প্রেমোত্তাপ পর্ব ১৯

0
604

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৯.

জানুয়ারির ব্যস্ত শহরে এখনো ঝিমিয়ে আসা শীত উঁকি দেয়। কৃষ্ণচূড়ার লাজুক ডালে এখনো শূন্যতা উপস্থিত। এখনো শহরের অলিতে-গলিতে প্রেমের প্রত্যাখ্যান জ্বলজ্বল করছে ডিসেম্বরের বিদায়ে। কোথাও বা তুমুল আহ্লাদে প্রেম গাঢ় হচ্ছে! এই এত হওয়া- না হওয়া ব্যাপারটার মাঝেই একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। যেই ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে সওদাগর বাড়ির সুখ। সেই বাড়ির চঞ্চল প্রাণে আজ করুণ আহাজারি। হসপিটালের গাঢ় পরিবেশে সেই আহাজারি জীবন্ত, সতেজ এবং যন্ত্রণার।

চঞ্চল চিত্রার দেহ এখন নিস্তেজ প্রায়। ক্লান্ত চোখের পাতা এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হসপিটালের গুমোট করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে প্রিয়জনেরা। ভাইয়ের দেহ ভেঙে আসতে চাচ্ছে চিন্তায়। আদুরে বোনের এই বিরাট ব্যাথা যে তার সহ্য হচ্ছে না। সে আজকে ভার্সিটি ছিল। হুট করে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো, জানানো হলো তার বোনের এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা। তারপর সে যেন প্রায় ঘোরের মাঝেই ছুটে এলো। তার সাথে এলো নিরু মেয়েটিও। মাহিন— চিত্রার এক্সিডেন্ট যার বাইকের সামনে ঘটেছিল, তার উপর ক্ষেপে যায় তুহিন। ক্ষুব্ধ হয়ে ছুটে যায় প্রহার করতে। কিন্তু ছেলেটা থামায় তুহিনকে, বিনীত স্বরে জানায় দোষ তার নয়। সে সাবধানেই চালাচ্ছিল। হঠাৎ চিত্রা কোথা থেকে ছুটে এলো সে ঠাহর করতে পারল না। মধ্য গতির বাইকটি থামতে থামতে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। তুহিন তবুও থামতে চায় না তবে সামলায় নিরু। ততক্ষণে বাড়ির প্রায় সকলে উপস্থিত হয়। চাঁদনী আপা, অহি, চিত্রার মা, চেরি, অহির মা-বাবা, আফজাল সওদাগরসহ সকলে।

প্রিয়জনদের দীর্ঘস্থায়ী অপেক্ষার পালা শেষ হলো, ডাক্তার বেরিয়ে এলো সুসংবাদ নিয়ে,
“চিত্রা সওদাগরের এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। তবে…..”

ডাক্তারের অযাচিত বিরতি বড়োই অসহ্যকর ঠেকল সওদাগর পরিবারের কাছে। মুনিয়া বেগম সহ্য করতে পারল না সে বিরতি। ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালেন,
“তবে?”

“উনার বা’হাতের আঘাত মারাত্মক পর্যায়ে ছিল যার জন্য তার কবজির হাড়ে ফাটল ধরেছে বলা যায়। আমরা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। এবং যেহেতু মাথায় ও পিঠেও আঘাত পেয়েছে সেহেতু দু’দিন আমরা অবজারবেশনে রাখবো তাকে। অতিরিক্ত ব্যাথা থেকে জ্বর আসবে। আর এখন জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফিরলেই তার সাথে দেখা করতে পারবেন।”

উপস্থিত সকলের মাঝে তুহিনকে বেশি ভেঙে পড়তে দেখা গেল। সে ধপ করে বসে পড়ল সাথের চেয়ারটাতে। মুখ ঢেকে ফেলল যন্ত্রণায়। মেয়েটা কত বেশিই না ব্যাথা পেয়েছে! ছোটো নাজুক শরীরটা কতটা আঘাত পেল! তুহিন যেন বাইক চালানো ছেলেটার উপর আরও একধাপ বেশি রেগে গেল। কেবল প্রকাশ করল না। মুনিয়া বেগম হলেন ছেলের আশ্রয়স্থল। এই ভয়ঙ্কর বিপদেও সে দৃঢ় স্বরে বললেন,
“তুহিন, এটা সামান্যই। ওর জানের ক্ষতিও তো হতে পারতো? তাই না? কিন্তু বেঁচে গিয়েছে। সেজন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ নয় কী?”

