প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ৪৪

0
844

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৪৪

ঊষা ব্যাগ থেকে একটা চিঠির খাম বের করে প্রত্যয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। চোখ জোড়া সংকুচিত করে তার দিকে তাকাল প্রত্যয়। বিস্ময়াহত হয়ে ছোট করে উচ্চারণ করে,” চিঠি!”
” হুম,তোমার জন্য। ”
” আমাকে চিঠি কে দিল?”
” মৃন্ময়ী। ”
প্রত্যয় দ্বিগুণ চমৎকৃত চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করল,” কখন দিল?”
” এক সপ্তাহ আগে,যাওয়ার আগের দিন। ”
” তোর সাথে দেখা করে গিয়েছিল? ”
” হ্যাঁ, চিঠিটা তোমাকে দিতে বলল। ”
চিঠির খাম খুলতে খুলতে প্রত্যয় জিজ্ঞাসু গলায় বলে ওঠে,” তুই খুলিস নি?”
” তোমার নামে চিঠি দিয়েছে তুমি পড়বে বলে। আমি পড়লে অন্যায় হয়ে যাবে না?”
” তোর অধিকার আছে পড়ার। ”
” অধিকার আছে,তবে আমি চাই না পড়তে। মৃন্ময়ীর চিঠির ভাষাগুলো একান্তই তোমার মাঝে থাকুক। ”
প্রত্যয় অতি যত্নে খাম খুলে চিঠিটা বের করল। মেলে ধরল মুখের সামনে।

