#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (শেষাংশের সমাপ্তি)
ইলহান মাথা নাড়িয়েই ছুটে যায়। ঐশ্বর্য একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে অর্ধমৃত শার্লির দিকে। তার চোখে ভাসছে এখনো তার প্রজাদের নির্মম মৃ’ত্যু। চোখ বুঁজে নেয় ঐশ্বর্য। রাগ হয়। ক্রোধের বশে আরো ইচ্ছেমতো তলো’য়ার দিকে আ’ঘাত করতে করতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে শার্লিকে। শার্লি তখন নিস্তেজ। তবে শ্বাস এখনো চলছে।
ক্লান্ত হয়ে কিছুটা দূরে সরে আসে ঐশ্বর্য। নদীর ধারে এসে নদীর স্বচ্ছ পানিতে ধুয়ে নেয় র’ক্তমাখা তলো’য়ার। আগের মতোই চকচক করতে থাকে সেটি।
সেই বৃষ্টির রাতে শার্লিকে প্রথম রাতের আঁধারে প্রাসাদ থেকে বের হতে নজরে পড়েছিল ঐশ্বর্যের। সেদিন সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও না জেনে তাকে কিছু বলতে পারেনি। তাই সে পরেরদিনই শার্লির অগোচরে তার কক্ষে ঢুকে সারাঘর কিছু না কিছু খুঁজে গেছে ঐশ্বর্য। শার্লির বিছানার নিচে সেদিন ‘দ্যা ডেভিল বুক’ এর ছেঁড়া এক পৃষ্ঠার অংশ পেয়ে সে সেদিনই বুঝেছিল ডেভিলদের সঙ্গে সে নিজেও যুক্ত ছিল। তাই জন্যই সে সেই বইয়ের এক পাতা ছিঁড়েও রেখেছে। পুরো কক্ষ ভালো করে দেখে আর শার্লির একটা ডায়েরির মাধ্যমে সে জানতে পারে শার্লির বাসনা ছিল এই রাজ্যের রাণী হওয়া। যেটা সে পারেনি। তাই প্রথম থেকেই ইলহান আর মৌবনিকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ঐশ্বর্যকেই মা’রতে চেয়েছিল। কিন্তু ইলহান আর মৌবনি পরে তার সঙ্গে সায় দেয়নি। ফলস্বরূপ শার্লি এই তলো’য়ার পেয়ে হ’ত্যাকান্ড শুরু করেছিল। তবে সেদিন পুরো কক্ষ তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই অ’স্ত্র হাতের কাছে পায়নি ঐশ্বর্য। তাই তাকে অন্যরকম পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। সে সবসময় শার্লির জান্তে অজান্তে নজর রেখেছিল। এর মাধ্যমেই ঐশ্বর্য আরো একটা কথা জানতে পারে। সেটা হচ্ছে শার্লি এতদিন প্রাসাদের সকলকে রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে এসেছে। এই রাজ্যের এক বিশেষ গাছের শিকড়ের ঔষধ। যা ঘুমে মগ্ন করে তোলে সঠিক সময়ে এবং ভোরের আগে ঘুম ভাঙ্গা অসম্ভব। তাই ঐশ্বর্য আজ রাতের খাবার খায়নি ইচ্ছে করেই। আর আজ সেই রাত যেই রাতে ঐশ্বর্য নিজের কাজ সম্পূর্ণ করেছে।
অ’গ্নি তলো’য়ার দুটো হাতে ধরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ঐশ্বর্য নদীর তীরে। তার কোঁকড়ানো চুল ঢাকা পড়েছে পাগড়ীতে। শুধু টলটলে পানিতে ফুটে উঠেছে তার মুখশ্রী। চোখেমুখে ঘাম ও র’ক্তের সংমিশ্রণে একাকার হয়ে অন্যরূপ ধারণ করেছে। পানিতে থাকা প্রতিচ্ছবির উদ্দেশ্যে ঐশ্বর্য নিজ মনে বলে উঠল,
“অবশেষে রাণী তার সন্তান তুল্য প্রজাদের বিচার করতে পেরেছে। সঠিক বিচার পেয়েছে কিনা জানি না এখনো। কারণ ওরা যেভাবে ছটফট করতে করতে ম’রেছে সেটা আমাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতোগুলো প্রাণের পরিবর্তে শুধু একটা প্রা’ণ নিয়ে শান্তি হচ্ছে না আমার। যদি পারতাম ওই বিশ্বাসঘাতকের প্রাণ ফিরিয়ে আবারও মা’রতাম। হাজারবার এমন করতাম। কিন্তু এতো সাধ্যের বাহিরে!”
একটু থামে ঐশ্বর্য। মুখে থাকা এই বিষের চেয়েও বি’ষাক্ত বিশ্বাসঘাতকের র’ক্ত তার ভালো লাগছে না। চোখমুখ জড়িয়ে একটু ঝুঁকে বেশ কয়েকবার পানির ঝাপ্টা দিল সে। মুখে রয়ে গেল বিন্দু বিন্দু পানির কণা। আবারও নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে ভ্যাম্পায়ার কুইন ঐশ্বর্য? তোমার কাজ এখানেই শেষ…?”
