#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৪৯
রজনীতে হওয়া বর্ষণের জলবিন্দুতে ধুয়েমুছে চাকচিক্য রূপ লাভ করল গাছের ধূলিধূসর পাতা,পথঘাট, সবকিছু। বাতাবরণ জুড়ে নির্মল পবন। গ্রীষ্মের প্রবল তাপদাহে বৃষ্টি যেন এক মুঠো সুখ হয়ে আত্মসমর্পণ করে অমর্ত্যলোকের কাছে। তার সেই আত্মসমর্পণে বিজয় উল্লাসে ছেয়ে যায় প্রকৃতি, ঝলমলে হয়ে ওঠে সবকিছু। প্রত্যুষে খিলখিল করে হাসছে যেন আশপাশ। প্রহর ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে উপবনের দোলনায় এসে বসল নিশাত। উপবন বলার কারণ হলো, দোলনার কাছে আসতে ক্ষুদ্র বন পেরিয়ে আসতে হয় তার। ফুপি সূর্যমুখীর বীজ ফেলেছিলেন এদিকটায়। সেগুলোর চারা গজিয়ে গাছ লম্বাটে হয়েছে খুব। ঘন ঘন গাছের ভিড়ে কেউ লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। দোলনার কাছ পর্যন্ত আসার জন্য দুইধারে সূর্যমুখীর বাগানের মাঝে দিয়ে সরু রাস্তা করে দেওয়া। সেটা দিয়ে এসে দোলনায় বসল নিশাত। পেছনে আবার নানানবিধ লতা গাছ দোলনাটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। প্রহর ভাই স্নানে গিয়েছে, সেই সুযোগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসল সে নিচে। তারপর একটু বাড়ির চারিধার ঘুরে দেখার জন্য আকুপাকু করা মনকে সায় দিয়ে চলে এলো এখানে। একবার ভেবেছিল, শিমুলের কাছে যাবে। কিন্তু এখনো ঘুমোচ্ছে মেয়েটা কাজের বুয়া থেকে জানতে পারল। কি এমন ঘুম মেয়েটার!
নিশাত হতবাক। যেই মেয়ে ভোরে ওঠার স্বভাব বহন করত, সে কি-না এত বেলা করে ঘুমে নিমগ্ন! রাতে কি ঘুমোয় নি? কী করে সারারাত জেগে? আজকাল শিমুল ও সৌরভ ভাইয়ের ওপর গাঢ় সন্দেহের বাসা বেঁধেছে ওর মন ভূমিতে। ভাইয়াও শিমুলের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী, আর শিমুলটাও আগের মতো কলটল দেয় না তাকে, মেয়েটাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হয় এখন। আজ প্রহর ভাই যাওয়ার পর ভালো করে জেঁকে ধরবে তাকে।
নিশাত পায়ের কাছে সৌন্দর্য বিলীনে মত্ত একটা লালচে রঙা বুনোফুল দেখে ঝুঁকে তুলে নেয় হাতে। গভীর চোখে তাকায় ফুলটার দিকে। প্রহর ভাইকে বিয়ের পর কখনো কিছু দেয় নি সে,সবাই না-কি প্রেমিক, স্বামীকে কত কি দেয়! আচ্ছা, ফুলটা দেবে কি? ফুলটা দিলে প্রহর ভাই আবার হাসবে না তো? যা লোক! সবসময় ওকে অ–পমান করেই তৃপ্তি পায় ওই অভদ্র পুরুষ। তাই ভাবল,ফুলটা ফেলে দিবে। তক্ষুনি কানে বাজল তীক্ষ্ণ সুরের প্রশ্ন,
” এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিস ফুলটায়? আমাকে তো কখনো এত মনোযোগ দিয়ে দেখিস নি। দেখবি দূরের কথা,ফিরেও তো তাকাস না আমার দিকে। মনে হয় তাকালে তোর শরীর জ্বলে যাবে,এমন ভাব করিস। ”
অপ্রতিভ, হতচকিত হয়ে যায় নিশাত। দৃষ্টি তুলে ভুলে যায় প্রতুত্তর করতে। ধবধবে শ্বেত পাঞ্জাবি পরিহিত, হালকা ভেজা চুলের পুরুষকে দেখে ডঙ্কা বেজে উঠল তার হৃদপিণ্ডে। চোখে এসে হানা দিল অপরিসীম মুগ্ধতা। এই পুরুষের প্রতি ওর এই মুগ্ধতার রেশ কাটবে না কখনো। বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে,কোনোভাবেই কিশোরী হৃদয় মানতে চায় না কোনো বাধা। উল্টো সমর্পিত হতে চায় এই পুরুষের কাছে। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে না সে,সরাসরি একদমই তাকাতে পারে না প্রহর ভাইয়ের দিকে। সরাসরি তাকাতে গেলে লজ্জা গ্রাস করে নেয়, বুকের গহীন সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় উথাল-পাতাল করে, ভয় হয় শা–ণিত দৃষ্টির কাছে ধরে পড়ে যাওয়ার। তাই চো–রাচোখে দেখে সর্বদা।