❝ কাঠের পুতুল যেভাবে নাচে এক হিংস্র জানোয়ারের ভয়ে আমি সেভাবেই নেচেছিলাম। নিজের জীবনের তিক্ত সত্যটা গোপনে রেখেছিলাম ভীষণ যত্নসহকারে। প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে দ্বিতীয় ভালোবাসা আঁকড়ে ধরতে আমার ছিল অগাধ ভয়। নিজেকে যতটা শক্ত খোলসে লুকিয়ে রেখেছিলাম ভিতর থেকে আমি তার চেয়েও নরম ছিলাম। আমার প্রথম ভালোবাসা আপনার মতোই ছন্নছাড়া এক যুবক ছিলেন, কিশোরগঞ্জে অতিথি হয়ে এসে কেড়ে নিয়েছিল আমার মন। আমি তখন সদ্য ম্যাট্রিক দিয়ে কলেজে পদার্পণের দিন গুণছি। হুট করে ঝড়ো হাওয়া হয়ে জীবনে এলো সেই যুবক। আমাদের বাড়ির পাশে এক বড়ো ভাইয়ার বন্ধু হবার খাতিরে বেড়াতে সেখানে এসেছিল সে। সেখান থেকেই পরিচয় এবং পরিচয় থেকেই প্রণয়। প্রণয়ের কয়েক মাসের মাথায় বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া। আসলে মা ছাড়া বড়ো হয়েছি আমি,বাবা ব্যাংকের চাকরির জন্য আমাকে তেমন সময় দিতে পারত না। কারো হুট করে পাওয়া ভালোবাসায়,ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি নিমিষেই মুগ্ধতার জালে জড়িয়ে যাই। আমার মুগ্ধতা, সেই মানুষটা কিছুই ভুল ছিল না। আমাদের বিপক্ষে ছিল আমাদেরই নিয়তি। একটা মেয়ে যতটা গভীর ভালোবাসা পেলে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবতী বলে দাবি করতে পারে আমি তেমনটাই পেয়েছি। কত সুখময় কপাল আমার,তাই না? এত ভালোবাসা পেলাম, নিঃসন্দেহে আমি সুখী মেয়ে। কিন্তু সুখের ওপর নজর লাগে জানেন তো? আমারই ভাগ্যের কালো নজর লেগেছিল বোধহয়। সারাক্ষণ ভাবতাম আমি কেন এত সুখী! কখনো ভাবন ঘরে আসে নি দুঃখও তো আমায় ছুঁতে পারে, সুখ নিয়ে কেন এত লাফঝাপ আমার! দুঃখ আমার সুখের ওপর হিংসে করে চলেই এলো জীবনে নীলাম্বরে আষাঢ়ের ঘন কালো কাদম্বিনীর মতো। হঠাৎ বাবা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। লুকোচুরি বিয়ে হওয়ায় দুই পরিবার থেকে অনুষ্ঠান করে ফের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়। আমার স্বামীর সাথে ফোনে আলাপন হতো তখন আমাদের। বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবার সময়টায় তাকে আমি কয়েক বার কল করেও পাই নি। তার পরিবারের কারো নাম্বার না রাখায় যোগাযোগ করতে পারি নি আমি। ভাবলাম রাজনীতি করে তাতে হয়তো ব্যস্ত। সুযোগ করে আমাকে কল দেবে। একদিন, দুদিন, তিনদিন, মাসখানেক চলে গেল,যোগাযোগ করল না আর। বাবা সুস্থ হয়ে বার কয়েক চেষ্টা করলেন যোগাযোগ করার সম্ভব হলো না। এর মধ্যে আমার ফোনটাও বাবার জন্য হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করার সময়টায় চুরি হয়ে যায়। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পাঁচ মাস পর আমিই বাবাকে নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসি, এসে জানতে পারি আমি আসার পাঁচ মিনিট আগেই আমার স্বামীকে দাফন করা হয়েছে। তিনি নাকি মাদকাসক্ত হয়ে মারা গেছেন। কথাটা বিশ্বাস হয় নি আমার। সেই বাড়ির কেউ আমার সাথে কথা বলতে রাজি ছিল না। প্রথম থেকেই তার পরিবারে আমাদের বিয়ে নিয়ে অমত ছিল। তাই অন্তিমের মৃত্যুর পর যোগাযোগ না করতে চাওয়াটা স্বাভাবিক। আমার বার বার মনে হচ্ছিল অন্তিমের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। ওহ হ্যাঁ, আমার স্বামীর নাম অন্তিম। যেই মানুষটার জীবনে কোনো কষ্ট ছিল না,বাজে অভ্যাস ছিল না,আমাকে এত ভালোবাসত সে কেমন করে পাল্টে গিয়ে এভাবে নিজেকে শেষ করে দেয়? নামটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে পরিচিত লাগছে? লাগারই কথা,সেও আপনাদের বিপক্ষে রাজনীতি করত একটা সময়। অন্তিম সেই ভয়ংকর পথ মৃত্যুর জন্য বেছে নেয় নি আমি জানি, তাকে মারা হয়েছে এবং খুবই ভয়ংকরভাবে। শুধু মাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের জন্য সমীরণ মেরেছে তাকে। সে জানতেই পারে নি আমার মাঝে সে তার একটা অংশ রেখে গিয়েছে। আমার একটা ছেলে আছে চার বছরের, যাকে আপনি আমার জীবনে আসার আগেও কুদৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখেছিলাম সমীরণের কারণে। নিজের এবং ছেলের সুন্দর একটা ভবিষ্যত গড়ব বলে ঢাকাতেই থেকে যাই। এটাই ছিল আমার জীবনের চরম ভুল। অত বছর সমীরণ আমাকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও আপনি আমার পেছনে পড়ার পর থেকে তার নজর চলে আসে আমার ওপর। আপনাদের ব্যাপারে সে সকল খোঁজ রাখত, শ–ত্রু বলে কথা। আপনি যেদিন থেকে আমার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া শুরু করলেন,সেদিন থেকেই অন্ধকারের অন্যতম অধ্যায় শুরু হয় জীবনে। যেই ছেলেকে সবার আড়ালে রেখেছিলাম তার ঠিকানা খুঁজে নেয় সে। কাছের কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া আমার ছেলের ব্যাপারটা কেউ জানত না, আমার বড়ো বোনের কাছে রেখেছিলাম তাকে। নিজেকেও যথাসম্ভব শক্ত রেখে,আড়ালে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সমীরণ আমাকে ঠিকি খুঁজে বের করে নেয়। সে হু””মকি দেয় আমি আপনার বুকের ভেতরের যন্ত্রণা হাহাকার না বাড়ালে সে বাবার ক্ষতি করবে। আসলে এসব মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। তাছাড়া সে আমার স্বামীর মৃ–ত্যুর পেছনে দায়ী সেটা জানতাম। তনুজা আপুর মাধ্যমে জানা হয়। আমেরিকা থেকে উনি আমার সাথে যোগাযোগ করেই সত্যটা জানান। প্রথমে আমি কেস লড়তে চাইলে আপু আমাকে দমিয়ে দেন,সমীরণ কতটা ভয়ংকর সে সম্পর্কে অবগত করেন। অন্তিমের বউ আমি এটা সমীরণের জানা ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ভেঙে দেওয়া। আপনার প্রতি মুহূর্তের খোঁজ সে রাখত। আমি তনুজা আপুর কথায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার উদ্দেশ্যে রাজি হয়ে যাই। আপনার ভালোবাসার প্রস্তাব প্রথমে আমার কাছে বিরক্ত লাগত, তিক্ত সত্যের মাঝে আবদ্ধ ছিলাম বলে বার বার ফিরিয়ে দিতাম আপনাকে। সমীরণের কথায় সেটার মাত্রা আরও বাড়ল। কিন্তু মানুষ যা ভাবে,যা প্ল্যান করে জীবনে সবসময় এমন হয় না।

