প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-২৫

0
961

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-২৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

প্রতিটা বংশে একজন রাগী, ঝগড়াটে, হিংসুটে, নিচু মন-মানসিকতার মানুষ থাকে। সে ছেলে, বোন উভয়েই হতে পারে। যে কিনা কারো সুখ সহ্য করতে পারেনা, সবার মাঝে দ্বন্দ্ব বাধায়। মুখের উপর কটু কথা বলে সবাইকে অপমান করার সুযোগ খুঁজে। অভীকদের বংশে এই মানুষটা হলো জাহানারা। তার স্বভাব সম্পর্কে কারো অজানা নয়। স্বভাব জেনেই সবাই তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। নীলিমাও ভয়ে ভয়ে থাকেন, এই বুঝি তার কোন দোষ খুঁজে নিয়ে সবার সামনে অপমান করে বসেন। বিয়ের পর এই ননদটাই তার জীবন নরক বানিয়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে বাসায় উঠেছেন তিনি। সেখানে গিয়েও কম করেন নি। এখন তার পুত্রবধূকে নিয়ে পড়েছেন। সবাই জাহানারার স্বভাব সম্পর্কে জানলেও তাহিয়া জানে না। নীলিমা সুযোগ খুঁজছেন তাহিয়াকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছেন না। আসতে না আসতেই জাহানারার সামনে পড়েছে তাহিয়া। চোখ দিয়েই বাষ্প করেছেন তিনি। অপমানের ঝুলি খুলে বসার আগেই নীলিমা আগ বাড়িয়ে বলল,
‘তাহিয়া, আম্মা তোর আসার পথ চেয়ে আছেন। আয় দেখা করবি। ‘

বলে এক প্রকার টেনে নিয়ে গেলেন শ্বাশুড়ির ঘরে। জাহানারারাও গেলেন পিছু পিছু। নীলিমা বুদ্ধি করে ছেলেকেও নিলেন সাথে। অভীকের উপস্থিতিতে তাহিয়াকে অপমান করার সাহস পাবেন না জাহানারা, এমনটাই ধারণা তার। সত্যিই পেলেন না। অভীক-তাহিয়া রেবুন্নেছার শিয়রে বসা দাদীকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করল। রেবুন্নেছার শরীরের অসুস্থতা জেঁকে বসলেও জবান সচল আছে। কথা বলতে পারেন। তাহিয়াকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। চেহারায় খুশির আভা ফুটিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। নাতিবউকে দেখে বেশ আনন্দিত দেখাল। নীলিমা দরজায় দাঁড়িয়ে জাহানারার দিকে তাকাচ্ছেন বারবার। জাহানারা চোখ মুখ কুঁচকে পরখ করছেন তাহিয়াকে। যে কোন সময় হামলে পড়বেন। এ যাত্রায় নীলিমা আবারও পদক্ষেপ নিলেন।

কিছুক্ষণ বসার পর ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ অনেক জার্নি করে এসেছিস তোরা, যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। দুপুরের খাবারের ও সময় হয়ে এসেছে, যখন তখন ডাক পড়বে। খেয়ে দেয়ে এসে বসিস আবার। অভীক, তাহিয়াকে নিয়ে তোর ঘরে চলে যা।’

অভীক স্ত্রীর পানে তাকাল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। চোখে মুখে ক্লান্তিভাব স্পষ্ট। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। প্রিয়তমার কথা ভেবেই উঠে দাঁড়াল অভীক। তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘তাহিয়া আসো।’

তাহিয়া উঠে দাঁড়াল। দাদীমাকে ওর বেশ ভালো লেগেছে। বাকি সবাই অপরিচিত। অচেনা লোক সমাজে থাকতে অস্বস্তি লাগছে কিছুটা। তাছাড়া শরীরটা ও ভেঙে আসছে। ধীর পায়ে অভীককে অনুসরণ করল। রেবুন্নেছা থাকা ঘরটা চার রুমের। চারপাশে বেড়া, উপরে টিন দেয়া, মেঝেতে কার্পেট বিছানো। ঘরটার সামনে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশে এই ঘরটার মতোই ছয়টা ঘর। অভীক উঠোন পেরিয়ে শেষ দিকে থাকা ঘরের দিকে এগুলো। নীলিমা আগে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন। অভীকের হাতে চাবি দিলেন। অভীক নীলিমা প্রবেশ করা ঘরটা পাশের ঘরের দিকে এগুলো। এ ঘরটা একবারে নতুন। কিছুদিন আগেই করা হয়েছে বোধহয়। এ ঘরের ডিজাইন কিছুটা আলাদা। চারপাশে নীল টিন, মাঝে দুটো কাঠের জানালা, একটা দরজা। উপরে ও টিনে ঘেরা। তাহিয়া সব কিছু পরখ করার সময় নীলিমা ওকে বললেন,
‘ফ্রেশ হয়ে নে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নে। আমি না ডাকার আগে বাইরে আসবি না। বুঝেছিস?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল। জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?

‘রান্নাঘরে গিয়ে দেখি রান্না কতটুকু হলো । ‘
বলে চলে গেলেন নীলিমা। অভীক তাহিয়াকে নিয়ে নতুন ঘরে প্রবেশ করল। এ ঘরে চারটা রুম। একটা বসার ঘর, একটা শোবার ঘর, একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। শোবার ঘরে একট খাট, একটা ড্রেসিংটেবিল, আর স্টিলের আলমারী। অভীক জানালা খুলে দিল। খাটের পাশে জানালা। তাহিয়া গিয়ে খাটে বসল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। শুধু ঘর আর ঘর চোখে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
‘ওই ঘরগুলো কার?’

