#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
[৭]
ঘুম থেকে উঠার পর একটা বি স্ফো রি ত খবর চিত্রাকে মুহূর্তেই বাকরূদ্ধ করে দিলো। সে ভয় পেলো অনেক, অথচ মানতে নারাজ। সে মনে প্রাণে যেন একটা বিশ্বাস এটে রেখেছে, তার বাহার ভাই তাকে এতটা ব্যাথা দিতেই পারে না। অসম্ভব এবং অসম্ভব এটা। সে বারান্দায় ছুটে গেলো। বাহার ভাইয়ের বাড়ির ভেতরটা অনেক উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো কিন্তু সক্ষম হলো না। অন্যান্য দিনের মতন হাঁক ছেড়ে ডাকলো বনফুলকে কিন্তু তাও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। সে আবার ঘরে এলো ব্যস্ত পায়ে৷ ঘরে আসার সময় তার সবচেয়ে পছন্দের রঙ্গনা ফুলের গাছটা ভুলবশত পায়ে লেগে ভেঙে গেলো। চিত্রার সেদিকে ধ্যান নেই। অন্যসময় এ কাজটা হলে সে কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তুলতো। কারণ এ গাছটা তার বাহার ভাই তাকে দিয়েছে যে! বড়ো যত্নের গাছ কি-না! কিন্তু আজ তার কোনো খেয়ালই নেই। বরং সে কিছুটা ছুটেই গেলো বাহার ভাইদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জুতো জোড়া পড়লো উল্টো। চেরি কয়েকবার পিছু ডাকলেও সেদিকে তার ধ্যান নেই।
বাহারদের বাড়িতে সকলের জটলা। একটা মেয়েকে ঘিরে বসে আছে বাহার ভাইয়ের মা-সহ চিত্রাদের বাড়ির মহিলাগণ। তার মাঝে রয়েছে অবনী বেগম আর রোজা সওদাগর। চিত্রার মা তো কলেজ থাকেন এ সময়টা। চিত্রা চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। শুকনো, জীর্ণ-শীর্ণ একটা নারী দেহ বসে আছে সেখানে। মুখে ব্রণের অস্তিত্ব, কালো কালো কত গুলো এলোমেলো দাগ, টানা মায়া মায়া দুটো চোখ, সরু নাক মেয়েটার। চেহারাটা ভীষণ মিষ্টি। বয়সটা ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কতই বা হবে? তেইশের এপাড়-ওপাড়! ঠোঁট দু’টো শুষ্ক। গালে লেপ্টে আছে অশ্রুর চিহ্ন। মেয়েটা বোধহয় কান্নাকাটি করেছিল কিছুক্ষণ আগে। চিত্রার অন্তর আত্মা কিঞ্চিৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটা কেঁদেছিল কেন? মেয়েরা তো বিয়ের সময় বাবার বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কান্না করে। এই মেয়েটা কী সেজন্যই কান্না করেছে? এবার চিত্রার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। বাহার ভাই সত্যি সত্যিই তাকে ধো কা দিলো না তো!
আয়েশা খাতুনের দৃষ্টি পড়লো চিত্রার দিকে। মুচকি হেসে বললো,
“এমা, আজ কে ডাকলো তোরে? তোদের বাড়ির মানুষ তো আমাদের বাড়িতে। উঠলি কীভাবে?”
চিত্রার চোখ জলে পরিপূর্ণ হলো। গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে। সে চোখ উল্টিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সক্ষম হলো না। চোখের জল কী আমাদের কথা শুনে? শোনে না। সে সবসময় অবাধ্য। আর তার এই অবাধ্যতার কারণে আমরা কখনো কখনো নিজেকে মানুষের কাছে দুর্বল প্রমান করে ফেলি কখনো বা নিজেদের বানাই হাসির পাত্র।
অবনী বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে এলেন। চিত্রাকে কিছুটা জাপ্টে ধরে বললেন,
“ওমা, ওমা, কাঁদছো কেন? কী হয়েছে চিত্রা? ভয় পেয়েছো?”
এমন আদুরে স্বর শুনে কান্নারা কী আর চুপ থাকে? চিত্রার কান্নারাও চুপ রইলো না। চিত্রা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মনে মনে বার বার সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে বললো এটা যেন দুঃস্বপ্ন হয়৷ চিত্রার যেন এখনই ঘুম ভেঙে যায়৷ সে নাহয় খারাপ স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে সব। কিন্তু চিত্রার ডাক বোধহয় উপরওয়ালা শুনলো না। পুরোটাই বাস্তব হলো।
আবনী বেগমের পাশাপাশি এবার যুক্ত হলো আয়েশা খাতুনও। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে সে আর বসে থাকতে পারলো না। এসেই চিত্রার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“কী হয়েছে তোর? ভয় পেয়েছিস? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস, মা?”