তারপর নিজের মুখে লাগাম দিল সে। হালকা হাসলো। হাসিটা কেমন যেন। খুশির নয়! অন্যরকম রহস্যময় হাসি। মাথা নিচু করে বলল,
“না। তোমার শেষ কাজ এখনো বাকি।”
ঐশ্বর্য কোথা থেকে যেন একটা কাগজের টুকরো বের করল। মোড়ানো কাগজের টুকরো ভালো করে খুলে নিল। তবে কাগজটার অর্ধেক অংশ ছেঁড়া। সেই ছেঁড়া কাগজ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মৃ’ত্যুই তোমার অন্তিম কাজ। তোমার মৃ’ত্যু এই রাজ্যের জন্য করা তোমার শেষ কাজ।”
বলে উঠে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। ডানহাতে তলো’য়ারটি ধরে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করল। তারপর শান্ত সুরে বলল,
“ভ্যাম্পায়ার কুইনের সবথেকে বড় ভুল ছিল এই অগ্নি তলো’য়ারকে জীবিত করা। আর সেই ভুলের মাশুল তাকে তার প্রা’ণ দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ হবে। আর আমি তৈরি।”
নিজের দুটো হাত দিয়েই এবার তলো’য়ার কৌশলে ধরে নিজের দিকেই তাক করল ঐশ্বর্য। পুরো শরীর একবার কেঁপে উঠলেও নিজেকে সরিয়ে নিল না সে। দৃষ্টি এবং লক্ষ্য স্থির করে বলল,
“যেই ভয়ানক অ’স্ত্র আমার স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেই ভয়ানক অ’স্ত্র আবারও প্রাণহীন হবে একমাত্র আমারই ধ্বংসে।”
চোখটা আপনাআপনি বুঁজে এলো ঐশ্বর্যের। নিজেই নিজেকে কি করে আ’ঘাত করতে সেটা তার জানা নেই। মৃ’ত্যু ভয় সকলের থাকে। তারও রয়েছে তবে তা অতিক্রম করেছে তার রাজ্য এবং প্রজাদের প্রতি ভালোবাসা। সে জানে এই অ’স্ত্র যতদিন সচল থাকবে ততদিন রাজ্যে শান্তি মিলবে না। সে আবারও সুখপাখির দেখা চায়। সে চায় ওই নীল আকাশে আবারও যেমন মুক্ত পাখির মতো রাজ্য মেতে উঠুক। চোখের পাতা বন্ধ করতেই যখন তার চোখের সামনে পুনম ও প্রেম ভেসে ওঠে চোখ খোলে সে। হাতটা নামিয়ে নিতে থাকে আস্তে আস্তে। এই কঠিন সময় তার মস্তিষ্কে উঁকি দেয় তার এবং প্রেমের প্রণয়ের মূহুর্তগুলো! সেইসব সুখানুভূতি! প্রেমের সেই স্পর্শ। তার বলা কথা! ঐশ্বর্য থরথর করে কাঁপতে থাকে। চোখে চিকচিক করে পানি। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে করে তীক্ষ্ণ হয়ে আসে তার দৃষ্টি। আবারও নিজের দিকে তাক করে।
“আমার মি. আনস্মাইলিং, পুনম, বাবা-মা আর এই রাজ্যের সকলকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যে আমাকে ম’রতে হবে।”
এবার সজোরে চালিয়ে দিল ঐশ্বর্য নিজের দিকে তলো’য়ার। নিজের শরীরে আ’ঘাত লাগার আগেই ভেসে এলো পুরুষালি কন্ঠস্বর। সে থেমে চোখ খুলে এক পলক সামনে তাকালো। সামনে ছুটে আসা সেই লোকটিকে দেখে চোখ দুটো শান্ত হলো তার। তবে মস্তিষ্ক নয়। মস্তিষ্কের অনুসরণে শান্ত চোখেই অনায়াসে অ’গ্নি তলো’য়ারটা নিজের পেটে এফোঁড়ওফোঁড় করল ঐশ্বর্য। নিশ্বাসটা কেমন যেন আঁটকে এলো। বেহায়া চোখজোড়া তবুও সেই মানুষটির দিকেই স্থির। টাল সামলাতে পারল না ঐশ্বর্য। মুখ দিয়ে তরল জাতীয় কিছু বের হচ্ছে। সে বুঝতে পারল র’ক্ত! শরীর ছেড়ে দিল এবার। দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে গেল। ধপ করে পড়ল। মাটিতে রাখল মাথা। নেত্রপল্লব তখনও স্থির। মানুষটি কাছে চলে এসেছে। মানুষটির মুখে কি যে ব্যাকুলতা!