‘একটা বাবার, একটা বড়ো চাচ্চুর, একটা ছোটো চাচ্চুর, একটা বড়ো চাচ্চুর ছেলে জয়নালের, একটা ছোটো চাচ্চুর ছেলে রামিমের। ‘ ট্রাভেল ব্যাগ থেকে কাপড় বের করার ফাঁকে উত্তর দিল অভীক। তাহিয়া ফিরতি প্রশ্ন করল,
‘সবার ঘর আলাদা থাকে? একটা ঘর বানিয়ে সবাই এক ঘরে থাকলেই তো হয়।’

অভীক উত্তরে বলল,
‘এটা আমাদের এদিকের একটা প্রথা বলা যায়। ছেলের বিয়ের পর বউ আর শ্বশুর শ্বাশুড়ি এক ঘরে থাকে না। আলাদা ঘর করে দেয় বাবা তাকে। সে বউ নিয়ে নতুন ঘরে থাকে। ‘

‘এমনটা কেন?’

অভীক হেসে বলল, ‘সম্ভবত ছেলে আর ছেলে বউকে প্রাইভেসি দেয়ার জন্য। বা শ্বশুর শ্বাশুড়ির জন্য সম্মান বৃদ্ধির জন্য। আমার ধারণা এমন কিছুই। ‘

ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে তাহিয়া বলল,
‘আমরা এখন যে ঘরে আছি এই ঘরটা কার?’
‘ এই ঘরটা তোমার আমার।’ হেসে বলল অভীক। তাহিয়া অবাক হলো। বিস্মিত স্বরে বলল,
‘দেখতে তো নতুন লাগছে। কবে বানিয়েছেন?’

‘ আমি বানাইনি। এটা বাবা তার ছেলে আর ছেলে বউয়ের জন্য বানিয়েছেন বিয়ের পরপর। পছন্দ হয়েছে?’ অভীক জানতে চাইল। তাহিয়া উঠে পুরো ঘর ঘুরে দেখল। তারপর হেসে বলল,
‘ এমন ঘর আগে দেখিনি, নতুন লাগছে। কিন্তু সুন্দর। ‘

অভীক স্মিত হেসে বলল,
‘ যাক, গৃহস্থের ঘর পছন্দ হয়েছে। বাবা জানলে খুশি হবেন। ‘

এই ঘরের কথাই গাড়িতে বলেছে অভীক! হতে পারে। এই ঘরের গৃহস্থ তো সে-ই। এখানে আসার পর একান্ত জায়গা পাবে কি-না শঙ্কায় ছিল, যাক একটা ঘর পাওয়া গেল। তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, হাসল ও। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
‘রান্নাঘর আছে দেখি। আমাকে কি রান্না করতে হবে?’

তাহিয়ার চোখে মুখে ভয়। অভীকের কাপড় নেয়া শেষ। উঠে দাঁড়াল সে। তাহিয়ার ভয় মাখা চেহারা দেখে হাসল। মুখটা গম্ভীর করে ভয় বাড়িয়ে দিতে বলল,
‘নতুন বউদের রান্না করতে হয়। কাল বড়ো কাতলমাছ আনা হবে, কেটে সবার জন্য রান্না করতে হবে। ‘

তাহিয়া ভীত ঢোক গিলল। জীবনে কখনো মাঁছের আঁশ ও ধরে নি গন্ধ বলে। এখন মাছ কাটতে হবে! আবার রাঁধতেও হবে! ভীত চোখে অভীকের দিকে তাকাল ও। অভীকের মুখটা গম্ভীর। হাসি নেই। কথার সত্যতা চেহারায় পাওয়া গেল। তাহিয়ার ভয় বাড়ল,
‘আমি তো কখনো মাছ কাটিনি, রান্নাও পারিনা। এবার কী হবে! সবাই তো আমাকে খারাপ ভাববে। ‘

ভয়ে তাহিয়ার চেহারা রক্তশূণ্য হয়ে গেছে। ভীত পর্বের ইতি টানল অভীক। ধীর পায়ে তাহিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। এক গাল হেসে বলল,
‘মজা করছিলাম পাগলী।’

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল,
‘মজা মানে? রান্না করতে হবে না?’
‘না।’ হেসে বলল অভীক।

‘তাহলে রান্নাঘর কেন এখানে?’ তড়িৎ প্রশ্ন করল তাহিয়া। অভীক তাহিয়ার চোখ থেকে চশমা খুলে নিল। হাতে থাকা টাওয়ালে গ্লাস পরিষ্কার করল, চশমাটা চোখে পরিয়ে দেয়ার সময় বলল,
‘ বাবার পুত্রবধুর যদি রাত বিরাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করে, বা সকালে সবার দেয়া নাস্তা পছন্দ না হয় তবে যেন নিজের পছন্দমতো কিছু বানিয়ে খেতে পারে তাই বাবা তার পুত্রবধুর জন্য এই বাড়তি রুম করেছেন। এই যে আশপাশে যত ঘর দেখছো, কোন ঘরে কিন্তু রান্নাঘর নেই। একমাত্র এই ঘরে আছে। বিশেষভাবে বানানো হয়েছে। ‘

