প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ৩১

0
1596

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩১

প্রহর বসে আছে হাঁটুগেড়ে। ইটের অতি ক্ষুদ্র এক কণা তার হাঁটুর চামড়া ভেদ করে প্রবেশ করতে চাইছে গহনে। সূক্ষ্ম যন্ত্রণা নাড়াতে চাইছে তাকে৷ কিন্তু সে ভাবলেশহীন, অনড়। জবাবের প্রতিক্ষায় চেয়ে আছে নির্নিমেষ। তার নিগূঢ় দৃষ্টির সবটা জুড়ে কেবলই নিশাতের অলক্তবর্ণ মুখশ্রী। টলছে না কিয়ৎপরিমাণ। সেই সঙ্গে আরও তিনটে মানুষের তিন জোড়া দৃষ্টি ওদের ওপর। গায়ে অজস্র ঝাঁকুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিশাতের চিত্তপটের সমস্ত ভাবনা চেহারায় ভেসে উঠেছে যেন। মেয়েটার কি কম্পজ্বর হলো! অধরোষ্ঠ কাঁপছে কিন্তু বিচ্ছেদ ঘটছে না তাহাদের। পৃথিবীতে মুক্ত হতে পারছে না ধ্বনিরূপে মেয়েটার ভয়ংকর অনুভূতিগুলো। চিকন চিকন হাত-পা,শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গে তরঙ্গের ছোঁয়া লেগেছে হয়ত। সরুভাবে আঁকা আইলাইনারে শোভায়িত চোখ দুয়ের চাউনিটাও অস্পষ্ট। প্রহরের খটকা লাগছে। প্রত্যয়ের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
‘ গাড়ির দরজা খোল প্রত্যয়। ‘
প্রত্যয় অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকায়। ঊষা আর শিমুলের দিকে নজর নিবদ্ধ করে। ওরাও বুঝতে পারছে না। উৎসুক দৃষ্টিগুলো এক নিমেষেই চিন্তিত হয়ে পড়ে।
‘ কী হয়েছে ভাই?’
গাড়ির দরজা মেলে দিয়ে শঙ্কিত গলায় জানতে চায় প্রত্যয়। প্রহর ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। পেশিবহুল দু হাতে তুলে নিয়েছে নিশাতের দেহটা। বুকের খুব কাছে আঁকড়ে ধরে নিরাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ গবেটটা এখনই বেহুঁশ হয়ে যাবে। ‘
শিমুলের মুখ হা হয়ে গেল। বিস্ময়ে নিবিষ্ট হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ বেহুঁশ কেন হবে ভাইয়া? কী হয়েছে ওর?’
ঊষা ওর কোমরের কাছের কাপড় টেনে ধরল। কানের ধারে ফিসফিস করল,
‘ ডোজ বেশি হয়ে গেছে, তাই সহ্য করতে পারছে না হলুদিয়া পাখি। ‘
শিমুল আরও অবাক হলো। একইভাবে ঊষার কর্ণ দুয়ারে মিহি স্বরে বলে,
‘ ডোজ? কীসের ডোজ আপু?’
ঠোঁটে হাত চেপে লাজুক হাসে ঊষা। কানে কানেই উত্তর দেয়,
‘ প্রেমের ডোজ। এই যে প্রহর ভাই সোজা আংটি পড়িয়ে প্রপোজ করল? এটা নিশু নিতে পারে নি। হয়ত বিশ্বাসই করতে পারছে না। ‘
‘ আমিও তো বিশ্বাস করতে পারছি না আপু। কাল ওইসব হলো। তারপর রাতেই ভাইয়া আমাদের ছাঁদে ডেকে বলল সকালেই তার সাথে বের হতে,নিশুকে আংটি পড়াবে। আমার আগে থেকেই মন বলত বড় ভাইয়া নিশুকে ভালোবাসে তাহলে তনুজা আপুর সাথে বিয়ে কেন বলো তো? কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনকি আজ নিশুকে আংটি পড়ানোর কথা তুমি,আমি,প্রত্যয় ভাইয়া বাদে একটা কাকপক্ষীও জানে না। সবকিছু এমন জটিল কেন? সত্যিটা কী?’
ঊষা মৃদু হেসে প্রতুত্তর করে,
‘ দুনিয়ার সবথেকে বড় সত্যি হলো বড় ভাইয়া নিশাতকেই চায়,নিশাতকেই ভালোবাসে। এর থেকে বেশি বুঝি না আমি রহস্যময় মানুষটাকে। ক’দিন আগেও চোখের সামনে যা ঘটত,কানে যা শুনতাম তাতে আমার মনে হত ভাইয়া নিশুকে চায় না। অথচ গত রাতে ধারণা বদলে গেল,সত্যি হলো আমাদের ভাবনাই। নয়ত তনুজাকে নিজ হাতে আংটি না পড়িয়ে ভাইয়া বেরিয়ে যাবে কেন বল? আর আমাদের স্বাক্ষী রেখে নিশাতকে ভালোবাসা কেন জাহির করবে না বাসলে?’
শিমুলের মস্তিষ্কে প্রশ্ন উদয় হলো। মুখে প্রস্ফুটিত করল,
‘ আচ্ছা ঊষা আপু। তুমি কাউকে ভালোবাসো?’
চোখ রাঙাল ঊষা। রাগত স্বরে আওড়ালো,
‘ তোর দুঃসাহস তো কম না। বড় বোনকে এমন প্রশ্ন করিস!’
শিমুল ঠোঁট উল্টে ফেলল।
‘ তোমার ভালোর জন্যই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি জানো বাবা,বড় কাকা তোমার বিয়ের কথা বলাবলি করছিল? ভালোবাসার মানুষ থাকলে বলে দাও। ‘
ঊষার অবাক কণ্ঠস্বর,’ বাবা বিয়ের কথা বলছিল?’
শিমুল তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়,’ হ্যাঁ। ছেলে ডাক্তার। অস্ট্রেলিয়া থাকে। প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হয়েছে বাবারও। ‘

