাড়ল। অভীকের ক্লাসে এক দেড়শো স্টুডেন্ট থাকে। আজ সেখানে কম হলেও তিনশো স্টুডেন্ট হলো। অন্য বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ও এসে বসেছে, এ যেন আজ সিনেমা দেখা হবে। শিক্ষক ছাত্রী প্রেম কিবা বিয়েকে মানুষ বেশ মজার সাথে উপভোগ করে। সে যদি হয় একি ক্লাসের তবে তো কথাই নেই। ক্লাসে তাহিয়া বসেছে পিছনের দিকে। অভীক ভিন্নচোখে একবারও তাকায়নি তাহিয়ার দিকে। তাহিয়ার চারপাশে বসা সবাই অন্তর্ভেদী নজরে তাহিয়াকে পরখ করছিল। এত লোক সমাজের মাঝে বসে অভীকজে ডিস্ট্রেক করার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই হলো না।
রস মাখিয়ে বলার মতো কোন ঘটনা ঘটল না। আবার হতাশ হলো সবাই। অপেক্ষায় রইল কোন চমকপ্রদ দৃশ্য দেখার। তাহিয়া ওদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ করতে চাইল। ও ব্যাপারগুলো উপভোগ করছিল। রাতে কলে কথা বলার সময় অভীককে সবার মনোভাবের কথা বলে হেসে কুটিকুটি হয়েছিল।

গ্রাম থেকে ফেরার পর থেকে তাহিয়ার মাঝে শূন্যতা এসে ভর করেছে। সময়ের পালাবদলে বাড়তে লাগল। শূন্যতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পরপরই টের পেয়েছে তাহিয়া। ওর মনে হতে লাগল, মানুষটাকে ওর দরকার, ভীষণ দরকার। সারাক্ষণ, সারাজীবন দরকার। সারাক্ষণ মানুষটার পাশাপাশি কাছাকাছি থাকতে চায় ওর মন। এই যে ফোনে কথা বলা, বিকেলে ঘুরতে বেরুনো, দুই এক ঘন্টা একসাথে কাটানো এই সময়টা যথেষ্ট না। সময়ের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। হুটহাট মন কেমন করে, অভীকের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেশক্তি বড্ড লোভী। অল্পতে তুষ্টি হয়না, আরও চাই আরও চাই করে।
গ্রামের কাটানো দিনগুলোর মতো সুখময় দিন কাটানোর ইচ্ছেটা প্রবল। দ্বিতীয়বারের মতো আফসোস হলো, নিজের শর্তের জন্য। শর্তটা না রাখলে এখন অভীকের সাথে থাকতো ও। ইচ্ছে করছে শর্ত ভেঙে চলে যেতে। সপ্তাহ কাটল এই চাপা শূন্যতার মাঝে। তাহিয়া বড্ড আবেগী আর জেদী প্রকৃতির মানুষ। মন যা চায়, তা তার চাই-ই চাই। আকস্মিক দূরত্ব কমানোর ইচ্ছে জাগল। ইচ্ছেদের দমিয়েও কাজ হলো না। বাধাহারা হলো, দ্রুত ছুটতে লাগল। এক পর্যায়ে ধৈর্যহারা হলো মন। অভীককে এক বিকেলে অভীককে ফোন দিয়ে বলল,
‘ ক্যাফেতে আসো। কথা আছে।’

যথারীতি ক্যাফেতে এলো অভীক। তাহিয়া আগেই এসে টেবিল বুক করে বসেছে। অভীক এসে বসে বলল,
‘ঘটনা কী মিসেস? আজ এত জুরুরি তলব?’