রেজাউল আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো তাহিয়া। সেই সাথে রান্না না করার স্বস্তি ও পেল। হেসে বলল,
‘ আংকেলের ভাবনা চমৎকার। এমনভাবে কেউ ভাবে না।’

অভীকের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য। ঘর বানানোর সময় ও ছিল না। বানানো শেষে রেজাউল সাহেব ওকে নিয়ে গ্রামে এসেছেন। ঘর দেখানোর সময় রান্নাঘরের কাছে এসে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ আগে আমাদের এদিকে সকালের নস্তা বানানো হতো না, গরম ভাত খেতে সকাল পার হতো। তোর মায়ের সকালের নাস্তায় পরোটা আর চা না হলে হতো না। পরোটা না হলেও এক কাপ চা তার চাই-ই চাই। আমাদের বাড়িতে এসে সকালে ভাত খেতে পারতো না ও, এক কাপ চায়ের জন্য চটপট করতো। একদিন মুখ ফুটে বলার পর কে যেন কটু কথা শুনিয়েছে ওকে। তখনকার সময়টা অন্যরকম ছিল। বউদের সুবিধা অসুবিধার গুরুত্ব দেয়া হতো না। ও মন খারাপ করতো অনেক। আমার ইচ্ছে হতো ঘরে একটা রান্নাঘর বানাতে, যাতে নীলিমার অসুবিধা না হয়। মাকে বলার পর মা আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। যার পরে কথাটা ভাবনা থেকে বের করতে বাধ্য হয়েছি। তোর মা সব মুখ বুঝে সহ্য করে যেত, নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা বলতো না কাউকে। ওর জীবনটা একবারে দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল, আমি চাইলেও কিছু করতে পারতাম না মা বোনের জন্য। খুব অসহায় লাগতো। সেই সময়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোর মায়ের সমস্যাগুলো তোর বউকে সহ্য করতে দিব না। তোর মায়ের মতো তোর বউয়ের জীবনটা যাতে দূর্বিষহ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখব, একটা সুন্দর বাসস্থান আমি করে দিব। অবশ্যই তাতে একটা রান্নাঘর থাকবে। এত বছর পর এবার পারলাম সিদ্ধান্ত সফল করতে। আমি তোর মায়ের জন্য তখন কিছু করতে পারিনি। তুই এখনকার ছেলে তুই পারবি। এই বাড়ি তোর, তাহিয়ার দায়িত্ব ও তোর। ও কোন অসুবিধা যেন না হয় সব দেখবি। তাহিয়া শহুরে মেয়ে, এখানে আসলে ওর মানিয়ে নিতে কঠিন হবে, তুই ওকে সাহায্য করবি। তুই স্পষ্টবাদী ছেলে ওর প্রতি অন্যায় হলে প্রতিবাদ করবি। যাতে পরে আমার মতো অনুতপ্ত না হতে হয়। ‘

রেজাউল আহমেদ কাধ চাপড়ে বলেছিলেন কত কথা। অভীক অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ছোটো বেলা থেকেই বাবা মা ওর আদর্শ ছিল, পদে পদে তারা ওকে শিখিয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ববোধ আর যত্মবোধটা বাবা মায়ের কাছেই পেয়েছে ও। বাবা মায়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ, ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে। বাবার এই কথায় আরো বাড়ল।

অভীক বাবার কথা ভেবে আনমনে হাসল। তাহিয়া বলল,
‘ সব গ্রামেই এমন প্রথা আছে?’
‘না, শুধু আমাদের জেলার গ্রামে এই রীতি। একেক জেলায় একেক প্রথা। অন্যান্য জেলায় একঘরে থাকে ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে। ‘

‘ সুন্দর তো! শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখিয়ে সকালে বেডরুম থেকে বের হওয়া লজ্জার ব্যাপার। এ লজ্জা থেকে বাঁচা গেল।’ প্রসন্ন হাসল তাহিয়া। অভীক বলল,
‘ প্রশ্নোত্তর পর্ব পরে হবে। আমি আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি জামা কাপড় বের করো।’

প্রশ্নোত্তর পর্বের ইতি টানল এখানেই। অভীক ফ্রেশ হয়ে এলো, এর পর গেল তাহিয়া। বাথরুমটা শহরের মতো সিমেন্টের, টাইলস করা। বাইরে দিয়ে টিনে ঘেরা। খুব একটা অসুবিধা হলো না তাহিয়ার। রেজাউল সাহেবকে কতবার যে ধন্যবাদ দিয়েছে তার হিসেব নেই।

গোসল সেরে বেরুতেই অভীক তার স্নিগ্ধ স্ত্রীকে পরখ করে হাসল। বলল,
‘ খাবার ঘরে ডাক পড়েছে চলো। ‘

হালকা গোলাপী থ্রি-পিস পড়েছে তাহিয়া । থ্রি-পিসের ওড়ানা দিয়ে ঘোমটা টানল মাথায়। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অভীক দু’কদম আগে হাটছে। তাহিয়া পিছনে। খাবার ঘরটা রেবুন্নেছার ঘরে। বিশাল রুমের মাঝে শীতল পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি সারি বেধে বসেছে অনেকজন। এক কোণে বড়ো সাইজের বেশ কয়েকটা পাতিল রাখা। পাতিলের পাশে বসা নীলিমা, অভীকের বড়ো চাচী রেহানা, বড়ো ফুপি মাজেদা। তিনজনে খাবার বেড়ে দেয়ার দায়িত্ব আছেন। তাদের পাশে বড়ো মোড়ায় বসে আছেন জাহানারা। কাজকর্মে বেলায় শেষে , খাওয়ার বেলায় প্রথমে থাকে কিছু মানুষ, তিনি এই কাতারে। বসে বসে হুকুম দিচ্ছেন, ভাবি আমারে মুরগার রান দেও, রুই মাছের মাথাডা দাও। বেজায় রাগ নিয়ে ননদের পাতে তরকারি তুলে দিচ্ছেন নীলিমারা দুই জা।