প্রহর দোলনায় এসে বসল ওর পাশে। নিশাত না তাকিয়ে কি মনে করে যেন কম্পনরত হাতে ফুলটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। প্রহর সেটা হাতে তুলে নিয়ে কেমন কাঠ গলায় বলল,
” এদিকে তাকা। ”
আদেশ ছিল নাকি ধ**মক নিশাত বুঝল না। মাথা নত করে ফিরে তাকাল। প্রহর ওর চিবুকে আলতো করে ছুঁয়ে মুখটা উপরে তুলে গালভর্তি চন্দ্রাকৃতির হাসি নিয়ে বলল,
” এটা দিয়ে আমি কী করব রে? কানে দিব? তুই চাইছিস মেয়েদের মতো ফুলটা আমি কানে দিই? জানতাম তুই আমার বেইজ্জতি চাইবি। প্রমাণ করে দিলি তুই কার মেয়ে। ছিহ! নিজের স্বামীর এত অবমাননা করছিস! তোকে আবার শা**স্তি দেওয়া জরুরি। ”
অশান্ত, প্রেমহীন, কাঠখোট্টা কণ্ঠ শুনে নিশাত ভড়কাল। মনে পড়ে গেল প্রহরের রাক্ষ**সের মতো কাণ্ডখানা। দ্রুত গতিতে ঘাড় পেছনে এলিয়ে অল্প সরে বসল সে। শ্বাসরুদ্ধভাবে বলল,” এমনিই দিয়েছি। আমার ভুল হয়েছে প্রহর ভাই, আপনি কানে দেবেন কেন? ”
প্রহরের কপালে কুঞ্চিত রেখা পড়ল। হঠাৎ করে চাপা ক্রোধে গর্জে উঠল সে,” স্বামীকে ভাই বলছিস কেন, গাধী? তোকে কি এখন শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে হবে আমি তোর স্বামী? স+ ব সংযুক্ত আ( া-কার) স্বা, ম ঈ( ী-কার) মী= স্বামী। নে বানান করে বলে দিলাম, মুখস্থ কর। ”
নিশাতের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। বার কয়েক উচ্চারণ করতে চাইল, ‘ ত্যাড়া লোক, ত্যাড়া লোক। ‘ এই এক মানুষ সর্বদাই সবকিছুতে ত্যাড়া। কোনোদিন যদি সিধেসাধা কোনো কথা বলে থাকে,তাহলে সেটা বোধহয় সজ্ঞানে বলে নি কিংবা ভুলে বলে ফেলেছে। ত্যাড়ামি বাস করছে তার শিরা-উপশিরায়, প্রতিটি রক্তকণিকায়, রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। পেটানো,একহারা, মেদহীন শরীরটাই ত্যাড়ামিতে ভরপুর। সবসময় শুধু ব**র্বরোচিত অত্যাচার চালায় ওর ওপর। ভীত স্বরে মিনমিন করে বলে,
” বানান পারি আমি। ভুল হবে না আর,প্রহর ভাই। ”
বলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নিশাত নিজের বেকুব কাজে। মুখে ডাকটা চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে যেন। সে কী করবে? মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। এতে তার কী দো–ষ!
প্রহরের চক্ষুদ্বয় রক্তিম চাহনি নিক্ষেপ করল নিশাতের দিক। অতি সত্বর হাত বাড়িয়ে ঝট করে বুকে টেনে আনল মেয়েটার কোমল দেহটা নিজের বক্ষস্থলে। পিঠে হাতের চাপ ফেলে আগ্নেয়গিরির মতো ঝাঁজালো রূপ ধারণ করে বলল,
” আবারো ডেকেছিস। তোর মুখে ভাই শুনলে নিজেকে এখন অসহায় লাগে, বর বর ফিলিং উধাও হয়ে যায়। নিশু রে নিশু, আমি তোর বর। ”
নিশাত অপরা**ধী এবং আতঙ্কিত গলায় বলে ওঠে,” ছোট বেলায় ভাই না ডাকলে বলতেন বেয়া**দব, মা**রতেনও। তখন থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রহর ভাই। আর এমন হবে না। ”
প্রহর ঈষৎ ঝুঁকে কপাল নিয়ে ঠেকাল নিশাতের কপালে। নাকে নাক ছুঁয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল ওর চেহারায়। বুকে উদ্বেল ঢেউ তুলে দিয়ে প্রমত্ত চোখে চেয়ে ডাকে,
” তিলবতী, ও তিলবতী!”