প্রেম নিজের সর্বোচ্চ বেগে ছুটে এসেও লাভ হলো না কোনো। তার প্রিয়তমা ততক্ষণে তার চোখের সামনে নিজের ধ্বংস হওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এ যেন তারই বুকে কেউ লাগামহীন ভাবে ছু’রি চালিয়ে দিল! অচিরেই বুকের ভেতরটা উথাল-পাতাল করতে শুরু করল।
ঘোলা হয়ে আসছে ঐশ্বর্যের দৃষ্টি। তার মাথাটা কোলে নিল প্রেম। তার মুখ থেকে কোনো কথা আসছে না। প্রেমও কোনো কথা না পেয়ে ঐশ্বর্যকে তুলে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। জাপ্টে ধরল এমনভাবে যেন নিজের থেকে একটু দূরে সরিয়ে দিলেও ঐশ্বর্য কর্পূরের মতো উবে যাবে। ঐশ্বর্যের ক্ষ’ত স্থান থেকে বের হওয়া র’ক্ত মাখামাখি হলো প্রেমের শরীরে। প্রেমের হাতে র’ক্ত আসা মাত্রই চোখ দুটো উল্টে যেতে লাগল। অথচ শান্ত ঐশ্বর্য। প্রেম উপলব্ধি করে ঐশ্বর্য একহাতে তার পিঠ খামচে ধরেছে। ঐশ্বর্যের গালে হাত রেখে সে পাগলের মতো বলে ওঠে,
“এটা কি করলে? কেন করলে? এমনটা কেন করলে? বলো?”
“নিজেকে জয়ী করতে!”
ঐশ্বর্যের নির্বিকার কন্ঠস্বর। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে চলেছে তখন। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। প্রেম ঐশ্বর্যকে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলে,
“কীসের জয়?”
ঐশ্বর্য হাসে। র’ক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। তার ভ্রুক্ষেপ নেই। হাসতে কষ্ট হলেও হাসি পাচ্ছে। হাসিটা আনন্দের বটেই।
“আমার মৃ’ত্যুতেই আসল জয় লুকিয়ে ছিল। এইযে আমার আ’ঘাত করা এই তলো’য়ার দেখছেন। এটার ধ্বংস একমাত্র তখনি হবে যখন এটা দ্বারা তার মৃ’ত্যু হবে যে এই অ’স্ত্র সচল করেছিল। আর আমি বার বার এই অ’স্ত্র দ্বারা আমার রাজ্যকে ক্ষত-বিক্ষত হতে দেখতে পারব না। তাই আমি…”
“নিজেকেই ধ্বংস করলে? কেন ঐশ্বর্য? আমার চাওয়ার দাম নেই তোমার কাছে?”
প্রেম চিৎকার করে করে একেকটা কথা বলছে। ততক্ষণে তার চিৎকারে ইলহান সহ সকলে উপস্থিত হয়ে থমকে গিয়েছে। অন্যদিকে মাধুর্য সেখানে প্রবেশ করেও চমকে ওঠে। সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে! এক চিৎকারে বলে ওঠে,
“আমার মেয়ে কি হলো! কেন হলো!”
সে ছুটে আসে। ঐশ্বর্য প্রেমের গালে হাত রাখে।
“আপনি তো আমার কাছে সবচেয়ে দামি। এই রাজত্ব, মুকুট, সিংহাসনও শেখ আনন প্রেমের কাছে ফিকে পড়ে যায়।”
প্রেমের অশ্রু আর বাঁধা মানে না। চিৎকার করে ওঠে। পাগলামি করে ঐশ্বর্যকে নিজের সাথে চেপে ধরে। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“ডক্টর, বৈদ্য কোথায়! যাকে পারো তাকে নিয়ে আসো। আমার ঐশ্বর্যকে বাঁচাতে হবে।”
মাধুর্য দৌড়ে এসে ঐশ্বর্যের কাছে পড়ে। আহ’ত ঐশ্বর্য ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মায়ের দিকে। তার মা ইতিমধ্যে কান্না করে একাকার করে ফেলেছে। সে উপুড় হয়ে ঐশ্বর্যের মাথা পাগলের মতো বুলাতে বুলাতে বলল,
“কি হয়েছে রে মা! কেন এমন করলে? তোমার কিছু হলে তোমার এই মা বাঁচবে কি করে?”
“আর তোমাদের কিছু হলে আমি কি করে বাঁচব মা? তাই তো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”
এবার মাধুর্য ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরে। শব্দ করে কেঁদে উঠে বলে,
“আমার মেয়েকে বাঁচাও কেউ!”