তাহিয়াকে দেখেই নীলিমা নিজের কাছে জায়গা করে দিলেন। অভীককে ও বললেন পাশে বসতে। রেহানা বললেন,
‘ওর চাচা ফুপারা না খাইয়্যা নামাযে গেছেন অভী আইলে খাইব, হেরলেইগ্যা। অভী এহন না খাইয়্যা ওগো লগে খাইবো না হয়?’

নীলিমা জাহানারার দিকে তাকালেন। হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছেন তাহিয়ার দিকে। নীলিমা বিড়বিড় করলেন,
‘অভী এখন রুম থেকে বেরুলে ওর উপর হামলে পড়ার জন্য একজন তৈরি। তা তো হতে দেয়া যায় না। ‘

মনের কথা মনে রেখে বললেন,
‘ অভীক এসেই বলছিল, ওর ক্ষিধে পেয়েছে। ভাইসাহেবদের নামায পড়ে আসতে তো আরও দেরি হবে। ছেলেটা ক্ষিধে নিয়ে এতক্ষণ বসে থাকবে? তারথেকে বরং খেয়ে নিক। রাতে একসাথে খাবে না হয়।’

রেহানা কিছু বললেন না আর। অভীক ভ্রু কুঁচকাল। ক্ষিধের কথা সে মাকে বলেনি, তবে মা মিথ্যা বলল কেন? সে তো জানে না মহিলাদের স্বভাব। মহিলাদের কথার তীর কখন, কোনদিকে যায় মহিলারাই বলতে পারেন।
কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ল অভীক। আদতে ক্ষিধে পেয়েছে ওর। শীতল পাটিতে অনায়েসে বসল অভীক। তাহিয়া খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা। এভাবে হাত পা ঘুটিয়ে খাওয়া হয়নি ওর। সে টেবিল চেয়ারেই অভ্যস্ত। নীলিমা তাহিয়ার পাতে বড়ো মাংস, বড়ো মাছের পিস দিল। মেঝেতে রাখা প্লেট থেকে ফুট দুয়েক উপরে থাকা মুখে গ্রাস নিতে হিমসিম খেতে হলো ওকে। কোনরকম খেয়ে উঠে গেল। একটা মোড়ায় বসল।

একজন মহিলা এলো। দেখতে মধ্যবয়স্ক। পাকাপোক্ত গ্রামীণ নারী, বেশ ভূশায় সেটাই মনে হলো। তাহিয়ার কাছে এসে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি, ভালা আছেন? চিনছেন আমারে? মুই রাহেলা। আপনের ননদ।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আট দশ বছরের মেয়েকে দেখিয়ে বলল, ‘আর এইডা আমার মাইয়্যা রাহি।’

ভদ্রমহিলার মুখে ‘ভাবি’ ডাকে বিব্রতবোধ করল তাহিয়া। এত বড়ো মহিলা ওকে ভাবি ডাকছে, বিষয়টা মেনে নেয়া যাচ্ছে না যেন। আবার বলে কি-না উনি ননদ! অভীকের ছোটো! এই মহিলার এত বয়স, এবার তাদের বড়ো অভীকের বয়স তাহলে কেমন? তাহিয়া চট করে অভীকের দিকে তাকাল। অভীক বসে ফুপিদের সাথে কথা বলছে। তাহিয়া ওর মাথায় চোখ ফেলল, চুল টুল পাক ধরল না কি! বয়স তো বোধহয় কম হয়নি। দেখতে তো মনে হয় না। তাহিয়া চোখ ফিরিয়ে সালামের উত্তর নিল। বলল,
‘ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, খাইছেন ভাবি?’
তাহিয়া মাথা নাড়াল। ভাতের চামচ হাতে প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে রেহানা বলল,
‘বউমা এইডা আমার বড়ো মাইয়া। কতা হইছে?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল।আরেকজন মহিলা এলো খাবার ঘরে। পান খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলেছে, ভুড়ি বেরিয়ে একাকার। সাথে আরেকটা মেয়ে, তাহিয়ার সমবয়সী হবে। মহিলা এসে দাঁড়াতেই তাহিয়া উঠে দাঁড়াল। ঝুকল সালাম করার জন্য। আসার আগে মা বলেছিলেন বড়োদের পা ধরে সালাম করতে। গ্রামে মুরুব্বিদের পা ধরে সালাম না করলে তারা খারাপ ভাবেন, মুখের উপর ‘বেয়াদব’ উপাধি দেন, অপমান করেন। অভীকের ছোটো চাচীর সাথে দেখা হয়নি এখনো। তাহিয়ার ভাবনা ওটা ওর চাচী শ্বাশুড়ি। সে ঝুকে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?’

