#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____১৩
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির উপস্থিতি ধরণীতলে। বিরহে আচ্ছাদিত প্রকৃতিতে শরতের বর্ষণ প্রেম প্রেম ভাবের স্বাগতম জানিয়েছে। শরীর কাটা দিয়ে মনে একটু একটু করে প্রণয়ের ঝড় তোলা আবহাওয়া। কি শীতল পরিবেশ! একমুঠো শিউলি হলে মন্দ হত না। নাকের কাছে ধরে বিশুদ্ধ সুবাসে জুড়িয়ে নেওয়া যেত মনপ্রাণ,ভেতর। ছাতা মাথায় ছেলেটা দৌড়ে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াল। এক মিনিট পূর্ণ হয়নি বোধহয় তড়াক করে দরজা মেলে সবিনয়ে হাসল। নম্রতার সহিত অনুরোধ করল,
‘ আসুন ম্যাম। ভাই আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন। ‘
নিশাত অনুভূতিশূণ্য,স্তম্ভিত। কেমন রিয়াকশন দিলে মানানসই হবে মাথায় ধরছে না তার। ছেলেটা ওর অত্যন্ত অপরিচিত। এই প্রথম দেখেছে। হতভম্ব দৃষ্টি পুনর্বার মেলে ধরে মাহিশার পানে। মাহিশার ঠোঁটে তখনও মনোমুগ্ধকর হাসির ছোঁয়া লেগে। ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলছে। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? কোন ভাই? কিছুই নিশাতের জানা নেই। বাধ্য হয়ে এক পা নিচে রাখল গাড়ির বাহিরে। কর্দমাক্ত ভিজে মাটি ছুঁয়ে দিল জুতো জোড়া। সরব করে নিজের মাথার উপরের ছাতা টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে বৃষ্টির ছটা গায়ে মাখতে শুরু করল ছেলেটা। তন্মধ্যে বৃষ্টির বেগও বাড়তে থাকে। ইতস্তত করে নিজের হাতে নিল ছাতা নিশাত। ছেলেটা ভাঁজ করা ছাতাটা খুলে নিজের মাথার উপর দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে জানায়,
‘ চলেন ম্যাম। ‘
নিশাত দৃঢ় পায়ে হাঁটছে। বৃষ্টিতে মাখামাখি গ্রামের রাস্তা। মাটি পিচ্ছিল৷ পরে গেলে মানসম্মানের ইতি ঘটবে। ছোট ছোট কদমে ছেলেটার পেছন পেছন এলো। গাড়ির দরজা আগে থেকেই মেলা। যেন তারই অপেক্ষার প্রহর গুণছিল ওকে ডেকে আনা মানুষটা। আলোকহীনতায় ভুগছে চারপাশ। প্রকৃতিতে আঁধার। সমস্ত পরিবেশ নির্জীব। বর্ষণ সন্ধ্যা এমনই হয়৷ রশ্মির অভাবে আবছা আবছা দৃষ্টিতে মানুষটার চেহারা দেখা মুশকিল হয়ে পড়ল। তবে নিশাত চিনতে পারল তাকে বিশদ, নিখুঁতভাবে। কণ্ঠ হতে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো বিস্ময়মিশ্রিত দু’টো শব্দ ।
‘ প্রহর ভাই! ‘
‘ ভিতরে আয় তিলবতী। ‘
ভরাট কণ্ঠ কেঁপে উঠল আকস্মিক। নিশাতের ধীরে ধীরে চলা হৃদস্পন্দন হঠাৎ করে তড়িৎ গতিতে ছুটতে লাগল। ছাতা বন্ধ করতে নিলে ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে,
‘ আমাকে দিন ম্যাম। আপনি গিয়ে গাড়িতে বসুন। ‘
