#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪।
ছেলেগুলোর কাজে পৃথা প্রচন্ড রেগে যায়। এখানে আসার পর থেকেই একটা পর একটা অঘটন ঘটেই যাচ্ছে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না। এখন আবার এসব…
পৃথা তাদের ধমক দিয়ে বলল,
‘কে আপনারা? এমন কেন করছেন?’
ছেলেগুলো উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘মাফ করবেন আফা। ভুল হইছে, আমরা আর কোনো মাইয়া গো কিছু কইতাম না। মাফ কইরা দেন।’
পৃথা ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারছে না। সারা আর রুহাও বেকুব বনে আছে। পৃথা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আচ্ছা, আপনারা করেছেনটা কী? ক্ষমা কেন চাচ্ছেন? আমি তো আপনাদের চিনি না।’
‘চিনতে হয়তো না আফা। খালি কন মাফ কইরা দিছেন, তাইলেই হইব।’
রুহা ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে সবটা বুঝতে পারল। ছেলে দু’টোর মধ্যে একজনকে সে চিনেও ফেলল। তবে পৃথাকে সেই সম্পর্কে কিছু বলল না। পৃথা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। মাফ করে দিয়েছি। এবার এখান থেকে দয়া করে যান আপনারা।’
ছেলেগুলোও দৌড় লাগাল। নিলয় ঘটনার আগা মাথা কিছু বের করতে না পেরে বলল,
‘ব্যাপার কিরে? ছেলেগুলো কারা?’
পৃথা বলল,
‘কী জানি, আমিও তো চিনি না।’
রুহা তখন বলল,
‘আচ্ছা বাদ দে, এসব নিয়ে ভেবে আমাদের ঘুরার আনন্দ আর মাটি করিস না।’
পৃথা ব্যাপারটা আমলে নিতে না চাইলেও কিছু একটা খটকা মনের মধ্যে তার রয়েই গেল। হুট করে কেউ এসে কেন তার কাছে ক্ষমা চাইবে? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। এমনি এমনিই তো আর কোনো কিছু হয় না। সবকিছুরই একটা কারণ থাকে, আর এই কারণটাও পরে সে খুঁজে বের করবে।
হালকা পাতলা কিছু কেনাকাটা করে গাড়িতে এসে যখন তারা বসে, তখন একেবারে দ্বিপ্রহর। পেটের ভেতর চো চো শব্দ হচ্ছে। তাদের বেশ জোরালো খিদে পেয়েছে, এখনই কিছু একটা পেটে না দিলে পেট ফেটে যাবে। তাই তারা আর এদিক ওদিক না গিয়ে দ্রুত চলে গেল কাছের একটা রেস্টুরেন্টে। তারা সেখানে বসতেই একটা বাচ্চা ছেলে এল খাবারের অর্ডার নিতে। ছেলেটাকে দেখে পৃথার খুব মায়া হলো। এইটুকু বয়সে বাচ্চাটা খেলাধুলা আর পড়াশোনার জায়গায় সে এখন কাজ করছে। দেহের গরন দেখে মনে হচ্ছে, খেতেও পায়না হয়তো ঠিক মতো। ছেলেটি এসেই বেশ চাঞ্চল্য স্বরে বলল,
‘কী খাইবেন? গরুর গোশত খাইবেন? আমরার হোটেলের গরুর গোশত অনেক মজা। একবার খাইলে আজীবন মনে রাখবেন।’
ছেলেটার কথা শুনে তারা হাসল। পৃথা বলল,
‘তাহলে তো একবার খেতেই হয়। যাও বাবু, চারটা গরু মাংসের প্লেট আর গরম গরম ভাত নিয়ে এসো।’
‘আর ভর্তা, ডাইল কিছু খাইতেন না?’
নিলয় বলল,
‘হ্যাঁ, নিয়ে আসো নিয়ে আসো, যা যা আছে সব নিয়ে আসো।’
ছেলেটাও আনন্দের সহিত নাচতে নাচতে সেখান থেকে চলে গেল। আশ্চর্য, এত অভাবের মাঝে থেকেও তার মনে কত ফূর্তি, কত আনন্দ। যেন তার থেকে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। অথচ কিছু কিছু মানুষের সব থেকেও তাদের কত হাহাকার, কত অভাব।
তারা যখন খাবার খাচ্ছিল তখন নিলয় খেয়াল করে, তাদের অপর পাশের টেবিলেই অর্ণব আর তার বন্ধু বসা। নিলয় তাদের দেখে খুশী হয় খুব। “অর্ণব ভাই” বলে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠে। তার গলার স্বরে মেয়েরাও পেছন ফিরে তাকায়। অর্ণবও খাবার রেখে তাদের দিকে চেয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। কিন্তু তাকে থেকে পৃথার একটুও ভালো লাগে না। তাই সে আবার ফিরে বসে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। নিলয় হেসে বলে,
‘ভাই, আমাদের টেবিলে চলে আসেন, একসাথে খাওয়া যাবে।’
পৃথা টেবিলের নিচ দিয়ে নিলয়ের পায়ে লাথি দিয়ে বলে,
‘কী সমস্যা তোর? নিজে একা খেতে পারছিস না? আজাইরা মানুষকে কেন ডাকছিস?’
