ে#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধীরাজ ও সুহানি বসে আছে একে অপরের মুখোমুখি। সুহানি ধীরাজকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। যা ফুটে উঠেছে তার চোখমুখে। সুহানি ধীরাজের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘কেমন আছ তুমি? আগের থেকে অনেক বদলে গেছ।’
ধীরাজ মৃদু হেসে জবাব দিল,
‘আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। মাফ করবে কিন্তু বদলে যাওয়ার কথা অন্তত তোমার মুখে মানায় না সুহানি আপু।’
সুহানি বুঝতে পারে ধীরাজ কি বোঝাতে চাইছে। ধীরাজ সুহানিকে শুধালো,
‘শুধুমাত্র আম্মুর কথায় তুমি কেন ভাইয়ার থেকে দূরে সরে গেলে? নিজেও কষ্ট পেলে আর ভাইয়াকেও এভাবে কষ্ট দিলে। যেটা তোমার থেকে অন্তত আশা করিনি।’
‘ব্যাপারটা এত সহজ না ধীর। তোমার মা কা’জই কিছু এমন করেছিল যা আমায় বাধ্য করেছিল এমনটা করতে।’
‘কি এমন করেছিল আম্মু?’
সুহানি মনে করে ৬ বছর আগের সেই ভয়ানক দিনটির কথা। রোজকার মতো সেদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরেছিল সুহানি। বাসাত আসতেই দেখে তার বাবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছে অহনা খন্দকার। সুহানিকে দেখেই অহনা খন্দকার বলে ওঠেন,
‘এই তাহলে তোমার গুণধর মেয়ে, যাকে আমার ছেলের পেছনে লা’গিয়ে দিয়েছ। সত্যিই তোমার কোন ল’জ্জা নেই শাহিন। আগে আমার পেছনে পড়ে ছিলে, আমি তোমায় পাত্তা না দিয়ে একটা বড়লোক ছেলেকে বিয়ে করেছিলাম, তাই আজ এভাবে রাজরানি হয়ে আছি। এখন নিজের উদ্দ্যেশ্য চরিতার্থ করতে না পেরে নিজের মেয়েকে..’
‘মুখ সামলে কথা বলো অহনা। আমার মেয়ে যে তোমার ছেলের সাথে প্রেম করছে সেটা আমি জানতামই না। জানলে অনেক আগেই ওকে এসব থেকে বের করে নিয়ে আসতাম।’
সুহানি বিস্ময়ের চরম শিখরে উঠে যাচ্ছিল তাদের কথোপকথন শুনে। এরমধ্যে অহনা খন্দকার উঠে দাঁড়িয়ে সুহানির মুখে টা’কা ছু’ড়ে মে’রে বলে,
‘এই নেও। তোমাদের মতো মেয়েদের তো এটাই দরকার। রা’স্তার মেয়ে একটা। শাহিন, তুমি নিজের মেয়েকে দিয়ে এসব না করিয়ে প’তিতালয়ে বেঁচে দিলেই তো পারো, ভালো ইনকাম করবে।’
সুহানি সেইসময় কিশোরী ছিল তার মনটাও অনেক নরম ছিল। এখনকার মতো এতটা শক্ত ছিল না তার মানসিকতা। নিজের সম্পর্কে এমন জ’ঘন্য কথা শুনে সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। শাহিন হোসেনও নিজের মেয়ের এমন অপমান মেনে নিতে পারেন না। ঘা’ড়ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দেন অহনা খন্দকারকে। অহনা খন্দকার চেচিয়ে বলেন,
‘সত্য কথা বললে সবারই গায়ে জ্বা’লা ধরে।’
শাহিন হোসেন সুহানিকে টেনে আনেন অহনা খন্দকারের সামনে। অতঃপর বলেন,
‘তুই এই মহিলাকে বলে দে যে ওনার ছেলের থেকে দূরে সরে আসবি।’
সুহানি সেই মুহুর্তে কিছু বলতে পারে না। সে যে অনেক ভালোবাসত ধ্রবকে৷ ধ্রুবকে ছাড়ার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারত না। তাই সে চুপ থাকে। অহনা খন্দকার সেইসময় বিদ্রুপ করে বলেন,
‘হু, তোমার মেয়ে তো একটা গোল্ড ডিগার। ও কেন ছা’ড়বে আমার ছেলেকে। এসব চিপ মেয়েদের আমার ভালোই চেনা আছে।’
শাহিন হোসেন পরপর কয়েকটা থা’প্পর বসিয়ে দেন সুহানির গালে। অতঃপর চিৎকার করে বলেন,
‘তোকে কি আমি এই দিন দেখার জন্য বড় করেছিলাম? নিজের মায়ের সাথে কেন ম’রে গেলি না তুই? তুই ম’রলে আমি শান্তি পেতাম।’
কথাটা বলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আগে থেকেই শাহিন হোসেনের
বুকে সমস্যা ছিল। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে যাওয়ায় বুকে হাত দিয়ে ব্যাথায় কুকিয়ে ওঠেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুহানি বাবা বলে চিৎকার করে তার বাবাকে সামলানোর চেষ্টা করে। অহনা খন্দকার বলে ওঠেন,
‘আবার নতুন নাটক শুরু।’
শাহিন হোসেন সুহানিকে বলেন,
‘আমাকে ছুঁবি না তুই, তুই আমার মেয়ে না।’
নিজের বাবার এই অবস্থা দেখে ঠিক থাকতে পারে না সুহানি। সে দৃপ্তকণ্ঠে অহনা খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আজ এই মুহুর্তে আমি আমার বাবাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আমি আপনার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরে আসব।’
অতীতের ঘটনাগুলো সবকিছুই বিস্তারিত ভাবে ধীরাজকে জানালো সুহানি। এরপর একটু দম নিয়ে বলল,
‘আমার বাবার সাথে তোমার মায়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বাবা মন থেকে ভালোবাসতেন ওনাকে, তাই তো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন মানুষ হয়েও দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির জন্য অনেক ত্যাগ করেছিলেন। তোমার মাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেও সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু তোমার মা আমার বাবাকে ঠকিয়ে বড়লোক ছেলে দেখে মানে তোমার বাবাকে বিয়ে করে নেয়। জানি তোমার কথাগুলো শুনতে অনেক খা’রাপ লাগছে কিন্তু এগুলো সত্যি।’
ধীরাজ আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,
‘এই কারণে তুমি ভাইয়ার থেকে দূরে সরে এসেছ?’