লজ্জা নেমে আসে ওর রক্তাভ চেহারায়। ছাতাটা দিয়ে আস্তেধীরে উঠে বসল গাড়িতে। ছেলেটা দরজা বন্ধ করে চলে গেল। প্রহর ভাই অপরিচিত লোকের সামনে কেন তিলবতী বলে ডাকল? বেশ শরম লাগছে। সবসময় অপ মান করে হয়তো তৃপ্তি পায়। গাড়ির এক পাশে সেঁটে বসতেই রাগী কণ্ঠ কানের পাতায় এসে ধাক্কা খেল।
‘ তুই জানালার সাথে চিপকে আছিস ক্যান? খেয়ে ফেলব আমি তোকে? ‘
অচিরেই লাফিয়ে উঠল নিশাতের অভ্যন্তর। থুতনি গলার কাছে গিয়ে ঠেকল। প্রহর সিটে মাথা এলিয়ে রেখে চোখ বুঁজে বাজখাঁই গলায় আদেশ করল,
‘ তুই এখুনি কাছে এসে বসবি। নয়ত তোর আটাশ দাঁত গায়েব করে ফেলব৷ এক থাপ্প ড়ে নাহলে দুই থাপ্প/ড়ে করব। তবুও তোর কাছে আসা চাই। ‘
ভয়ে ভয়ে কিছুটা কাছে গিয়ে বসল নিশাত। প্রহর ভাই এমন ধম-কাচ্ছে কেন? পাশে বসতে ওর কেমন কেমন যেন করে। মাঝে দশ ইঞ্চি দূরত্ব থাকলেও বুকটা ঢিপঢিপ করে আর এখন তো কাছে। খুব বেশি কাছাকাছি। ভেতরের হাল যদি ধরে ফেলে প্রহর ভাই তাহলে আজ নিস্তার নেই। পচিয়ে ফেলবে একেবারে। যতক্ষণ না পঁচা দুর্গন্ধ ছড়াবে ততটুকু সময় বিনা বিরতিতে পচিয়ে যাবে কথার মাধ্যমে। নিশাত এমনটা হতে দিবে না। সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে মা-ইর,অ-পমান,পচানি সব সহ্য করে আসছে। নিঃশ্বাস ভার ভার হয়ে যায় লোকটা পাশে থাকলে। দেহ টা শক্ত করে, খিঁচে বসে রইল। শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ আমরা কোথায় যাব প্রহর ভাই? ‘
‘ তোকে বিক্রি করে দিতে। ‘
‘ বিক্রি? ‘
‘ হু। ‘
নিশাতের কাজলমাখা দুই আঁখিতে ভয়ের আভাস। প্রহর ভাইয়ের কোনো ভরসা নেই। ওকে বিক্রি করে দিলেও দিতে পারে। তাছাড়া সৌরভ ভাই বলেছে রাজনীতিবিদরা জঘন্য কাজের সাথে জড়িত থাকে। জনসম্মুখে এক থাকে আর গোপনে সব ধরনের খারাপ কাজকারবার চালিয়ে যায় ক্ষমতার জোর দেখিয়ে। আচ্ছা প্রহর ভাই এমন হয়ে গেল না তো! ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠল,
‘ আমি আপনার সাথে যাব না। ‘
‘ তুই সতেরো বছরের একটা বেক্কল। কিন্তু এখন যেহেতু আমার তোকে দরকার তাই নিয়ে যাব। তুই যেতে না চাইলেও আমার কিছু আসে যায় না৷ কেমন মামাতো বোন হলি যে ফুপাতো ভাইয়ের কাজে আসবি না? ধিক্কার জানানো উচিত তোর মতোন মামাতো বোনকে। সামান্য কিডনি দুটোই তো দিয়ে দিতে হবে তোর। ‘
নিশাত স্তব্ধ, হতবাক। প্রহরের কোন কথা মজা,কোনটা গুরুতর ব্যাপার সে বুঝে না। বয়সে সতেরো হলেও পিংকির মতো ততটা চালাক সে হতে পারে নি। অনেক মেয়ে আছে না? বয়সে যতই হোক বেক্কল টাইপ,বুঝে কম, চুপচাপ থাকে,সে ঠিক তেমন ধাচের। বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসে,
‘ আপনি সত্যিই আমায় বিক্রি করে দিবেন। ‘
‘ হ্যাঁ। তোর ক্রেতা,বিক্রেতা দুটোই আমি। এখন রোবট না হয়ে থেকে সুন্দর করে বস। ভালো করে শ্বাস নে। ‘