তলবের কারণ মুখ দিয়ে বের হলো না তাহিয়ার। স্নায়ুবিক দৌর্বল্যগ্রস্থ হয়ে পড়ল। কিভাবে বলবে কথাটা ভেবে পাচ্ছেনা। নিজেকে অস্বাভাবিক লাগছে ওর। যথাসাধ্য চেষ্টা করল স্বাভাবিক রাখার। সক্ষম হলো এক পর্যায়ে। কৃত্রিম হাসি টেনে বলল,
‘এমনিই ডেকেছি। আজ শুক্রবার ক্লাসে দেখা হবে না। ভাবলা এক কাপ কফি খাই একসাথে। ‘

‘আবহাওয়া তো ভিন্ন মনে হচ্ছে।’ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল অভীক। তাহিয়া প্রসঙ্গ বদলাতে টেবিলের উপর থাকা মেন্যুকার্ড হাতে নিল। চোখ বুলানো পুরো কার্ডে। হতাশ সুরে বলল,
‘গ্রীণ টি তো নেই। তুমি কি নিবে?’
‘ক্যাপাচিনো । ‘
‘তোমার জন্য ক্যাপাচিনো আর আমার জন্য কোল্ড কফি অর্ডার দিই। আর কিছু নিবে তুমি?’

সাধারণত, বাইরে খেতে গেলে অর্ডার দেয়ার দায়িত্ব অভীকের কাধে থাকে। এতে তাহিয়া দায়সারা। অভীক ওকে জিজ্ঞেস করে করে অর্ডার দেয়, কিংবা নিজের পছন্দমতো। কখনোই নিজ থেকে অর্ডার দেয়না তাহিয়া। আজ কী হলো! একটু বেশিই খাতিরযত্ন করছে মন হচ্ছে? ঘটনা কী! অভীক গোয়েন্দা চোখে তাকাল তাহিয়ার পানে। চাক্ষুষ চোখে পরখ করে বলল,
‘না।’

তাহিয়া ওয়েটার ডেকে অর্ডার কনফার্ম করল। অর্ডার আসা অবধি কোন কথা বলল না। ইতি-উতি করতে লাগল। অভীক ভ্রু কুঁচকে দেখে যাচ্ছিল। মনে মনে কারণ খুঁজছিল। কোনভাবেই সমীকরণ মিলছেনা ওর। ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। তাহিয়া স্ট্র নাড়ছিল শুধু। অভীক প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে বলল,
‘তোমার আজ হয়েছেটা কী বলো তো? অদ্ভুত ব্যবহার করছো কেন?’

তাহিয়া তড়িৎ মাথা নাড়াল। স্ট্র মুখে নিল। ক্যাপাচিনো ভরতি কাপের পিরিচে একটা চামচ দেয়া হয়েছে। অভীক চামচ দিয়ে ফোমগুলো গুলে নিচ্ছিল। আকস্মিক তাহিয়া বলে উঠল,
‘আমি বাসায় যাব।’

তৎক্ষনাৎ কথাটার সঠিক মর্মার্থ বুঝল না অভীক। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এসেছো তো পাঁচমিনিট ও হয়নি, এখনই চলে যাবে!অন্তত কফিটা শেষ করে নাও। তারপর আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিব।’

আবার চামচ নাড়ানোয় মন দিল অভীক। তাহিয়া ইতস্ততভাবে বলল,
‘আমি আমার বাসার কথা বলছিনা।’

‘তাহলে?’
প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে জানতে চাইল অভীক। তারপর চামচ পিরিচে রেখে কাপে চুমুক দিল। তাহিয়ার উত্তরের অপেক্ষায় রইল। এই মেয়ের কান্ড কারখানা সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

‘আমাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলছি।’
লাজুক স্বরে বলল তাহিয়া। দৃষ্টি ঠান্ডা কফিভরতি গ্লাসে।

অভীক এবারও তৎক্ষনাৎ বুঝল না। সেকেন্ড দশেক লাগল কথাটা বুঝতে। বুঝে উঠতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তাহিয়ার দিকে। এত তাড়াতাড়ি কথাটা আশা করেনি ও। কিছুক্ষন কথা বলতে পারল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল,
‘আ ইউ শিওর?’

