#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব______২৬
নিশাতের অবস্থা বেগতিক, উৎকট। বেসামাল হৃৎস্পন্দন। চেহারার রং প্রায় উড়ু উড়ু প্রহরের উচ্চারিত বাক্যখানা কর্ণগোচর হতেই। ইতমধ্যে ঘোরতর বিষমে হলদেটে রঙ উবে গিয়ে সমস্ত মুখ রক্তশূণ্য, মলিন। চিকন, কমজোর হাতে প্রহরের পেটের অর্ধাংশ ধরে রাখা স্থানে শক্ত করে ধরল। দেহ এগিয়ে গেল কিছুটা। দেখতে ছোট বাইকে দূরত্ব রাখার মতোন জায়গা ছিল না, যতটুকু ছিল সেটাও বিলীন হয়ে গেল সম্পূর্ণ। ভয়ের দমকে মেয়েটা প্রহরের কানের অতি সান্নিধ্যে উচ্চারণ করে,
” আপনি এসব আব্বুকে দেখাবেন?”
প্রহর রিস্ক নামক শব্দটা সমেত ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল কিঞ্চিৎ। হেলমেট তার দৃষ্টিতে আবরণী পর্দা হিসেবে কাজ করছে। নিশাত বুঝল না,দেখল না সেই দৃষ্টি। শুনল কেবল জবাবে নিরলস প্রশ্ন,
” কোনসব?”
বলতেও গলা আঁটকে আঁটকে আসছে নিশাতের। কি করে বলবে অমন ‘অস””ভ্য, আজগুবি’ শব্দ! সকরুণভাবে আওড়ালো,
” একটু আগে যেসব বললেন?”
প্রহর সমুখে চেয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে টেনে বলল,”ওহ! চুমুউ?”
কথাটা শ্রবণগ্রন্থিতে আসতেই এলোমেলো হলো শরমে অন্তঃপুর। নিশাত চওড়া পিঠে থুতুনি ঠেকিয়ে মিনমিন করে, ” হ্যাঁ ওটাই। ”
” বলতে লজ্জা, করতে লজ্জা লাগে নি? তুই আমার হাতই ছাড়ছিলি না। হাতের উপরের জায়গায় ঠোঁট দুইটা চেপে রাখছিলি। বহু কষ্টে ছাড়িয়ে আনছি। তোর ভাই দেখলে আমাকে শূ””লে চড়ানোর বন্দোবস্ত করত,মান সম্মানের ফালুদা হয়ে যেত আমার। আর মামুজান অনেক অবিচার করেছে আমার সাথে,এমন সুযোগ লুফে নেওয়া উচিত। ”
নিশাত অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে,” আমি এমন করি নি। আপনি মিথ্যা বলছেন। ”
তার দৃঢ় বিশ্বাস সে এমনটা করতেই পারে না। প্রহরের নিকটস্থেই ওর সারা কায়া শিউরে ওঠে। অতএব, চুমুর ন্যায় কান্ড ঘটবে না কখনো। তড়াক করে ব্রেক কষল প্রহর। বাইক থামিয়ে বলল, ” নাম। ”
ঝাঁঝালো,কঠিন স্বর। নিশাতের গায়ে অতি সন্তপর্ণে শিহরণ বয়ে গেল অচিরেই। নেমে দাঁড়াল। প্রহরও নামল। হেলমেটটা খুলল না। পকেট থেকে মোবাইল ও একটা ওয়ান টাইম মাস্ক বের করে করে। মাস্কটা দেখিয়ে বলে উঠল,
” জলদি এটা পড়। আর স্কার্ফটা দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নে। ”
নিঃশব্দে ভারী স্বরের আদেশ পালনে মত্ত হয় নিশাত। গোলগাল চেহারাটা অতিশয় ভালোভাবে ঢেকে নিল। অবিন্যস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আশেপাশে। ওরা এসে থেমেছে পাশের গ্রামের সীমানায়। হকচকিয়ে গেল সে। কখন মহানন্দ গ্রাম পেছনে ফেলে এখানে এসে থমকালো লক্ষ্যই করে নি। কণ্ঠে বিস্ময়ের ছোঁয়া,
” বাড়িতে যাব না? ”
প্রহর মোবাইলে ব্যস্ত নজর নিবদ্ধ রেখে জানায়,
” যাবি না। ”
” আব্বা,আম্মা,সৌরভ ভাই চিন্তা করবেন। ”