অনুভব পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। মনের সকল অনুভূতি যেন ম’রে গিয়েছে। তাকে কিছু কেউ বললেও শুনছে না। সকলে ছোটাছুটি করছে বৈদ্য ডেকে আনতে। ঐশ্বর্য সেসবে পাত্তা দিল না। উল্টে বলল,
“আমার পুনমের খেয়াল রাখবে মা। দেখবে ও যেন আমার মতো কোনো ভুল না করে বসে।”
আটকা আটকা গলা ঐশ্বর্যের। বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো পড়ছে। এবার বাবার দিকে তাকায় সে। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসছে। ঠোঁট নীল হয়ে এসেছে বি’ষে। তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে ইশারা করে অনুভবকে আসতে বলে কাছে। অনুভব দূরে দাঁড়িয়ে। জোর পায় না হাঁটার। একটু সময় নিয়ে রোবটের মতো ধীর পায়ে হেঁটে আসে। মেয়ের কাছে বসে। ঐশ্বর্য বলে,
“আমাকে যেমন সব কথায় সায় দিয়েছো। পুনমের সব কথায় সায় দেবে না। বুঝলে? আর নিজের খেয়াল রাখবে। সবসময় জেদ করবে না।”
অনুভব কাঁপা হাতে ঐশ্বর্যের কপালে হাত রাখে। কাঁপা সুরেই বলে,
“তোমার কিছু হবে না।”
ঐশ্বর্য কিছু বলে না। এবার তার কান্না আসে। চোখ বুঁজে কান্না লুকায়। প্রেমের পিঠ আরো জোরে খামচে ধরে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলে,
“মি. আনস্মাইলিং! একবার বলবেন? জয় হক আমার রাণী সাহেবার?”
প্রেম ভাষাহীন। ঐশ্বর্যকে একহাতে ধরে রয়েছে। রাজ্যের সকলে স্তম্ভিত! তারা এখনো বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে। প্রেমকে কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে আবারও বলে,
“বলুন না!”
অনুভব বুঝতে পারে ঐশ্বর্যের কথা। চোখ ইশারায় প্রেমকে বলতে বলে। প্রেম থেমে থেমে বলে ওঠে,
“জয় হোক আমার রাণী সাহেবার!”
ঐশ্বর্য স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভেতরে শান্তি অনুভব করছে। তীব্র যন্ত্রণায় বুঁজে আসছে চোখ। নিস্তেজ গলায় বলে,
“এতোদিন ভ্যাম্পায়ার কুইন হয়ে থেকেছি। শেষ মূহুর্ত #প্রেমের_ঐশ্বর্য হয়ে থাকতে চাই। আমি #প্রেমের_ঐশ্বর্য! আর…”
কথাটুকু সম্পূর্ণ হয় না। দুটো ঠোঁট লেগে যায়। নিস্তেজ হয়ে যায় দেহ। মাধুর্যেরও সবটা ঘোলাটে লাগে। মেয়েকে চোখ বুজতে দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। চিৎকার দেওয়ার আগেই সে টলে পড়ে। অনুভব তাকে ধরে। অন্যদিকে মেয়ের নিথর দেহের দিকে চেয়ে থাকে। তার অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে ঐশ্বর্যের গালে পড়ে অশ্রু! চিৎকার তারও করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সে এমন করলে কি করে সামলাবে সবাইকে?
প্রেম পাগলের মতো করে ঝাঁকাতে থাকে ঐশ্বর্যকে। তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে। চারিপাশটা কেঁপে ওঠে।
“না তুমি এমন করতে পারো না। পারো না ঐশ্বর্য। পারো না তুমি। এমন করতে পারো না।”
কথা বলার মাঝেই সেই অগ্নি তলো’য়ার থেকে সৃষ্টি হয় এক তীব্র রশ্মি। সকলে সহ্য করতে পেরে চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে যখন চোখ খোলে তখন আবিষ্কৃত হয় এক কাগজ। তলো’য়ারটা তখন গায়েব। তার বদলে পড়ে আছে কাগজ। র’ক্তে মেখে যাচ্ছে দেখে কাগজটা তুলল ইলহান। সকলের দিকে তাকিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলল। জোরে জোরে পড়তে থাকল।
” আমি অগ্নি তলো’য়ার। আমার দ্বারা মৃ’ত্যু অনিবার্য হলেও এর একটি প্রতিষেধক আছে। সেখানেই যাও যেখানে আমায় পেয়েছিলে। সেখানেই লুকিয়ে রাখা সেই প্রতিষেধক! তোমার কাছে সময় মাত্র দুই প্রহর। এর মধ্যে বি’ষ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। তার আগেই উদ্ধার করো সেই প্রতিষেধক।”
প্রেম যখন উন্মাদের মতো কাঁদছিল তখন তার কর্ণকুহরে কথাগুলো প্রবেশ হতেই ইলহানের দিকে তাকালো সে। তখন বৈদ্য এসে উপস্থিত হয়েছে। ঐশ্বর্যের শ্বাস চলছে মৃদু ভাবে। দ্রুত তাকে নিয়ে রওনা হলো প্রাসাদের দিকে।
প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে ঐশ্বর্যের কক্ষে শুইয়ে দেওয়া হলো ঐশ্বর্যকে। বৈদ্য চিকিৎসা করতে আরম্ভ করল। তবে তিনি কিছুই করতে পারবেন না তিনিও ভালোভাবে জানেন। দরকার সেই প্রতিষেধক। কারোর সঙ্গে কোনোরকম কথা না বাড়িয়ে প্রেম পা বাড়ায় প্রায় ধ্বংসাত্মক ডেভিল কিংডমের দিকে। যাবার আগেই আয়নার দিকে পড়ে তার দৃষ্টি। আয়নায় বড় বড় করে লিখা,
“আপনার সঙ্গে আমার আরো কিছু বছর বাঁচার খুব ইচ্ছে ছিল। আরো কিছু বছর বাঁচতে চেয়েছিলাম। তবে আমার সেই বাঁচার আর্তনাদ কেউ শোনে নি। চেয়েছিলাম আমি আর আপনি মিলে আমাদের ছোট্ট পুনমের বিয়ে দেব। দুজনের একসঙ্গে বয়ষ্ক হবো। আপনার বুকে বৃদ্ধ বয়সেও মাথা রাখতে চেয়েছিলাম। ভাগ্য এতো নিষ্ঠুর কেন বলুন তো?”
