#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
ঘড়ির কাটায় রাত ১:০৫ মিনিট বাজে। করিডোরে পাতানো চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বই হাতে বসে আছে অভীক। চোয়ালে পেশাগত গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে, চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বইয়ে ডুবে আছে, মনটাও বোধহয় বইয়ের কালো অক্ষরে বিচরণ করছে। কাল ক্লাসের যে অধ্যায়ে লেকচার দিবে, সে অধ্যায়টা দেখে নিচ্ছে। অলস মস্তিষ্কটাকে বইয়ে ডুবিয়ে অবসর সময়টা পার করার প্রক্রিয়া হিসেবে বেছে নিয়েছে বইকে।
মাহমুদার সফলভাবে সার্জারি হয়েছে দিন চারেক আগে। সার্জারির পরের রাত গুলোতে তার সঙ্গী হয়েছে তুহিন কিংবা ফিরোজ খান। হাজার বলে ও কোথাও পাঠানো যায়নি তাদের। হাসপাতালেই রয়ে গেছেন। তিন পুরুষ মিলে করিডোরে বসে গল্প করে রাত পার করেছেন। তাই বই নিয়ে এলেও পড়া হয়নি। মাহমুদার অবস্থার উন্নতি দেখে ফিরোজ খান আজ ফিরে গেছেন, তুহিনের সমবয়সী মীরার ভাই এসে তুহিনকে তাদের বাসায় নিয়ে গেছে।
সবাই যেতেই একাকিত্ব এসে ঝেকে বসেছে অভীককে। একাকিত্বময় সময়টায় সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে বইকে। যখন সে বইয়ে পুরোপুরিভাবে ধ্যানমগ্ন হয়েছে তখন কানে এলো এক নারীকন্ঠী হাসির শব্দ। নুপুরের ঝনঝন শব্দের মতো হাসির শব্দটা কানে বাজতেই পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল অভীকের। মনোযোগচ্যুত হলো। ছন্দের মতো বেজে যাচ্ছে হাসির শব্দটা। অভীক ভ্রু কুঁচকাল। শব্দটাকে অনুসরণ করে চারদিক চোখ বুলাল। শব্দ ধরে পর্যবেক্ষণ করতেই বুঝতে পারল শব্দটা তার পেছনের কেবিন থেকে আসছে।
কেবিনটা তো মাহমুদার। তবে এই কন্যাহাসিটা কার? তাহিয়ার! এই মেয়ে রাতবিরাতে উচ্চৈঃস্বরে হাসছে কেন! চারদিকে মানুষ ঘুমাচ্ছে, ব্যাঘাত ঘটতে পারে, মেয়েটা কি জানে না? এত অবুঝ কেন মেয়েটা? ইচ্ছে করছে গিয়ে একটা ধমক দিয়ে আসছে, ওখানে তাদের দু’জনের মা আছে। নীলিমা আজ বান্ধবীর সাথে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। মায়েদের সামনে মেয়েকে ধমক দেয়া যায়না।
ইচ্ছেদের দমিয়ে কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে বইয়ে চোখ রাখল অভীক। হাসির শব্দটা তখনো ভেসে আসছে বিরতিহীনভাবে। বইয়ে মনোযোগ রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। তারপরও বসে চেষ্টা করল বইয়ে মনোযোগ দেয়ার। হাসিটা ঝঙ্কার তুলে বাজছে কানে, মনে। ভীষণ জ্বালাচ্ছে। নাহ্! আর পারা যাচ্ছে না। বইটা পাশের চেয়ারে রেখে উঠে দাঁড়াল। কেবিনের দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাঝে পকেট থেকে ফোন বের করল। তাহিয়ার নাম্বারে গিয়ে টেক্স বক্সে গিয়ে লিখল,
‘সময় দেখেছো? রাত কত হলো, আশপাশের সবাই ঘুমাচ্ছে। এত জোরে হাসছো কেন? মৃদুস্বরে হাসা যায় না? শব্দ কমাও, ফাজিল।’
সেন্ড বক্সে ক্লিক করার আগে কী মনে করে দরজার মাঝে তাকাল, গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি চলে গেল রোগীর বেডটায়। মাহমুদা শুয়ে আছেন, তার বাঁ পাশে নীলিমা বসে আছে, ডান পাশে মায়ের শিয়রে বসে আছে হাস্যজ্বল এক শ্যামকন্যা। সে এখনো প্রাণবন্ত হাসছে। মেয়েটার হাসি সুন্দর, শ্যামবতীদের আল্লাহ তা’আলা চেহারায় আকর্ষণীয় দিক দিয়ে সৃষ্টি করেন। কারো ঠোঁটের নিচে তিল, কারো কাজলকালো চোখ, কারো গালে টোল, কারো ছোট্টো পাথরের নাকফুল বসানো চিকন নাক, আবার কারো হাসি।
তাহিয়ার বাদামী চোয়ালের হাসিটা সুন্দর, উপর পাটিতে একটা গঁজ দাঁত আছে। প্রাণবন্ত হাসলে দাঁতটা দৃশ্যমান হয়, সুন্দর দেখায়। অভীক চোখ সরাল। মায়ের দিকে তাকাল। নীলিমা ও হাসছেন। শব্দ না হলেও শরীরটা দুলছে। মাহমুদা হাসছেন মৃদুভাবে। তিনজনের হাসির কারণ একই, কেমন ছন্দে ছন্দে হাসছে। অভীকের কুঁচকে থাকা কপালের চামড়া সোজা হলো, বিরক্তির রেখাটাও অস্তিত্ব হারাল তড়িৎ। তাদের এই হাস্যজ্বল মুহুর্তের ইতি টানতে ইচ্ছে হলো না অভীকের। মুহুর্তটা ফ্রেমবন্দী করার মতো, চমৎকার মনে হলো তার। স্ত্রী আর মায়ের এমন মুহুর্ত ক’টা ছেলের দেখার সৌভাগ্য হয়?