ঊষা হতবাক, বাকরুদ্ধ। বাবা সব জানে। ঠিক কতটা ভালোবাসে প্রত্যয়কে সেটা তাঁর জানার বাহিরে নয়। তাহলে! বিয়ে করবে না ও। প্রত্যয়কে ভালোবেসেই দিব্যি এ জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। সব ভালোবাসায় যেমন পূর্ণতা নেই, তেমনি জীবনকে পরিপূর্ণ করতে সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। একাকীত্বকে বরণ করে অপ্রকাশিত প্রেমোত্তাপ নিয়েই পুড়ে ছাঁই হতে নিঃসংকোচে রাজি সে। এটা বাবা কেন বুঝতে পারছে না!

প্রত্যয় পানির বোতল নিয়ে ছুটে এলো। জ্ঞান হারায় নি নিশাত। চোখ বুঁজে প্রহরের বুকে পড়ে আছে। শরীরের সকল শক্তি হারিয়ে গিয়েছে ওর। বুকের ভেতরের যন্ত্রটার ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণহীন। মাদল বাজছে অন্তঃকরণে। এসবের ভর সামলাতে পারছে না ও। লজ্জার দাপটে প্রহরের বুক থেকে সরে সোজা হয়েও বসতে পারছে না। প্রহর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ রক্তের মতো তোর কি ভালোবাসায়ও ফোবিয়া আছে?’

প্রত্যয় গাড়ির ভিতরে বোতলটা রেখে মুখ লুকিয়ে কেটে পড়ে। মনে পড়ল, দু’টো দিন ধরে মৃন্ময়ীকে একদমই জ্বালানো হয় নি। ঢাকা ফিরেই মেয়েটার কাছে ছুটে যেতে হবে। চোখ দুটি যে তুমুল তৃষ্ণার্ত।

‘ কথা বলছিস না কেন? ‘
নিশাত নিরুত্তর। প্রহর রেগেমেগে বলে উঠল,
‘ সর, সর। আমার বুক থেকে সর। আংটি পড়িয়েছি এর মানে এই নয় যে তুই আঠার মতো লেগে থাকবি। ‘
নিশাত আলগা হয়ে বসে। প্রহর পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ মুখ খুলে পুরোটা পানি আমার মাথায় ঢাল। ‘
নিশাত সজাগ দৃষ্টিতে তাকাল চক্ষুদ্বয় বড় বড় করে। কল্পনা ভেবে প্রশ্ন করল,’ হু?’
‘ তাড়াতাড়ি পানি ঢাল মাথায়। আমার প্রপোজালের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস তুই মৃগী রোগী। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে চ*ড় মারি৷ মাত্র ভালোবাসা দেখিয়েছি,মা*রতে পারব না। তার চেয়ে ভালো আমার মাথাটা ঠান্ডা কর। ‘

বোতলের মুখটা খুলে হাতে মুষ্টিবদ্ধ করল নিশাত। ভয়ে ভয়ে পানিভরা বোতলটা এগিয়ে নিয়ে ধরে প্রহরের মাথার কাছে। এ মানুষের ভরসা নেই। ওকে আবার মে”রে বসে যদি! ঢালতে গিয়ে হাত পিছিয়ে আনে একবার, বাড়িয়ে দেয় পুনশ্চঃ। শেষমেশ চোখ বুঁজে ঢেলে দেয় জল। সহসা শুনতে পায় নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর,
‘ তোর ওড়না দিয়ে মাথাটা মুছে দে এবার। ‘
নিশাত নিরুপায় হয়ে মিনমিন করে বলে,
‘ তুমি চোখ বন্ধ রাখো ভাইয়া। ‘
বলতেই প্রহর চোখ বন্ধ করতে সময় নষ্ট করে নি। গা থেকে ওড়না অর্ধেক খুলে চুল মুছতে আরম্ভ করে নিশাত। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ওর। হরমোনের প্রবল সাড়ায়,উত্তেজনায় আবারও শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে গাড়িতে। চুল মুছতে থাকা হাতটা থমকে গেল আকস্মিক।
‘ তোকে আমি তিলবতী কেন ডাকি জানিস?’
ছোট্ট করে উত্তর দিল, ‘না। ‘
‘ ছয় বছর বয়সে একবার মা’কে পেটের,পায়ের গোড়ালির,হাতের,পিঠের গলার কাছের তিল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলি ফুপু এগুলো কী? সেদিনই নামটা আমার মাথায় আসে। কিন্তু তখন আমি তোকে কু*নজরে দেখতাম না। এখন কীভাবে দেখি শুনবি?’