নিশাত কোনো মন্ত্রে বশীভূত হওয়ার মতো করে সাড়া দেয়,” হু।”
” তোকে বিয়ে করে আমার শুধু আদর নিয়েই জ্বালা না,সবদিক থেকেই জ্বালা। তুই আমায় ভাই ডাকিস, আদরও করিস না, ভালোবাসিও বলিস না আবার আমাকে ভালো করে দেখিসও না। আমার মতো সুদর্শন বরটাকে তুই অবহেলা করিস কীভাবে? ”
হৃদয় তন্ত্রী বেজে ওঠে নিশাতের। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যায় এক প্রবল প্রেমময় নেশা তার মাঝে। উত্তর দেয় প্রহরকে কলকল মধুর স্বরে,
” আপনাকে আমি দেখি,গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখি। ”
” কই,তোকে আমার দিকে তাকাতে দেখি না!”
” সরাসরি দেখি না তো,লুকিয়ে দেখি,আপনার নজর লুকিয়ে। ”
” তাহলে আমি ঠিকি বলেছিলাম, তুই একটা চু***রনি। ”
ভ্রম ও বশ দুটোই ছুটে প্রচন্ড বেগে উড়ে গেল কোথাও। কান,চোখ, দৃষ্টি সব সজাগ হলো নিশাতের জাদুকরী কণ্ঠে হঠাৎ তিতা কথা শুনে। সে ভুলেই গেছিল,এটা শ্রদ্ধেয়, ত্যাড়া রাজ্যের রাজা প্রহর ভাই।
প্রহর ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। বলে,” যেতে হবে, বিকেলে মিটিং আছে। চল,ঘরে চল। ”
আড়ষ্টভাবে ওঠে দাঁড়ায় নিশাত। প্রহরকে সত্য বলে দিয়েছে সে,লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার সত্যটুকু। এখন সুযোগ পেলেই মজা নিবে এটা নিয়ে। আবার কানে আসে,
” আমি এ মাসে আর আসব না গ্রামে। সামনের মাসে আসব। ”
নিশাতের মনটা বিষাদে ভরে গেল। বিচ্ছেদ শব্দটুকু এখন আর যে সয় না তার। অভিমান হয়, অযাচিত অভিমান। জানে, দূরত্ব প্রহর ভাই ইচ্ছে করে সৃষ্ট করে না,তবুও অপরিমেয় অভিমানে দ্বিগুণ তপ্ত হয়ে ওঠে হৃদয়ের উষ্ণ ভূমি। নিজের লাজলজ্জা অতলান্তিকে ডুবিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলিষ্ঠ দেহটা। অশ্রুভেজা গলায় বলে,
” ভালোবাসি, প্রহর ভাই। ”
প্রহর বুকে জড়িয়ে থাকা হাত দুটো ধরে হাতের মালকিনকে সামনে নিয়ে এসে বুকে মিশিয়ে নেয়। অসহিষ্ণু গলায় বলে ওঠে,
” আমার তিলবতী কাঁদছে। এই তিলবতী, কাঁদছিস কেন তুই? চলে যাচ্ছি বলে? আবার আসব তো সামনের মাসে। ”
নিশাত জানে না কেন তার এত কান্না পাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে এই বিচ্ছেদ তাকে দুঃখের ছোঁয়ায় জর্জরিত করছে। এই বিচ্ছেদ এক বুক কষ্ট উপহার দিচ্ছে তাকে।
বুকে মুখ গুঁজে থেকে অস্পষ্টভাবে বলে,” জলদি চলে আসবেন। ”
” তোর বর রাজনীতি করে, কোনো যুদ্ধে যাচ্ছে না। সব তচনচ হয়ে গেলেও তোকে আমি ছাড়ছি না,সুইটহার্ট। কত যুদ্ধ করলাম শ্বশুরজানের সাথে তোকে পাওয়ার জন্য, সব বৃথায় দেওয়ার মতো গর্দভ আমি নই। ”
বলেই প্রহর ওষ্ঠ চেপে ধরল নিশাতের চুলের ভাঁজে। শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা।
_________________________
রফিক আজম পুকুর পাড়ে বেতের মোড়া পেতে বসে আছেন। সৌরভ সেদিকে যাওয়ার জন্য পায়চারি করছে বারংবার। ছেলের অস্থিরতা চোখে বিঁধল উনার। কাছে ডাকলেন,
” এদিকে আয়, সৌরভ। কিছু কইবি?”
সৌরভের অভ্যন্তরে তুফান চলছে। ভয়রা হানা দিচ্ছে। আব্বার প্রতিক্রিয়া কেমনতরো হবে সেটা ভেবে ভেবে তাপহীন, শীতল দিনেই দরদর করে ঘামছে সে। সবটাই লক্ষ্য করলেন রফিক আজম। গুরুগম্ভীর কণ্ঠখানা নাড়লেন,
” কী হইছে বাপ? কোনো সমস্যা? ”
সৌরভ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেরে,শিমুলের চেহারাটা কল্পনা করে নিস্তরঙ্গ গলায় বলে ফেলল,
” নিশাতের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে স্মরণিকা নিবাসে, আমার বিয়ের প্রস্তাবটাও রাখবেন, আব্বা। শিমুলরে ভালোবাসি। ”
#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)