” করুক। “- সিধেসাধা জবাব প্রহরের।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস সঞ্চার করতে পারল না নিশাত। অপারগ সে। ভিতরে ভিতরে টেনশন ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ওর জীবনের সাথে জড়িত একেকজন মানুষ যেন এটম বো—মা। মা’কে সে ভয় পায়,আব্বার গম্ভীর ভাব না চাইতেও বুকের ভেতরে কম্পন ছড়িয়ে দেয়,সৌরভের আদর যেমন সুন্দর ক্রোধান্বিত হাল তার চেয়ে বিভ–ৎস। আর প্রহর! প্রহর ভাই তো ওর ক্ষুদ্র জীবনের জটিল প্রহেলিকা।
প্রহর মোবাইলটা আগের স্থানে রেখে বলে,” তুই অবিশ্বাস করেছিস আমাকে। তোকে এখন দেখানো যাবে না। আগে সেখানে যাই,তারপর একটা বিহিত করব। বাইকে উঠ। ”
মাইলের পর মাইল পারি দিয়ে বাইক এসে থামল দুচালা এক বাড়ির উঠোনে। বাড়ির একপাশে প্যান্ডেল বাঁধানো। মাংস,মশলার ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে সমগ্র বাড়িতে। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে লোকজন বাড়ির পথে ছুটছে। নিশাত বুঝল তারা কোনো বিয়ে বাড়িতে এসেছে। বাড়ির উঠোনে ঢোকার মুখে খুব বেশি অসাধারণ নয়,সাধারণ একটা গেইট তার ক্লান্ত আঁখিদ্বয়ে বিঁধেছে। উঠোনে দাঁড়িয়েই প্রহর অবশেষে মাথা থেকে কালো হেলমেটটা খুলল। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হুকুম করে, ” ধর। ”
নিশাত ঝটপট, বাক্যহীন হাতের আঁজলায় তুলে নিল হেলমেটটা৷ প্রচন্ড ভার। পেটের কাছে ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল। ধরন এমন যেন জিনিসটা অতি মূল্যবান,আগলে রাখতে হবে সযত্নে। চোখে এসে আটকালো প্রহরের চুলে ব্যাকব্রাশ করার মোহনীয় দৃশ্য। এটা ভীষণ মাদকতার ন্যায় কাজ করে ওর মনে। একটু একটু করে অভিলাষ জাগায় সেই চুলে পাঁচটা আঙ্গুল ডুবিয়ে দেবার, ট্রিম করা দাঁড়িতে আলতো করে স্পর্শ করবার। ও প্রহরের শ্যামল সৌন্দর্যে এতটাই ডুবে গিয়েছে টেরই পেল না পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ধ্যানমগ্ন নিঃশেষ হলো ভারিক্কি একটা সুরে।
” আমি ভাবছি তুমি আসবা না বাবা। ”
পাশ ফিরে তাকায় নিশাত তড়িৎ গতিতে। তার বাবার বয়সী এক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে আকাশী রঙের একটা পাঞ্জাবি, মুখে প্রসন্নতার হাসি লেগে আছে। প্রহর নম্র গলায় বলল,
” কি বলেন! আপনি কল দিয়েছেন,আমি আসব না? একটু দেরি হয়ে গেল এই আরকি। বিয়ে পড়ানো শেষ? ”
” বিয়েটা পড়ানো শেষ বাবা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার পথে,ঘরে এসো খাবারের ব্যবস্থা ওখানেই করি। ”
” সমস্যা নেই। আমরা প্যান্ডেলেই খেতে পারব। ”
লোকটা নিশাতের দিকে তাকাল। প্রশ্নাত্মক চাহনি।
” ও?”
নিশাত জড়ীভূত হয়ে গেল। অপরিচিত মানুষের সামনে ঈষৎ অপ্রস্তুত সে। তার ওপর প্রশ্নের তীর ওর দিকে ছুড়ে মারা হয়েছে। প্রহর ওর হাত থেকে হেলমেটটা বাইকের ওপর রেখে বলে,
” অ–হংকারী রফিক মামুজানের মেয়ে। ”
লোকটা বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কণ্ঠে প্রবল উৎকণ্ঠা,
” কি বলো! ও রফিকের মেয়ে?”