অভীক তাহিয়ার দিকে তাকাল এক পলক। পরক্ষণেই চোখ সরাল। কী মনে করে ঠোঁট কামড়ে টেক্সট বক্সে টাইপ করা লিখাটা মুছে ফেলল। কিছু হাসিদের বাধা দিতে নেই।
তাহিয়ার বদ স্বভাবকে শাসাতে গিয়ে নিজের ইচ্ছেকে শাসিয়ে করিডোরে ফিরে গেলো অভীক। চেয়ারে বসে পকেট থেকে হেডফোন বের করল, ফোনে কানেক্ট করে সফট মিউজিক ছেড়ে কানে গুঁজল। গানের আওয়াজে হাসির শব্দটা এসে ধাক্কা খাচ্ছে না আর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার শান্তিমতো বইয়ে মনোযোগ দেয়া যাবে, এই মননে বই খুলে বসল। বিপত্তিটা হলো বইয়ের চোখ বুলাতে গিয়ে। কোনভাবে বইয়ে মনোযোগ দিতে পারছে না। আগে কানে আর মনে বাজছিল হাসির শব্দটা, এবার হাসির দৃশ্যটা চোখে ভাসছে। কানে মিউজিক চলছে, সব ঠেলে যেন শব্দটা কানে বাজছে, মনটা আজ অবাধ্য হয়ে হাসির স্মরণে নেমেছে। আচ্ছা জ্বালাতো! এই মেয়ে এবার রীতিমতো জ্বালাচ্ছে। হাজার চেষ্টার পর ও বইয়ে মনোযোগ দিতে পারল না অভীক। আবারও কপালের বিরক্তির ভাজ পড়ল।
গম্ভীরমুখে বলল,
‘আমার শান্তির সাথে এই মেয়ের কিসের শত্রুতা আল্লাহ জানেন!’
চোখের ক্যানভাসে ভাসা চিত্রের অত্যাচারে বসে থাকা দায় হলো। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল অভীক। করিডোরের শেষ সীমায় থাকা বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।
★
নীলিমা মাহমুদা তাদের স্কুল জীবনের নানা ঘটনা বর্ণনা করছেন। হাস্যরসী ঘটনা আওড়িয়ে হাসছেন তারা। হাসাহাসি পর্ব শেষ হলো রাত দেড়টার দিকে। মাহমুদার ঘুম পেয়েছে, তিনি ঘুমাবেন। নীলিমা আকস্মিক বললেন,
‘অভী একা একা কী করছে কে জানে? তাহিয়া, যা দেখে আয় তো।’
মায়ের কাছ ছাড়ার ইচ্ছে হলো না তাহিয়ার। সে বলল,
‘মা ঘুমালে যাই?’
‘মাহমুদার কাছে আমি আছি। তুই যা।’
মাহমুদাও সায় জানালেন,
‘ এ কদিন তো ভাইয়া আর তুহিন ছিল। আজ ওরাও নেই। ছেলেটা একা পড়ে গেছে। তুই গিয়ে দেখে আয়, কী করছে ও।’
মা আর শ্বাশুড়ির কথাকে প্রাধান্য দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। ওর গায়ে আজ মেরুন কালার কুর্তি আর কালো প্লাজো। কালো ওড়নাটা বেডে পড়ে আছে। তাহিয়া ওড়না গলায় প্যাচিয়ে নিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা অবধি যেতেই নীলিমা বললেন,
‘যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারিস। আমরা কিছু মনে করব না।’
তাহিয়া বিব্রতবোধ করল কেন যেন। দ্রুত বেরিয়ে গেল। করিডোরে অনুসন্ধানী দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাঙ্খিত মানুষটার খোঁজ করল। শেষ প্রান্তে বারান্দায় রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন ধরা, কথা বলছে! এই রাত দুপুরে কার সাথে কথা বলছে! ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আকস্মিক স্ত্রীদের সন্দেহী ভাবটা এসে ভর করল তাহিয়াকে। চোখ ছোটো ছোটো করে একবার তাকাল। তারপর ভাবল, এখন গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, বউ থাকতে এতরাতে কার সাথে কথা বলেন। কোথাও প্রেম টেম করেন না তো!
পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলাল। প্রত্যক্ষভাবে জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক উত্তর তো দিবেই না, উলটো মজা নিবে, পরোক্ষভাবে কথা বের করতে হবে।
করিডোরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল তাহিয়া, তারপর লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। চার তলা থেকে চলে গেল নিচতলায়, লিফট থেকে ক্যান্টিনে। এই হাসপাতালের ক্যান্টিনটা সারারাত খোলা থাকে, তাহিয়ার জন্য সুবিধা হলো। দুটো চায়ের অর্ডার দিল। চা আসতেই হাটা ধরল। কী মনে করে আবার ফিরে গিয়ে ক্রিম বিস্কিটের মিনি প্যাক নিল। বিস্কুটটা তার পছন্দ। চারতলায় গিয়ে চা হাতে অভীকের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কথা শোনার চেষ্টা করল। লোকটা একবারে নিচুস্বরে কথা বলছে, শোনা যাচ্ছে না। সন্দেহের মাত্রা গাঢ় হলো। সন্দেহী চোখে তাকিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। অভীক চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। অপ্রত্যাশিত চেহারা দেখে চমকাল কিছুটা।
অবাক চোখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘তুমি!’
সবুজ চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল তাহিয়া। মুখে কিছু বলল না। মেয়েরা জাতগত ভাবে হিংসুটে হয়, বিশেষ করে সঙ্গীর ব্যাপারে। সঙ্গীকে কারো সাথে কথা বলতে দেখলেও তাদের চোখ হিংসার আগুনে জ্বলে। হিংসা থেকে রাগের উপসর্গ। তাহিয়ার ভেতরে কুড়কুড় করে জ্বলছে রাগের শিখা। নব প্রেমে আবার কে হানা দিল, এই ভয়ে কাঁপছে বুক। মুখ খুললে রেগেমেগে আবার কী না কী বলে ফেলে। জোর করে অভীক থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কানে দিতে পারে, অপাশ থেকে মেয়ালি আওয়াজ এলে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ ও করতে পারে। তাহিয়ার পক্ষে এমন করা অসম্ভব কিছু নয়। এখন রাগ দেখানো উচিত হবে না, এই লোকের মনের খবর জানতে হবে। অভীক নামক অধ্যায়টা তার সিলেবাসের বাইরে, বিস্তারিত ঘেটে পড়া হয়নি। পড়তে হবে, জানতে হবে, নয়তো কমন পড়বে না। আবার কে এসে পাশ করে চলে যায়! তা তো হতে দেয়া যায়না। পড়ার মনন নিরবে গা ঢাকল।
অভীক ভ্রু কুঁচকে রেখেই চায়ের কাপ হাতে নিল। ফোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
‘আই কল ইউ লেটার।’
কল কেটে দেয়ায় তাহিয়ার সন্দেহের মাত্রা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। সন্দেহভাজন কেউ না হলে কাটবে কেন! চোখ ঘুরিয়ে আঁধার মাড়ানো আকাশে চোখ রাখল। অভীক বারান্দায় টিমটিমে আলোতে তাহিয়াকে দেখে নিয়ে বলল,
‘ হাসির পর্ব ছেড়ে বেরিয়ে এলে কেন?’
‘এসে আপনার প্রেমে ব্যাঘাত ঘটালাম না কি?’ দাঁত চিবিয়ে বলতে ইচ্ছে করল তাহিয়ার। কিন্তু বলল না। সামনের মানুষটার আরেকটা রূপ তার অজানা নয়।
লম্বা শ্বাস ছেড়ে রাগ সংবরণ করে বলল,
‘আন্টি আপনার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন।’
‘তোমার আন্টি, চা ও আনতে বলেছেন না কি!’ মজা করে বলল অভীক। তাহিয়া গমগমে গলায় বলল,
‘আমি কোথাও খালি হাতে যাই না।’
অভীক চোখ বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিল। তাহিয়া অন্যদিকে ফিরে বিস্কুটের মিনি প্যাকেট অভীকের সামনে বাড়িয়ে দিল। সবুজ চায়ের সাথে কেউ বিস্কুট খায়? তাও ক্রিম বিস্কুট! আজ খাতিরযত্নের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেল না? কারণ টারণ আছে না কি! অভীকের তাকিয়াকে পরখ করে ভাব বুঝার চেষ্টা করল, পরাস্থ হলো। মেয়েটা অন্যদিকে ফিরে আছে। সে বলল,
‘বিস্কুট নিব না।’
তাহিয়া বিস্কুট ফিরিয়ে নিল। তার ভেতরটা অস্থিরতায় ফেটে পড়ছে, কাঙ্খিত প্রশ্নটা করতে । তর সইতে না পেরে আকস্মিক বলে ফেলল,
‘আপনার কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল?’ অতীত থেকে বর্তমান বেরিয়ে আসবে।
তাহিয়া এহেন প্রশ্নে তড়িৎ চোখ খুলল অভীক। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল তাহিয়ার দিকে। আন্দাজ করা যায়, তাহিয়া এমন প্রশ্ন করবে সে কস্মিনকালেও ভাবে নি। সে ভ্রু কুঁচকাল। অবাকের সাথে বলল,
‘কেন, বলো তো?’
উত্তর না দিয়ে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করায় রাগ দমিয়ে রাখতে পারল না তাহিয়া। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘বলতে বলছি বলবেন। ছিল কোন গার্লফ্রেন্ড, প্রেমিকা, আশিকা, দিলরুবা?’
বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অভীক। মেয়েটা এই টোনে কথা বলছে কেন? কথার মাঝে তীক্ষ্ম অধিকার বোধ। চেহারাটাও সুবিধার না, কেমন ক্ষেপে গেছে। হলো কী এই মেয়ের! কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ছিল না, কোন গার্লফ্রেন্ড, প্রেমিকা, দিলরুবা।’
‘স্কুল লাইফ থেকে এখন অবধি কখনো ছিল না! ‘ সন্দিহান হয়ে বলল তাহিয়া। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। অভীক স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘না।’
কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো না তাহিয়ার। সে ফিরতি বলল,
‘আসোলেই ছিল না, না কি স্বীকার করছেন না। সত্যটা বলুন।’ তাহিয়ার স্বরটা দৃঢ়।
এই মেয়ের মতিগতি আদৌ বুঝতে পারবে অভীক? এই তার ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করে, আবার রাগ দেখিয়ে কথা বলে! বিস্ময়কে দমিয়ে উত্তর দেয়ার মনস্থির করল। শীতল গলায় বলল,
‘দুটো কারণে আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না। প্রথমত, ছোটোবেলা থেকে মা সবসময় বলতেন, কখনো মেয়েদের দিকে প্রেম নিয়ে তাকাবি না। তুই বড়ো হলে মা তোকে একটা রাজকন্যা এনে দিব। হাইস্কুল, কলেজ, এমনকি ভার্সিটির প্রথম ক্লাসে ও যাওয়ার আগে এই কথাটা বলেছেন। হাইস্কুল আর কলেজে কথাটার মানে না বুঝলেও ভার্সিটি লাইফে এসে ঠিকই বুঝতে পেরেছি। মা আমার জন্য কাউকে ঠিক করে রেখেছেন। তারপর মায়ের মতে যখন আমি বড়ো হয়েছি তখন মা তার বলা তথাকথিত রাজকন্যাকে বিয়ে দিলেন আমার সাথে। পারতপক্ষে, সে রাজকন্যাই ছিল না। তার ছিল না রাজ, ছিল না তাজ। যা ছিল তা হলো, কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামির ধাত। রাজকন্যা নয়, সে হলো কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামিময় অস্বস্তিকন্যা। ‘
শেষের কথাটা রগড় করে বলল অভীক। আকস্মিক তেঁতে উঠল তাহিয়া,
‘আমি এমন না। মোটেও কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামি করিনা। ‘ সত্যটা জানলেও স্বীকার করতে চাইল না সে।
অভীক হেসে ফেলল, ‘সত্যিই করো না?’
‘না।’ দৃঢ়স্বরে বলল তাহিয়া।
দুজনের মাঝে দেড়হাতের দূরত্ব। অভীক দূরত্ব কমিয়ে তাহিয়ার দিকে ঝুকে এলো কিছুটা। অভীকের আকস্মিক পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত ছিল না তাহিয়া। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল । স্নায়ুবিক দৌর্বল্যগ্রস্থ হয়ে পড়ল আকস্মিক, চা ধরা হাতটা কেঁপে উঠল। ভীত ঢোক গিলল, কেঁপে উঠে তড়িৎ অন্য পাশে সরে গেল। অভীক তাহিয়ার একটা হাত উপরে তুলে বলল,
‘ তোমার কথাই সত্যি। তুমি ওসব কাঁপা-কাঁপিতে নেই। আমিই ভুল ছিলাম। ‘ ব্যাঙ্গাত্মক শোনাল অভীকের কথাটা।
তাহিয়া চোখ খিচে মনেমনে বলল, আপনার এমনটা করা উচিত নয়, একদমই নয়। আমাকে এভাবে জব্দ করেন শুধু। বদলোক একটা! এটা কি বীজগণিত অংক কষা চলে যে, লেফট হ্যান্ড সাইড সমান রাইট হ্যান্ড সাইড প্রমাণ করা লাগবে! হুটহাট কাছে আসতে হবে কেন আপনার? বলে কয়ে এলে তো আমি ঠিকঠাক থাকি।
অভীক সরে গেল। তাহিয়া কথা ঘুরাল,
‘দ্বিতীয়ত?’
