#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
১৫.
গোছানো একটি জীবনের যখন ছন্দপতন শুরু হয় তখন সে জীবনটা বয়ে বেড়ানো কষ্ট সাধ্য হয়ে ওঠে। চাঁদনীর বেলাও ব্যাতিক্রম হলো না। তার সুন্দর, স্বচ্ছ জীবনটাকে হুট করেই এতটা ঘোলা হয়ে যেতে দেখে সে দিকভ্রান্ত হয়ে গেলো। কান্নার সাহসও হলো না তার চোখ দুটোর। আর কত কাঁদবে! ক্লান্তি বলেও তো একটা জিনিস আছে?
চাঁদনী ফ্যালফ্যাল নয়ন জোড়া মেলে বসে আছে নিজের আঁধার ঘরটায়। বাকরুদ্ধ, বিমর্ষ চোখ গুলো আজ চির নিদ্রা চাচ্ছে। যে চোখে কাজলের আস্তরণ মায়া সৃষ্টি করত আজ সে চোখে ধূ-ধূ মরুভূমি। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পুরুষকে হারিয়েছে, হারিয়েছে সকল রঙ শেষে কিনা চরিত্রটার উপরও এত গাঢ় কলঙ্ক পড়তে হলো?
অভিযোগ অভিযোগে ভারি হয় মন। ফোনের স্ক্রিন অন করে তার আর মৃন্ময়ের আলোচিত সেই ছবিটি দেখে। আপাত দৃষ্টিতে ছবিটিতে অশ্লীলতার ছিটেফোঁটা নেই কিন্তু এই একটা ছবি চাঁদনীর জীবনটা নরক করতে যথেষ্ট। ছবিটি সকাল অব্দি তাদের সোসাইটির গ্রুপে থাকলেও তা আপাতত ফেসবুক তোলপাড় করেছে বিভিন্ন ক্যাপশন সমেত। সেগুলোও খারাপ না, ভীষণ রোমান্টিক ক্যাপশনে তা শেয়ার করেছে মানুষ। অথচ সকলে যা ভাবছে তার এক ফোঁটা যদি সত্যি হতো তবুও চাঁদনীর আফসোস থাকতো না। কিন্তু এটার আগাগোড়া পুরোটাই তো মিথ্যে। কিন্তু তার গালে চ ড়ের ছাঁপ মিথ্যে নয়। তার পরিবারের চোখে তাকে নিয়ে বিস্ময়টা মিথ্যে নয়। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে নিজের নামে এমন ভয়ঙ্কর কথাটাও তো মিথ্যে নয়!
চাঁদনী ফোনের স্ক্রিনের ছবিটায় কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এখানে যে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে কেউ বিশ্বাসই করবে না। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে চাঁদনীর হাসি মুখটা বেশ স্পষ্ট। চাঁদনী কখনোই কারো সাথে কোনো শত্রুতা করেনি জানা স্বত্তে, তবুও কে এমনটা করল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিনা কারণে কেউ এমনটা কেন করবে! চাঁদনীর মাথায় হুট করে একটা কথা এলো। সবাই যেহেতু ছবিটা দেখেছে তার মানে সবার মাঝে মৃন্ময়ও আছে। কিন্তু এমন একটা ছবি দেখার পরও ছেলেটা তার সাথে একটুও যোগাযোগ কেন করল না? মৃন্ময় যা পা গ ল ছেলে, এতক্ষণে তো তার তান্ডব চালানোর কথা কিন্তু সে এতটা নিশ্চৃপ কেন? চাঁদনী নিজের মনেই প্রশ্নটা করে উত্তর হীন দিশেহারা হলো। তৎক্ষণাৎ কল লাগাল মৃন্ময়ের ফোনে। পর পর কয়েকবার রিং হয়েই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য উতলা। সে আবার কল দিল। প্রায় কিছুক্ষণ রিং হতেই অপর পাশ থেকে মৃন্ময়ের ঘুম ঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো ইন্দুবালা…”
“মৃন্ময়, কোথায় তুমি? তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
“কী কথা? বলুন?”
“তুমি কোথায় এখন? আমার সাথে দ্রুত দেখা করো। তোমার সাথে কথা আছে। তুমি কী কিছুই জানো না?”
