#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।
পৃথা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্ষীণ সুরে বলে,
‘আমি চলে যাচ্ছি, বাবা। দোয়া করো।’
পৃথার বাবার গাল বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আমাকে ভুল বুঝো না, মা। আমি তোমার ভালোর জন্যই এসব করেছিলাম।’
পৃথা ম্লান হেসে বলে,
‘আমার ভালো করতে গিয়ে যে বড্ড বেশি খারাপ করে ফেলেছ, বাবা। সেই খারাপটা এখন আমি কী করে পুষাব বলো?’
পৃথার বাবা ঠোঁট কামড়ে অন্য দিকে ঘুরে তাকালেন। পৃথা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাড়ির পরিচিত মানুষরা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘কিছুক্ষণ আগেও আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। জীবনে যে মানুষগুলোকে আমার সুখ দুঃখে আমার ধারে কাছেও দেখেনি আজ সেই মানুষগুলোও আমাকে কথা শুনাতে বাকি রাখেনি। আশা করি এখন আপনারা আপনাদের উপযুক্ত জবাব পেয়ে গিয়েছেন।’
পৃথার ফুপি তখন জবাবে বলে উঠেন,
‘আমরা কি আর এত কিছু জানতাম নাকি?’
পৃথা ফুপির দিকে তাকায়। খানিকটা শক্ত গলায় বলে,
‘কিছু না জানলে চুপ থাকতে হয়, ফুপি। অযথা কাউকে ছোট করতে হয়না।’
পৃথার এই কথার জবাবে তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। তারপর পৃথা অর্ণবের মা বাবার কাছে যায়। মৃদু হেসে তাদের পা ধরে সালাম করে। অর্ণবের মা বলেন,
‘বেঁচে থাকো, মা। আমি আজ আবার আমার মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। আজ তো আমার আনন্দের দিন।’
অর্ণব তখন পৃথার বাবাকে গিয়ে সালাম করে। আর বলে,
‘চিন্তা করবেন না, বাবা। আমি আপনার মেয়েকে ভালো রাখতে পারব।’
পৃথার বাবা ঢোক গিলে অর্ণবের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘হ্যাঁ, আমিও তাই দোয়া করি।’
পৃথা তার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তার ফেলে আসা পুরোনো জীবনের আবার নতুন করে সূচনা হতে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কে পুরোনো স্মৃতির মেলা না বসলেও আজ থেকে আবার নতুন স্মৃতি জমা হবে, আপাতত সে তাতেই খুশী।
পুরোনো শ্বশুরবাড়িতে নতুন করে পা রেখে ভীষণ অভিভূত হয় পৃথা। চারদিকে কত কত ফুলে সাজানো। ঝকঝকে চকচকে কোনো কিছু চোখে না পড়লেও বেশ সুন্দর আর সুশীল সবকিছু। অর্ণবের মা পৃথাকে বরণ করে বাসায় তুললেন। তারপর তাকে সোফার রুমে বসিয়ে তিনি হালকা খাবারের আয়োজন করতে গেলেন। পৃথা বসে বসে সবকিছু চোখ বুলাচ্ছে। অর্ণব তার পাশে গিয়ে বসে। পৃথার হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘কিছু মনে পড়ে, পৃথা? আমাদের প্রথম পালিয়ে বিয়ে করার পর আমরা ঐ চাচার বাড়িতেই উঠি, তারপর আমি মা বাবাকে জানানোর পর, উনারা বিনা দ্বিধায় বললেন, তোমাকে নিয়ে এই বাড়িতে আসার জন্য। তুমি যখন প্রথম তোমার শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছিলে সেদিন তুমি আনন্দে আত্মহারা ছিলে। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় তোমার সংসার জীবন। ঐ যে ঐ কেবিনেট’টা দেখছ? ঐখানে যা আছে সব তোমার কেনা। আর ঐ ফ্লাওয়ার ভাসটা, ঐটাও তুমি কিনেছিলে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিসে তোমার হাতের ছোঁয়া আছে। তোমার অনুপস্থিতে এই জিনিসগুলো রুক্ষ শুষ্ক ছিল। আজ সেগুলো আবার প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে।’
পৃথা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে অসহায় সুরে বলে,
‘আমার কি কখনোই এসব মনে পড়বে না, অর্ণব?’