মহিলা ওকে ধরে ফেললেন। নীলিমা আগ বাড়িয়ে বললেন
‘তাহিয়া, এটা তোমার বড়ো ফুপিশ্বাশুড়ির মেজো মেয়ে সোনিয়া। আর পাশের জন সোনিয়ার মেয়ে সিনথিয়া। ‘

সোনিয়া বলল, ‘ভাবি ভালা আছেন? ‘ সিনথিয়া বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম মামী।’

তাহিয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মহিলাও অভীকের ছোটো! এই মহিলার বয়স চল্লিশ হবে নিশ্চিত। দেখতে এমনই লাগছে। এবার অভীকের বয়স তো মনে হচ্ছে পঞ্চাশ হবে? শেষ অবধি একটা বুড়োকে বিয়ে করল না কি! সাংঘাতিক ব্যাপার। অবাক হয়ে আবার তাকাল অভীকের দিকে। এই লোকটা নিজের বয়স লোকাচ্ছে কোথায়? কত কথা মাথায় এলো। কোনমতে কুশল বিনিময় করল। নামায শেষে পুরুষরা ফিরে এলো।

তাহিয়ার সাথে দেখা হলো সবার। মুরুব্বিদের দেখেই সালাম দিল তাহিয়া। অভীকের তিন ফুপা আর দুই চাচার সাথে কুশল বিনিময় হলো। হেসে কথা বললেন উনারা। তাদের সাথে আরো দুজন ছিল, দাঁড়ি গোঁফে বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছিল ওনাদের। তাহিয়া তাদের ও মুরুব্বি ধরেছিল। শেষে বের হলো ওরাও ওর দেবর জয়নাল আর রামিম। তাহিয়াকে দেখে নিয়মমাফিক ‘ভাবি’ ডাকল। তাহিয়ার মনে হলো আর কিছুক্ষণ থাকলে ও ‘ভাবি’ ডাকে পৃষ্ট হয়ে যাবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুযোগ পেলে অভীকের জন্ম নিবন্ধন কার্ড চেইক করবে। না জানি কোন জেনারেশনের মানুষ উনি। জানা দরকার।

খাবার শেষে বাইরে বের হলো অভীক। তাহিয়া ও বের হলো। আশপাশ তাকিয়ে দেখল না কেউ নেই। উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল,
‘শুনুন!’
অভীক পিছু ঘুরে বলল,
‘বলুন।’
‘আপনার বয়স কত?’ প্রশ্নটা মনের শিরোনাম আপাতত। না জেনে থাকা দায় হয়ে উঠছে। অভীক অবাক হলো কিছু,
‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’ সামনে পা বাড়িয়ে প্রশ্ন করল অভীক। তাহিয়া কদম বাড়িয়ে উত্তর দিল,
‘ আমার সমবয়সী মেয়ের মা ও আমাকে ভাবি ডাকছে। যে দেখছে সেই আমার আমার ননদ দেবর দাবি করছে। এতগুলো মুরুব্বির বড়ো আপনি, আপনার বয়স নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ‘ বলে তাহিয়া।

অভীক ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক চাইল স্ত্রীর পানে। পেট পাকিয়ে হাসি আসছে ওর। হাসল না ও, গম্ভীরমুখে বলল,
‘আমার চাচা, ফুপির মিলে পঁচিশজন ছেলে মেয়ে। আমি সবার বড়ো। এবার চিন্তা করো আমার বয়স কতো হয়েছে। চল্লিশের ধাক্কা খেয়েছি কয়েক বছর হলো। শরীরের যত্ন নিই, চুল কালার করি বলে আমাকে বয়সটা বুঝা যায় না। তোমার চেয়ে কয়েক বছর নয়, জেনারেশন গ্যাপ আমার। ‘

তাহিয়া ইতঃপূর্বে ওর মাকে বলতে শুনেছে, অভীক ওর বংশের বড়ো ছেলে। সবে মনে পড়ল। ও রিপিট করল,
‘সত্যি!’
অভীক ঠোঁট চেপে হাসল,
‘ সঠিক সময়ে বিয়ে করলে এতদিনে আমি দাদা হয়ে যেতাম। পড়ালেখা, বিসিএস, চাকরি এসবের পিছনে ছুটতে ছুটে বয়স পেরিয়ে গেল। এখনো ‘বাবা’ হতে পারলাম না। অথচ দেখো আমার ছোটো সোনিয়া নানী হবে কদিন পর।’

কথা বলতে বলতে ঘরে এসে পৌঁছল ওরা। তাহিয়া অভীককে টেনে বিছানায় বসাল। নিজেও বসল পাশে। অভীককে পরখ করল অন্তর্ভেদী চোখে। ফ্যাট জমেনি পেটে। অভীকের চুল নেড়েচেড়ে দেখল। নাহ্,চুলে ও পাঁক ধরে নি। কালার করার কোন চিহ্ন নেই। চেহারায় বয়স্ক ভাব ও নেই। দেখতে যুবকের মতোই লাগে। ওর ভাবসাব দেখে অভীক হেসে যাচ্ছে চাপাস্বরে।
তাহিয়া সন্দেহী চোখে বলল,
‘চল্লিশ প্লাস? অসম্ভব! আপনি নিশ্চয়ই মজা করছেন?’

