#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।
সাজেক ভ্রমণের সুন্দর কিছু স্মৃতি কুড়িয়ে পৃথার বাসে উঠতেই মনে হলো, আবার তার বন্দী জীবনের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। বাবার এক গাদা শাসনে আজকাল সে যেন হাঁসফাঁস করে। তাও বাবা বোঝেনা। তার আজকাল সবকিছু কেমন যেন উলোট পালট লাগে। যেন অনেক কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, মা’কে হারিয়েছে ঠিক। তবে সে যেন আরো কিছু হারিয়েছে। বার বার মনে হয় যেন কী একটা তার মাথায় ঘুরছে। কিছু ছবি, কিছু দৃশ্য চোখ বুজলেই যেন ভেসে উঠে। সে বুঝতে পারে না এসবের অর্থ। ঐ একটা এক্সিডেন্টের পর সব কিছু ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। মন, মস্তিষ্ক আলাদাভাবে কাজ করছে যেন। মন বলছে এক, আর মস্তিষ্ক দেখাচ্ছে আরেক। আজকাল ঐ ছেলেটাকে দেখলেও যেন তার কেমন চেনা চেনা লাগে। তার কথার স্বর, তার মুখশ্রী, তার অবয়ব যেন খুব চেনা। কোথাও কি সে ছেলেটাকে দেখেছিল? না তো দেখেনি। তবে কেন এই ছেলেটাকে এত চেনা চেনা লাগে? ছেলেটার মুখটা এত কেন পরিচিত?
পৃথা জবাব পায় না। জানলার বাইরে অন্ধকার। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র আলোর ছটা এসেও সেটা আবার মিশে যাচ্ছে। তার বন্ধুরা সবাই ঘুমাচ্ছে। শুধু বন্ধুরা বললে ভুল হবে, বাসের সবাই’ই প্রায় ঘুমাচ্ছে। ঘুম আসছে না কেবল তার চোখে। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চললে তার মনে হয় কোথাও একটা কিছু একটা খটকা বোধ হয় রয়ে গিয়েছে। কেমন যেন অনুভূত হয়। কিছু একটার জন্য বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু সেই জিনিসটা কী সেটা সে বুঝতে পারে না। এসব নিয়ে আজকাল সে খুব ভাবছে। ভাবতে ভাবতে মাঝে মধ্যে খুব মাথাও ধরে তার। আর এখনও ধরেছে।
রাতের রাস্তা, গাড়ি চলাচল কম হওয়ায় তাদের গাড়ি খুব তাড়াতাড়িই কুমিল্লায় এসে পৌঁছে। তখন পনেরো মিনিটের ব্রেক দেওয়া হয়। সবাই ঘুম থেকে জেগে যার যার প্রয়োজনে বাইরে যায়। রুহা, নিলয় আর সারাও ঘুম থেকে উঠে। পৃথা তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। রুহা তাকে দুবার ডাকলেও সে কোনো সাড়া দেয় না। পেছনের সিট থেকে অর্ণব এসে ওদের বলে,
‘তোমরা যাও। ও যখন ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। আমি এখানে আছি।’
অর্ণবের কথার পর সবাই একে একে নেমে গেল। অর্ণবের খুব ইচ্ছে করছিল পৃথার পাশে একটু বসবে, কিন্তু সেই সাহস সে আর জুগিয়ে উঠতে পারেনি। তাই সে আবার পেছনে তার সিটে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর বাসে একটা ছেলে উঠে। সেও এই বাসের যাত্রী। তার সিট পৃথার দুই সিট পেছনে ছিল। তবে সে এখন তার সিটে না বসে পৃথার কোণ বরাবর একটা সিটে বসে। সেখানে বসে সে দু’পা ঘুরিয়ে পৃথার দিকে মুখ করে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ সে এভাবেই বসে থাকে। গাড়িতে তখন অর্ণব ছাড়া আর তেমন কেউ ছিল না। ব্যাপারটা অর্ণবের নজর এড়ায়নি। সে তার সিট থেকে উঠে এসে পৃথার সিটের সামনে দাঁড়ায়। পৃথার দিকে চেয়ে দেখল তার গায়ের ওড়নাটা একটা সাইড হয়ে আছে। অপর পাশের ছেলেটা চেয়ে আছে যে তার আর কোনো হুঁশ নেই। অর্ণব কোনো কথা না বলে ঠাস করে ছেলেটার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেটা যেন পুরো বেকুব বনে গিয়েছে। সে গালে হাত দিয়ে রাগি গলায় বলল,
‘এই যে মি. আমায় আপনি মারলেন কেন?’
অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আপনার গালে মশা ছিল। মশাকে মেরেছি, আপনাকে না। তবে এখন যদি আপনি আপনার সিটে না গিয়ে বসেন তাহলে কিন্তু এবার আপনাকেও মারতে পারি। তাই ভালো ছেলের মতো নিজের সিটে চলে যান।’
ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কেন, না গেলে কী করবি তুই?’