চিত্রা কেঁদেই চলেছে। কান্নার কোনো থামা থামি নেই। সকলে মুহূর্তেই তাজ্জব বনে গেলো। বাহারও ধপধপ পায়ে দ্রুত নেমে এলো ছাঁদ থেকে। লোকটার চুল বেয়ে বরাবরের মতনই পানি পড়ছে। ছাঁই রাঙা টি-শার্ট টা শরীরকে মুড়িয়ে রেখেছে। লোকটা কপালে ভাঁজ ফেললো, বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, কাঁদছো কেন? কী সমস্যা?”
বাহারকে দেখে চিত্রার কান্নারা আহ্লাদী হলো। চিত্রা ঠোঁট ফুলিয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
“আপনি নাকি বিয়ে করেছেন?”
বাহার সহ উপস্থিত সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাহার তো বেশ জোরেসোরেই বললো,
“কী! কী খেয়েছো ঘুম থেকে উঠে!”
বাহারের অভিব্যক্তিই চিত্রাকে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিলো। সে যে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে সেটাও বুঝে ফেললো মুহূর্তেই। সে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
“ঐ, ঐ মেয়েটা কে?”
“ও তোর বাহার ভাইয়ের বান্ধবী। বেড়াতে আসছে।”
আয়েশা খাতুনের দুই বাক্যেই চিত্রার কান্না নির্বাসিত হলো। চেরি মেয়েটার কথায় লাফানো যে তার বিরাট ভুল হয়েছে সেটা তার মস্তিষ্ক মুহূর্তেই অনুভব করে ফেললো। অবনী বেগমের কণ্ঠে এখনো চিন্তার ছোঁয়া, সে চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“কান্না করেছিলে কেন, চিত্রা?”
চিত্রা আমতা-আমতা করলো, এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছোটো করে বললো,
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছি ছোটোমা।”
“সেজন্য কাঁদতে আছে! বো কা মেয়ে!”
চিত্রা মুচকি হাসলো। তার বুকের উপর থেকে বড়সড় একটা পাথর যেন মুহূর্তেই পরে গেলো। আহা, কী শান্তি। ঘুম থেকে উঠে কি কান্নাকাটিই না করতে হলো মিছিমিছি! চিত্রা আড়চোখে তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে। লোকটা কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে! মনে হচ্ছে এই যেন ভ স্ম করে দিবে তাকে। চিত্রা আর বাক্যব্যয় না করে ছুটে গেলো নিজেদের বাড়ি। জেনেশুনে বাঘের মুখে পড়ার কোনো মানেই হয় না।
_
তুমুল রোদ মাথার উপরে। বিশাল আকাশে সূর্য যেন তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে। গরমে ঘেমে একাকার অহি। মাথার উপরে গোলাপি রঙের ছাতাটা কিছুটা ছায়া দেওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত। তবে এমন তুখোড় রোদের কাছে ছাতাটা নিতান্তই সামান্য কিছু। অহি চোখের গোলগোল চশমাটা আরেকটু ঠেলে দিয়ে আঁটসাঁট করলো চোখের সাথে। শরীরে একটা হাঁটু সমান ঢিলে সাদা রঙের শার্ট, গলায় ঝুলিয়ে রাখা স্কার্ফ গাঢ় খয়েরী রঙের, হাতে চিকন চেইনের ঘড়ি মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া। মেয়েটা সবসময় সাধারণ থাকতে পছন্দ করে। ফার্মগেটের রাস্তা পেরিয়ে সরু গলি ধরলো সে। পথে আজ রিকশা, গাড়ি খুব স্বল্প আর যতটুকু আছে সেগুলো ধানমন্ডি অব্দি যেতে চাচ্ছে না। কী ভীষণ যন্ত্রণায় পড়লো সে! তাই কিছুটা পথ হেঁটেই এগোচ্ছে। দেখা যাক কোনো রিকশা গাড়ি আদৌও পায় কি-না!
