#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
১১.
“চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর
তুই থার্মোমিটারে মাপলে….!”
হলুদ রাঙা বাতি গুলো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কোণ ঘেঁষে। যেন প্রেমিকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রূপসী প্রেমিকা। চলন্ত গাড়িটাই বাজছে গান খানা। চিত্রার চিত্ত উত্তেজিত, দৃষ্টি তার গাড়ির বাহিরের ঘোলা কাঁচে। গাড়ি চালাচ্ছে তুহিন। গাড়িতে অবস্থিত তার মা, বাবা, অহি আপা, চাঁদনী আপা। পেছনের গাড়িতে পরিবারের বাকি সদস্যরা। এখন রাত সাড়ে তিনটা। তাদের গন্তব্য কুমিল্লা। ঢাকা থেকে এত রাতে কুমিল্লা যাওয়ার কারণ অবশ্যই ভয়াবহ। চিত্রার দাদীর অবস্থা শোচনীয়। হয়তো আজ রাতটুকুও সময় নেই বৃদ্ধার হাতে। সংসারের সকলকে দেখার বড্ড ইচ্ছে। তাই এই রাতকে উপেক্ষা করেই সকলে ছুটে যাচ্ছে সেখানে। মৃত্যুর আগে একটা বার মানুষটাকে দেখতে পারলেই সবার শান্তি। নাহয় চিরকাল একটা আফসোস থেকে যাবে।
চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে সকলের দিকে খুব সাবধানে দৃষ্টি রাখলো। একমাত্র তুহিন ভাই ছাড়া সকলেই ঘুমে। অবশ্য সকলকেই কাঁচা ঘুম থেকে জাগিয়ে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া হচ্ছে তাই হয়তো কারোই ঘুম কাটে নি। কেবল ঘুম নেই চিত্রার চোখে। বাহার ভাইদের বাড়ির কোল ঘেষে খসে পড়া বিধ্বস্তার গল্প তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। তাড়াহুড়ায় সে কাউকে বলতেও পারেনি কিছুক্ষণ আগে যে বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে একটা এম্বুলেন্স বেরিয়ে গেছে। বলার আগেই তো গ্রামের বাড়ি থেকে কল এলো সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঠিক এমন সময় চিত্রা চেয়েও আর বলতে পারেনি। তবে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সে আবার ভালো করে বাহার ভাইদের ঘরটা দেখেছে। গেইটে বড়ো তালা তখনও ঝুলছিল। তার মানে এই বাড়িটার সাথেও খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে। অথচ চিত্রা কি করবে বুঝতেই পারছে না। দাদীও তার পর না। দাদীকেও দেখতে যাওয়া উচিত। আবার বনফুলের সাথেও তার আত্মার সম্পর্ক। অথচ মূল্য দেওয়ার বেলায় আত্মার সম্পর্কের আগে রক্তের সম্পর্ক মূল্য পেলো।
চিত্রার দমবন্ধ লাগছে। গাড়ির কাঁচটা খুলে দিলে সে একটু বোধহয় শ্বাস নিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো। কিন্তু সে তুহিনের সাথে কথা বলছে না। কীভাবে জানাবে তার মনের আকুতি! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। তার সেকেন্ড কয়েক পরেই চিত্রার পাশের জানালাটা খানিক খুলে গেলো। বাহিরের উন্মাদ বাতাস ছুঁয়ে দিলো চিত্রার চোখ মুখ। এতক্ষণের বুক ভারটা যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। চিত্রা আড়চোখে ভাইয়ের পানে তাকালো। তুহিনের দৃষ্টি সামনের ঘুমিয়ে থাকা আঁধার রাস্তায়। চিত্রার খুব ইচ্ছে হলো ভাইজানকে মনের অস্থিরতা জানাতে কিন্তু পরক্ষণেই বিকেলের কথা মনে পড়ে সে ইচ্ছে পথেই মারা গেলো। যে মেয়েটা পাগলের মতন ভালোবেসেছে বলে ভাইজান তাকে এত গুলো মানুষের সামনে চড় দিতে দ্বিধাবোধ করেনি, সে মেয়েটার ভয়ানক খবরও হয়তো তার ভাইকে বিচলিত করতে পারবে না। চিত্রা জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলো। হুট করেই মনে হলো বনফুলের ফোনে একটা কল করে দেখা যাক রিসিভ হয় কি-না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মুহূর্তেই তার হাতের পার্সটা থেকে ফোন বের করলো। ফোন লাগালো কাঙ্খিত নাম্বারে। তার মনের অস্থিরতার মাঝে দুমুঠো তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিয়ে ফোনের অপর পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠটি বলে উঠলো ‘আপনার কলটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’। চিত্রার মন ছোটো হয়ে এলো। বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে একসাথেই আসে।
আরও সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চিত্রার চোখ নিভে এলো নিদ্রায়। অতঃপর সে তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে।
_
দীর্ঘ অনেকটা পথ পেরিয়ে ব্রাক্ষনবাড়িয়ার নিবিড় ছোটো শহরটায় এসে গাড়ি থামে চিত্রাদের। বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটায় লাল ইটের সৌন্দর্য। পুরোনো হওয়ায় কিছুটা রঙ তামাটে হয়েছে। পুরোনো পুরোনো একটা সাজ তার আদল জুড়ে। বিশাল লোহার গেইট পাড় হয়েই বাড়িটা।