অভীক এবার হো হো করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
‘অবশ্যই মজা করছি। তোমার মা আর আমার মা ক্লাসমেট ছিল। তোমার মায়ের দশ বছর আগে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছে। অবনী আপু আর আমি পিঠাপিঠি ভাইবোন। এসব ভাবলেও তো সমাধান আন্দাজ করা যায়। তা না করে আমাকে বুড়ো বানানোর পায়তারা করছিলে বোকা মেয়ে। তাই আমিও মজা করলাম। ‘

তাহিয়া হিসেব কষল। ত্রিশ বত্রিশ হচ্ছে বয়স। দ্বিধাভরা চোখে বলল,
‘তাহলে ওরা সবাই আপনার ছোটো হয় কিভাবে? একেকজনের ছেলেমেয়ে আমার সমান।’

‘অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে সবার। এই যেমন সোনিয়ার বিয়ে হয়েছে পনেরো বছর বয়সে। ওর গ্রোথ বেশি ছিল বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। গ্রামে এমন অহরহ হয়। বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিয়ে, কাজ কর্মের মাঝে শরীরের যত্ন না নেয়ায় শরীর ভেঙে গেছে। দেখতে বয়স্ক লাগে। বয়স বেশি না। আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোটো হবে। আর ওর মেয়ের বয়স চৌদ্দ পনেরো। দেখতে বড়ো লাগে। মাত্র এইটে পড়ে।’

এবার সমীকরণ মিলল তাহিয়ার। ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অভীক এক হাতে তাহিয়াকে আগলে নিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
‘তুমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছ। আচ্ছা যদি এখন দেখো সত্যি আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, তবে কী করবে? ছেড়ে চলে যাবে?’

অভীক মজার স্থলেই প্রশ্ন করল। তাহিয়া ও মজার স্থলে বলল,
‘ আমি বয়সে নয়, মন আর মানুষে আটকা পড়েছি। ওসব বয়স টয়স আমাকে ছাড়াতে পারবে না। কোন সম্ভাবনা নেই।’

কী সুন্দর শুনাল কথাটা! অভীক হাসল, প্রাণবন্ত। কিছু বলল না এ সম্পর্কে। ওর হাসিতেই সব প্রকাশ পেল। প্রসন্ন হেসে বলল,
‘ কিছুক্ষণ ঘুমাও, আজ অনেক ধকল গেছে। ‘

এসবের মাঝে জাহানারার হিংসে প্রকাশ করা হয়ে উঠল না। তাহিয়ার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে। অভীক ছিল না পাশে। বাইরে কথা শোনা যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে বাইরে বের হলো তাহিয়া। অভীক উঠোনে দাঁড়িয়ে রামিমের সাথে কথা বলছে। তাহিয়াকে দেখে বলল,
‘ রান্নাঘরে পিঠা বানানো হচ্ছে। মা ও আছে, ওখানে যাও।’
রান্নাঘর দেখিয়ে দিল অভীক। তাহিয়া গেল সেদিকে। উঠোনের এক কোণে রান্না ঘর। এটা ভেড়ার। তাহিয়া রান্নাঘরের কাছাকাছি যেতেই থমকে গেল ভেতরকার কথা শুনে।

‘হুনলাম, রেজার পোলার বউ আইছে। কেমন দেখলা বউ রে? ডাহো আমরা ও দেহি। কিরাম বউ আনছে রেজায়।’ কন্ঠটা অপরিচিত ঠেকল তাহিয়ার কানে। ইতঃপূর্বে শুনে নি সে। ওর কথাই বলছে দেখে সচেতন হয়ে শুনল তাহিয়া। উত্তরে এলো,

‘ কালা ত কালা, আবার কানাও। চশমা বিনা দেহে না। আমগো রাজপুত্তুরের লাহান পোলার লগে এই মাইয়্যারে এক্কারেই মানায় না। কী দেইখ্যা যে ভাবি এই মাইয়্যারে বউ করছে আল্লাহ জানে। আমার মনে অয়, এই মাইয়ার মায় তাবিজ করছে, বাপমরা মাইয়্যা অভীকের গলায় ঝুলোনের লাইগ্যা। আর নইলে মাইয়্যা বশ করছে আমগো পোলারে। কিরাম লাগে দেখতে, আমার দেইখ্যাই খারাপ লাগছে। কত ভালা বউ পাইতো আমার ভাস্তে, ভাবি পোলাডার জীবনডা শেষ কইর‍্যা দিসে। ‘

এ স্বরটা পরিচিত তাহিয়ার। আসার পর শুনেছে। স্বরটা জাহানারা বেগমের। ফুপিশ্বাশুড়ির বলা সব কথা শুনল তাহিয়া, বুঝল ও। কথাগুলো তীরের মতো বিধল বুকে, কী যে কষ্ট দিল! সে দেখতে এতই খারাপ যে, তার কারণে অভীকের জীবন শেষ হয়ে গেছে? সে তাবিজ করেছে? অভীককে বশ করেছে? বাস্তবিক অর্থে অভীক ওকে বশ করেছে। বিয়েতে তো ও রাজিই ছিল না। না জেনে একটা মানুষের সম্পর্কে কীভাবে বলতে পারে মানুষ!

ওর ভাবনার মাঝে দ্বিতীয় স্বরটা আবার কথা বলে উঠল,
‘তোমার ছোড়ো মাইয়্যার লাই না রেজার পোলার লাই বিয়ার লাই দেকছিলা। দেয় নাই কেন? তোর মাইয়্যা ত সুন্দরী আছে। মানাইতো দুজনরে। তোর মাইয়্যারে না আইন্যা কালি কেন আনছে?’