তাহিয়া মাথা নাড়ল। অভীক বিস্ময়ে ভ্রু নাড়ল। ভেতরটা খুশিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে দিনটা এসেছে, এসেছে সুযোগ। সেই সুযোগ, যার অপেক্ষায় ছিল অভীক। বহুপ্রতীক্ষিত সুযোগ। অভীক ভেবেছিল মাসছয়েক সময় লাগবে ভেবেছিল সময়টা আসতে। কিন্তু অতিব আবেগী তাহিয়া একটু তাড়াতাড়িই এগিয়ে নিয়ে এসেছে সময়টাকে। অভীক প্রাণবন্ত হাসল। আজ ওর খুশির দিন, আনন্দের দিন। আজ ওর দিন। প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করার দিন। নতুন এক অগ্রযাত্রার দিন। অভীক কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে কৌতুকের সুরে বলল,
‘ তিনবছরের অনড়তা তিনমাসেই শেষ! কিভাবে কী হিয়া?’

‘ তুমি তো জানোই, আমার আবেগটা একটু বেশিই।অল্পতেই আবেগী হয়ে যায়। এখনো হয়ে গেছি। আই কান্ট লিভ উইদাউট টাইপ ফিলিংস হচ্ছে আমার। অনুভূতি গুলোকে দমাতে পারছিনা। কী করব?’ লজ্জা, হতাশা মাখামাখি স্বরে বলল তাহিয়া।

মানুষ যখন কাউকে ভীষণ আপন ভাবে, তখন এই অনুভূতিটা হয়। এটা নিচক আবেগ। এই আবেগ শুনতে যতটা কঠিন মনে হয়, একে দমানো ততটা কঠিন বা অসম্ভব না। সময় মানুষকে সব শিখিয়ে দেয়। সময় মানুষকে পোষ মানিয়ে নেয়। মন থেকে চাইলে সব পারা যায়।
ওদের দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। তাহিয়া চাইলে এতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারে, বাড়তি অনুভূতিগুলো দমিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু ও তা করছে না, করার চেষ্টাই করছেনা। আবার বলছে পারছেনা। মেয়েটা আবেগী বলেই অসম্ভব মনে হচ্ছে। তাহিয়ার ইচ্ছাগুলো অভীকের মনে তো কত আগে এসেছে, ও দমিয়ে রেখে দিব্যি চলছে না? তাহিয়াকে বুঝতে দিচ্ছে? না, কারণ সব আবেগ সব জায়গায় দেখানো উচিত না। জীবনটা আবেগের নয় বিবেকের। আবেগে ভেসে গিয়ে বাস্তবতা ভুললে চলবে না। জীবনে প্রেম ছাড়া ও হাজার কাজ আছে, হাজার লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে। যা পূরণ করতে হয়। অভীক বিড়বিড় করে বলল,
‘তোমার আবেগটা একটু বেশি। মাত্রাতিরিক্ত। কিন্তু বাস্তবতাটা যে আরও কঠিন। অতি আবেগ একদিন দুঃখের কারণ হতে পারে। এই দুঃখটাই আমি চাইনা না হিয়া। দুঃখিত।’

মনের কথা মনে চেপে কৌতুকের সুরে বলল,
‘কী জামাই পাগল বউরে আমার ! লোকে জানলে হাসবে। বউ পাগল করার দায়ে জেল টেলে ঢুকিয়ে দেয় না কি, এই ভয়ে আছি। সাংঘাতিক হিয়া!’

‘উচিত হবে একদম। গ্রামে নিয়েছো কেন আমায়? এখন আমি থাকতে পারছি না। সব দোষ তোমার।’ রেগে বলল তাহিয়া। অভীক হাসল,
‘দিওয়ানা হয়েছো তুমি, অথচ দোষটা আমার! চমৎকার!’