প্রেমের ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে যেন। ভেতরে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। হৃদয়ে রীতিমতো ভারী বস্তু দিয়ে আ’ঘাত করছে কেউ। অন্যপাশের আয়নার দিকেও তাকায় প্রেম। সেখানেও লিখা,
“আমার যা ইচ্ছে তাই হয়ে যাক। আমি মাটির সঙ্গে মিশে যাই! তবুও আপনাকে ছাড়ব না। সেই শুরু থেকে ছাড়িনি আজও তা করব না। আমি আপনাতেই শুরু আপনাতেই শেষ!”
প্রেম এবার ছুট লাগায় হাতে তলো’য়ার নিয়ে। সে সেদিন আবারও প্রবেশ করেছিল সেই ভয়ানক রাজ্যে। নিজের প্রেয়সীকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে। এখানে পৌঁছাতেই তার এক প্রহর যখন পার হয় তখন হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজ্যের প্রবেশ দ্বার নতুন করে তৈরি হয়ে হয়েছিল। ঐশ্বর্য ঠিকই বলেছিল। যতদিন ভালো থাকবে ততদিন খারাপও থাকবে। সে তো সেদিন রাজ্যে থাকা ডেভিলদের শেষ করেছিল। যারা রাজ্যের বাহিরে ছিল তাদের তো কিছুই হয়নি। এই নতুন করে রাজ্য তৈরি ছিল হয়ত তাদেরই কাজ।
প্রেম সেদিন ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজ্যে প্রবেশ করে। খুব কাছাকাছি পৌঁছায় লক্ষ্যের তবে বাঁধ সাধে কেউ। যখনই অগ্নি তলো’য়ারের সেই সিন্দুক খুলতে যাবে তখনি ধরা পড়েছিল সে। তার হাতে তলো’য়ারের আঘা’ত করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে যুদ্ধ করেছিল। তবে এক পর্যায়ে হাত থেকে তলো’য়ার ছুটে যায়। এক জায়গায় ছিটকে যায়। সে তাকায় ভালো করে চারিপাশে তাকে ঘিরে রাখা ডেভিল গুলোর দিকে। তাদের মাঝে একজন সিন্দুক থেকে প্রতিষেধক বের করে অদ্ভুত হাসতে শুরু করে। আর প্রেমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“এটা তোমার চাই?”
“হ্যাঁ চাই। এর বদলে তোমরা যা চাইবে তাই দেব। তবুও আমার কাছে দাও।”
তারা সকলে হাসে। আর বলে ওঠে,
“মগের মুল্লুক নাকি? চাইলেই পাওয়া যায়? হাঁটু গেঁড়ে বস।”
প্রেমের যেকোনো মূল্যে সেই প্রতিষেধক চাই। সে পিছু ফিরল না। হাঁটু গেঁড়েই বসল। সেই কাঙ্ক্ষিত ডেভিল তার থেকে বেশ দূরত্বে প্রতিষেধক রেখে বলল,
“নাও সেই প্রতিষেধক।”
প্রেম যেন চাঁদ পেয়েছে। অন্য কোনো দিকে খেয়াল করল না। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল সেটির দিকে। তখনই তলো’য়ার চালানোর শব্দ হয়। ধারালো তলো’য়ার তড়তড় করে প্রেমের পিঠে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরকম টু শব্দ না করেই পড়ে যায় সে। হাত-পা ছুঁড়ে চেষ্টা করে প্রতিষেধক নিতে তখনও। আবারও তাকে আ’ঘাত করা হয়। সকলে মিলে ইচ্ছেমতো তার ওপর হামলে পড়ে। মারাত্মকভাবে আ’ক্রমণ করে বসে। প্রেম ছটফটিয়ে ওঠে। একা পারে না সকলের সাথে। তবুও প্রেমের দৃষ্টি আঁটকে ছিল সেই প্রতিষেধকের মাঝে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রেম। কপাল থেকে বিরামহীনভাবে ঝরছে র’ক্ত। গালের এক পাশ কে’টে গিয়েছে। পিঠ থেকে এখনো রক্তক্ষরণ থামেনি। কোনোরকমে একটা কাপড় বেঁধে রাখা। হাঁটতে কষ্ট হলেও মুখে হাসি বজায় রেখেছে সে। কারণ তার হাতে প্রতিষেধক। ঐশ্বর্য আগের মতো হবে। তার রাণী সাহেবা তার সাথে বাঁচবে! আর কি চাই?