কড়া নির্দেশে মনে ভয় নিয়েই একটু টেনশনমুক্ত হয়ে বসল নিশাত। ওর দৃঢ় বিশ্বাস প্রহর ভাই এত নির্দয় হবেন না। কেবল ক্ষেপানো,ভয় দেখানো কাজ তার। আরো কিছু ভাবতে যাবে নিমিষেই বক্ষস্থলে ধুপধাপ কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। জোরসে বজ্রপাত হলো হৃদপিণ্ডের গোপন প্রকোষ্ঠে। পাঁচ আঙুল আঁকড়ে ধরল প্রহরের এক হাত। চিকন কোমরে সুপুষ্ট হাতের চাপ বৃদ্ধি করে প্রহর ওর দেহটা আরো কাছে টেনে নিল। গলায় মুখ গুঁজে রেখেই বলে,
‘ নড়বি না নিশু। তোদের বাড়ি গিয়ে না খেয়ে ফিরেছি। তোর কি মায়া হয় নি? মেহমানদের প্রতি তোদের কোনো মায়াই নেই। এখন আমার ঘুম পেয়েছে। তোর ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমাব। যদি একটুও ডিস্টার্ব করেছিস খুব খারাপ হবে। এটুকু বয়সে তুই আমার করা খারাপ কাজটা সহ্য করতে পারবি না। সো বি অ্যা গুড গার্ল বাবু। ‘
নিশাতের নরম,অপ্রতিভ সুর কানে গেল প্রহরের। সরল স্বীকারোক্তি মেয়েটার,’ আমার কেমন যেন লাগছে প্রহর ভাই। ‘
‘ তোর ভাই খেতে দিল না আমায়, তুই এখন ঘুমাতেও দিবি না? খুব পাথর মন তোদের। সবসময় আমাদের সাথে তোরা অন্যা””য় করে আসছিস। কেমন কেমন লাগলেও চুপ থাক। ‘
কথাটা শুনে নিশাত নিশ্চুপ হয়ে গেল। অপরদিকে ভেতরে তীব্র উম্মাদনায় মেতে ওঠেছে আবেগ,কিশোরী অনুভূতি। গাড়ির মধ্যে এক বিন্দুও আলোর উপস্থিতি নেই। দু ধারের জানালার কাঁচ উঠানো। সামনে তাকিয়ে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘোর অন্ধকারেও লাজে মরণ অবস্থা ওর। প্রহর ভাইকে এত কাছে সহ্য করতে পারছে না সে। গাঢ় নিরবতা ভেঙে দৈবাৎ ডাকতে চাইল,
‘ প্রহর ভা,,,’
সম্পূর্ণ সমাপ্ত করবার আগেই প্রহর কোমরে দুই হাত রেখে চাপ প্রয়োগ করল। উঁচিয়ে বসালো ওকে। সহসা বলে উঠল,
‘ মাথাটা টিপে দে। দোয়া করে দেবো,ভালো বর পাবি।’
নিশাত সচকিত নয়নে তার মুখটা দেখার প্রয়াস চালাল। ব্যর্থ হলো। চারিধারে যে দীপ্ততার দুস্থিতি। তবে নিজের ডান হাতটাকে আবিষ্কার করল প্রহরের বুকে। দ্রুত বেগে সরিয়ে আনল। ভীরু ভীরু ভাবনা নিয়ে হাত টা তার কপালে স্পর্শ করাতে গিয়ে ভুলবশত ছুঁয়ে ফেলল দুই ঠোঁট। ঝক্কি খেল নিমেষে। প্রহর চাপা গর্জন করে সঙ্গে সঙ্গে,
‘ঠোঁট না মাথা টিপতে বলেছি। ছিহ! নিশু অন্ধকারের সুযোগ নিতে চাইছিস? এসব শিখিস এ বয়সে! রফিক আজম জানে তাঁর মেয়ে স্কুলে পড়তে যায় অথচ আমি জানি স্কুলে প্রেম করতে যায় সে। শুনেছি একটা প্রেমও করেছিস? ‘
নিশাত ভীতুর ন্যায় বিচলিত হয়ে বলল,’ প্রেম করি নি। ছেলেটা শুধু কয়েকবার প্রপোজ করেছিল। শিমুল,আয়না সবাই বলছিল রাজি হয়ে যেতে। এ বয়সে নাকি প্রেম করলে কিছু হয় না। ছেলেটা আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ওরা বলছিল এতে আমাদের এসাইনমেন্ট করে নিতেও সমস্যা হবে না। প্রেম করতে তো কঠিন কিছু করা লাগবে না। শুধু এক দু’টো কথা বলতে হবে, তাই আমি,,’
‘ তাই তোর মন গলে যাচ্ছিল?’