নিলয় পৃথাকে পাত্তা দিল না। সে আবারও অর্ণব কে একই কথা বলল। অর্ণব হেসে বলল,
‘আরে না না ভাই, তোমরা খাও। আমরা এখানেই ঠিক আছি।’
নিলয় বলল,
‘ঠিক আছে তাহলে, খাওয়া শেষ হলে একসাথে বেরিয়ে চা খাব।’
‘আচ্ছা।’
নিলয়ের কথায় পৃথা বিরক্ত হলো খুব। ছেলেটাকে আগ বাড়িয়ে এত কিছু করতে কে বলেছে? সব ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি না করলে তার হয় না। আর এই এক ছেলেও হয়েছে। তারা যেখানে যায়, সেও এসে সেখানেই হাজির হয়। কেন, আর কি কোনো রেস্টুরেন্ট নেই? এই একটাতেই তাকে আসতে হবে, আশ্চর্য তো?
নিলয়ের কথা মতো খাবার শেষে সবাই মিলে চা খেতে গেল। সেখানে গিয়ে নিলয় আর অর্ণব জম্পেশ গল্প জুড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে অর্ণবের বন্ধু রনি পৃথার বান্ধবীদের সাথে সময়ে সুযোগে হালকা পাতলা ফ্লার্টিং ও করে যাচ্ছে। পৃথা এতে রাগছে খুব। কিন্তু তার বান্ধবীরা এতে বেশ মজা পাচ্ছে। কেমন করে ভেটকাচ্ছে দেখো, দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে। পৃথা নাক মুখ ফুলিয়ে বসে রইল কেবল, চাও খেল না সে। নিলয়ের দিকে বার বার চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছে, কিন্তু তাও লাভ হচ্ছে না কিছুই। সে অর্ণবের সাথে এমন ভাবে কথা বলছে যেন তারা কত পরিচিত, অথচ তাদের কালই প্রথম দেখা হয়েছে মাত্র।
পৃথা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সে নিজেকে শান্ত রাখছে এই ভেবে যে, তার বন্ধুরা এবার হয়তো থামবে, এবার হয়তো এই জায়গা থেকে উঠবে তারা। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উল্টো এক কাপ চা খেতে এসে তারা বিকেল থেকে সন্ধ্যা বানিয়ে ফেলেছে। এবার আর ধৈর্যে কুলাচ্ছে না পৃথার। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে খুব জোরে সোরে একটা ধমক দিয়ে বলল,
‘হয়েছে তোদের? নাকি আজ এখানেই খাবি, এখানেই ঘুমাবি, সব এখানেই করবি? আমার না তোদের সাথে আসাটাই ভুল হয়েছে। আর জীবনেও আমি তোদের সাথে কোথাও যাব না।’
‘তাহলে একটা বিয়ে করে নে। তখন আর আমাদের সাথে ঘুরতে হবে না, জামাইকে নিয়ে ঘুরতে পারবি।’
সারার কথায় পৃথা চেতে বলল,
‘এখন তো তাই করতে হবে দেখছি। তোদের সাথে আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। মাথা খারাপ করে দিয়েছিস আমার।’
অর্ণব মৃদু হেসে বলল,
‘ভুল বললেন। আপনার মাথা কেউ খারাপ করেনি। আপনার মাথা তো আগে থেকেই খারাপ। আর এখন বোধ হয় সেটা আরো ড্যামেজ হচ্ছে। মাথার যত্ন নিন। নয়তো ভবিষ্যতে…’
বাকি কথা শেষ করার আগেই পৃথা প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘আমার কিন্তু এবার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, নিলয়। উনাকে কিছু বল, নয়তো আমি কিন্তু নিজেকে আর কন্ট্রোল রাখতে পারব না।’
অর্ণব শব্দ করে হেসে বলল,
‘কন্ট্রোল হারিয়ে আবার উল্টা পাল্টা কিছু করবেন না তো?’
‘নিলয়, তুই কিছু বলবি উনাকে।’
পৃথা আবারও চেঁচাল। তার চেঁচানোর শব্দে আশে পাশের মানুষগুলো বিরক্ত চোখে বারবার তাদের দিকে তাকাচ্ছে। নিলয় বলল,
‘শান্ত হয়ে বস, মানুষ দেখছে তো।’
‘দেখুক। আর তুই আমাকে কেন শান্ত হতে বলছিস? উনাকে কিছু বল, উনি আমার সাথে এমন কেন করছেন?’
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘শান্ত হোন। আমি চলে যাচ্ছি। আর এত রাগ দেখাতে হবে না।’
‘যা বিরক্ত করার তো করেই ফেলেছেন, এখন গেলেই কী বা না গেলেই কী।’
অর্ণব বলল,
‘তাহলে কি আরেকটু থেকে যাব?’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘না না, যান।’
নিলয় বলল,
‘এভাবে বলছিস কেন, পৃথা। উনি থাকলে কী অসুবিধা?’
‘অনেক অসুবিধা, তুই বুঝবি না।’
‘আচ্ছা থাক, আর কাউকে অসুবিধায় পড়তে হবে না। আমি যাচ্ছি। কটেজে আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’
পৃথা ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
‘আর যাতে দেখা না হয়, সেই দোয়াই করি। আল্লাহ হাফেজ।’
অর্ণব আর কিছু না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। রনি উঠল। সবাইকে হেসে বিদায় জানাল। শেষে পৃথার কাছে গিয়ে বলল,
‘আসছি ভা…’
পৃথা ভ্রু কুঁচকাতেই সে থেমে গেল। তারপর ঢোক গিলল। বলল,
‘আচ্ছা যাই, ভালো থাকবেন।’
চলবে…