পরক্ষণেই নিশাতের পানে হাসিভরা চোখে চাইল। বলল,
” আমি তোমার ও প্রহরের বাবার বন্ধু। হয়তো শুনো নি আমার কথা। যোগাযোগ নেই তো। ”
শেষোক্ত কথাতে মন ভাঙ্গার আভাস,বিষাদ খুঁজে পায় নিশাত। মানুষটার গলাটা কেঁপে উঠল যেন। হতবাক নেত্রে তাকায় লোকটার নিষ্প্রভ চেহারায়। এ গ্রামে বাবার বন্ধু আছে, কখনো শুনে নি ও। তাছাড়া লোকটাও বলল যোগাযোগ নেই। সবথেকে আশ্চর্যজনক কথা হলো ফুপা আর আব্বা বন্ধু ছিল এ বিস্ময়কর সত্যিটা সে আজ জানতে পেরেছে। কত কথা লুকিয়ে আছে ওর অগোচরে! জিজ্ঞেস করলেও সবাই ধম”””কায় কিংবা মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। যত কথা লুকায়িত সব বাড়ির বড়দের মধ্যে।
নিশাত সরব করে সালাম দেয়। লোকটা বিনিময়ে জবাব দেয়। আদুরে ভঙ্গিতে শুধায়,
” ঘরে এসো মা। হাত মুখ ধুইয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর খাবে।”
বিয়ে বাড়ি। হৈ হুল্লোড়ে জমজমাট সমগ্র বাড়ি। গুটি কয়েক মানুষজন আড়চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। কেউ কেউ প্রকাশ্যে চেয়ে আছে পলকহীন, অনিমেষনেত্রে। নিশাত ভালোভাবে চেয়ে অনুধাবন করে,ওর থেকেও প্রহরের দিক কিছু কিছু লুব্ধনেত্র নিবদ্ধ। ধীরগতিতে, চুপি চুপি পা ফেলে হৃদপুষ্ট দেহের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায় ও। প্রহর তখনও সেই লোকের সাথে নানান বাক্যে মগ্ন। নিশাত চোখের কোণা দিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে প্যান্ডেলের পাশে জড়োসড়ো হওয়া মেয়েগুলোকে দেখে নেয়। অকস্মাৎ হাতে স্পর্শ অনুভব করায় চমকে ওঠে ও। হিম শীতল স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া বরাবর। শক্ত একটা হাত ওর হাতটা করপুটে বন্দী করে নিয়েছে, হাতের মালিকের নজর সমুখেই আঁটকে। বিমূঢ় দৃষ্টে দু হাতের সন্ধিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ও। তক্ষুনি শোনা গেল,
” কী দেখছিস?”
নিশাত দ্রুতপদে বলে উঠল,” কিছু না। ”
প্রহর ওর হাতটা আরেকটু টেনে ধরল। সন্দিগ্ধ নজর মেলে জিজ্ঞেস করল, ” গলা কাঁপছে কেন?”
হড়বড়িয়ে বলে নিশাত,” কই?”
নিরুত্তর প্রহর। ওর হাতটা ধরে লোকটার পেছন পেছন ঘরে আসে। লোকটা একজন মধ্য বয়স্ক মহিলাকে ঢাকলেন। মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে ছুটে আসলেন উনি। ওদের দেখিয়ে মহিলাটাকে বললেন,
” রফিকের মেয়ে ও। প্রহর স্কুল থেকে নিয়ে আসল। ”
মহিলাটা নিশাতের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট, আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
” তোমার বন্ধুর মেয়ে অনেক সুন্দর। মাশাআল্লাহ। ”
” ওদের ফ্রেশ হবার ব্যবস্থা করো। আর ওকে এক সেট ড্রেস দাও,স্কুলের জামাটা ঘামে ভিজে আছে। ”
নিশাত সংকোচ নিয়ে প্রহরের মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রহর মুখ খুলে,
” জামা লাগবে না হাবিব কাকা। একটু পর আমরা চলে যাব। আপাতত ওর হাত মুখ ধোঁয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ”
” আচ্ছা বাবা। ”
অচেনা জায়গায় এসে অল্পক্ষণের জন্য জামা পাল্টানোর বিষয়টায় ইতস্তত অনুভব করছিল নিশাত। প্রহর ওর চোখের ভাষা বুঝতে সময় লাগাল না। হায়! এমন করে যদি চক্ষু আরশিতে প্রেমের বাক্যটা ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে পারত ও! তাহলেই বোধহয় বিনা বিলম্বে, সহজে,কষ্টবিহীন দ্রুত পড়ে ফেলতে পারত প্রহর। কণ্ঠনালি গলিয়ে ভালোবাসি এই শ্রুতিমধুর শব্দের মুক্তি দেওয়ার ন্যায় দুঃসহ কাজ করতে হবে না।