অর্ণব হেসে ছেলেটার কাছে গেল। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বেশি কিছু করব না। যেই চোখগুলো দিয়ে আমার বউকে দেখছিলি, সেই চোখগুলো শুধু তুলে ফেলব।’
অর্ণবের কথা শুনে ছেলেটা আর দ্বিতীয় কিছু বলার সাহস পায়না। সে চুপচাপ নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ে। অর্ণব তখন তার দিকে আরেকবার চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে নিজের সিটে চলে যায়।
ব্রেক টাইম শেষ। সবাই একে একে গাড়িতে এসে বসে। গাড়ি ছাড়ার পর গিয়ে পৃথার ঘুম ভাঙে। রুহা তাকে জাগতে দেখে বলে,
‘দেখ, তোর জন্য আচার, চিপস আর চকলেট নিয়েছি। তুই ঘুমাচ্ছিলি বলে আর ডাকিনি। নে এগুলো এখন খা।’
পৃথা খুশি খুশি রুহার হাত থেকে প্যাকেট টা নিয়ে একটা আচার বের করে খেতে লাগল। বাকি তিন ঘন্টার পথ আর ঘুমাল না সে। ঢাকা কমলাপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমেই সে রুহাকে বলল, সে ওয়াশরুমে যাবে। রুহা তাকে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুম থেকে পৃথা বের হয়েই রনিকে দেখল ছেলেদের ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাল, ও যখন এখানে তখন ওর বন্ধু ও নিশ্চয়ই এখানেই আছে। এই ছেলেগুলোও তাদের সাথে এসেছে নাকি? পৃথা রুহাকে ডেকে বলল,
‘এই রুহা, দেখ এই ছেলেটা ঐ ছেলেটার বন্ধু না?’
রুহা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এই ছেলে কোন ছেলে? আর ঐ ছেলেই বা কোন ছেলে?’
‘আরে, ঐ যে আমাদের সাথে সাজেকে দেখা হয়েছিল যে, কী যেন নাম… ওহ হে, অর্ণব। ঐ যে দেখ, উনার বন্ধু।’
পৃথা হাত দিয়ে রনিকে দেখালে রুহা স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?’
‘উনারাও কি আমাদের সাথেই এসেছেন?’
‘আমি কী করে বলব? উনাদের কথা বাদ দে। তোর হয়েছে? চল, আমাদের এবার সি. এন. জি’তে উঠতে হবে তো। নিলয় কবে থেকে ঠিক করে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘আচ্ছা, চল।’
,
পৃথা বাসায় পৌঁছতেই তার বাবাকে দেখতে পেল তাদের বাড়ির গেইটের সামনে। বাবাকে দেখে পৃথা দ্রুত বাবার কাছে গেল। আদর মাখা গলায় বলল,
‘ভালো আছো, বাবা?’
পৃথার বাবা খানিক অভিমানের সুরে বললেন,
‘এতদিনে বাবার কথা মনে পড়েছে তাহলে। কোথাও ঘুরতে গেলে তো বাবার কথা একেবারে ভুলেই যাও। তোমাকে বাবা কত মিস করেছি জানো? তুমি তো ঘুরার আনন্দে বাবাকে একটা কলও দেওয়ার সময় পাওনি।’
‘সরি বাবা, রাগ করো না। তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। চলো চলো, ভেতরে গিয়ে দেখাই।’
সারা সকাল ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে পৃথার ঘুম ভাঙে। তাও আবার এমনি এমনি না, ঘুমের মাঝেই তার বমি পাচ্ছিল। কোনোরকমে তাই সে উঠে বসে ওয়াশরুমে যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও তার আর বমি হয় না। কিন্তু বমি বমি ভাবটা থেকে যায় ঠিকই। সে অস্থির মন নিয়ে বিছানায় এসে বসে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে পাঁচটা বাজতে চলছে। নাক টেনে চুল গুলো ঠিক করে সে। শরীরটা আবারও খারাপ লাগছে। অস্বস্তি লাগছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। মুখটাও কেমন যেন তেঁতো তেঁতো লাগছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। পেটে খিদে থাকলেও খেতে ইচ্ছে করছে না। সে তার বাড়ির খালাকে ডাকল।খালা এলে সে বলল,
‘খালা, বাসায় কি কোনো আচার হবে? আমার না খুব আচার খেতে ইচ্ছে করছে।’
খালা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
‘না তো খালা, বাসায় তো কোনো আচার নাই। আপনে কইলে আমি বাইরে থেইকা আইন্না দিমু।’
‘না থাক তাহলে, লাগবে না।’
খালা পৃথাকে কিছুক্ষন মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন,
‘শরীর খারাপ আপনার, খালা?’
‘ঐ একটু জার্নি করে এসেছি তো, তাই হয়তো শরীরটা দূর্বল লাগছে।’
‘আপনি তো দুপুরে কিছু খান নাই, খাবার আনমু?’
‘না, এখন না একটু পর। আমি বলব আপনাকে।’
‘আইচ্ছা খালা। আর কিছু লাগলে ডাইকেন। আমি পাশের রুমেই আছি।’
খালা চলে গেলে পৃথা আবারও শুয়ে পড়ে। চোখ তার তখন লেগে আসে। কিন্তু পুরোপুরি ঘুমানোর আগেই তার রুমে তার বাবা আসেন। এসে বলেন,
‘পৃথা মা, এখনও ঘুমাচ্ছিস?’
পৃথা মিটমিট করে চেয়ে বলল,
‘না বাবা, কিছু বলবে?’
‘দেখ, কে এসেছে।’
পৃথা উঠে বসে। দরজার দিকে চোখ যেতেই বিরক্তির রেশ তার চোখে মুখে ফুটে উঠে। কেন যেন এই ছেলেটাকে তার একটুও সহ্য হয় না, অথচ তার বাবা এই ছেলের জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছে।
চলবে…