প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ২৭

0
1679

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব______২৭

নিশাতের নরম, শীতল গালে সপাৎ করে এক থা””প্পড় পড়ল। অচিরেই তপ্ততায়,জ্বলনে নড়েচড়ে উঠল মেয়েটা। নিঃসংকোচে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু কপোল ছুঁয়ে অবিরাম নিচে গড়াতে শুরু করল। লালচে,টলমল অশ্রুসিক্ত চক্ষুজোড়া নিক্ষেপ করল চোখ পাকিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকা তেজী এক পুরুষের পানে। কী কারণে,কেন চ-ড় খেল নিশাত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। প্রশ্ন করতেও কলিজা ছোট হয়ে যাচ্ছে যেন। উপায় না পেয়ে চুপটি করে বসে বসে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল কোনো প্রকার শব্দহীন, অনবরত। সেকেন্ডের কাটা পার হলো বোধহয়,বজ্রপাতের মতো ওর কর্ণকুহরে হামলা করল তেজী পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ গর্দভ আমি তোকে থা”””প্পড় দিয়েছি কেন জিজ্ঞেস করবি না? না জিজ্ঞেস করে কেঁদে যাচ্ছিস কেন?’
প্রহরের রাগত্ব স্বরে অনিচ্ছায় নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘ মে”””রেছেন কেন?’
‘ তুই আমাকে আগে কী ডাকতি?’
‘ কী ডাকতাম? ‘
নিশাত হতবাক, কণ্ঠ ভেজা। প্রহর বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে দিয়ে আদেশ করল,
‘ হাত দে। ‘
হাতের দিক এক নজর তাকাল নিশাত। ব্যকুল তার অভ্যন্তর। ওই হাত ছুঁবে কি ছুঁবে না তা নিয়ে মনে অসংখ্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব,প্রবল উত্তেজনা। প্রহর বিরক্ত হয়ে তেঁতে উঠল,
‘ হাতটা ব্যথা করিয়েই শান্তি পাবি?’
তড়িঘড়ি করে বা হাতটা প্রহরের হাতের করপুটে রাখল ও। নিমিষেই তোলপাড় সমগ্র সত্তায়। বিদ্যুৎ গতিতে শিহরণ খেলে যেতে লাগল সারা দেহে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। নিজেকে আবিষ্কার করল সুঠাম দেহের সন্নিকটে,শ্যাম মুখখানির অত্যন্ত কাছাকাছি।

প্রহর হাতটা কঠিনভাবে মুঠোয় পুড়ে রাখল। অল্প একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই আমাকে আগে ” আপনি” করে ডাকতি?’
এহেন প্রশ্নে নিশাত থ হয়ে গেল। চোখের জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল নিমিষেই। পরক্ষণেই ফটাফট উত্তর দিল,
‘ না। ‘
‘ কী বলে ডাকতি?’
মেয়েটা কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ, কিছুটা কাঁপুনি সমেত বলল,
‘ তুমি করে। ‘
প্রহর তিরস্কার সুরে উচ্চারিত করে,
‘ তাহলে ডাক বদলে গেল কেন? তুই কী এখন তুমি করে বলতে লজ্জা পাস? কাহিনী তো এমনই মনে হচ্ছে আমার। নাকি অনেক বছর গ্রামে আসি নি বলে আগে কী ডাকতি ভুলে গেলি?’
তিন তিনটে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে নিশাত ঘাবড়ে গেল। শেষের প্রশ্নটার উত্তরটা ও পারে। উত্তরটা হলো- প্রহরের সাথে যোগাযোগ না থাকায় পূর্বের মতোন সেই তুমি ডাকটা ডাকতে ভারী লজ্জা লাগে। এখন এটা মুখে বললে প্রহর যে আরো একবার ওর গাল লাল করে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপায় এখন মৌনতা। মৌনমুখে সময় পার করতে উদ্যত হলো ও। প্রহর কঠিন গলায় বলল,

‘ গ্রামে আসার পরই আমি এই ব্যাপারটা নোটিশ করেছি। রাস্তাঘাটে থা””প্পড় দিলে তোর মান সম্মান থাকবে না,তাই থাপ্প–ড়টা চার দেয়ালের মাঝেই মা-রলাম। যত হোক তোর সম্মান মানে আমার সম্মান, তোর বেইজ্জতি মানে আমার কলিজা ক্ষত হওয়া। যা করব আমি করব,অন্য কেউ তোকে ছুঁতেও পারবে না। আমারটা আমিই সামলাব, আমিই শাসাবো, আমিই মা-রব,আদরও আমিই করব। অন্য কোনো ব্যক্তির জায়গা নেই তোর আমার মাঝে। একদম খু”””ন করে গায়েব করে ফেলব।’

নিশাত নির্বাক,স্তব্ধ। বুকটা ধপধপ করছে ওর। প্রহরের ঝাঁঝালো চাহনি হতে দৃষ্টি সরালো। তার সদ্য সচেতন হওয়া,প্রেমের উষ্ণতায় পুড়ে ছাড়খাড় হতে থাকা চিত্ত একটু একটু করে প্রহরের উচ্চারিত একেকটা কথা ঠাহর করতে মত্ত হয়ে পড়ল। বুঝল কিছু কিছু। তবে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসফল হলো। প্রহর ভাই কি ওকে পছন্দ করে! করলে তনুজাকে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছে! হয়ত ওকে মামাতো বোন হিসেবে এভাবে ট্রিট করছে। সবসময়ই এমন করে আসছে,এ আর নতুন কী! মা**রছে,শাসাচ্ছে,মন চাইলে একটু আধটু যত্ন দেখায়। এই মানুষটা এমন কেন? ওর জন্য সঠিক একটা কিছু বুঝবার কোনো পথ কেন রাখছে না!