মুনিয়া বেগম সদা কঠিন থাকার একটি ক্ষমতা নিয়ে জন্মিয়েছেন বোধহয়। কখনো, কোনো ব্যাপারে তাকে মারাত্মক রকমের বিচলিত দেখা যায় না। সবসময় বিপদে ভেঙে আশা মানুষের ভরসা হয়েই থাকেন তিনি।

অহি মিহি স্বরে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। ক্ষণে ক্ষণে নাকও টানছে। চাঁদনী যে কাঁদছে না, তেমনটা নয়। তবে অহির কান্না, চেরির কান্না সামলানোর দায়িত্ব যেহেতু তার ঘাড়ে পড়েছে তাই তার আর আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে কান্না করা হচ্ছেনা। তবে তার ভেতরটা ভেঙে আসছে। চিত্রা তার খারাপ সময়ের কঠিন ঢাল। অভিমানী মেয়েটাও চাঁদনী আপাকে বাঁচাতে বড়োদের সামনে বুক পেতে রাখে। চাঁদনী আপার কষ্ট দেখে, সে-ই মেয়েই তো হাউমাউ করে কাঁদে। পৃথিবীতে আমাদের জন্য কান্না করা মানুষের বড়োই অভাব। বেঁচে থাকা মানুষের জন্য সচারাচর কেউ কাঁদতে চায় না। কাঁদে তো মৃত মানুষের জন্য। অথচ সেই প্রথা মিথ্যে করে দিয়ে, চিত্রা প্রায় রোজই কাঁদে চাঁদনী আপার দুঃখে। এই মেয়েটাকে হারালে, চাঁদনী যে নিজের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল শুভাকাঙ্খীকে হারাবে! কত-শত ভাবনার মাঝেই চাঁদনীর ফোন বেজে উঠল খুব গোপনে। ফোনের ভাইব্রেশনের তোপে কাঁপছে যেন শরীরও। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকালো, ফোন বের করতেই, ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘মৃন্ময়ের’ নাম্বারটি। মৃন্ময় নামটা দেখেই চাঁদনীর রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেল। ভেতর ভেতর ভোঁতা একটি রাগ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার চরম সর্বনাশ করেও, এমন মাঝ রাস্তায় চ ড় খাওয়ার পরেও কী এই নির্লজ্জটার শিক্ষা হবে না? চাঁদনী ফোনের দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী জানে, সে যতক্ষণ ফোন না ধরবে ততক্ষণ একটানা ছেলেটা ফোন দিতেই থাকবে। তাই সে অপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার কলের জন্য। কিন্তু চাঁদনীর অপেক্ষারা সময় বাড়িয়ে সেকেন্ড থেকে মিনিট হয়, অথচ দ্বিতীয় কলটি আর আসেনা। ক্ষণে ক্ষণে চলতে-চলতে মিনিটের কাটা পাঁচে গিয়ে ঠেকে। চির-পরিচিত অভ্যাসটি মিথ্যে হয়ে যায় কোন সে অবহেলায়! নতুন নিয়মে। ছেলেটি আর কল দেয় না। চাঁদনী তীর্থের কাকের ন্যায় নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। অতঃপর সে অনুভব করে, তার অপেক্ষা, কেউ একজন উপেক্ষা করে নিয়ম বদলে ফেলেছে। ভেতর থেকে ভারী শ্বাস বেরিয়ে আসে। বদলে যাওয়ার এই পৃথিবীতে সকল নিয়ম যে অনিয়মেই এসে ঠেকে, চাঁদনী তা ভুলে গেল কী করে!

চিত্রার জ্ঞান ফিরতেই কেবিনে ভীড় করে তার প্রিয়জনেরা। চিত্রা চোখ মেলে তাকায়। তীক্ষ্ণ একটি ব্যাথা তার শরীর জুড়ে ছড়াছড়ি করে। সে ঘোলা চোখে চারপাশে তাকায়। আবছা দৃষ্টিতে সকলের মুখ দৃষ্টিগোচর হয়। তুমুল ব্যাথা নিয়েও চিত্রা ক্ষীণ হাসলো। অসুস্থ স্বরে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি।”

এতটুকু কথা বলতে গিয়েও যেন মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠল। অহির ফ্যাচফ্যাচ কান্না ততক্ষণে শব্দতে রূপান্তরিত হলো। চিত্রা হাসল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
“এ আমি কী দেখছি! ছোটো আপা আমার জন্য কাঁদছে?

