#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____১১
নিশাত খেয়াল করল গত দু’দিন ধরে ওর ভাই একদম ভালো নেই। আগের মতো ঠিকঠাক, হাসিমুখে কথা বলে না। কেমন যেন পাথুরে,কাঠিন্য ভাবমূর্তি চেহারায়। দু’দিনে শুধু মধ্যাহ্নে দু বেলা ভাত খেতে দেখেছে। তাও অর্ধেক খেয়ে প্লেট ঠেলে উঠে গিয়েছে। অকস্মাৎ ভাইয়ের এই আমূল পরিবর্তন ছোট্ট নিশাতের বুক ভারী করে তুলল। বার কয়েক কথা বলার মুখ্যম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে কিন্তু পেল কই! বিয়ে বাড়ি,হৈ চৈ অবস্থা। কানভর্তি কলরব। তিনদিনের মধ্যে ভালোমতো একটা আয়োজন করে বিয়েশাদি চাট্টেখানি কথা নয়। কিন্তু তাড়াহুড়ায় বিয়ের ব্যাপারটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। বাবা আসার পর চাচা,চাচী,বাবা মিলে বদ্ধ ঘরে ঘন্টা দেড়েক কিসের যেন আলোচনায় মত্ত ছিলেন। অতঃপর এর একদিন অতিবাহিত হতেই পিংকি কে দেখতে পাত্রপক্ষ হাজির। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছিল পিংকি। সারাদিন অভুক্ত ছিল,চাচীর পায়ে পড়ে বিয়ে করবে না বলে আহাজারি করছিল বারংবার,অনবরত।
নিশাতের বেশ খারাপ লাগছিল। সামান্য চিঠিকে কেন্দ্র করে কেউ বিয়ে দিয়ে দেয়? প্রেমের ব্যাপারে এত স্ট্রিক্ট কেন বাবা,চাচা সবাই? ফুপির সাথে বাবার মনোমালিন্যের কারণ টা ও জানে না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই জানল ফুপিকে এই বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর প্রেমের বিয়েই বলে কি? নাকি অন্য কারণ? পিংকির বড় আপা নিশাতকে হলদে একটা জামদানি পড়িয়ে দিল। বলল,“ তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে নিশু। শাড়িতে বড় বড় লাগছে, ছোট্ট পিচ্চি টাকে। ”
তৎক্ষনাৎ নিশাতের কণ্ঠ গলিয়ে ধা-রালো কয়েকটা প্রশ্ন বের হলো,“ আমি ছোট হলে পিংকি কি আপা? ওকে কেন এত জলদি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ?”
নাহিন আপা নিঃশ্বাস ফেললেন শব্দ করে,অতি দীর্ঘ সেই নিঃশ্বাস। ধরে আসা গলায় আওড়ালেন, “ বড়রা যেই সিদ্ধান্ত নিবে তাই মানতে হবে নিশু। পিংকির ভাগ্যে এ বয়সে বিয়ে নির্ধারিত বলেই হচ্ছে।”
নিশাতের অক্ষিকোটরে জল জমল সেকেন্ডেই। অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে ভাগ্যের দোষ দিলেন আপা। পিংকির রুমে এসে দেখে আজ আর মুখে মলিন ভাব টা নেই ওর। বিনা দ্বিধায় সাজতে বসে গেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে নিচে আসল ও। সৌরভ ভাই কোনো ত্রুটি রাখছে না স্টেজ সাজাতে। নিশাত তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল ভেজা ভেজা গলায়, “ ভাইয়া!”
পশ্চাতে ঘাড় বাঁকাল সৌরভ। বোনের দিকে তাকিয়ে চক্ষুদ্বয় আঁটকে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,“ তুই তো আজ বাথরুমের ঘুমন্ত পরী থেকে হলদে পরী হয়ে গেলি নিশু৷ ”
“ আমার থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে পিংকি কে। ”
সাবলীল, স্থির, নরম কণ্ঠ শুনে সৌরভ চমকে গেল। আকস্মিক মনে হলো তার বোকা বোনের বুদ্ধি খুলছে। ফুলের মালাটা ডেকোরেশনের লোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে কপট, মেকি হেসে বলল, “ পিংকি কেও দেখে বলব তোর থেকে বেশি সুন্দর লাগছে কিনা। ”
নিশাতের কাজলেমাখা নেত্র ভেদ করে অশ্রু কণারা গাল স্পর্শ করে সোজা গলা বেয়ে নামছে। চোখের নিচ কাজল লেপ্টে ঈষৎ কালো হয়ে গেল। ক্রন্দন মিশ্রিত অথচ নিম্নস্বরে বলল,“ আমি সব জানি ভাইয়া। গত রাতে দেখেছি তুমি পিংকির হাত ধরে কাঁদছিলে ছাদে। দরকার হলে আমি বাবার পায়ে পড়ে বলব পিংকিকে যেন বিয়ে না দেয়। ”
সৌরভ বাকরুদ্ধ। অবয়বে আঁধার জুড়ে বসল। চারদিকে মানুষের আনাগোনা। গ্রামের লোকজন এদিক সেদিক কান পাততে অত্যন্ত পটু। সতর্ক চাহনি মেলে নিশাতের হাত ধরে পুকুর পাড়ে নিয়ে আসল। ঊর্ধ্বশ্বাসে অনুরোধ করল,
” তুই বাবাকে কিছু বলবি না। আমি আমার মনকে পিংকির প্রতি ঝুঁকে যাওয়াতে আটকাতে পারি নি,এটা আমার ব্যর্থতা। ”
“ তাই বলে মেনে নিবে?”