আমি চেয়েছিলাম সমীরণের কথা রাখতে আপনাকে ভেঙে দিয়ে এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে,কিন্তু আমিই জীবনে আবার মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম, জানেন? ভেবেছিলাম অন্তিমের মতো আবারও কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আপনার প্রেমের আহ্বান, পাগলামি, চোখের যন্ত্রণায় ডুবে আমিও ক্ষণিকের জন্য পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। বুঝি নি সবই ছিল মোহ,মিথ্যে। এত নিখুঁত অভিনয় কেউ করতে পারে জেদের বশীভূত হয়ে! না,অভিযোগ নেই আপনার প্রতি। পথভোলা পথিক আমি ঠিকি নিজের পথ খুঁজে নেব,আমার অন্তিম আমাকে পথ চলা শিখিয়ে গেছে। আমি অন্যের কথায় নিরুপায় হয়ে আপনাকে ঝলসে দিতে গিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছি। আপনি জেদে সফল হয়েছেন, বুকের ভেতর এই সত্যটা পুষে রাখতে পারি নি আর। আমাদের আর কখনো দেখা হবে না বলে চিঠিতে কথাটা প্রকাশ করার সুযোগটুকু পেলাম। যদি কোনোদিন জেনে ফেলেন আমি কোথায় আছি তবুও দেখা করতে আসবেন না দয়া করে। নিজেকে অপরাধী ভাববেন না, অপরাধী তো আমি। ঊষা আপুকে বিয়ে করে আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন,সমীরণ থেকে মুক্ত হয়ে ছাড়তে পারছি বিষাক্ত এ শহর। নয়ত নিজের মাঝে ভালোবাসা নিয়ে আপনার সাথে যন্ত্রণা দেবার খেলায় আমি ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিলাম। মোহ ছাপিয়ে আপনি সত্যিকারের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেছেন,এতে আমি খুশি হয়েছি। আমি কেবলই আপনার জীবনে জেদ,মোহের, অসমাপ্ত অধ্যায় ছিলাম। কখনো যদি আমার না থাকার খবর আপনার কানে আসে আমার ছেলেটাকে একটু আগলে রাখবেন? হারাতে হারাতে নিঃস্ব আমি। এত এত কথা শুধু আপনাকে সত্য বলে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। ক্ষমা করে দেবেন আমায়, আগলে রাখবেন ঊষা আপুকে। অসম্ভব ভালোবাসে আপনাকে, আমার কাছে আপনার প্রেমের দাবি নিয়ে অনেক বার এসেছিল শুধুমাত্র আপনার সুখের জন্য। আমার এক তরফা প্রেমহীন, আপনার জেদের অধ্যায় এটুকুই ছিল। ❞