অর্ণব তার গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে,
‘হ্যাঁ, পড়বে তো। কেন পড়বে না। সবকিছু তোমার মনে পড়বে। আস্তে আস্তে মনে পড়বে। শুধু তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়ো না, তাহলেই হবে।’
‘আচ্ছা।’
অর্ণব তখন মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে পৃথার ললাটে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ায়। পৃথা খানিকটা চমকে বলে,
‘আরে, মা দেখবেন তো।’
অর্ণব হেসে বলে,
‘ছেলের ভালোবাসা দেখলে মা বরং খুশিই হবেন।’
পৃথা আবার কিছু বলার আগেই অর্ণবের মা খাবার নিয়ে এলেন।
এত এত খাবার দেখে পৃথা মুখ কালো করে বলল,
‘মা, এত খাবার কে খাবে?’
অর্ণবের মা হেসে বললেন,
‘কেন, তুমি খাবে।’
‘তাই বলে এত খাবার?’
অর্ণবের মা পৃথার পাশে বসলেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, আজ থেকে এত খাবারই তোমার খেতে হবে। কারণ এখন থেকে তুমি আর একা নও, তোমার সাথে আরো একজন আছে। তাই আজ থেকে তোমাকে একসঙ্গে দুজনের খাবার খেতে হবে। আমাদের পুচকির কথাও তো তোমাকে ভাবতে হবে, তাই না?’
পৃথা মুচকি হেসে বলে,
‘ঠিক আছে।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পৃথা তাদের রুমে গেল। অর্ণব তার জন্য রুমটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। পৃথার সেটা দেখে খুব ভালো লাগে। পৃথা বিছানায় গিয়ে বসে। সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেখানে বড় একটা ছবির ফ্রেম। আর সেই ফ্রেমে অর্ণব আর তার হাস্যজ্জ্বল এক ছবি। এই ছবিটা দেখে পৃথার মনে হচ্ছে তারা হয়তো প্রচন্ড সুখী দম্পতি ছিল। কী সুন্দর দুজন হাসছে। তাদের আশেপাশে কেবল সুখ আর সুখ। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,
‘এই ছবিটা কখন তুলেছিলাম?’
অর্ণব বলে,
‘বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে হানিমুনে কক্সবাজার গিয়েছিলাম, আর এটা সেখানেরই ছবি।’
পৃথা অবাক হয় বলে,
‘আমি কক্সবাজারে গিয়েছি?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, গিয়েছ তো আমার সাথে।’
‘ও আচ্ছা, সেজন্যই আপনি সেদিন এত কিছু বলছিলেন। তার মানে কি, ওগুলো আপনার স্বপ্ন ছিল না সত্যিই আমার সাথে ঐরকম কিছু হয়েছিল?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, সত্যিই এমন কিছু হয়েছিল। সেদিন কক্সবাজারে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলতে ফেলতে আবার ফিরে পেয়েছিলাম।’
পৃথা বলে,
‘আর সেজন্য আপনি আমাকে আর কক্সবাজার নিয়ে যাবেন না?’
‘উঁহু, আর যাওয়া যাবে না।’
পৃথা কিছুক্ষণ তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। অর্ণব ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বলে,
‘এই তুমি তো কাপড় নিয়ে যাওনি।’
পৃথা দরজা খুলে বের হয়। তার ব্যাগ খুলে কাপড়গুলো নিয়ে আলমারিতে রাখতে গেলেই সে দেখে আলমারিতে তো আরো কাপড় আছে। পৃথা অর্নবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এগুলোও কি আমার কাপড়?’
অর্ণব বলে,
‘হ্যাঁ, এগুলোও তোমার কাপড়।’
পৃথা তখন মৃদু হেসে তার কাপড় গুলো আলমারির এক সাইডে রেখে দেয়। তারপর সেখান থেকে একটি কাপড় নিয়ে আবার ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
,
রাতে খাবার টেবিলে বসে দেখে তার শাশুড়ি অনেক খাবার রান্না করে ফেলেছে। এত খাবার সে কী করে খাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার উপর খাবারের গন্ধে হুটহাট তার আবার বমি চলে আসে। সে অসহায় চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার শাশুড়ি মা তখন জিজ্ঞেস করেন,
‘কী হলো, পৃথা? খাচ্ছো না কেন?’
পৃথা বলে,
‘এত খাবার?’ শাশুড়ি মা বলেন,
‘কেন, খেতে পারবে না?