নিশাত ওড়না দিয়ে শরীর ভালো করে ঢেকে নিল। সতর্ক দৃষ্টিতে প্রহরের পানে চাইল। চোখ বুঁজে আছে সে। অস্ফুটস্বরে তাল মিলিয়ে বলল ,
‘ কীভাবে? ‘
ঝট করে চোখ মেলে তাকালো প্রহর। গাঢ় চাহনি৷ একাগ্রচিত্তে চেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
‘ নব্বই পারসেন্ট কু**নজর আর দশ পারসেন্ট সুনজরে। ‘
নিশাত তৎক্ষনাৎ আমতা আমতা করে,
‘ আমি বাড়ি যাব। ‘
‘ ভয় পাচ্ছিস? আমার কু নজরের ভয়? তোর ওপর কু নজর দেওয়ার রাইটটা শুধু আমারই। সহ্য করতে হবে তোর। মাথায় ঘোমটাটা দে। ‘
কাঁপা কাঁপা হাতে ঘোমটা টানল ও। কিশোরী হৃদয়ে লহরি খেলে যাচ্ছে। তার অ**সভ্য প্রহর ভাই তাকে ভালোবাসে ভাবলেই মন কাননে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। ঘোমটা টেনেই নামিয়ে ফেলে নেত্রযুগল।

প্রহর আঙ্গুলে তুলে নেয় নত চিবুক। আলতো হেসে বলে,
‘ তোকে টুকটুকে লাল বউ লাগছে তিলবতী। আমার অধৈর্য্যের যৌবন বয়স পার করে এসেছি ধৈর্য্যশীল হয়ে তোকে পাব বলে। অপেক্ষা করেছি তোর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখার। ভেবে রেখেছি যেদিন দেখব সেদিনই তোকে নিয়ে ছুটে যাব কাজী অফিসে। গোছালো সব ভাবনা উলোটপালোট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামুজানের সামনেই তাঁর মেয়েকে চিরতরে হাসিল করব আমি। বর হিসেবে পছন্দ তোর আমাকে? অনেক কষ্ট দিব কিন্তু। ‘

নিশাত নরম হাতে প্রহরের অন্য হাতের পিঠে হাত রাখল। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না ওর। প্রহর অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠল,
‘ তুই যে বোবা ভুলে গেছিলাম। একটা হিন্টস দিয়ে দে। আমাকে আর বুড়ো বানাইস না। ‘
কি নিদারুণ যন্ত্রণা! এতদিন ভালোবাসার জন্য খাঁচায় বন্দি পাখির ন্যায় ছটফট করছিল নিশাত। এখন স্বপ্নের মতো পেয়েও প্রকাশ করতে পারছে না। মনের সাথে যুদ্ধ করে বলল,
‘ আমি আপনাকে ছা,,ছাড়া থাকতে পারব না। ‘
‘ আমি তোকে বাঁচতেও দিব না আমাকে ছাড়া। ‘
বলেই ওর কপালে উষ্ণ ওষ্ঠের ছোঁয়া লেপ্টে দিল প্রহর। জমে গেল নিশাত। মূর্তি হয়ে গেল মুহূর্তেই। ঝমঝম আওয়াজ মস্তিষ্ক জুড়ে।
—————————————————

বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে ঊষা। পরশু ঘরোয়াভাবে আকদ হবে ওর। পাত্রের ছুটি কম। ফলপ্রসূ বিয়েতে তাড়াহুড়ো। পাত্রকে অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে মোশতাক সাহেবের। উনার বন্ধুর ছেলে হয়। ঊষাও আর নাকচ করে নি। ঢাকা ফিরেই মিনিটেই সম্মতি দিয়ে দিল বিয়েতে। পাত্রের পরিবারের সাথে একেবারে আকদের দিনই দেখা হবে। শহরতলীতে আঁধারের খেলা চলছে। বই নিয়ে বসল ঊষা টেবিলে ল্যাম্পশেডের অল্পস্বল্প আলোয়। রুমের দরজা খোলা। গটগট করে প্রবেশ করল কেউ অনুমতি বিহীন। সশব্দে বইটা বন্ধ করে দিয়ে অসংবরণ ক্রোধে ফেটে পড়ল লোকটা,

‘ তুই বিয়েতে অনুমতি দিয়েছিস?’

#চলবে,,,!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here