‘তুমি আমাকে হিপনোটাইজ করেছো। কীসব পাগলামী করছি আমি! নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আমার। মনটা তুমি তুমি করছে। কিছু ভালো লাগছে না। এর জন্য তুমিই দায়ী। আক্রোশ ঝরে পড়ল তাহিয়ার গলা থেকে।

প্রথম প্রেম, আর প্রেম বিয়ের শুরুর দিকে মেয়েদের মন অতিরিক্ত উড়নচণ্ডী হয়। আবেগে ভাসে, কল্পনার জগতে হারায়। সবকিছু ফ্যান্টাসি মনে হয়। গল্প সিনেমায় দেখা সোনালী সময়ই তাদের কাম্য থাকে। না পেলে হতাশ হয়। পাগলামো করে। তাহিয়ার এখন সেই দশা। অভীক আবার হাসল, মৃদু। বলল,
‘এখন তুমি আমাকে কী করতে বলছো?’

‘ম্যানেজ করতে। ‘ আশাভরা গলায় বলল তাহিয়া।

অভীক লোকের ধার ধারে না। তাও বলল,
‘লোক কী বলবে? তিন বছরের কথা বলে তিনমাসে বউ নিয়ে হাজির!’
‘তোমার বউ তুমি বাসায় তুলবে, কার কী তাতে?’
‘শর্ত তো আমার ছিল না। তুমি আপিল করেছো, তোমার মা পেশ করেছে উচ্চ আদালতে। উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। তারপর আমি সায় দিয়েছি। এতে আমার ভূমিকা নেই খুব একটা। তোমরা বউ শ্বাশুড়ি জানো।’

‘তুমি আন্টিকে বলো। ‘
‘ অসম্ভব। বউ পাগল বলবে আমায়। আমি লজ্জার ভাগি হতে পারব না। তুমি তোমার শ্বাশুড়িকে বলো। শর্ত আদান প্রদান তোমাদের মাঝেই হয়েছে।’

অভীক নির্বিকার চিত্তে কফিতে চুমুক দিচ্ছে একের পর এক। তাহিয়া ওর দায়সারা ব্যবহার দেখে অবাক হলো। ও ভেবেছে অভীক খুশি হবে ওর সিদ্ধান্তে। তাহিয়া অভীকের হাত টেনে মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘তুমি এমন করছো কেনো? তুমি শুধু আন্টিকে বলো, বাকিটা আমি সামলে নিব।’

‘আমি পারব না।’

‘কেন?’

অভীক কৌতুকের স্বরে বলল,
‘ফেইল করা মানুষজনকে আমি আমার সংসারে নিই না। আমার সংসার করতে ও শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগবে।’

তাহিয়া করুণ স্বরে বলল,
‘তুমি কি সত্যিই চাইছো না আমি এখন ওই বাসায় যাই?’

অভীক নিরব রইল। উত্তর দিল না। তাহিয়ার মনোক্ষুণ্ণ হলো। মলিন হলো মুখ। বিস্মিত হলো চোখ, পানি এসে ভীড় জমাল। কোনমতে বলল,
‘মূল কারণ কী?’
‘পড়াশুনা। আমি চাইছি তুমি শর্ত মাফিক গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমার সংসারে আসো। এই শর্তের ভঙ্গ হোক আমি চাইছিনা।’ অভীকের স্বরটা গম্ভীর।

তাহিয়া অবুঝ গলায় বলল,
‘পড়াশুনা ভালো লাগে না আমার। আমি পারব না পড়াশোনার পেছনে পরে থাকতে। পড়ালেখা করে কী হবে? আমি তো কোন চাকরিবাকরি করব না। তোমার কী কম আছে? আমি দিব্যি বসে খেতে পারব।’