পৃথা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
‘না মা, কেমন যেন…’
তারপর সে থেমে যায়। শাশুড়ি মা বুঝতে পারেন। তিনি উঠে পৃথার পাশে এসে বসেন। আর বলেন,
‘ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
তিনি খুব যত্ন করে পৃথাকে খাইয়ে দিতে আরম্ভ করেন। তবে পৃথা বেশি খেতে পারে না, তার গা গুলানো শুরু হয়ে যায়। সে বলে,
‘মা, আর খেতে পারছিনা।’
পৃথার শাশুড়ি বলেন,
‘কিন্তু, এটুকু খেলে কী করে হবে? তোমার তো এখন বেশি বেশি খেতে হবে, মা।’
পৃথা অসহায় স্বরে বলে,
‘সত্যি আমি আর খেতে পারছি না, মা।’
তার শ্বশুর তখন বলেন,
‘থাক, ও যখন আর খেতে চাইছে না তখন আর জোর করো না।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পৃথা রুমে যেতেই দেখে রুমটা অন্ধকার। তবে তার মাঝেও কিছু ফেইরি লাইটের মিটমিটে আলোয় বেশ সুন্দর লাগছে রুমটা। পৃথা দরজা আটকে বিছানায় এসে বসে। তারপর সে মৃদু সুরে ডাকে,
‘অর্ণব, কোথায় আপনি? বারান্দায়?’
অর্ণব বারান্দা থেকে এসে তার পাশে বসে। পৃথার চোখের দিকে চেয়ে বলে,
‘তুমি জানো পৃথা, আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, কীভাবে তোমাকে সবটা সত্যি জানাবো। তখন শুধু একটা কথাই মাথায় আসছিল, যদি সব সত্যি জানার পর তুমি আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ো, তাহলে তো তোমার শরীরও আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। সেই ভয়ে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু, আজ আমার মনে হচ্ছে হয়তো তোমাকে আরো আগেই সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে এই দিনটাও আমাদের জীবনে আরো আগেই চলে আসতো।’
পৃথা অর্নবের হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘সব কিছুরই সময় আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকে। আর সেই নির্ধারিত সময়ের আগে কিছুই ঘটে না।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’
পৃথা তারপর অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখে। আর বলে,
‘আমার এই কথাগুলো ভেবে এখন যেমন কষ্ট হয় আবার মাঝে মাঝে খুব হাসিও পায়। এই যেমন, আমি মা হতে যাচ্ছি অথচ আমি এতদিন ধরে ভাবছিলাম আমি হয়তো মোটা হয়ে যাচ্ছি, তাই আমার পেট বড় হয়ে যাচ্ছে। আজও তো রুহাকে বলছিলাম, আমাকে ব্যায়াম করতে হবে পেট কমাতে হবে, পেটটা বেশি বড়ো। কিন্তু তখনও তো আমি জানতাম না, এই পেটে আমার অস্তিত্ব আছে। আপনার আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব।’
অর্ণব তার কথা শুনে হাসে। তারপর তার পেটের উপর হাত রেখে বলে,
‘আমাদের বাবুও বোধ হয় তখন তোমার কথা শুনে হাসছিল।’
পৃথাও হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, হয়তো।’
তারপর সারারাত দুজন আরো গল্প করে। তাদের জমিয়ে রাখা অনেক অনেক কথা আজ একজন অন্যজনের কাছে ব্যক্ত করে। তাদের ছোট্ট বাবুকে নিয়ে কত শত পরিকল্পনা করে। পৃথা তো তার নামও ঠিক করে ফেলে, কোন স্কুলে ভর্তি করবে সেটাও ঠিক করে ফেলে। বাবুকে বড়ো হয়ে কী বানাবে সেটাও ভেবে ফেলে সে। আর তার এত এত উত্তেজনা দেখে অর্ণব হাসে। আর প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবে,
‘এইতো আজ তার জীবন সার্থক হয়েছে, আজ তার জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। অগোছালো জীবনটা তার আবার নতুন করে সেজে উঠেছে। তার প্রেমাঙ্গনা তার জীবনে ফিরেছে। সাথে নিয়ে এসেছে একটা সুন্দর ফুলের কলি। এখন তো সে কেবল সেই ফুলের কলি থেকে ফুল ফোটার অপেক্ষা করছে।’
চলবে….