অভীক হেসেই বলে গেল,
‘দ্বিতীয় এবং প্রধাণ কারণ হলো, আমি কখনোই নাম আর অধিকারহীন সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলাম না। আমি একজনকে আমার সব অনুভূতি তুলে দিব, কিন্তু তার কথা গলা উঁচু করে কারো কাছে বলতে পারব না। হুটহাট তাকে নিয়ে বের হলে পথিমধ্যে কোন বয়স্ক আত্মীয়ের সাথে দেখা হলে, তার পরিচয় দিতে গিয়ে আমাকে আমতা-আমতা করতে হবে, চোরের মতো মুখ লুকাতে হবে। তারপ্রতি আমার কোন অধিকার থাকবে না। সম্পর্কের বৈধতা থাকবেনা, না আইনগতভাবে, আর না ধর্মীয়ভাবে। এই সম্পর্কের নিদিষ্ট পরিচয় নেই। যে যদি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যায়, বাসায় ছটফট করা ছাড়া আমার কিছু করার থাকবে না। আমি দেখতে যেতে পারব না। কেন?কারণ তার পরিবারের সামনে দেয়ার মতো তার সাথে সম্পৃক্ত আমার কোন পরিচয় নেই, নেই অধিকার। তার প্রতি আমার কোন অধিকার থাকবে না। সে মরে গেলে তার জানাজায় যাওয়ার ও অধিকার থাকবেনা আমার। সম্পর্কের কোন নিশ্চয়তা থাকবে না, প্রতিনিয়ত হারানোর ভয়ে বুকটা কাঁপতে থাকবে। হুটহাট জুড়ে যাবে, আমার সব ধ্যানমন, আমার সব অনুভূতি নিয়ে দিনশেষে চলে যাবে। অনুভূতিগুলোকে অপাত্রে দান করে নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে আমার। অবৈধ সম্পর্কটার জন্য বিয়ের মতো বৈধ সম্পর্কটায় আমার অনিহা আসবে। প্রেমিকাকে সব অনুভূতি দিয়ে বউয়ের জন্য কিছুই খুঁজে পাব না। দিন শেষে, হায়াত শেষে আমাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রেমিকার দায়িত্ব, অনুভূতির মূল্য কিংবা দায়িত্বের জবাবদিহিতা হাশরে না হলেও স্ত্রীর দায়িত্ব অবহেলা, অনুভূতির অমুল্যের জবাবদিহিতা এবং কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সেখানে প্রেমিকার জন্য শাস্তি আর স্ত্রীর জন্য সম্মান প্রদান হবে। প্রেমিকার জন্য আমি শাস্তি পাব, প্রেমিকার জন্য স্ত্রীকের অসম্মান করার জন্য ও শাস্তি পাব। তো ফলাফল কী দাঁড়াল, বেঁচে থাকতে যে অনুভূতি বাঁচাতে এত কিছু করলাম, অনুভূতি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে শাস্তি পেয়েছি, মরার পর প্রমাণ হলো সেই অনুভূতিটা আমি অপাত্রে দান করেছি! যেই অনুভূতির তাড়ানায় বেঁচেছি, সেটাই সাপ হবে। আমি নিজের ভালো চাই। যে সম্পর্কে এত নেতিবাচক দিক সেই সম্পর্কটা আমার পছন্দ নয়।’
লম্বা কথা শেষে থামল অভীক। তাহিয়া মনোমুগ্ধ হয়ে শুনছে। সন্দেহের দল উড়ে গেছে সেই ক্ষণে। অভীকের কথা শুনে অভীক হলো, এভাবে তো কখনো ভাবা হয়নি! অভীক চায়ে চুমুক দিল। গলা ভিজিয়ে আবার বলল,
‘ আমার মতে সম্পর্ক এবং অনুভূতি দুটোই হতে হবে, শুদ্ধ, স্বচ্ছ, বৈধ, পবিত্র। যেখানে অধিকার, দায়িত্ববোধ, বৈধতা সব থাকবে। যে সম্পর্কটায় থাকলে দশজনের সামনে গলা উঁচু করে বলা যাবে ‘মানুষটা আমার সঙ্গী, তার সাথে আমি ধর্মীয় এবং আইনগতভাবে লিখিত, পবিত্র,বৈধ বন্ধনে আবদ্ধ আছি।’ প্রেমিক-প্রেমিকা হলে এতটা জোর গলায় বলা যায় না। এই যে রাত দুপুরে তুমি আমার সাথে কথা বলছো। এখন কোন মানুষ যদি এসে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সম্পর্ক কী? আমি জোর গলায় বলতে পারব, আমরা স্বামী স্ত্রী। তখন তারা কিছু বলবে না, বিনা বাক্যে চলে যাবে। কিন্তু তুমি যদি আমার স্ত্রী না হয়ে প্রেমিকা হতে, তাহলে আমি বলতে পারতাম না। প্রেমিকা বললে তারা ব্যঙ্গ করে বলতো, ‘রাত বিরাতে নষ্টামি করেন? ‘ এমন মন মানুষিকতার চারপাশের মানুষের। আমাদের ইয়াং জেনারেশনের কাছে বিয়ের আগে যেটা ‘প্রেম- ভালোবাসা’, বয়স্কদের কাছে সেটা ‘নষ্টামি’। কিন্তু বিয়ের পরের অনুভূতি গুলোর দাম তাদের কাছেও আছে। এ সমাজের কাছে প্রেমিক প্রেমিকার অনূভুতির মূল্যায়ন নেই। আমার কথা হচ্ছে আমার অনুভূতির মূল্য এবং গ্রাহ্যতা থাকতে হবে।