‘হু, জানো সেইদিনের ঐ ঘটনার পর আমার বাবা প্রাণে বেঁচে গেলেও পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে যান। নিজের বাবার এই পরিণতি আমি মেনে নিতে পারিনি। বারবার নিজেকেই দো’ষী মনে হচ্ছিল। ৩ বছর এভাবে কা’টিয়ে আমার বাবা একসময় আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যান।’
ধীরাজ ক্ষীণ কন্ঠে শুধায়,
‘তাহলে সবকিছু কি এখানেই শেষ? আম্মুর কৃতকর্মের জন্য তুমি আর ভাইয়া কেন শা’স্তি পাবে?’
‘হয়তো শেষ, নতুবা শুরু। জানো তো, অহনা খন্দকার মা হিসেবে যেমনই হোক, আমার বাবা কিন্তু বাবা হিসেবে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। উনি যেই মুহুর্তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ল’ড়ছিলেন সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়েও আমার কথা ভাবছিলেন। উনি জানতেন আমি ধ্রবকে কতোটা ভালোবাসি। তাই তো আমাকে বলেছিলেন যদি কোনদিন অহনা খন্দকার নিজের ভুল বুঝতে পেরে মন থেকে সবকিছুর জন্য আমার কাছে ক্ষ’মা চায় তাহলে যেন আমি যেন আবার ধ্রবর জীবনে ফিরে যাই। নাহলে নয়।’
ধীরাজ উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘আমি এখনই ভাইয়াকে সব জানাবো। তারপর ভাইয়া আম্মুকে ঠিকই রাজি করাবে আম্মুকে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে।’
‘না ধীরাজ তুমি এমনটা করবে না। আমি চাই যে উনি মন থেকে আমার কাছে ক্ষমা চান। ধ্রুবকে জানালো হয়তো ধ্রুবর জোরাজোরিতে উনি রাজি হবেন কিন্তু আমি সেটা চাইনা।’
‘তার মানে আম্মু যদি তোমার কাছে কখনো ক্ষমা না চায় তাহলে তোমাদের সম্পর্ক শে’ষ তাই তো?’
সুহানি মাথা নাড়ায়। ধীরাজ উঠে চলে যেতে চায়। তখন সুহানি বলে ওঠে,
‘যদি আমাকে নিজের বোনের নজরে দেখে থাকো তাহলে প্লিজ ধ্রুবকে এসব বিষয়ে কিছু জানিও না।’
ধীরাজ কোন কিছু না বলে চলে আসে।
★★★
নিজের কিছু বন্ধুদের সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ধীরাজ। সুহানির সাথে কথা বলার পর থেকে তার মন মেজাজ আজ একদম ভালো নেই। ধীরাজের এক বন্ধু তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘কি হলো ধীরাজ? তোর মুখ এমন লাগছে কেন?’
‘কিছু না।’
ধীরাজরা যাচ্ছিলই এমন সময় কোথা থেকে একটা গাড়ি অল্পের জন্য তাদের পাশ দিয়ে যায়। আরেকটু হলেই ধা’ক্কা খেত। ধীরাজের মেজাজ এতে আরো গরম হয়ে যায়। সে চেচিয়ে বলে,
‘চোখ নেই তোর? আ’বাল কোথাকার।’
গাড়িটা হঠাৎ থেমে যায়। গাড়ি থেকে এত অতীব সুন্দরী রমণী নেমে আসে। পরণে তার জিন্স এবং টপস। কোকড়ানো চুলের মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে নিজের সানগ্লাস খুলে রাগী কন্ঠে সুধায়,
‘কে আমায় এই বা’জে ভাষায় গা’লি দিলো? সাহস থাকলে সামনে এসো।’
ধীরাজ বুক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আমি। কি করবেন বলুন। দেখে গাড়ি চালাতে পারেন না?’
মেয়েটি বলল,
‘তুমি চিন আমি কে? আজাদ গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজের মালিক আজাদ চৌধুরীর মেয়ে অর্পা চৌধুরী আমি।’
ধীরাজের এক বন্ধু বলে ওঠে,
‘আমাদের বন্ধুও যে কেউ নয়, খন্দকার এন্টারপ্রাইজের নাম শুনেছেন? অহনা খন্দকারের ছেলে ও।’
অর্পা নিজের হ্যান্ডওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল তার কাছে বেশি সময় নেই। তাই সানগ্লাসটা পড়ে নিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। যেতে যেতে ধীরাজের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘I will see you.’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