‘ আমার মাইয়্যারে আনলে তো হইতোই, সুখের কমতি হইতো না। আমার মাইয়্যার কোনখান দিয়া কম নাই। রাঙাচাঙা মাইয়্যা আমার, রূপে যেমন গুনে তেমন। ষোলো আনা পাইতো। মুই কইছিলাম, ভাবি কয়, মাইয়্যা ঠিক কইরা রাখছে। কোন বান্ধবীর মাইয়্যা। মুই ভাইবজিলাম, মাইয়্যা জাবিন তুন রূপ গুনে ভারি অইবো। অহন ত দেহি আমার মাইয়্যার দ্বারে কাছে ও নাই। কেমনে যে রাজি হইছে অভীক আল্লাহ জানে। অভীকের কী দেখ্যাইয়্যা মজাইছে কে জানে? শরীর শাক্কা ও এত ভালা না, নজর দেওনের মত না। তাবিজ কইরা বশ করছে। কত সুন্দর বউ পাইতো পোলাটা, কী পাইল! এই কালা মাইয়্যা নিয়া চলব কেমনে? আমার ত পোলারে দেখলেই মায়া লাগে। আহাইরে!’

জাহানারার কথায় তাহিয়া চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। শরীর নিয়ে জাহানারার মন্তব্যের ওর চোখে বর্ষা নামল। কান্নার মাত্রা বাড়ল দ্বিতীয় স্বরের কথা শুনে,
‘ তাবিজ লাগে না। শহুরে মাইয়্যারা বহুত খারাপ হয়, বিয়ার আগে আইশটো দশ জনের লগে ইটিস পিটিস থাহে। রাইত কাডোনের ধাত আছে ওগো। বিয়ার আগেই পোয়াতি হইয়্যা যায়। ওইরাম কিছু কইরা পোলারে ফাঁসাইবার পারে। ওগো বাছ-বিচার নাই। দেখো গিয়া আকাম কইরা পোলার গলায় ঝুইল্যা পড়ছে। ‘

শুধুমাত্র রংটা একটু চাপা বলে মানুষ এত খারাপ ভাবনা মনে আনতে পারে! এ দেশে ছেলেদের কালো হলে দোষ নেই, মেয়েদের শ্যামবর্ণের হলেও দোষ! পবিত্র সম্পর্কটাকে অবধি অপবিত্র করে ফেলল এরা! আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এরা ও দুজন নারী। নারী হয়ে অপর নারীর সম্পর্কে এত খারাপ মন্তব্য কিভাবে করতে পারে! মানুষের মন মানুষিকতা এত নিচু কেন? মায়ের বয়সী মহিলা কিভাবে এই মন্তব্য করতে পারে! গায়ের রং নিয়ে যে মানুষ এত বিরূপ ধারণা রাখতে পারে গ্রামে না এলে তাহিয়ার অজানাই রয়ে যেত। ভেতরে বলা মানুষগুলোর কথা কানে বাজল আবার। গাল বেয়ে চোখের পানি পড়তে লাগল।

আকস্মিক সেখানে উপস্থিত হলেন নীলিমা। তিনি শ্বাশুড়ি কাছে ছিলেন। তাহিয়াকে ডাকতে গিয়ে জানলে পারলেন তাহিয়া রান্না ঘরে। জাহানারা উপস্থিতি সেখানে, ভেবেই বুক কাঁপল উনার। দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগুলেন। তাহিয়ার দিকে এগিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
‘কীরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

তাহিয়া তড়িঘড়ি করে চোখ মুছল। লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ‘
‘আমি তোর দাদীমার কাছে ছিলাম। চল ভেতরে।’

সামনে পা বাড়ালেন। কদম বাড়াতে গিয়ে ভেতরের কথা শুনলেন। তড়িৎ তাকালেন তাহিয়ার দিকে। এদিকটা অন্ধকার, তাহিয়ার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কিছু শুনে নি তো! তিনি কথা বলে উঠলেন,
‘আমাদের পাশের বাড়ির এক চাচী পিঠা বানাচ্ছেন। তোর ফুপি শ্বাশুড়িও আছেন। আয়, ভেতরে।’

তাহিয়ার উপস্থিতি জানান দিলেন। নীলিমার কথায় ভেতরকার কথা বন্ধ হলো কিছুক্ষণ। নীলিমা তাহিয়াকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। চুলার ধারে বসে ভাপা পিঠা বানাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ নারী বিউটি বেগম। তার পাশে মোড়া পেতে বসে আছেন জাহানারা। হাতে ভাপা পিঠা ধরা, খেতে খেতে গল্প করছেন তিনি। তাহিয়াকে দেখে বিউটিকে ইশারা দিলেন। আগুনের আলোতে বিউটি তাহিয়াকে পরখ করতে লাগল। নীলিমা মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘চাচী, আমার ছেলের বউ।’

তাহিয়া সালাম দিল। মহিলা সালাম নিলেন না। চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। জাহানারা মুখের উপর বলে দিলেন,
‘ভাবি আমগো পোলার লাই আরো ভালা মাইয়্যা পাইতা। আমার মাইয়্যা আনলা না, আমি কিচ্ছু মনে করি নাই। আমারে কইতা, এক থেইক্কা এক চান্দের লাহান মাইয়্যা হাজির করতাম। এই মাইয়্যারে কী দেইখ্যা আনলা? কালা, কানা, শরীর স্বাস্থ্য ও ভালা না, আবার কাম কাজ ও পারে না হুনলাম। মাইয়্যার আছে টা কী? এত খুঁত নিয়া জীবন চলোন যায়? পোলার জীবনডা শেষ কইরা দিলা ইচ্ছে কইরা। আমগো বংশে এত খারাপ বউ আহে নাই আর।’