নিশাতের কান্নার বেগ বাড়ল। সৌরভ বোনকে বুকের মাঝে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার হৃদয় চিরে রক্ত ঝড়ছে গোপনে,অতিশয় সাবধানে। সত্যটা গলায় এসে আঁটকে যাচ্ছে, দলা পাকিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক টা শব্দাংশ। বাচ্চাদের মতো এ বয়সে এসেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দগুলো গুছিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,
” পিংকি গত রাতে কি বলেছে জানিস? ও এখন নিজেই রাজি। হবু বরকে খুব পছন্দ হয়েছে ওর। অতঃপর আমি বুঝলাম ওর দিক থেকে আমার জন্য যেটা ছিল সেটা নিতান্তই তুচ্ছ একটা আবেগ। ভালোই হলো সেই মিথ্যা আবেগের বশীভূত প্রেম আমি বহুকাল বহন করব না নিশু। নয়ত পরে সামলে উঠতে পারতাম না। ”
আবেগ! পিংকি আবেগে ভাইয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিল? তবে কি এটা সত্যি মোহ কেটে যায়? নিশাত ভাইকে ঝাপটে ধরার চেষ্টা করল। ওর ছোট ছোট হাত সৌরভের বলিষ্ঠ দেহ আঁকড়ে ধরতে পারল না। কোমল দেহী অধিকারীণি, দুর্বল চিত্তের নিশাত ভাইয়ের যন্ত্রণা নিরবে অনুভব করতে পারছে সেটাই বা কম কি!
পুরো গায়ে হলুদে সৌরভের দেখা কোথাও মিলল না। মা,চাচী হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও নিশাত উত্তর দিতে অক্ষম। প্রিয়তমার অন্যের জন্য গায়ে হলুদ মাখা সইতে পারবে না ওর ভাই। বাহ্যিক দিক থেকে নিজেকে কঠিন দেখালেও অন্দরমহলে কতটা দুর্বলতা লুকিয়ে রেখেছে তা অল্পস্বল্প আঁচ করে ফেলেছে সে। পিংকির প্রতি ক্রুদ্ধতা জন্মালো। আগের দিনগুলো থেকে আরো বেশি ঘৃ’ণা করতে আরম্ভ করে। ওর ভাইয়ের হৃদয় পুড়ছে আর এই মেয়ে হেসে হেসে কথা বলছে হবু বরের সঙ্গে ভিডিও কলে। নি ষ্ঠুর মানবী!
—————————
বরযাত্রী আসার আগে নিশাত পিংকির রুমে গেল। কেউ নেই। সবাই নিচে। এক গাট্টি বাচ্চাকাচ্চা ছিল ওদেরও রুম থেকে বের করে দিল সে। বাচ্চাগুলো যেতে চাইছিল না। বার কতক কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে,” আমলা নতুন বউয়েল লগে থাকমু। যামু না। ”
ঠেলে ওদের বের করে দিতেই পিংকি লেহেঙ্গা দু হাতে ধরে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। হতবিহ্বল চোখে তাকায়। চাহনি দ্বিধান্বিত। ভীরু ভীরু কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” ওদের বের করলি কেন নিশু?”
” তুই এখুনি আমার ভাইয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি। ”
নিশাতের তেজী কণ্ঠস্বর। আগুন ঝরছে কণ্ঠে। মুখের আদলে বিশেষ পরিবর্তন। রক্তিম লাল হয়ে উঠেছে হলদেটে মুখশ্রী খানা। পিংকির গলা শুষ্ক হয়ে গেল মুহুর্তেই। ভয়া/তুর কণ্ঠ, ” কে,,,কেন?”