ইতি,
মৃন্ময়ী।

ইতি টানার পরও চিঠিটার শেষ অংশে আরও কিছু লেখা দেখতে পেল প্রত্যয়। লাল কালি দিয়ে লেখা,
❝ ভালোবাসার নিয়ে মিছে খেল আর খেলবেন না প্রত্যয়। আপনার মিছে ভালোবাসায় আমার হৃদয় জ্বলে পুড়ে অঙ্গার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের আর দেখা না হোক। ❞

চিঠিটা পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রত্যয়ের বুক চিড়ে। যে মেয়েটাকে সে শক্ত ধাঁচের ভাবত,সে আসলে ভেতরে ভেতরে ছিল ভঙ্গুর। শেষোক্ত যন্ত্রণামিশ্রিত কথাগুলো তার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে। কী করে পারল সে এত বড়ো অন্যায় করতে! কারো সাথে ভালোবাসার অভিনয় করার আগে কখনো কেন ভাবে নি ওই মানুষটার মনের কথা! কেন সে মৃন্ময়ীর ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ নেয় নি! মৃন্ময়ী তাকে ক্ষমা করে দিলেও সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।

ঊষা তার গুমোট চেহারা দেখে হাতটা স্পর্শ করল আলতো করে। স্মিত হেসে বলল,“ অনুশোচনা হচ্ছে? ”

প্রত্যয় তড়াক করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওর দিকে। পরক্ষনেই মাথা নত করে ফেলে। ঊষা হাতের পিঠের ওপর হাত ছুঁয়ে বলে,“ এই অনুশোচনা-ই তোমার জন্য শাস্তি ভাইয়া। এর থেকে বড়ো শাস্তি আর হয় না। মেয়েটা জীবনে কত কষ্ট পেল, তোমায় ভালোবেসে অবশিষ্ট সুখটুকুও হারিয়ে ফেলল। ইচ্ছে করে তোমায় ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু মৃন্ময়ী আমাকে যাওয়ার সময় কী বলে গিয়েছে জানো? বলল, ভালোবাসার মানুষকে দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে রেখে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে। সে এসেছিল বলেই হয়ত আমি তোমার থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে বসার চিন্তা করছিলাম। আর আমি অন্য কারো হওয়ার চিন্তা করতেই হয়ত তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি হলো। কিন্তু সবদিক থেকে ভাগ্যের খেলায় মেয়েটাই ঠকে গেল। জ্বলল প্রেম উত্তাপে।
________________

গ্রামে বহুবছর পর এত বড়ো সালিশ বসল বাজারের কাছের বটগাছের তলায়। সালিশের কেন্দ্রবিন্দু রফিক আজম। রবিন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশে। পুরোনো কাহিনির পৃষ্ঠা খোলা হলো পুনরায়। যেই কাহিনি ছিল অসমাপ্ত, তারই সমাপ্তি পাতা লেখা হবে আজ। প্রহর এসে উপস্থিত হলো সেখানে। রবিন নত মাথায় নিরু ও তার কাবিননামার কাগজটা রাখল সবার সামনে পাতানো টেবিলের ওপর।
#চলবে~
( অনেকদিন না লেখায় গল্পটা লিখতে গিয়ে হাত চলছিল না। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল নতুন করে লিখা শিখছি। যাই হোক গল্প শেষের পথে। কয়েকদিনে শেষ হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব বৃহস্পতিবারে রাতে পাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here