বেশ খালি রাস্তায় একটা মিষ্টি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই আইসক্রিমের ভ্যান। অহি চোখ পিটপিট করে তাকালো মেয়েটার দিকে। ভীষণ পরিচিত মনে হলো বাচ্চাটাকে৷ অহি তাই ছোটো কণ্ঠে ডাক দিলো,
“এই বাবু।”
অহির এক ডাকেই বাচ্চাটা অহির দিকে তাকালো। মিনিট কয়েক ব্যয় করলো অহির মুখমন্ডলে। তারপর হুট করেই রাজ্য হয় করা এক হাসি দিয়ে ছোটো ছোটো পায়ে দৌড়ে এলো। অহির হাঁটু জড়িয়ে হলো ভীষণ আদুরে হাতে।
অহি বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলালো। মিষ্টি হেসে বললো,
“তুমি চিনতে পেরেছো আমায়?”
বাচ্চাটা আদুরে ভঙ্গিতে মাথা দুলালো। অহিও হাসলো। এই মেয়েটার জন্যই তো সে সেদিন রেস্টুরেন্টে কেমন বাচ্চাদের মতন ঝগড়া করেছিলো! ভাবতেই অহির লজ্জা লাগে। মাঝে মাঝে সে কতটা বোকামি করে বসে তাই না!
অহির ভাবনার মাঝেই মেয়েটা আধো আধো কণ্ঠে বললো,
“আন্তি আইতকিরিম দেও।”
কথাটা বলেই বাচ্চাটা দু-হাত বাড়িয়ে দিলো। ছোটো ছোটো গোল গোল হাত গুলো। অহি হাসলো, বাচ্চাটার নাক টেনে বললো,
“তোমার কী আইসক্রিম ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না?”
বাচ্চাটা উপর-নীচ মাথা দুলালো, যার অর্থ লাগে। অহি গাল টিপে বললো,
“আর কী ভালো লাগে?”
“তোমাকে।”
অহি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো মেয়েটার দিকে। কী পাঁকা মেয়ে! বাচ্চাটা তার মাঝেই তাড়া দিয়ে বললো,
“আইতকিরিম দেও আন্তি।”
অহি হাসলো। আইসক্রিমের ভ্যানটার কাছে গিয়ে ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম কিনে দিলো। বাচ্চাটা ছোটো ছোটো হাতে সাবধানে ধরলো সেটা। অহি বাচ্চাটার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
“আচ্ছা হুমু, তুমি একা কেন? তোমার পাপা কোথায়?”
অহির কথায় উত্তর দিলো না হুমু। মনের সুখে সে ঠোঁট চাপলে আইসক্রিমে। এর মাঝেই কোথা থেকে ছুটে এলেন সেদিনের ভদ্রলোকটা। ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে, কপালের মাঝে চিন্তার রেখা। মেয়েকে কিছুটা টেনে নিজের কোলে নিয়ে অনবরত চুমু খেকে লাগলেন। হুমু বাবার চিন্তিত মুখটা দেখে গলা জড়িয়ে ধরলো বাবার। কেমন বড়োদের মতন করে বললো,
“ভয় পেয়ো না পাবা, এইতো আমি এখানে, আন্তির সাতে (সাথে)।”
মেয়ের কথায় হুশ ফিরলো ভদ্রলোকের। সে অহির দিকে তাকিয়ে চমকে গিয়ে বললো,
“আরে ঝগড়ুটে মহিলা, আপনি!”
এমন ডাকে অহির বেশ রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও রাগলো না। লোকটাকে বেশ অবাক করে দিয়ে হেসে উঠলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
“হ্যাঁ আমি, আজও আইসক্রিম কিনে দিতে এলাম বোধহয়।”
অহির ঠান্ডা মেজাজে এবার লোকটা নিজেইই লজ্জা পেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“ধন্যবাদ, আমার মেয়েকে রাখার জন্য।”
অহি স্মিত হেসে উত্তর দিলো,
“আজকের আইসক্রিমের দাম মাত্র চল্লিশ টাকা, চারশত টাকা দিবেন নাকি আজ?”
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কৃতজ্ঞতার তো দাম নেই। সেদিনের জন্য দুঃখীত।”
“হুমুর বাপকে ক্ষমা করা হলো।”
অহি কথাটা বলে নিজেই চমকে গেলো। চিত্রার সাথে থাকতে থাকতে সেও যে ওর মতন হয়ে যাচ্ছে ভেবেই হাসি এলো। অতঃপর দু’জন একসাথে হেসে উঠলো। লোকটা হাসতে হাসতে বললো,
“আমি হুমুর বাপ তবে নাম নওশাদ।”
“আমার নামটা আন্তিই রইলো। হুমুর আইতকিরিম আন্তি।”
#চলবে