” আমার ভাইয়ের ভালোবাসা নিয়ে নাটক মা/রিয়েছিস, আবার বলছিস কেন? চ-ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেবো। পারলে বুড়ি নানী হয়ে যাইস বিয়ে বসতে। তখন দেখবি তোর লাড্ডু মার্কা বরও তোকে নানী ডেকে রিজেক্ট করে যাবে। ”
পিংকি থতমত খেয়ে গেল। হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। বিমর্ষ মুখে বলতে চাইল, ” তুই সব জেনে গেছিস?”
নিশাত দ্বিগুণ রা গান্বিত স্বরে বলে উঠল, ” নিচে চল। ”
সিঁড়ির গোড়ায় আসতেই সৌরভ গামছা হাতে এদিকে ছুটে এলো। মেহমান সামাল দিতে দিতে হাঁপিয়ে ওঠেছে প্রায়। পিংকির বধূ বেশী রূপ টা এক পলক অবলোকন করতেই তার বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিশাতের দিক।
” ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন? ”
” ও তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। ”
” কি?”
কিঞ্চিৎ চিল্লায় সৌরভ। ধমকায়,” তুই পা গল হয়েছিস? বিয়ে বাড়ি এটা। আর কিসব বলছিস? বোকা মেয়ে। সাধে কি আর তোকে বোকা বলি আমরা?”
রোদনভরা চাউনি মেলে ধরল নিশাত। অল্পস্বল্প কাঁপল গলা,” ও তোমার কাছে ক্ষমা না চাইলে আমি স্বস্তি পাব না ভাইয়া। এরকম ফা জিল মেয়ে কেন আমার ভাইকে কাঁদাবে? ”
সৌরভ অন্যত্র তাকিয়ে পিংকির উদ্দেশ্য আদেশমূলক বাক্য ছুঁড়ে দিল,” তুই উপরে যা পিংকি। ”
পিংকি জিতে গেল এমন ভাব। হাসল ঠোঁট বাঁকিয়ে। চলে যেতে নিলে নিশাত শক্ত করে ওর হাত টা চেপে ধরল। ব্যথাসূচক ধ্বনি কণ্ঠ ভেদ করে বাহিরে আসল নিমিষেই। নিজের লম্বা লম্বা নখ মেয়েটার শ্বেত বর্ণ কব্জিতে দাবিয়ে রেখেছে নিশাত। সৌরভ ফিরে তাকাল। সূক্ষ্ম চোখে চাইল হাতের দিক। আঁতকে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে,
” ছাড় ওকে নিশু। ”
নিশাতের নিরলস,সাদামাটা কথা,” ক্ষমা চা। নয়ত এখুনি বাহিরে গিয়ে চেঁচিয়ে তোর মান সম্মানের ফালুদা বানাব আমি। ”
পিংকি ভড়কালো। আইল্যাশ খুলে গেছে তার। নিশাতের থেকে ছাড় পেল না। অগত্যা তরতর করে বলল,
” ক্ষমা করে দিন সৌরভ ভাই। আমি আবেগে বুঝতে পারি নি কিছু। ”
সৌরভ শব্দহীন পায়ে প্রস্থান করে। এখানে কিছু বলার নেই তার। পিংকির প্রতি ক্ষোভ, অভিমানের দেয়াল পিংকি হাজার বছর ধরে ক্ষমা চেয়েও ভাঙতে পারবে না।
নিশাত পিংকিকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাত ঝাড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ” জীবাণু ধরে ফেলেছি। এখন যেই ব্যাডায় মুগ্ধ হইছস,আবেগ শেষ হয়ে গেলে আবার ফিরে আসিস না। ”
___________________________
বরযাত্রী এসে হাজির গেইটে। নিশাত সবাইকে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ল একদম মধ্যে। নিমিষেই সকলের মধ্যমণি হয়ে গেল। সামনে চাইতেই চক্ষু ছানাবড়া ওর। বড় বড় বৃহদাকার ধারণ করল চোখ দু’টো । মাথা ভনভন শুরু হলো। মনে হলো,একটা ফ্যান ভটভট শব্দে তার মাথার ওপর ঘুরছে। হৃদয়ের উন্মাদনা টিপে ধরে কণ্ঠস্বর। আদৌ পিংকির বিয়ে হবে? বাবা কেমন ব্যবহার করবে? বরের সাথে প্রহর ভাই? শুভ্র পাঞ্জাবি, কালো সানগ্লাস, মাথার এলোমেলো চুল সব কেমন ঘা য়েল করছে হৃৎপিন্ডে।
নিশাত আর সহ্য করতে পারল না,পরিচয় দিল অধৈর্যশীলতার। টুপ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সবাই বলতে লাগল ঘুমিয়ে গেল নাকি? একেকজন অবাকতা প্রকাশ করছে,” মেয়েটা বোনের বিয়ের গেটেও ঘুমিয়ে গেল? এরকম ঘুমপাগল,বেআক্কল মেয়ে গেইট ধরতে আসে কেন?”
#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)