“কী জানার কথা বলছেন? হয়েছে কী? আমি তো….”
মৃন্ময় বাকি কথা বলার আগেই কলটা বিচ্ছিন্ন হলো। চাঁদনী তখন উন্মাদ প্রায়। আবার ব্যস্ত গতিতে কল দিতেই অপর পাশ থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে উঠল ‘আপনার কলটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।’
চাঁদনীর আর সহ্য হলো না এত লুকোচুরি, এত যন্ত্রণা। সে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গিয়ে নিজের ফর্মাল পোশাকটা বদলে এলো। সাদা রঙের একটা জামা পড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সওদাগর বাড়ি তখন নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ আগেই সে বাড়ির উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছে বাড়িটাকে। চাঁদনীর বাবা আফজাল সওদাগর প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছেন। চাঁদনীর মা রোজা সওদাগর নিজের এত বড়ো মেয়ের গায়েও হাত তুলতে ভুলেননি। চাঁদনীর দাদী অবশ্য চিত্রাকেও কথা শুনিয়েছেন। কী বিশ্রী ভাবে দোষারোপ করেছেন! তার ভাষ্যমতে, না চিত্রা গ্রাম থেকে শহরে আসার ইচ্ছে পোষণ করতো আর না এতকিছু হতো।
ড্রয়িং রুমে কাউকে না পেয়ে সেই সুযোগে বেরিয়ে গেল চাঁদনী। রাত তখন আটটা বাজছে। পথে ঘাটে পথচারী দেখা যাচ্ছে বেশ। চাঁদনী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, যদি কেউ তাকে আবার কথা শোনায়! সেই ভয়ে। চাঁদনী অনেকটা লুকিয়েই মৃন্ময়দের বাড়িতে উপস্থিত হলো। সংশয়ে তার বুক কাঁপছে। কলিং বেলটা বাজাবে কি-না ভেবে সে ক্লান্ত। তবুও মনে সাহস সঞ্চয় করল, দাঁত মুখ খিঁচে বাজিয়ে ফেলল কলিংবেল। কলিংবেল বাজানোর সেকেন্ড পেরুতেই দরজা খুলে দিল বাড়ির নতুন বউ। মেয়েটা চাঁদনীকে চিনতে সময় ব্যয় করল না। চাঁদনীকে দেখেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“আরে আপু, আসুন না ভেতরে। আপনাকে দেখাই যায় না। আজ কি মনে করে এলের! আল্লাহ্, ভেতরে আসুন না।”
চাঁদনী চোরা চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আঙ্কেল আন্টি কেউ বাসায় নেই?”
“না তো। ওরা একটু গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।”
“মৃন্ময় আর শাহাদাৎ কোথায়?”
“ভাইয়া তো বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছেন আর উনি অফিস থেকে এখনও আসেনি।”
চাঁদনীর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। মৃন্ময় শহরে নেই মানেই চাঁদনীর এই সময়টা আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে। এটা ভাবতেই চাঁদনীর মাথা ঘুরে উঠলো। তার উপর সারাদিন না খাওয়া। নিলা হয়তো বুঝলো চাঁদনীর অবস্থা। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“আপু, আপনি কী অসুস্থ?”