অহি এবার পুরোদমে কেঁদে উঠল, শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
“তুমি এত কেয়ারলেস কেন? এজন্যই তুমি বকা খাও। সাবধানে চলতে না পারলে রাস্তায় বের হবে না। শুধু শুধু আমাদের চিন্তায় ফেলেছ। তোমাকে যদি আর একা বের হতে দিয়েছি, তো দেখো।”

“ভাগ্যিস বের হয়েছিলাম! নাহয়, ছোটো আপা যে আমায় এত ভালোবাসে, সেটা কী জানতাম নাকি!”

মেয়েটা এ অবস্থাতেও দুষ্টুমি করে যাচ্ছে দেখে অহির মায়া আরও বাড়লো। সেই মায়া নিয়ে সে আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিল বোনের চোখ-মুখ। অহির ভাব-ভঙ্গিতে কখনো এত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু ভালোবাসা যে খুব বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। চিত্রার ডান চোখের কার্নিশ ঘেঁষে খুব গোপনে পালিয়ে গেল মুক্তোর মতন অশ্রুবিন্দুরা৷ একে একে বাড়ির সাকলেই তাকে আদর করল। কিন্তু তুহিন দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা দূরে, দরজার সাথে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নিরু। বাড়ির সকলের আদরের পালা যখন শেষ হলো, তখন নিরু এগিয়ে এলো, মিষ্টি হেসে শুধাল,
“ভালো আছো?”

চিত্রা শুনল প্রশ্নটা, তবে জবাব দিল না। বরং মুখ ফিরিয়ে নিল সাথে সাথে। নিরু মেয়েটা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বোধহয় চিত্রার আচরণে। তবুও চিত্রার মাথায় আদুরে হাত রাখল, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“সুস্থ হয়ে উঠো তাড়াতাড়ি। তোমার ভাই তো তোমার এ অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে।”

“আপনি তো আছেন, সামলানোর জন্য। আপনি থাকলেই আমার ভাইয়ের আর কিছু লাগবে না।”

চিত্রার গলার স্বর কঠিন। তাজ্জব বাড়ির লোক। মুনিয়া বেগম ধমকে উঠলেন,
“চিত্রা!”

নিরু মেয়েটার মুখে তবুও হাসি। সে চিত্রার মাথায় হাত আগের মতন রেখেই উত্তর দিল,
“আমি সামলাতে হয়তো পারবো কিন্তু তোমার শূন্যতা আদৌও আমি পূরণ করতে পারতাম? তোমার ভাইয়ের জীবনে তোমার জায়গাটা ঠিক কী, তা বোধকরি আমার বলে দিতে হবে না, তাই না? তাহলে কেন শুধু শুধু আমার সাথে তোমার তুলনা করে তোমার নিজের জায়গাটাকে হালকা করছো?”

মেয়েটার কথা শুনে, চিত্রার শক্ত মুখের আদল নরম হলো। কিন্তু সে তবুও নিরু মেয়েটার উপস্থিতি ভালো ভাবে নিতে পারল না। পুরোনো ক্ষতে নতুন জ্বলন তৈরী হলো। ভাইয়া আর এই নিরু মেয়েটার জন্যই আজ তার এবং বনফুলের সম্পর্কে ঘূণে ধরেছে। নরম হয়েছে বন্ধুত্বের শক্ত ভিটে। চিত্রার চোখে যন্ত্রণার অশ্রু। আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো। আজকে তার পাশে বসে বনফুল মেয়েটার হাউমাউ করে কান্না করার দৃশ্য হতে পারতো। বোকা বোকা কণ্ঠে মেয়েটা হয়তো চিত্রাকে বকতো। বন্ধুত্বের বন্ধন আরও গাঢ় হতো, হয়তো। কিন্তু কিছু হলো না তেমন, কিছু না। সব বদলে গেছে। তার এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা জেনেও বনফুলের মন গলেনি। আসেনি মেয়েটা তাকে দেখতে। কিচ্ছু আর আগের মতন নেই, কিচ্ছু না। চিত্রার কোমল মনে আছড়ে উঠল শূন্যতা। সে ফুপিয়ে কেঁদে দিল সেই শূন্যতা সামলাতে না পেরে। ভাইয়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“চলে যাও তুমি, ভাইজান। চলে যাও। তুমি আমার সুখে কালি দিয়েছ, তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। চলে যাও।”

তুহিন ফ্যালফ্যাল করে বোনের ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর মিনিট পেরুতেই মাথা নত করে কেবিন ছাড়ল। সকলেই এ-সব হতবিহ্বল চোখে দেখল। এছাড়া তাদের করার যে কিছুই নেই।