আমার জীবনে বিশেষভাবে একজন নারীই আসুক, আমার সব ধ্যানমন তার কাছেই থাকুক। সে হোক বৈধ। যার ভালোমন্দ দেখার, আগলে রাখার দায়িত্ব থাকুক আমার কাধে। দায়িত্বের সাথে সাথে যাকে আমি মনে পুষে রাখতে পারব। যার প্রতি আমার অনুভূতিটা মুল্যবান হবে সবার কাছে। সেই একজন আসুক আমার জীবনে। আমার পথচলার সঙ্গী হয়ে, আমার বন্ধু হয়ে, আমার অনুভূতি হয়ে, আমার জীবনের আলো হয়ে। যার কাছে আমার অনুভূতি দিয়ে কখনো ঠকব না, নিঃস্ব হবো না। আমার যে অনুভূতির মূল্য পাওয়া যাবে বেঁচে থাকতে এবং পরকালে। এই জন্যই প্রেম করা হয়নি। ‘
তাহিয়া অভিভূত হয়ে শুনছে। কী সুন্দর ভাবনা লোকটার! মনোভাব কী চমৎকার! হৃদপিণ্ড চলকে উঠছে তার। কারো প্রথম প্রেম হওয়া সুন্দর ব্যাপার। কিন্তু কারো প্রথম, শেষ এবং একমাত্র ভালোবাসা হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। শ’য়ে কজন এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মায়? অভীকের সব অনুভূতি তার জন্য জমানো আছে, এ অনুভূতি একান্ত তার। এতে কারো ভাগ নেই। কেউ নেই, লোকটা তার, একান্তই তার। ভেবেই সুখের দোলা লাগল মনে। হৃদস্পন্দন বেড়ে কত হলো কে জানে? একশো পেরুলো না কি! একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে খুশির কী হতে পারে? ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল আপনাআপনি। অভীকের অগোচরে অন্যদিকে ফিরে হাসল সে।
তাকে লক্ষ করে অভীক বলল,
‘তুমি ভেবো না, আমি তোমাকে ভালোটালো বাসি। ওসব ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেল। আমার অনুভূতি এখনো তোমার জন্য জাগ্রত হয়নি। ওসব কাজে আমি অনভিজ্ঞ। ওসবে তোমার অভিজ্ঞতা ভালো, তোমাকেই আগাতে হবে। ‘
বলবেনা করেও কত কী বলে দিল লোকটা? কী ইঙ্গিত দিল? সে আগালে লোকটাও আগাবে, এর আগে নয়? হাহ্! আগ্রহ না জাগলেও জেগে যাবে। সে তার কদম তো বাড়িয়েই ফেলেছে। আর কয়েক কদম বাড়িয়ে অভীককে ছুঁয়ে ফেলবে, নিজের ভাগের ভালোবাসাগুলো আদায় করে নিবে। নিবেই? হ্যাঁ, নিতে যে হবেই। সিদ্ধান্ত কষল তাহিয়া। হাতে থাকা চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
নয়া প্রেমে মনখুশির বেলায় অসুন্দর জিনিস সুন্দর লাগে, বিস্বাদ জিনিস সুস্বাদু লাগে। খুশিতে আজ ঠান্ডা চাও অমৃত লাগছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাহিয়া মনে মনে বলল,
‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই,
ডাইনে ও বায়ে আমি তোমাকে চাই,
দেখা, না দেখায় আমি তোমাকে চাই,
না বলা কথায় আমি তোমাকে চাই।
প্রথমত আমি তোমাকে চাই,
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই…
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই,
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই’
সুমন চ্যাটার্জির ‘তোমাকে চাই’ কবিতার কয়েকটা লাইন এলোমেলো করে আবৃত্তি করল তাহিয়া। একবার নয়, বারংবার। আড়চোখে একবার তাকাল পাশে দাঁড়ানো হলদেটে মানবের দিকে। ‘এ্যাডিডাস’ এর সাদা টি-শার্টটায় কী সুন্দর লাগছে লোকটাকে! চোখে কেমন ঘোর লাগছে। লোকটার উচিত নয় সাদা পরার, একদমই নয়। সাদা রংটায় ছেলেদের সুদর্শন দেখায়। লোকটা কি এটা জেনেই সাদা পোশাক পরে আসে? কেন? তাকে আকৃষ্ট করার জন্য? কিন্তু সে তো আগেই লোকটার ব্যক্তিত্বে আটকে গেছে। ওই যে অবনীর বাসায় মানুষের ভরা রুমটা থেকে তার হাত ধরে বের করে আনল, পাঁচতলা বেয়ে ওষুধ এনে খাইয়ে দিল, তার এই যত্নাভাব আর দায়িত্ববোধ দেখেই তো অঘটন ঘটে গেল, সাংঘাতিকভাবে প্রেমে পড়ে গেল। রূপে ঘোরটা লেগেছে এর পরে। তবে এমন রূপে সাজবে কেন? এটা অনুচিত। এই রংটা পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। শীঘ্রই। ঘোর টোর লেগে আবার কী কান্ড বাধিয়ে বসে, তার ঠিক নেই।
তাহিয়া চোখ ঘুরাল, ঘুরাল কথাও,
‘ গার্লফ্রেন্ড না থাকলে তখন কার সাথে কথা বলছিলেন?’