হাবিব সাহেবের এক ছেলে,এক মেয়ে। ছেলে পুলিশের চাকুরীতে আছে। মেয়েটার আজ বিয়ে। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষের আচরণ খুবই অমায়িক। বিশেষ করে প্রহরের প্রতি। পারছে না তাকে মাথায় তুলে রাখছে। ঘরের ভেতরের টেবিলে ওদের জন্য হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে দেয়। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু পরিবারের হালচাল জানতে চান হাবিব। উনার ছেলে এসে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে। চাকরি কেমন চলছে জানায়। এক সময়ে হাবিব চাচার বউ জানালেন উনাদের আর্থিক অবস্থা ছিল প্রচন্ড শোচনীয়। বেকার ছেলে,বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ডুবে যায়। অনেক জায়গায় ছেলের চাকরির জন্য আবেদন করলেও হচ্ছিল না। হয় মোটা অংকের টাকা ঢালতে হবে, নয় লাগবে সুপারিশ। তন্মধ্যে এ গ্রামে একবার প্রহর আসলে হাবিব সাহেব প্রহরের সামনে উপস্থিত হয়। প্রহর আগে থেকে চিনত উনাকে। দূরাবস্থার কথা শুনে নিজ দায়িত্বে ক্ষমতা খাটিয়ে নির্জীব, ভাঙ্গাচোরা সংসারটাকে জোরা লাগিয়ে সতেজ করে তুলে। ক্ষমতার অপব্যবহার ভালো নয়,তবে সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যদি কারো লাভ হয় ক্ষতি কী!
খাওয়া শেষে বাড়ির সকলে ছুটে গেলেন মেয়ে বিদায় দিতে। এক দু’জন মেয়ে উঁকিঝুকি দিয়ে বার বার প্রহরকে দেখছিল। ছোট আকৃতির একটা কক্ষ। চারটে দেয়ালের মধ্যে স্রেফ দুটো মানব-মানবীর শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া চলছে। নিশাত বসা ছিল এক কোণায় পাতা চেয়ারে। প্রহর পা দু’টো বিছানায় তুলে গলা উঁচাল,
” নিশু দরজাটা লাগিয়ে আয়। ”
” হ্যাঁ? ”
” দরজাটা লাগিয়ে আয় গাধী।”
অপমানে কান ঝা ঝা করে উঠে নিশাতের। ভালো করে বললে কী হতো! দুয়ারে মেয়েদের দেখে ওর ভেতর জ্বলে উঠল। ‘ শ্যামলা পুরুষ দেখেই এ হাল। ফর্সা হলে আপনারে আমি কই লুকাইতাম প্রহর ভাই? নাকি শ্যামলা রূপটাই মাইয়াদের টানে?’ মনের অন্তরিক্ষে উদ্ভট, অদ্ভুত ভাবনা উড়ে বেড়াচ্ছে দ্বিধাহীন। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস বিমোচনে লেগে গেল।
” আরেকজনের কষ্টের কামাইয়ের বানানো বাড়ির দরজাটা ভাঙার মতলব করেছিস নাকি তুই? তুই বড়লোকের বেটি বলে কি সবাই বড়লোক? ”
রাগমিশ্রিত,ঝাঁঝের কণ্ঠ শুনে বাকহারা নিশাত। পিলে চমকে উঠল। সত্যিই তো! এত জোরে কেন লাগাতে গেল সে! মাথা নুইয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” বাড়ি কখন যাব?”
” দরজা কি বাড়ি যাওয়ার জন্য বন্ধ করিয়েছি? তুই এদিকে আয় বেক্কল। ”
নিশাত ভীরু ভীরু পদলি ফেলে বিছানার কাছাকাছি আসল। প্রহর মোবাইলে বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিতে গিয়ে থামল। মেঝেতে স্পর্শ পা দেখিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বলল,
” পা উঠিয়ে বিছানায় বস। তোর সাথে ঠিক নেই। যা দেখাব, দেখেই তুই আমার মোবাইল হাত থেকে ফেলে দিবি তাতে সন্দেহ নেই। মোবাইল ভাঙার জরিমানা চাইতে গেলে দেখা যাবে শ্রদ্ধেয় মামুজান ফের আমার নামে মা-মলা ঠুকবেন। ”
নিশাত হতভম্ব। কণ্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো বিস্ময়াবিষ্ট প্রশ্ন, ” মাম-লা?”