_

আকাশের বুকে বিরাট রূপোর থালার মতন চাঁদ এঁঁকে নির্বিকার হাসছেন সৃষ্টিকর্তা, একেকটা তাজা-তাজা প্রাণের অসহ্য ব্যাথা দেখে। ভাবছেন, মনুষ্য জন্ম গেল দুঃখ পুষেই! অথচ মানুষ চাইলেই দুঃখ ভুলে সুন্দর জীবন সাজাতে পারত।

চাঁদনীর ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার জামায়। চুলের জলে ভিজে গেছে পিঠের একাংশ। অথচ মেয়েটার হেলদোল নেই। সে শূন্য চোখে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। হসপিটাল থেকে এসেই গোসল করেছে। গরম-শীতের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সে প্রায় জুবুথুবু। মোবাইল স্ক্রিনে থমকে গেছে তার অপেক্ষারা। চির স্থায়ী ভাবেই হয়তো!

সে হতাশার শ্বাস ফেলল। টানা দেড় ঘন্টা যাবত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পরও পাশের বিল্ডিং থেকে আজ চিরপরিচিত স্বরে কেউ ‘ইন্দুবালা’ বলে ডাক দেয়নি। এমনকি কেউ আধো আদ্র সুরে গান তুলেনি ‘ইন্দুবালা গো, ইন্দুবালা গো’ বলে। নিজের এহেন ভাবনায় বিরক্ত চাঁদনী। না, সে মৃন্ময়কে ভালোবেসে এসব ভাবছে তেমনটা না। সে ভাবছে অভ্যাসবশত। মানুষ সব বদলাতে পারলেও অভ্যাস বদলাতে তার বহু সময় লাগে। তাই হুট করে চাঁদনী চাইলেও তো আর অভ্যাস বদলাতে পারছে না। অভ্যাসের তোপে না চাইতেও ভেবে ফেলছে ছেলেটাকে। তন্মধ্যেই চাঁদনীর ফোনে নোটিফিকেশন আসে। সে ফেসবুক অন করতেই মৃন্ময়ের কতগুলো হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখতে পায়। কোথাও একটা গিয়েছে সে, কারো বিয়ের অনুষ্ঠান বোধহয়! বন্ধু-বান্ধবের সাথে আনন্দের ছবি দিয়ে ভাসাচ্ছে নিউজফিড। কই, মৃন্ময়ের মুখের কোথাও তো দুঃখের কোনো প্রলেপ নেই! তবে! তবে চাঁদনী কেন তাকে ভেবে দেড়টা ঘন্টা বিসর্জন দিল? নিজের প্রশ্নের ভারে নুইয়ে আসে চাঁদনীর অনুভূতি। সবশেষে সে ব্লক করে মৃন্ময়ের ফেসবুক আইডিটা। হতাশার শ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, মৃন্ময় শাহাদাৎ এর ভাই!”

ব্যস্, এখানেই হয়তো আরেকটা সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোলাগার পুষ্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো!

_

হসপিটালের বেডে চিত্রার ক্লান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। সাথে হতাশাও। কিসের একটা বুক ভার করা অনুভূতি তাকে শান্তি দিচ্ছে না। কিসের সেই অনুভূতিটা? বনফুল আর বাহারের অনুপস্থিতিই কী সেই বুক ভারের কারণ? মুনিয়া বেগম বসে আছেন তার বেডের পাশেই। চোখে রাজ্যের ঘুম তবে মেয়েকে পাহারা দেওয়ার জন্য ঘুম আর হয়ে উঠছে না।

নিস্তব্ধতা ঠেলে চিত্রার কেবিনে কারো প্রবেশ ঘটতেই সজাগ হয়ে গেলো মুনিয়া বেগমের ক্লান্ত দেহ। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্বামীকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“তোমার সময় হয়েছে তাহলে!”

নুরুল সওদাগর স্ত্রী’র পানে চাইল গম্ভীর দৃষ্টিতে, রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
“সময় হয়েছে বলেই এসেছি। এক্সট্রা কথা আমার পছন্দ নয়।”

মুনিয়া বেগম হয়তো আরও দু-চারটে কঠিন কথা বলতেন কিন্তু চিত্রার কোমল মুখ পানে চেয়ে মায়ের ভাষারা নরম হয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে চুপ হয়ে গেলেন সে, মুহূর্তেই। নুরুল সওদাগর গম্ভীর পায়ে এগিয়ে এলেন, গমগমে স্বরে বললেন,
“সাবধানে চলতে পারো না? সামনে পরীক্ষা তোমার, আর তুমি হা-পা ভেঙে বসে আছ?”