এতক্ষণে তাকে প্রশ্নবিদ্ধের কারণ বোধগম্য হলো অভীকের। মেয়েটা তাকে সন্দেহ করছিল! সন্দেহের বশেই এত অধিকারবোধ? কী আশ্চর্য! কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা রগড় স্বরে মিশিয়ে সে বলল,
‘ তাইতো বলি, আজ বাড়তি খাতিরযত্ন কেন! এখন বুঝতে পারলাম, আয়োজন করে আমার পেট থেকে কথা বের করা তোমার উদ্দেশ্য। আমাকে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলেও কিন্তু বলে দিতাম। এই মাখন বিস্কুটে আমাকে মাখানোর চেষ্টা করতে হতো না তোমার। ‘
জব্দ হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল তাহিয়া। ভাবেনি অভীক এভাবে তাকে জব্দ করবে! এবার কী বলবে সে! কত কথা জমা ছিল মনে, সব কেমন যেন মুছে গেল। পুরোটায় শূন্যতা বিরাজ করছে যেন, বাকশক্তিও রুদ্ধ হয়ে গেছে। এবার মুখটাও ঘুরাল। অভীক চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে হাসল, নিঃশব্দে। মুখের সামনে থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে হাস্যমুখ বলল,
‘তুমি বউ বউজনক আচরণ করছো, তাহিয়া। সবকথায় আগ্রহ দেখাচ্ছো, কেয়ার টেয়ার করছো, সন্দেহ ও করছো। তোমার আচরণ সাংঘাতিক দিকে চলে যাচ্ছে। এ ধারায় চলতে থাকলে তোমার তিন বছরের পণ তো অকালেই ঝরে যাবে। সময় থাকতে আচরণের চিকিৎসা করাও, নয়তো পরে আবার সময়-সুযোগ নাও পেতে পারো। ‘
চোখ মুখ খিচে দাঁড়িয়ে রইল তাহিয়া। লোকটা মহাপাজি। তাকে জব্দ করার সুযোগ খুঁজে যেন, পেলেই লুফে নেয়। এই লজ্জাভাবটাও অতিরিক্ত জ্বালাচ্ছে, যখন তখন এসে হানা দেয়। যখন ভাবে একটু চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, তখনই এসে ঝাপটে ধরে। সে তার কার্যসিদ্ধি করতে পারেনা। এখন এসে হানা দিল আবার। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। তাহিয়া পিছু ঘুরল। যেতে নিলে অভীক বলল,
‘যেই প্রশ্নের জন্য অস্বস্তির বাধ ভেঙে এত ধাপ এগিয়ে এলে, সেই প্রশ্নের উত্তর না নিয়েই চলে যাবে?’
তাহিয়া তাকাল না। ধীর স্বরে বলল,
‘লাগবে না।’
অভীক হাসল, হাসিটার শব্দ হলো। হাসি থামিয়ে বলল,
‘ ‘সন্দেহ’ হলো ‘ঘুণ পোকা’র মতো। সম্পর্কে একবার ঢুকলে সম্পর্কটাকে খেয়ে নিঃশেষ করে দেয়। পরিণতি ভয়াবহ হয়। আজ সন্দেহ করছো, কাল দেখা যাবে আমাকে পাহারা দিতে আমার বাসায় গিয়ে উঠেছো। কোমরে কাপড় গুজে খুন্তি হাতে আমার চোখ রাঙাচ্ছো। কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে বুঝতে পারছো, তুমি!’
আবার হাসল । শব্দটা তাহিয়ার কানে বাজল। তাহিয়া কদম বাড়াল। অভীক শীতল স্বরে বলল,
‘ সাংঘাতিক ঘটনা ঘটার আগে তোমার ভুল ধারণার চিকিৎসা করা উচিত। তোমার শ্বাশুড়ি আমাকে তোমার জন্য প্রস্তুত করতে গিয়ে মেয়েবন্ধু বানাতেও দেননি। কলে আমার ফরেনার ফ্রেন্ড ছিল। অবশ্যই সে ছেলে। আমরা একসাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। ওদের দেশে এখন দিন। এইসময়টায় অবসর থাকে। তাই মাঝরাতে কথা হয়। আর কিছু জানাতে হবে? কললিস্ট দেখাতে হবে?’
‘লাগবে না।’ ছোটো করে উত্তর দিয়ে হাটায় মন দিল তাহিয়া। কিছুদূর গিয়ে পিছু ফিরল। অভীকের অদ্ভুত একটা দৃষ্টি এসে ধাক্কা খেল চোখে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে,এক ভ্রু উঁচিয়ে কিভাবে যেন লোকটা তাকিয়ে আছে ওর পানে। তাহিয়ার মনে হলো এ দৃষ্টি নয়, তীরন্দাজের ধনুক থেকে বের হওয়া তীর। যা সোজা এসে তার বুকে বিঁধেছে, হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। আবার মনে হলো,
‘এটা দৃষ্টি হতে পারে না, একদমই না। এটা ইন্দ্রজাল, যা আমাকে কাবু করে ফেলেছে।’
তড়িৎ ঘুরে হাটা ধরল। এক প্রকার দৌড়ে মায়ের কেবিনে এলো। নীলিমা, মাহমুদা ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলিমা বাড়তি বেডে শুয়েছে। তাহিয়ার জন্য জায়গা রেখেছেন। তাহিয়া নিঃশব্দে গিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভাসল অভীকের সেই গভীর চাহনি, কেমন শিহরিত হলো সারা গতর। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। এই মুহুর্তে তার নিজেকে ষোড়শী কন্যা মনে হচ্ছে, নয়া প্রেমে মাতোয়ারা প্রেমিকা। আবেগী বয়সে প্রেমে পড়ল মানুষ কত কী করে! খাওয়া ঘুম সব উজাড় করে প্রেমপুরুষকে নিয়ে ভাবতে থাকে। কারণে অকারণে হাসতে থাকে, কতবার আয়নায় দেখে! ধ্যান জ্ঞানে স্থান দেয় প্রেমপুরুষকে।
.