কক্ষে প্রবেশ করেই এতো এতো ভীড় থেকে বিরক্ত হয় সে। এতো ভীড় কেন? তবে ভীড় হওয়া অযৌক্তিক না। এই রাজ্যের রাণী ঐশ্বর্য। তাকে দেখতে তো এতো এতো ভীড় হবেই। প্রেমকে দেখা মাত্র সকলে মাথা নুইয়ে নেয়। তাকে যাবার রাস্তা করে দেয়। প্রেম এগিয়ে যায়। সকলের কান্নামাখা চেহারা দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়। তবুও এগোতে থাকে। কান্না সুর ততই বেশি গাঢ় হতে থাকে। আপাদমস্তক কাঁপতে থাকে। বিছানা অবধি যেতেই নিজের মা-বাবাকে দেখে কিছুটা হেঁসে ওঠে প্রেম। আর জিজ্ঞেস করে,
“মা-বাবা তোমরা কখন এলে?”
মিসেস. পরিণীতা এবং কবির সাহেব প্রেমের দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত মিসেস. পরিণীতার দুটো চোখ। প্রেমের ভ্রু কুঁচকায়। তার মা তাকে এমন অবস্থায় দেখা মাত্র এগিয়ে আসে। তার গালে মুখে হাত রেখে বলে,
“এ কি অবস্থা তোমার প্রেম?”
“কিছু না মা। এইতো প্রতিষেধক দেখো! ঐশ্বর্য ঠিক হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মিসেস. পরিণীতা হু হু করে কেঁদে ওঠেন। কান্নার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে এসে ঐশ্বর্যের পাশে বসে প্রেম। তার হাতের প্রতিষেধক দ্রুত বৈদ্যের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন! দ্রুত কাজ করুন। হাতে সময় নেই।”
সকলে স্তব্ধ। মুখে নেই কোনো ভাষা। অন্যপাশে এলিনা ছোট্ট পুনমকে কোলে নিয়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে দেখে এলিনাকে প্রেম রাগী সুরে বলল,
“একি! পুনমকে এতো ভীড়ে রেখেছো কেন? নিয়ে যাও এখান থেকে।”
এলিনা দাঁড়াল না। প্রেমের কথায় সত্যিই বেরিয়ে গেল দৌড়ে ঘর থেকে পুনমকে গিয়ে। প্রেমের পিঠে যন্ত্রণা হচ্ছে। পিঠে সে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতেই মৃদু চিৎকার হয়ে উঠল। হাত দিতেই বুঝল র’ক্তের স্রোত বইছে। তাতে কি? ঐশ্বর্য ঠিক হলেই নিজের চিকিৎসা করাবে। আগে দেখে নেবে ঐশ্বর্যের হাসোজ্জল মুখ। কিন্তু বৈদ্যকে চুপ থাকতে দেখে প্রেম আবারও বলে উঠল,
“কি হলো? কাজ করছেন না কেন? সময় পেরিয়ে যাবে তবে এই প্রতিষেধক ব্যবহার করবেন?”
“সময় ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে কিং। আমায় ক্ষমা করুন। এই প্রতিষেধক আর কোনো কাজে আসবে না।”
প্রেম কিছু বুঝে উঠতে পারে না। বুকে চিনচিন করে ওঠে। নিজের শরীরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। তবুও জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”
“আপনি আসতে দেরি করে ফেলেছেন। বি’ষ কুইনের সারা শরীরের ছড়িয়ে গেছে। দুই প্রহর পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ উনি আমাদের মাঝে নেই।”
থরথর করে কেঁপে ওঠে প্রেম। দুই প্রহর পেরিয়ে গেছে? কখন কিভাবে? ঐশ্বর্যের পানে তাকায় সে। অশ্রুসিক্ত নয়ন তার। অশ্রুতে ভরাট চোখেও ঐশ্বর্যকে দেখছে সে। নীলাভ চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না তার প্রিয়তমার। সে যে চোখ বুঁজে রেখেছে। চোখমুখ নীল হয়ে গিয়েছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ঝুঁকে পড়ে প্রেম ঐশ্বর্যের দিকে। তাকে আবারও আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিজের সাথে। তাকে সে নিজের মাঝে মিশিয়ে নিতে চায়। ব্যাস…আর কোনো কথা বলে না। তবে ঐশ্বর্যের কানে কানে বলে,
“আই এম সরি এ্যাংরি বার্ড। আমি আসতে দেরি করে ফেলেছি। তার জন্য এতোই অভিমান?”