“না না, নিলা, তেমন কিছু না।”
“ভেতরে আসুন না আপু। এসে বসুন।”
চাঁদনী তাকাল নিলার পানে। মেয়েটা এত স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করছে তার সাথে? মেয়েটা কী চাঁদনীর ভাইরাল হওয়া ছবিটা দেখেনি? হয়তো দেখেনি, দেখলে নিশ্চয় এত ভালো আচরণ করতো না। নিশ্চয় ঠেস দিয়ে কিছু বলত।
চাঁদনীর ভাবনার মাঝেই নিলা আবার বলল, “আসুন না আপু। এসে একটু বসুন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে অনেক।”
“না নিলা, দরজাটা আটকে দেও। আমার একটু কাজ আছে। পরে আসব।”
কথাটা শেষ করেই চাঁদনী পা আগালো পথের দিকে। পেছন থেকে নিলার আশ্বাস ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে আমি অনেক বিশ্বাস করি, আপু। আপনি এমন একটা মানুষ, যাকে দেখলেই মনেহয় পবিত্রতা শব্দটা কেবল আপনার জন্য সৃষ্টি। আমি কখনোই আপনার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারিনা। সেখানে এসব ছবি দেখে আপনার ভেঙে যাওয়া মোটেও মানায় না।”
চাঁদনী অবাক চোখে ঘুরে দাঁড়াল। নিলা মেয়েটার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা। চাঁদনী যেন ছোটো এই কথা গুলোর মাঝে বিরাট ভরসা খুঁজে পেল। এই হাসিটা কোথাও একটা তাকে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি দিল। মেয়েটার সাথে তার পরিচয় খুবই সীমিত সময়ের কিন্তু তবুও মেয়েটা কত বিশ্বাস করেছে তাকে। অথচ তার নিজের মা, যে তাকে দশমাস গর্ভে আর এত বছর হৃদয়ে ধারণ করেছে সে মা’ই কেমন ভুল বুঝল। আহারে জীবন!
_
বাহিরে বাতাস, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে প্রায় কাক ভেজা হয়ে চিত্রাকে পড়াতে এসেছে বাহার। মেয়েটা জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। জ্বরটা বোধহয় কমেনি। বাহার এসে রাশভারি কণ্ঠে ডাক দিল,
“চিত্রা..”
চিত্রা আধো আধো চোখে তাকাল, অসুস্থ কণ্ঠ বলল,
“আজ পড়াবেন?”
“পড়াতেই তো এলাম। পড়বে না?”
“বাড়ির পরিস্থিতি খারাপ। জানেন না চাঁদনী আপার কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“আপার ছবি তো ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে।”
“তো?”
বাহারের ভাবলেশহীন উত্তরে চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আপনি তো বলছেন কেন? এটা নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছে।”
“তোমাদের বাড়ির মানুষ গুলা একেকটা তো মগজ ছাড়া। ছবিটাই তো আমি এমন কিছুই দেখিনি। চাঁদনী একটা ছেলের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক একটা ছবি। বন্ধু কিংবা ভাইয়ের মাথাতেও এমনে হাত বুলায় মানুষ। তাই বলে এত হা হুতাশ করতে হবে? তোমরা কী ভাত খাও না ভুসি?”
বাহারের কথা যুক্তিযুক্ত ছিল কিন্তু তা সহ্য হলো না নুরুল সওদাগরের। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“বেয়াদব ছেলে। আমরা ভুসি খাই?”
“সেটা আমি কীভাবে জানব? আমি কী আপনাদের ভুসি কিনে দিয়ে যাই? কিন্তু আপনাদের মাথা থেকে বের হওয়া গোবর মার্কা বুদ্ধি দেখে বুঝতে অসুবিধা হবেনা যে আপনারা কী খান।”
নুরুল সওদাগর তেড়ে এলেন। ধমকে বললেন,
“রাস্কেল।”
“শালা, ভালোর কোনো জামানায় রইল না। ভালো কথা বললেও মানুষ খেঁকিয়ে উঠে।”
নুরুল সওদাগর এবার রেগে বাহারকে ধাক্কা দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় ছেলেটা দু-পা পিছিয়ে গেলেও ঠোঁটে ঝুলানো ছিল মুচকি হাসি। চিত্রা দুর্বল শরীরটা নিয়ে দ্রুত উঠে বসল। তার ভয় হচ্ছে, এখানে কিছু উল্টোপাল্টা না হয়ে যায়। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে বাহার মুচকি হেসে বলল,
“আপনার শরীরে তো ভালোই জোড় আছে। সেজন্য তো বলি ষাঁড় লাথি দিলে মানুষের হাড় ভাঙে কেন। ভুসির অনেক ক্ষমতা।”
বাহারের উদ্দেশ্য ছিল নুরুল সওদাগরকে খ্যাপানো আর সেই লক্ষ্যে সে সক্ষম হলো। নুরুল সওদাগর যখন রেগে চিৎকার দিলেন বাহার তখন হেলেদুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রা অসহায় চোখে সেটা দেখল কেবল।
#চলবে