তাহিয়ার কৈশোর পেরুলেও আবেগটা রয়ে গেছে। প্রেমটা কাবু করেছে তাকে।
এই যে নয়া প্রেমে কাবু হয় সারারাত ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করতেই অভীকের চেহারা ভেসে উঠছে চোখে, কানে বেজে উঠছে অভীকের বলা কথা গুলো। শব্দহীন হাসিতে পার করল সারারাত। অভিজ্ঞতাটা একবারেই নতুন তার জন্য। রেহানের প্রতি তার ছিটেফোঁটা আবেগ ছিল, যার গাঢ়তা ছিল না। সেটা ভালোলাগা ছিল, প্রেম ছিল না। প্রেমটা বোধহয় অভীকের উপরই হলো। এই মুহুর্তে এসে বুঝতে পারছে তাহিয়া। প্রথম প্রেমের অনুভূতি গুলো চমৎকার হয়, পরের প্রেমে অনুভূতিগুলো ফিকে হতে শুরু করে বলে সেই চমৎকার অনুভূতি আসে না। মনোমুগ্ধকর অনুভূতিতে বিমোহিত হয়ে তাহিয়া বিড়বিড়াল,
‘ প্রেম হলো তাও আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষের উপর! মানুষ বলে বিয়ের পর প্রেম হয় না। আমি বলি, তোমরা প্রেমের কায়দা জানো না। অনুভূতি গুলো জমা রাখো, নিজের নামে লেখা মানুষটাকে দাও, প্রেমটা শুধু জমবে না, জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। আহ্! প্রেম! কী অনুভূতি! আমি অভিভূত! ‘
সারারাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে মাইগ্রেন হানা দিল ভোর রাতে। ব্যাথায় অতিষ্ঠ হয়ে তাহিয়া অভীককে ম্যাসেজ করল,
‘আমার দিকে আর কখনো এভাবে তাকাবেন না। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি।’
উত্তর এলো না। মাহমুদা উঠার পর মাকে সময় দিতে গিয়ে তাহিয়ার স্মরণ থেকে মুছে গেল ব্যাপারটা।
.
অভীকের সাথে দেখা হলো সকাল ন’টায়। কেবিন থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে যাচ্ছিল তাহিয়া। কদিন যাবত মীরা খাবার নিয়ে আসছে, আজ নিষেধ করেছে। কষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওর উপর।ভেবেছে আজ ক্যান্টিন থেকে কিনে নিয়ে আসবে। করিডোরের মাঝে দেখা হলো অভীকের সাথে। অভীক এর মাঝে বাসায় গিয়ে কলেজের জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাহমুদার কেবিনের দিকে আসছে। তাহিয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বলল,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘ক্যান্টিনে যাচ্ছি।’ থেমে ধীরে উত্তর দিল তাহিয়া।
অভীক গম্ভীরমুখে বলল, ‘আসার সময় ফার্মেসি থেকে এক পাতা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এসো।’
‘কেন!’ ভ্রু কুঁচকাল তাহিয়া। অভীকের দৃষ্টি তার হাতে পরা ডায়াল ঘড়ির উপর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আজ তোমার ঘুম হবে না।’
‘কেন!’ কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। অভীকের কথা তাহিয়ার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অভীকে মুখটা স্বাভাবিক, না হাসিমাখা, আর না রাগের আভা।
সে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘কারণ আমি এখন তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলব। কথাটা বলতে হলে তোমার দিকে তাকাতে হবে। আর আমি তাকালে তো তোমার আবার ঘুম টুম হয় না না কি। তাই আগে থেকে সতর্ক করছি। ‘
এতক্ষণে কৌতুকের আভা ফুটে উঠল অভীকের চোখে মুখে। তাহিয়া মনে মনে বলল, একটা মানুষ এতটা পাজি কিভাবে হতে পারে! কোথাকার কথা ঘুরিয়ে কোথায় নিয়ে আসছে। আমি ভাবলাম, কী না কী! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কী বদ, লোকটা! এতটা হওয়া উচিত নয়। সে কথা ঘুরাল, এই লোক ম্যাসেজটা নিয়ে নয়তো আবার লেগপুল করবে,
‘কী গুরুত্বপূর্ণ কথা!’
তাহিয়ার দিকে তাকাল অভীক। তারপর বলল,
‘মাকে বলবে, আজ বিকেলে আসব না আমি।’
‘কবে আসবেন!’ উদ্ধিগ্ন হয়ে আনমনে বলে ফেলল তাহিয়া। অভীক হেসে ফেলল,
‘রাত হবে আসতে আসতে। মা ফোন ধরছে না। মাকে বলে দিও। আর নিজের খেয়াল রেখো।’
বলে যে পথে এসেছে সে পথেই চলে গেল। পরের দিন গুলো এক কাপ চায়ের আলাপেই কাটল। তারপর এলো মাহমুদার রিলিজের দিন, আর অভীকের সংস্পর্শ থেকে তাহিয়ার বিচ্ছেদের দিন। আবার তাহিয়ার দিন পঞ্জিকায় মন খারাপের মধ্যবেলা এসে পড়ল। মায়ের জন্য শান্তি ও লাগছে, অভীকের জন্য মনটা কেমন করছে। সেভাবে আবার কবে দেখা হবে? আলাপ কী হবে? হবে এক কাপ চায়ে তাকে চাওয়া? নয়া প্রেমমাখা চায়ে বিচ্ছেদের লিকার পড়ল যেন।
চলবে…
কাল দিইনি বলে আজকের পর্বটা একটু বড়ো করে দিলাম। প্রায় ৩,৭০০+ শব্দের পর্ব। সবার থেকে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।