চিত্রার মাথা নত, ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়,
“সরি, আব্বু।”

চিত্রা ভেবেছিল তার বাবা হয়তো আরও কয়েকটা কথা শোনাবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাবা আর বকা-ঝকা করলেন না। কিয়ৎক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর প্রস্থান নিলেন। মুনিয়া বেগমও স্বামীর এহেন আচরণে তাজ্জব। হজম করতে পারল না ব্যাপারটা। তাই তৎক্ষণাৎ স্বামীর পেছন পেছন সে-ও বেরিয়ে গেল। চিত্রা হতাশার শ্বাস ফেলল। অবশ চোখে আশপাশ তাকাতেই মায়ের ফোনটা চোখে পড়ল। একবার ফোন, আরেকবার বাহিরে দৃষ্টি দিয়েই চিত্রা ফোনটা তুলে নিল। যন্ত্রের মতন ডায়াল করল মুখস্থ নাম্বারটিতে। প্রথমবারে অপর পাশ থেকে রেসপন্স এলো না। চিত্রা তাই ব্যস্ত গতিতে আবার কল দিল। এবার বার কয়েক রিং হতে বাহারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কে বলছেন?”

চিত্রার চোখ বুজে আসে। মায়ের নাম্বারটাও লোকটার কাছে সেভ নেই! হাহ্! দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় হসপিটালের কেবিন। বাহার আবার শুধায়,
“কাকে চান?”

চিত্রা সময় নিল না, ঝটপট উত্তর দিল, “আপনাকে।”

অপর পাশ উত্তর শুনে তুমুল নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। পরপর চিত্রার অসুস্থ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে চাচ্ছি, দিবেন কী আমায়?”

বাহার কিঞ্চিৎ হাসল চিত্রার প্রশ্নে। ধানমন্ডির বিশাল হসপিটালের সামনের পার্কেই তার অবস্থান। সেখান থেকে হসপিটালের দিকে তাকিয়ে সে গাঢ় স্বরে উত্তর দিল,
“আমি যে সওদা করতে পারিনা। পারলে না-হয় আদান-প্রদানের বিষয়টা আগানো যেত!”

“ভালোবাসতে পারেন কী? সেটা পারলেই হবে।”

“পারিনা।”

চিত্রার উৎফুল্ল ভাব মিইয়ে এলো বাহারের উত্তর শুনে। চোখ জুড়ে টইটম্বুর হয়ে এলো অশ্রুরা। লোকটা কী তাকে চিনতে পারেনি! সংশয়ে মন টলে চিত্রার। উভয় পক্ষই নিরব তখন। প্রায় সেকেন্ড পেরুতেই নিরবতা ভেঙে প্রিয় পুরুষ বলে উঠল,
“রঙ্গনা, এই ভালোবাসতে না পারা আমিকে নিয়ে তুমি কী করবে বলো! কেন যেচে যন্ত্রণা টানছো, বলোতো? তাজা প্রাণে ব্যাথা পাওয়ার এত ইচ্ছে!”

চির-পরিচিত সেই ডাক শুনে চিত্রার চোখ বুজে এলো। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আপনি যন্ত্রণা হলে, আমি নির্দ্বিধায় তা বইতে রাজি।”

বাহার হাসল, বিবশ কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছ কেন, মেয়ে? যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর আগেই কেঁদে ভাসাচ্ছ! তুমি জানো না? তুমি কাঁদলে সকল যন্ত্রণা নরম হয়ে যায়, তুমি কাঁদলে সকল ব্যাথা সুখ হয়ে যায়। কেঁদেই কী তাই মাত দিতে চাচ্ছ, মেয়ে? তবে শুনে রাখো রঙ্গনা, তোমার জন্য- যন্ত্রণার বাহার, সুখ হতেও রাজি।”

বাহারের কথায় ফিক করে হেসে উঠল চিত্রা। পরপরই বাবা-মায়ের তুমুল কণ্ঠ ভেসে আসতেই সে থেমে গেল। সেখানে কান দিতেই আবছা ভাবে বাবার কণ্ঠে তার বিয়ের কথা ভেসে এলো।

#চলবে…..?

[যেহেতু অনেকদিন পর শুরু, সবাই মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন। আর ভালোবাসা।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here