তাহিয়ার হাতের বাধন থেকে নিজের হাতে ছাড়াল অভীক। পরপরই তাহিয়ার হাত ধরে কোমল গলায় বলল,
‘আমার স্ত্রী হওয়ার আগে তুমি একটা মেয়ে, তোমার মায়ের বড়ো সন্তান। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে কাজে নেমেছেন আন্টি। বয়স হচ্ছে এখন, অসুস্থতাও জেঁকে ধরেছে। সার্জারি হলো কদিন আগে। এ শরীর নিয়ে আর কতকাল করবেন? তুহিন ও ছোটো। ওর পড়ালেখা শেষ করে প্রতিষ্ঠান হতে অনেক দেরি। এতসময় অবধি আন্টির পক্ষে কাজ করাটা সম্ভব হবে না। উনার বিশ্রামের প্রয়োজন। মাকে একটু বিশ্রাম দিয়ে সংসারের হাল ধরা বড়ো সন্তান হিসেবে তোমার কর্তব্য। নিজের জন্য না হলেও তাদের জন্য পড়ালেখাটা করো। মায়ের জন্য কিছু করো। আমার সামর্থ আছে আন্টিদের ফিনানশিয়ালি হেল্প করা, কিন্তু আন্টির আত্মসম্মানবোধ প্রবল। আমার সাহায্য গ্রহণ করবেন না। কারণ সবার চোখে এটা বেমানান। মানানসইটা তোমার হবে। আংকেলের মৃত্যুর পর থেকে আন্টি তোমার জন্য করেই যাচ্ছেন। আর কত? আন্টির কষ্টটা বুঝো, পড়াশুনা শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। একদিন গিয়ে যেন আন্টির মনে হয়, তিলে তিলে আয়ের টাকায় মেয়েকে পড়ালেখা করানোটা সার্থক। আন্টি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত দেখার স্বপ্ন দেখেন। তার স্বপ্ন পুরণ করো?
তুমি জানো? উনি ভবিষ্যতে নিয়ে চিন্তিত? উনাকে স্বস্তি দাও, বুঝাও যে, তার পাশে তুমি আছো, তুমি তার দেখাশুনা করবে। আন্টির জন্য হলেও তোমার পড়াশোনা করা উচিত।’

অভীক থামল। কফিতে আরেক চুমুক দিয়ে বলল,
‘পড়ালেখা তোমার, মা ভাই তোমার, দায়িত্ব ও তোমার। এতে আমার সম্পৃক্ততা নেই। পড়ালেখা করলেও তুমি আমার স্ত্রী, না করলেও তুমি আমার স্ত্রী। আমার সব আয় তোমাদের ঘিরে। তুমি বসে খেতে পারবে, এতে আমার কোন সমস্যা নেই। তোমার পড়ালেখার সাথে আমার কোন স্বার্থ জড়িত নেই। এটা সম্পূর্ণ তোমার জীবনগত ব্যাপার।

আমি আমার বাবা মাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। বাবা রিটায়ার্ড করবেন আগামী বছর। তারপর পুরো সংসার এসে পড়বে আমার কাধে। আমি বেশ আনন্দের সাথে সংসারের ভার বহন করব। কারণ এটা আমার দায়িত্ব, বাবা মায়ের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি। একজন সন্তান হিসেবে আমার যেই দায়িত্ব আছে, এই দায়িত্বটা তোমার উপর ও অর্পিত আছে। বাবা মাকে দেখাশুনো করা দায়িত্ব সব সন্তানের কাধে অর্পিত। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে। আর্থিকভাবে বাবাকে সাহায্য করাও এর মধ্যে পড়ে। বাবা মায়ের সামর্থ যতদিন থাকে ততদিন পরিশ্রম করে সন্তানদের খাওয়ান, বার্ধক্য জেঁকে বসলে সম্ভব হয়না বলে পরিশ্রম ছেড়ে অবসর নেন। নির্ভর হন ছেলেমেয়ের উপর। তখন ছেলে মেয়ের উচিত বাবা মাকে খাওয়ানো। সব দায়ভার নিজের কাধে নেয়ার। তুহিন ছোটো মানুষ, ওকে ধরলাম না। দুই তিন বছর পর তুমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। মায়ের এত কষ্টের টাকায় পড়ে মাকে না সাহায্য করে ঘরে বসে থাকবে তুমি? তোমার কি উচিত নয় সংসারের ভার তুলে নেয়া?’