নীলিমা তড়িৎ তাকালেন তাহিয়ার দিকে। আগুনের আলোয় স্পষ্ট তাহিয়ার চোখের পানি। মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমা পুত্রবধূর কাছে গিয়ে হাত ধরলেন। স্বগর্বে বললেন,
‘ যেমন হোক, ও আমার পুত্রবধূ। সব দেখে শুনেই এনেছি ওকে। এতে আমার আফসোস নেই, কখনো হবে ও না।’

থেমে তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘যা রুমে যা।’

.
বর্ষামুখর চোখে রুমে ফিরল তাহিয়া। অভীক তখন দাদীর কাছে। উঠোনে দেখা হয়নি। খালি রুমটায় পা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল তাহিয়া। এত অপমানিত হয়নি আগে কখনো। কেউ ওর গায়ের রং নিয়ে কটু কথা শোনায়নি। বালিশে মুখ চেপে কাঁদল অনেকক্ষণ। বাইরে অভীকের আওয়াজ শোনা গেল। অভীক আসছে এদিকে। কম্বল মুড়িয়ে চোখ মুখ ঢেকে শুয়ে রইল তাহিয়া। অভীক রুমে এসে ওকে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল।
‘ তুমি না রান্নাঘরে গেলে, ফিরে এলে কখন? আর এই অবেলায় শুয়ে আছো কেন হিয়া? শরীর খারাপ?’
বিছানায় বসে উদ্ধিগ্ন হয়ে লাগাতার প্রশ্ন করে গেল অভীক।

তাহিয়া লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করল। তড়িঘড়ি করে চশমা পরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের মাঝে চলা লাইটের আলোয় নিজেকে দেখল কিছুক্ষণ। অভীক ভ্রু কুঁচকাল আবার। তাহিয়ার আচরণ অদ্ভুত ঠেকছে। ও উঠে গিয়ে তাহিয়ার পাশে দাঁড়াল।

অন্তর্ভেদী চোখ অভীককে পরখ করল তাহিয়া। আসোলেই লোকটা সুদর্শন। আবার নিজেকে দেখল, ওর সৌন্দর্য অভীকের তুলনায় কম মনে হলো। নিজের রূপ নিয়ে ইতঃপূর্বে হীনমন্যতায় ভোগেনি, আজ ভুগছে। সময় ভুগাচ্ছে? অভীককে দেখার মাঝে জাহানারার কথা কানে বাজল।
সত্যিই কি অভীকের সাথে ওকে মানায় না? খারাপ লাগে? আবার ভালো করে পরখ করল। অভীকের হাইট পাঁচ ফুট আট হবে, ওর পাঁচ ফুট দুই। রঙটা অভীকের হলদে সাদা। এই রঙা ছেলেরা সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়। অপরদিকে ওর গায়ের রঙ বাদামী। এতদিন সবাই বলতো উজ্জ্বল বাদামী। অভীকের পাশে দাঁড়ানোর পর এখন মনে হচ্ছে ওর গায়ের রঙ কালো। অভীকের বাধানো শরীর। চেহারাও বেশ মায়াবী। চাপ দাঁড়িতে কতই না আকর্ষণীয় লাগে লোকটাকে! ওকে প্রসাধনীতে এতটা চমৎকার লাগে কখনো? নাহ। কত ভাবনা এলো মনে।

অভীক ভ্রু কুঁচকাল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

তাহিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করল। গলা থেকে কষ্টের দলা সরিয়ে বলল, ‘দেখছি। ‘
‘কী দেখছো?’
‘আমাদের দুজনকে পাশাপাশি মানাচ্ছে কি-না।’ কেমন করে বলল তাহিয়া। অভীক ফির‍তি ভ্রু কুঁচকাল,
‘তা কী বুঝলে?’

তাহিয়া আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি অনেক রূপবান, আমি রূপবতী নই। একটু ও না। আপনি রাজপুত্রের মতো, কিন্তু আমি রাজকন্যার মতো নই। মানাচ্ছে না আমাদের।’

অভীক তাহিয়াকে নিজের দিকে ঘুরাল। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ এসব কী বলছো? আর কেনইবা বলছো?’

তাহিয়ার চোখে চশমা থাকায় কান্নাভাব বুঝা যাচ্ছিল না এতক্ষণ। কাছে আসায় বুঝা গেল। তড়িৎ চশমা খুলে যাচাই করল অভীক। তার উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘এ্যাই, তুমি কেঁদেছো? কী হয়েছে? ‘

তাহিয়া আবার ঘুরে দাঁড়াল। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি দেখতে কি খুব বেশি খারাপ?’

‘আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী আমার হিয়ারানী। খারাপ দেখার প্রশ্নই উঠে না।’ তড়িৎ জবাব দিল অভীক, কোমল স্বরে। কথাটা সুন্দর শুনাল। কষ্টের মাঝেও হাসল তাহিয়া। লোকটা কি মন থেকে বলছে কথাটা, না কি আবেগ থেকে?

চলবে…

বিঃদ্রঃ ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। হুটহাট প্রোগ্রামে জানানোর সময় হয়নি। আর গল্প দেয়ারও সময় পাইনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here