বিশাল এক জার্নির পর মানুষ গুলো ক্লান্ত। গাড়ি থামতেই সকলে বেরিয়ে এলো গাড়ি ছেড়ে। বাড়ির কাজের লোকগুলো ছুটে এসে ব্যাগ গুলো নামিয়ে ফেললো গাড়ি থেকে।
সকলেই ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলো বাড়ির ভিতর। শুনশান নিরবতায় বাড়িটা আচ্ছন্ন। সকলে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই হতভম্ব। কারণ গতকাল রাতে বৃদ্ধার যে অবস্থার কথা শুনে তারা ছুটে এসেছিল তার এক ফোটা চিহ্নও বৃদ্ধার মাঝে নেই। সওদাগর গিন্নী পায়ের উপর পা তুলে রাজকীয় ভাবে বসে আছে। কারুকাজ সংবলিত সোফা খানায় সাদা চামড়ার সত্তর উর্ধ্ব নারীও কেমন উজ্জ্বল লাভা ছড়াচ্ছে। সওদাগর বাড়ির তিন ছেলেই ছুটে এলেন নিজেদের মায়ের কাছে।
আনোয়ারা সওদাগর ছেলেদের পানে তাকালেন, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমি মরি নি, এত সহজে বোধহয় মরবো না। কেবল তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম যে তোমাদের মা জীবিত তাই এ পথ অবলম্বন করা।”
আফজাল সওদাগর, নুরুল সওদাগর ও আমজাদ সহ বাকিরাও অবাক হলো। আনোয়ারা সওদাগর খুব কঠোর আর চতুর একজন মানুষ তাই বলে নিজের শরীর নিয়ে এত বড়ো কথাটা যে বলতে পারে কেউ ভাবেইনি।
নুরুল সওদাগর কপাল কুঁচকে ফেললেন মায়ের এহেন হেয়ালিতে। বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন,
“আপনি তো শহরে চলে গেলেই পারতেন আম্মা। আমাদের সকলেরই ব্যস্ততা রেখে ছুটে এসেছি আপনার গুরুতর অবস্থার কথা শুনে। আর আপনি কি-না ঠাট্টা করছেন!”
“নুরু, তুই কী আমার জীবিত চেহারা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করছিস? কালকের বলা মিথ্যা টা সত্যি হলেই কী খুশি হতিস নাকি?”
মায়ের শক্ত কণ্ঠের দাপটে থেমে গেলেন নুরুল সওদাগর। বাড়ির বউরা এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ির হালচাল জিজ্ঞেস করলো। নাতি নাতনিরাও দাদীকে নিয়ে হৈচৈ করলো কেবল এক কোনায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ রইলো। দাদীর সাথে বরাবরই তার ভাব তেমন বেশি না। দাদী সবসময় সবাইকে কঠিন কঠিন কথা বলেন যা চিত্রার অপছন্দ। আর সেই অপছন্দই দু’জনের মাঝে একটা দেয়াল তৈরী করেছে।
আনোয়ারা সওদাগর সকলের সাথে ভাব বিনিময় করে সবাইকে যার যার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে রুম অনেক গুলো থাকা স্বত্তেও সবসময় গ্রামে এলে চিত্রারা চার বোন এক রুমে থাকে। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। চিত্রা, চাঁদনী, চেরি, অহি একটা রুমেই উঠলো। এত মানুষ এক সাথে বিধায় একটা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান ভাব দেখা দিলো এতদিনের ঝিমিয়ে থাকা বাড়িটাই। সকলে ফ্রেশ হয়ে আবার বিশ্রাম করতে চলে গেলো। কেবল ঘুম নেই চিত্রার চোখে। বিরাট ঝড়ের আশংকায় তার বুক যেন কেমন করে কাঁপছে।
_
বাড়ির সাথে লাগোয়া এক রাজকীয় পুকুর ঘাট রয়েছে। ঘাটের একটা সুন্দর নামও রয়েছে। নীলকণ্ঠ ঘাট। পুকুরের পানি গুলো বিশেষ কোনো কারণ বশত নীলচে রঙের। এবং সেই কারণেই ঘাটের নাম নীলকণ্ঠ ঘাট। এই ঘাটের পশ্চিম দিকে বিশাল সরষে ক্ষেত। জায়গাটা নিরিবিলি তবে সুন্দর। চিত্রার পছন্দের একটি জায়গা। ঘুম না আসাতে সে চলে এলো পুকুরপাড়। পাথরের তৈরী মোটা পাড়ে বসলো। পা গুলো ডুবিয়ে দিয়ে আনমনে বসে আছে সে। সূর্য তখন মাথার উপরে আলো ছড়াচ্ছে তবে গাছ গাছালির জন্য সূর্যের প্রখরতা ছুঁতে পারছে না চিত্রাকে।
চিত্রা হাতের মুঠোফোন টা আবার তুলে ধরলো। কিছুটা দোনোমোনো করে কল লাগালো বনফুলের নাম্বারে। সে ভেবেছিল এবারও হয়তো কলটা যাবে না অপর পাশে। এবারও হয়তো চিত্রার মনটা তুমুল খারাপ করে অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠটা শুনাবে অসহায়ত্বের বাণী। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয়। গমগমে গলায় পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যাঁ রঙ্গনা, বলো?”
চিত্রার বোধহয় হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠলো। সে হতভম্ব কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“বাহার ভাই! ভালো আছেন?”
“ভালো আর রাখলে কই?”
বাহারের কথায় থেমে গেলো চিত্রা। কেমন অপ্রত্যাশিত লাগছে সবটা।
#চলবে