‘ ওঠ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়িতে ফিরতে হবে। ‘

নিশাত মনের উতালপাতাল ভাবনা নিয়ে প্রহরের হাতে হাত রেখেই ওঠে দাঁড়ায়। প্রহর অন্য হাতে পকেট হাতড়ে একটা ক্ষুদ্র নীল বক্স বের করে সামনে ধরল। চিনতে সামান্যও মাথা খাটাতে হলো না ওর। এটা একটা আংটির বক্স। বক্সটা প্রহর ওর হাতের আঁজলায় রেখে বলল,

‘ এটা আমার বহু বছরের জমানো প্রেম। এখন তোর কাছে আমানত রইল। ভুল করেও খুলবি না। শুধু জানবি এই আমানত তুই আগলে রাখলেই সঠিক সময়ে সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পাবি। হতে পারে তোর অতিরিক্ত কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস, যার জন্য তুই ভিতরে ভিতরে অস্থির। ‘

একরাশ বিস্ময়ে জড়িয়ে পড়ল নিশাত। বক্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রহর ধীর স্থির ভঙ্গিতে, গাঢ় স্বরে বলল,

‘ শোন তিলবতী। আমি একটু অন্যরকম,একটু না পুরোই। অগোছালো, নির্বিকার স্বভাব ছাড়তে পারব না। তোর সাথে এমন আচরণ করেই শান্তি পাই আমি। বাকি সবার মতো যত্ন আমি প্রকাশ্যে করতে পারব না। তোর জন্য অপ্রকাশ্যেই অনেক কিছু করতে অভ্যস্ত আমি। ‘

নিশাত অপ্রতিভ হলো। সামলাতে ব্যর্থ সে গভীর স্বরের একেকটা বাক্য। তড়বড় করে ডাকল,
‘ প্রহর ভাই! ‘
সঙ্গে সঙ্গে ভরাট স্বর ভাসল,
‘ তোর সামনেই আছি। বল। ‘
বুনন করা প্রশ্নটা গুলিয়ে ফেলল সে। প্রচন্ড অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওর মনকে। নতজানু হয়ে প্রহরকে বলল,
‘ তোমার ব্যবহারে আমি কষ্ট পাই না। ‘
প্রহরের চক্ষুদ্বয় বড় বড় আকার ধারণ করল। প্রশ্নবিদ্ধ, তুখোড় দৃষ্টিতে চাইল। প্রশ্নসূচক বাক্য মুক্ত হলো কণ্ঠ হতে,
‘ তুই সত্যিই আমার ব্যবহারে কষ্ট পাস না?’
নিশাত ক্ষীণ স্বরে জবাবে জানায়, ‘ না। ‘

‘ তোর হাবভাব ভালো না নিশু। আমার ধম-কিয়ে ধম-কিয়ে কথা বলায় তোর চোখে পানি চলে আসে তা কি আমি লক্ষ্য করি না? কিন্তু ইদানিং তুই অন্যরকম বুলি আওড়াচ্ছিস। শুনলাম তোর নাকি বমি বমি পাচ্ছে? কৃমির ওষুধ খাস না ক’মাস হবে? চল,এক্ষুণি তোকে ওষুধ কিনে দেবো। ‘

নিশাতের কলিজা মুচড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রথমেই মাথায় এলো শিমুলের নামটা। শরমে অবস্থা কাহিল। যদি সম্পূর্ণ ঘটনা শিমুল প্রহরকে বলে দিয়ে থাকে,তাহলে ও খতম। কিন্তু মনে হয় না বলেছে। অস্থিরতায় মেতে উঠল অন্তঃপুর। প্রহরের পিছু পিছু বাহিরে এলো। বাহিরে আসতেই দেখতে পেল বাবার সেই বন্ধুকে। মেয়ের বিদায় লগ্ন সমাপ্ত করে সবে দুয়ারে এসে থামলেন। প্রহর উনাকে দেখা মাত্রই বলল,

‘ আসি চাচা। চিঠিটা?’
‘ ওহ হ্যাঁ! একটু দাঁড়াও বাবা। আমি গুছিয়ে রেখেছি। ‘

হাবিব সাহেব ত্রস্ত পায়ে গেলেন,ফিরেও আসলেন দ্রুত পদলি ফেলে। পার্থক্য কেবল হাতে একটা চিঠি। বহু পুরোনো বোধহয়। খামে কেমন নীলচে রং লেপ্টে আছে। প্রহর চিঠিটা হাতে নিয়ে বলে,’ আসি। ‘