প্রশ্ন তুলে রাখল তাহিয়ার জন্য। তাহিয়ার অবুঝ মনে বুঝ আসতে লাগল। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। ও তো নিজের কথা ভাবছে, মায়ের জন্য তো ভাবেই নি। ছোটোবেলা থেকে দেখেছে মা ওদের কত কষ্ট করে মানুষ করেছে, ওর তো উচিত মায়ের জন্য কিছু করা। ভাবনাগুলো আপনাআপনি মাথায় আসার কথা ছিল, এলো না কেন? নিজের উপর রাগ হলো ওর। উত্তর দিল না তাহিয়া।

অভীক বলল,
‘এখন তুমি আবেগী হয়ে পড়ালেখা ছাড়তে চাইছো। আচ্ছা ছেড়ে দিলে। আমি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। ছুটিয়ে সংসার করলে, পড়াশোনা বন্ধ হলো। এরপর কী হবে?
আবেগ না বেশিদিন থাকে না। বিয়ের পর ‘ছ’মাস, একবছরের’ সোনালী সময়ের পর আবেগ কমে আসে। বাস্তবতা চোখে ভাসে। আন্টি রিটায়ার্ড হলেন। তুহিন বইয়ে আছে ডুবে। সংসার সামলামোয় হিমসিম খাচ্ছেন আন্টি। চিন্তিত মাকে দেখে মায়ের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করবে তোমার। কিন্তু তুমি কিছুই করতে পারবে না, কারণ আবেগের বশে নিজেকেই হারিয়েছো তুমি, সাথে পড়ালেখা টাও। পড়ালেখাটা থাকলে একটা চাকরির জোগাড় করা যেত। কিন্তু তখন তাও হবে না। তুমি দিশেহারা হয়ে যাবে। হাজার চেয়েও কিছুই করতে পারবে না। আমার সংসারে হাজার সুখ থাকা সত্ত্বেও মায়ে দুঃখ তোমাকে সুখে থাকতে দিবেনা। দিন শেষে তুমি নিজেকে দুঃখী পাবে, আজকের এই আবেগটা সেদিন তোমার আফসোস হবে। আমি তোমার এই আফসোস, এই দুঃখকেই চাইছিনা। আমি চাইছি তুমি সুখে থাকো, এখন, তখন, সবসময়। এর জন্যই পড়ালেখা করতে বলছি। আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করো হিয়া। পড়াশোনা করাটা তোমার জন্য বাধ্যতামূলক, চাকরিটাও। আমার জন্য না, তোমার মায়ের জন্য।’

তাহিয়ার আবেগী মনে মায়ের ভালোবাসার ভূত চাপল। পড়ালেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে ওর। বলল,
‘ পড়ালেখা তো তোমাদের বাড়ি থেকেও করতে পারব। ওখানে গেলে কী সমস্যা?’

‘আকাশের যত তারা, সংসারের তত ধারা। এই ধারা পড়তে গিয়ে পড়ালেখা হবে না। একটা বউয়ের অনেক দায়িত্ব থাকে, সেসব পালন করতে গিয়ে পড়ালেখা মন বসবে না তোমার। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চাইবে। আর সংসার, পড়াশোনা দুটো একসাথে সামলাতে হিমসিম খাবে তুমি। পারবে না। চাপ বেশি পড়বে। পড়ায় খারাপ করবে। সিজিপিএ এর মান ভালো না হলে এত কষ্টের পড়াটা কাজে আসবে না। তাই তোমার বাসায় থেকে পড়ো। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলে নিয়ে যাব। আবেগটাকে একটু দমাও, আবেগে জীবন চলে না। বিবেককে কাজে লাগাও। মনোযোগ দিয়ে পড়ো। এটা হচ্ছে আমার মতামত। এবার তোমার মতামত বলো, পড়ালেখা করবে না কি সংসারে মন দিবে। ‘
ঠান্ডা মাথায় কথা বলে আবার প্রশ্ন তুলে রাখল। তাহিয়া মাথা নাড়ল।

‘করব পড়ালেখা। ‘

অভীক প্রসন্ন হাসল, ‘আমি তোমাকে গাইড করব।’

‘বলা সহজ করা কঠিন’ কথার বাস্তব রূপ টের পেল প্রথমদিন অভীকের কাছে পড়তে গিয়ে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here