‘ না না। আমি রাজি হয় নি প্রহর ভাই। প্রেম করি নি আমি। ‘
মেয়েটার প্রায় কেঁদে দেওয়ার অভিপ্রায়। প্রহর ক্ষিপ্র গলায় বলল,
‘ আমি জানি। প্রেম করলে তুই এতদিনে আস্ত থাকতি না। শুধু তোর ভেতরের কথা বের করছিলাম। প্রেম নিষিদ্ধ তোর। ‘
নিশাত সাহস করে বসে তখন। জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি প্রেম করেন প্রহর ভাই? ‘
‘ একটা গাধী পুষছি। গাধীটা বড় হলে আমি বুড়ো বয়সে প্রেম করব। ‘
রুক্ষ স্বরে কথাটা বলে প্রহর মুখ গুঁজে দিল কোমল ঘাড়ে। শ্রবণ হলো ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, ‘ তুই আর একটা কথাও বলবি না নিশু। তোর কণ্ঠ টাও বি শ্রী। কান ঝালাপালা করে ফেলছে। ‘
অবর্ণনীয় কষ্টে ভুগতে থাকল নিশাত। ওর কণ্ঠ বাজে? আর কি কি বাজে লাগে ওর প্রহর ভাইয়ের কাছে? সারা রাস্তা একটা বাক্যও উচ্চারণ করল না। বরঞ্চ ঘুম থেকে জেগে নিজেকে আবিষ্কার করল কারো বুকে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার শব্দ কানে প্রবেশ করছে অবলীলায়। গাড়ি চলছে না,থেমে আছে। একটু নড়তেই প্রহর গলা শোনা গেল,
‘ তুই একটা সুযোগসন্ধানী মেয়ে নিশু। কই আমাকে ঘুমাতে দিবি তা না করে পুরো রাস্তা আমার বুককে তোদের বাড়ির সম্পত্তি ভেবে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এলি। ‘
এটা প্রহর ভাইয়ের বুক! নিশাত নত মস্তকে উঠে বসল সঙ্গে সঙ্গে। এত এত শরমের কান্ড আজই হতে হচ্ছে! জানালার কাঁচে টোকা পড়ল দু একটা। সামনে ড্রাইভার নেই। কালো কাঁচ নামিয়ে দিতেই নিশাত প্রায় চমকিত। প্রত্যয়ের হাসি লেগে থাকা মুখটা দেখে চিল্লিয়ে উঠল মৃদু,’ ভাই!’
প্রত্যয় মায়াময় কণ্ঠে বলল, ‘ দ্রুত নেমে আয় পরী। ‘
গাড়ি থেকে নেমে নিশাত দুটো চমকের সাথে পরিচিত হলো। প্রথমত চোখের সামনে বিশাল বড় বাড়ি দেখে। দ্বিতীয়ত্ব সমুখে দাঁড়ানো গোলগাল চেহারার মেয়েটা চক্ষু আয়নায় ভেসে উঠতেই।
ঊষা এগিয়ে এসে ঝাপটে ধরল ওকে। উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করল,
‘ আমায় মনে আছে? কি সুন্দর হয়ে গেছো তুমি! আরেকটু বড় হলে আর কোনো সমস্যা থাকত না। ভাইয়া টুপ করে উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারত চিরদিনের জন্য। ক্ষণিক সময়ের জন্য রাখতে হত না আমার কাছে। ‘
নিশাত ঊষাকে পেয়ে দ্বিগুণ খুশি হয়ে গেল। দু গাল ফুলোফুলো হয়ে উঠল। বলল,
‘ চিনেছি আপু। তুমিও কত সুন্দর হয়ে গেলে।’
‘ পুরো এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছিলাম দাঁড়িয়ে। গাড়ি এসে থামার পরও তুমি ঘুমাচ্ছিলে এক ঘন্টার মতো। তোমাকে অনেক প্ল্যান করে এখানে এনেছি জানো? তাও ভাইয়াকে অনুরোধ করতে হয়েছে অনেক৷ এত ঘটা করে আনার পেছনে একটা কারণ আছে। ‘
নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতে হলো না নিশাতের। ঊষা নিজেই কানের কাছে ফিসফিস করে কারণ টা বলল। মুহূর্তে আঁড়চোখে প্রহর ভাইয়ের দিকে তাকাল ও। প্রহর সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে ততক্ষণে।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)