বাইকে ওঠে প্রহরের কাঁধে হাত রাখল নিশাত। ভয় পাচ্ছে ও। বেলা ফুরিয়ে গেল,নিশ্চয়ই মজুমদার বাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেছে ওর এখনও বাড়ি না ফেরার। প্রহরের সামনে কিছু বলতেও পারছে না। উজ্জ্বল প্রকৃতি নিভে গিয়ে কমলাটে আবরণে আবৃত হয়েছে। বাইক চলছে দ্রুত গতিতে। হয়ত প্রহরেরও ফেরার ভীষণ তাড়া। সাপোর্টের খাতিরে আরেকটু শক্ত করে প্রশস্ত কাঁধে হাতটা চেপে ধরল ও। তক্ষুনি ভয়ংকর এক দূর্ঘটনা ঘটে গেল। এমন ঘটনার সম্মুখে প্রথমবার পড়েছে ওর তনুমন,চোখ।
___________________________________

রফিক আজম হিসাবের খাতাটা নিয়ে হিসেব কষছিলেন। আর অল্প কিছুক্ষণ। তৎপরে আজান পড়বে মাগরিবের। রোকেয়া পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। মনটা বিষিয়ে আছে তাঁর পিংকির মায়ের কথা শুনে। স্বামীর কাছাকাছি চেয়ার টেনে বসে গলা ঝারলেন।

‘ নিশাতের আব্বা। ‘
‘ হু। ‘
খাতায় নজর নিবিষ্ট রেখেই ডাকে সাড়া দিলেন রফিক আজম। রোকেয়া শুকনো মুখে বললেন,
‘ নিশুরে লইয়া একটা কথা কইতাম। ‘
‘ কী কথা? কী করছে ও?’
স্বামীকে এসব বলা যাবে না বিধায় কথাটা মনে চেপে রেখে, অন্য কথা তুললেন,
‘ মাইয়ার বয়স কম হয় নাই। আপনেরে অনেক আগে আমার এক খালাতো বোনের কথা বলছিলাম না?’
‘ তোমার ওই দূর সম্পর্কের খালাতো বোন?’
‘ হ্যাঁ, রুমানা আফা। আফার পোলার কথা কইছিল গত বছর আমাদের নিশুর জন্য, আপনের মনে আছে?’

গত বছর নিশাতের মামার বাড়িতে ওর মামাতো বোনের বিয়েতে রোকেয়ার দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন নিশাতকে এক দফা দেখেই পুত্রবধূ রূপে বাছাই করে বসেন। প্রস্তাব রাখেন সরাসরি। তখন রফিক আজম বলে দেন যে বিয়ের কথা ভাবেন নি মেয়ের জন্য। বয়সে এখনও মেয়ে অপরিপক্ক। কিন্তু এখন সেটা বলতে পারবেন না তিনি। কারণ এই অপরিপক্ক বয়সেই পিংকিকে অন্য ঘরে তুলে দিয়েছেন। বছর পেরিয়ে রোকেয়া ফের কেন এ প্রসঙ্গে কথা বলছে ঠাহর করতে পারছেন না। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,
‘ হঠাৎ এই কথা কিরে সৌরভের আম্মা?’
‘ রুমানা আফা আমাকে গত রাতে কল দিছিল। বলল তার মাইয়ার বিয়া ঠিক। এখন ছেলেরও একটা গতি করতে চায়। নিশাতের ওপর এখনও তার মন পইড়া আছে। ‘

কথাটা বলে জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে নিলেন রোকেয়া। রফিক আজম হিসাবের খাতা বন্ধ করলেন নিঃশব্দে। স্ত্রীর দিক ঘুরে বসলেন। বললেন,

‘ ছেলেরে আমি দেহি নাই। শুনছি রাজনীতি করে। আমার এসব কাম ভাল্লাগে না। জাইনা শুইনা কলিজার টুকরারে এমন ছেলের হাতে আমি দিতে পারমু না। ‘

রোকেয়া দ্বিরুক্তি করলেন তৎক্ষনাৎ,

‘ আপনি যেমন মেয়ের জন্য পরিবার চান,তেমনই তারা। ছেলে রাজনীতি করে ঠিকি কিন্তু খারাপ না। শুনছি স্বভাব চরিত্র অনেক ভালা। আপনি একবার ভাবেন না নিশাতের আব্বা। তারা একবার নিশাতরে দেখবার আসতে চাইতেছে। শহরে গেলে ও ভালো কইরা পড়তেও পারব। বিয়া এহনই করাইব না। মেট্টিক হইয়া গেলে তারপর নাহয়,,,

‘ ছেলের নাম কী?’

রোকেয়া মৃদু সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টায় মগ্ন হলেন। কণ্ঠনালি ভেদ করে অস্ফুট উন্মুক্ত হলো নামখানি,

‘ সমীরণ। ‘

#চলবে,,,!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here