কথাগুলো ঐশ্বর্যের কান অবধি পৌঁছায় না। পৌঁছাবেও না। শরীরে এবার বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার। মিসেস. পরিণীতা এগিয়ে আসে। আর ছেলের পাগলামিতে বলেন,
“ও তো ছেড়ে চলেই গেল বাবা। তুমি নিজের চিকিৎসা করাও। তোমায় বাঁচতে হবে। আমার দোহাই লাগে তোমার।”
“ঐশ্বর্য এটা অন্যায় করেছে মা। খুব বড় অন্যায়। ও তো সকলের ন্যায় বিচার পাইয়ে দেয়। তবে আমার প্রতি এ কেমন অন্যায় রাণী সাহেবার? একদিন সে জোর করেই আমার জীবনে প্রবেশ করেছিল। আবার আজকেও জোর করেই আমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছে। কেন আমি সবসময় মেনে নেব? নেব না আমি অন্যায় মেনে।”
মিসেস. পরিণীতা শব্দ করে কেঁদে ওঠেন আর বলেন,
“কিন্তু তুমি এতে কিছুই করতে পারবে না প্রেম। ঐশ্বর্য আর নেই যে!”
প্রেম মাথা উঠিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে তাকায়। নয়ন ভরে দেখে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই প্রথম দিনের কথা। সেই উশৃংখল মেয়ের মুখশ্রী! সেই জেদি চোখ। সেই রাগ! সেই পাগলামি। সবকিছু এতো দ্রুত ফুরিয়ে গেল বুঝি?
কবির সাহেব এসে প্রেমকে সরাতে চান। প্রেম সরে আসে। কারো কথা তার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে বাঁচতে পারতো। পুনমের জন্য বাঁচতে পারতো। তবে তাকেও যে বি’ষ পান করানো হয়েছিল। তার শরীরে তা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রেমের শক্তি ক্ষয় হতে লাগল। চোখ দুটো বড্ড ক্লান্ত। কখন যেন চিরতরে বুঁজে যাবে। ঐশ্বর্যের কানের কাছে অতি কষ্টে মাথা নিয়ে গেল সে। ফিসফিস করে জোর দিয়ে বলল,
“একসাথে বাঁচতে পারিনি তো কি হয়েছে? তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না। ভালোবাসতে বুঝি একাই পারো?”
কবির সাহেব সহ সকলে প্রেমকে ধরে টানাটানি করছে। এক পর্যায়ে প্রেম নিজে থেকে ছেড়ে দেয় বাঁধন। আলগা হয়ে যায়। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসে। অন্ধকার হতে থাকে চারিদিকে। শেষ বারের মতো কানে আসে মায়ের করা চিৎকার! প্রেম শেষ বার হঠাৎ হেঁসে ওঠে। কিছু একটা বলে। কেউ শুনতে পায় না। সে নিজেই বলে এবং শোনে।
“আমার একান্ত একটি পৃথিবী ছিল। ভালোবাসাই মোড়ানো পৃথিবী। সেখানে ছিলাম আমি এবং আমার অর্ধাঙ্গিনী। পৃথিবী আগুনে জ্বলে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল চোখের সামনে। তবুও আমি পিছু ছাড়ব না আমার প্রিয়তমার!”
বর্তমান…
“এভাবে তবে শেষ হয়েছিল #প্রেমের_ঐশ্বর্যের এবং ঐশ্বর্যের মি. আনস্মাইলিং এর কাহিনী? এভাবেই বুঝি হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছিল তারা?”
আনমনা প্রশ্ন পুনমের। চোখের অশ্রু চিকচিক করছে। কষ্ট না হলেও অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে। তার মা তো জয়ী হয়েছিল। তার মা যে এই রাজ্যের আসল রাণী সাহেবা। মাধুর্য মাথা নাড়ায়। আর বলে,
“হুমম। প্রেমও অবশেষে তার অর্ধাঙ্গিনীর পিছু নিয়েছিল। কেউ তাকে আটকাতে পারে নি।”
“সেটা তো নেওয়ারই ছিল মেরি জান! ভাগ্য কি করে বদলাবে?”
কথার মাঝে এক পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে। পুনম পুলকিত চোখে পিছু ফিরে তাকায়। কক্ষের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বিশেষ জনকে দেখে লাফিয়ে ওঠে পুনম। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই ভারি গলা প্রশ্ন করে,
“কি হয়ে কথা হচ্ছে আমায় ছাড়া?”
“তোমায় ছাড়া কোনো কথা হতে পারে? তাড়াতাড়ি এসো!”
ছুটে এসে পুনম নিজেই জড়িয়ে ধরে বিশেষ জনকে। সে-ই স্নেহের সাথে পুনমের মাথা হাত রেখে হেসে ওঠে। এবার পুনম কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বলে ওঠে,
“মি. অনুভব সিনহা! সারাদিন বিজনেস, রাজ্য না করে একটু নাতনি নাতনি করলেও তো পারেন।”
হাসিটা প্রগাঢ় হয় অনুভবের। শব্দ করে হেঁসে বলে,
“আমার নাতনিকে মিস করছিলাম জন্যই তো ছুটে এলাম।”
“আমার জানা আছে কত নাতনিকে মিস করছিলেন। আমার ঘাড়ে ব’ন্দুক রেখেছেন। আসলে তো নিজের ওয়াইফকে মিস করেছিলেন। তাই তো এতো রাতেও চলে এসেছেন। ওয়াইফ ছাড়া এক রাতও থাকা যায় না তাই না?”