প্রহর আফসোসের সুরে বলে ওঠে, ” পৃথিবীতে বোধহয় তোর বাপের মতো এক পিসই আছে। তার ফুলের মতো সৌরভ ছড়ানো ছেলের গায়ে টোকা দিয়েছিলাম বলে আপন, নিরীহ ভাগিনার নামে মামলা দিয়েছে। মা-রামা-রির মতো একটা তুচ্ছ কান্ডে রক্তের ভাগিনার নামে কেউ মামলা করে বল? মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানিস? তোকে পয়দা করা মামুজানটাও তোর মতো বেক্কল। ”
বিড়ম্বনার শিকার হলো নিশাতের হৃৎপিণ্ড। কস্মিনকালেও ভাবে নি তার আব্বা এমন কিছু করতে পারে। এত ক্ষোভ কেন আব্বার প্রহর ভাইদের প্রতি? এত নির্দয় কেউ হয়? আপন বোনের ছেলেদের সাথে এমন করে? মুহূর্তেই অনুভূত হচ্ছে প্রহর ভাই যত খোটা,কথা শুনায় সব যুক্তিযুক্ত,জায়েজ।
” নে ধর। দেখ তোর কু-কর্ম। রাস্তায় যখন বললি বিশ্বাস করিস না,ইচ্ছে করেছে পিঠের ছাল তুলে ফেলি। পরে চিন্তা করলাম এতে আমারই লস। মলম পট্টি তো আমার টাকা খরচ করেই করতে হবে। ”
মোবাইলটা বিছানার ওপর রেখে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে নেয় প্রহর। নিশাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোবাইলটা হাতে নিল। নিমিষেই চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে আরম্ভ করল সে। আপাদমস্তকে তীব্র উন্মাতাল শুরু হলো। কঠিন হয়ে দাঁড়াল নিজেকে সামলানো। প্রহরের হাতটা জড়িয়ে ধরে হাতের পৃষ্ঠে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খাচ্ছে ও। দাঁতে দাঁত চেপে প্রহর সেটা ফ্রন্ট ক্যামেরায় বন্দী করে নেয়। এটা যে ও সজ্ঞানে করে নি তা নিশ্চিত। অপার লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে, মাথা ঘুরছে তার। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-মনে মনে বহুবার তার বেতাল মন প্রহরকে চুমু খেয়েছে। তাই বলে এখন বাস্তবে! মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলল,
” এটা,,,এটা কখন হয়েছে?”
” যখন তুই আমাকে চুম্মা চুম্মি করছিলি। ”
করুণ, কোমল গলায় ডাকল নিশাত,” প্রহর ভাই ”
প্রহর ধপ করে উঠে বসল। অভয় দিয়ে বলে,
” চোখ বন্ধ করছিস কেন? বেহুশ হবি নাকি ঘুমাবি?”
সঙ্গে সঙ্গে পরনের শার্টটা দুদিকে টেনে ধরে বুকের দিক ইশারা করে পুনরায় বলে,
” সরকারি বুকে মুখ লুকিয়ে লজ্জা সব গায়েব করে ফেল। একটু ঠিক হতে হবে। কারণ তারপর আমি আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। ”
নিশাত লজ্জাবনত, অধোমুখে অনুরোধ করে,
” আপনি এটা ডিলিট করে দিন। ”
ক্ষেপে যায় প্রহর। ওর দুই বেনুনি টেনে ধরে,” করব না। ”
মৃদু ব্যথায় ককিয়ে ওঠে নিশাত। প্রহর বেনুনি ছেড়ে দিয়ে বলল,” এটা আমি সারাজীবন রেখে দেবো। আমৃত্যু এটা আমার কাছেই থাকবে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে চুমু খেয়েছে বলে কথা। প্রথম সবকিছুই সুন্দর জানিস না? জানবি কেমনে? তুই পারিস খালি আমাকে ধ্বংস করতে। বুঝদার হলে এতকিছুর বোঝা বইতে হতো না আমার। আরো কাছে আয়। ”
হাঁটুতে ভর দিয়ে খানিকটা কাছে গেল নিশাত। অভ্যন্তরে হরমোনের প্রবল সাড়ায় অতিষ্ঠ সে। নিমিষেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ল মোহনীয় কণ্ঠের জাদু,
” যোজন যোজন দূরত্ব হতে পারে দেহের,মনের না।
ভিন্ন দুটি মানব মনে একই প্রেমের সুর বাজলে,তাল মিললে, সেই প্রেমের উষ্ণতায় পুড়তে দুটি হৃদয়কে বাঁধা দেওয়ার শক্তি কোনো তৃতীয়ব্যক্তির নেই, তিলবতী। ”
#চলবে,,,