অনুভবের হাসি থামে না। পুনমও হেঁসে দেয়। ঐশ্বর্যের পর যেন তার আরেক সন্তান পুনম। অনুভব পুনমের মাঝে ঐশ্বর্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তাই তো তাকে নিয়েই বেঁচে থাকা।
নিশুতিরাত। আশপাশটা যখন স্তব্ধ তখন এক অদ্ভুত আওয়াজ বেজে ওঠে। নূপুরের আওয়াজ চারিদিকে মাতিয়ে তোলে। এক জোড়া পা এগিয়ে যায় বড় বড় করে টানিয়ে রাখা ছবিগুলোর দিকে। ছবিগুলোর কাছে এসে থামে পুনম। মুখে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। তার সামনে বড় একটা ছবি। ছবির নিচে স্পষ্ট লেখা, ‘প্রেমের ঐশ্বর্য’। পুনম তার ডাগরডাগর চোখে তাকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে উচ্ছ্বসিত করে। সেই হিংস্র মুখভঙ্গি যেন পুনমের মনে কৌতুহল জাগায়। এই তার মা। হাতে বড় একটা তলো’য়ার। তার দৃষ্টিতেই তো সকলে ঝলসে যাবে। অ’স্ত্রের কি প্রয়োজন? পাশের ছবিতে তাকায় পুনম। তার মা-বাবার একসাথের ছবি। দুজনেই সিংহাসনে বসে। যেন সিংহাসন তাদের জন্যই তৈরি! পুনম মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে,
“তোমাদের ভালোবাসা সচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। জানি আদেও সম্ভব নয়। মা খুব ভাগ্যবতী যে এমন একজনকে পেয়েছে যার মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে মাথাব্যথাই ছিল না। আর বাবাও ভাগ্যবান মানুষ। নিশ্চয় তুমি খুব ভালো ছিলে বাবা। নয়ত কি করে মায়ের কঠিন মন ভেঙে ভালোবাসার সঞ্চার করতে পেরেছিলে?”
কথাগুলো বলতে বলতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় পুনম। চাঁদের আলো এসে পড়ে ছবিগুলোতে। যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছবিগুলো। পুনম স্থির চোখে রূপালী চাঁদের দিকে তাকায়। আর আনমনে বলে,
“মা জানো? সবাই বলে আমি নাকি তোমার প্রতিরূপ! সত্যিই কি তাই? আমি জানি সত্যিই সেটা নয়। কারণ তোমার মতো তীব্র সাহস আমার নেই। তুমি তুমিই হতে পারো। অন্য কেউ হতে পারে না। তুমি অনন্য এক নারী! আর সেই নারীর চমৎকার এক প্রেমিক ছিল শেখ আনন প্রেম।”
যেন আকাশে ভাসছে প্রেম এবং ঐশ্বর্যের খুনসুটি। পুনমের চোখে ভেসে ওঠে চাঁদের মাঝেই একজন নারী এবং পুরুষের প্রতিচ্ছবি! ওইযে তারা! হাসিতে মেতে উঠেছে। ঐশ্বর্য শান্তিতে বুকে মাথা রেখেছে তার উম্মাদ প্রেমিক পুরুষের। ওইযে ফুটে উঠেছে সেই উন্মাদ প্রেমিক এবং প্রেমিকার গল্প!
-সমাপ্ত-
[বি.দ্র. অনেকের মেনে নিতে খারাপ লাগবে প্রেম এবং ঐশ্বর্যের পরিণতি। তবে আমি গল্প শুরু থেকে এভাবে সাজিয়েছি। আমি বলেও দিয়েছিলাম গল্পে তিনটা অংশ ফুটে উঠবে। শেষ অংশটিতে ফুটে উঠবে একজন রাণীর তার রাজ্যের প্রতি ভালোবাসা। সেটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি কিনা জানা নেই। ঐশ্বর্য এমন এক নারী যে কিনা অন্য অস্তিত্বের হলেও ভালোবেসেছে এক সাধারণ মানুষকে। সেই সাধারণ মানুষ প্রেম কতটুকু ঐশ্বর্যের পাশে থেকেছে সেটাও ফুটিয়ে তুলেছি আমি। হয়ত অনেকের কষ্ট লাগবে। খারাপ লাগবে। সেটা মার্জিতভাবে বলতে পারেন। আশা করছি পাঠকমহলের কাছ থেকে কোনো আ’ক্রমণাত্মক মক্তব্য পাবো না। অবশ্যই আপনাদের মত আছে। সেটা ভালো করে বলবেন। গল্পটা নষ্ট করে দিলেন, গল্পটা খারাপ হয়ে গেল এমন মক্তব্য করবেন না। দুঃখের পরিণতি দিলেই গল্প নষ্ট হয় না। গল্পের সমাপ্তি যেমন খুশির হয় তেমনই দুঃখেরও হয়। গল্পের সমাপ্তি আগে থেকেই জানলে সেটা পড়ে লাভ কি বলুন তো? ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ছিল। আর শেষ পর্বে আশা করছি গঠনমূলক মক্তব্য পাবো।]