#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।
রিপোর্ট নিয়ে এই ঝামেলার সমাধান করতে পারেনি বলে পৃথা অর্ণবকে কল দেয়, তাকে হসপিটালে আসতে বলে। হঠাৎ হসপিটালে আসার কথা শুনে অর্ণব খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবে, পৃথা হয়তো সব বুঝে ফেলেছে। তাই সে বিচলিত হয়ে দ্রুত হসপিটালে আসে। এসেই তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
পৃথার চোখ মুখ ভীষণ উদ্বিগ্ন। অর্ণবকে দেখে সে চিন্তিত সুরে বলে,
‘সত্যি করে বলুন তো, আপনি আদৌ আমার রিপোর্ট হসপিটাল থেকে নিয়েছিলেন কিনা?’
অর্ণব আমতা আমতা করে বলে,
‘হ হ্যাঁ, নিয়েছিলাম তো।’
পৃথা ভ্রু কুচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘তাহলে সেই রিপোর্ট এখন কোথায়?’
অর্ণব শুকনো মুখে বলে,
‘রিপোর্টটা তো ভুলে আমি ডাক্তারের কেবিনেই ফেলে চলে গিয়েছি।’
পৃথা বলে,
‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’
অর্ণবের ভয় আরো বেড়ে যায়। সে এখন কী বলবে বুঝতে পারছে না। পৃথা তপ্ত সুরে বলে,
‘আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। ডক্টর বলেছেন, কেবিনে আমার কোন রিপোর্ট নেই। রিপোর্টটা তাহলে কোথায় গিয়েছে, অর্ণব?’
অর্ণব বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পৃথাকে সে এখন কী বলে বুঝাবে সেটা সে বুঝতে পারছে না। পৃথা উত্তরের আশায় তার মুখ পানে চেয়ে আছে। অর্ণবের চোখমুখ দেখেও তার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। তার বারবার মনে হচ্ছে অর্ণব তাকে মিথ্যে বলছে। কিছু একটা তার থেকে লুকাচ্ছে। অর্ণবের এই মৌনতা পৃথার দুশ্চিন্তা আর সন্দেহকে কেবল বাড়িয়েই যাচ্ছে। পৃথা পুনরায় প্রশ্ন করে,
‘কী হয়েছে, অর্ণব; কিছু বলছেন না কেন? রিপোর্ট টা কোথায় গেল? আপনি কোথায় রেখেছেন সেটা?’
অর্ণব মিইয়ে যাওয়ার সুরে বলে,
‘হয়তো আমি রিপোর্টটা হারিয়ে ফেলেছি।’
পৃথা চেতে উঠে বলে,
‘হারিয়ে ফেলেছেন মানে কী?’
অর্ণব নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘তুমি এত দুশ্চিন্তা কেন করছ? তোমার রিপোর্টে সবকিছু নরমাল ছিল, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি তো।’
পৃথা চোখ বুঝে নিঃশ্বাস ফেলে তারপর বলে,
‘ঠিক আছে তাহলে, এখন আমার সাথে ডাক্তারের কাছে চলুন।’
অর্ণব আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। ভাবে, এবার হয়তো সব সত্যটা পৃথা বুঝে ফেলবে। পৃথার প্রশ্নের মুখে পড়ে অর্ণব একেবারে চুপ হয়ে যায়। আর কোন উপায় না পেয়ে সে পৃথার সাথে ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করে। কেবিনে প্রবেশ করার পরই পৃথা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে,
‘দেখুন তো ডক্টর, উনি কিছুদিন আগে আপনার কেবিনে এসেছিলেন কিনা?’
ডক্টর অর্ণবের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন। অর্ণব দূর থেকে তাকে ইশারা দিয়ে কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করে, ডক্টর হয়তো সেটা বুঝতে পারে। তাই তিনি বলেন,
‘হ্যাঁ, উনি এসেছিলেন।’
অর্ণব আশ্বস্ত হয়। সে বলে,
‘ডাক্তার, আপনি মনে করে দেখুন, সেদিন আপনার কেবিনে আমি একটা রিপোর্ট ফেলে গিয়েছিলাম; সেই রিপোর্টটা আমার স্ত্রীর।’
ডক্টর যেন আরেক দফা অবাক হলো। কিছুদিন আগে যে মেয়েটা তার বন্ধুর সাথে এসে বললো, সে অবিবাহিত আজ হঠাৎ সে একজনের স্ত্রী কী করে হয়ে গেল? আশ্চর্য! এইসবের আগামাথা তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।
পৃথা জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা ডক্টর, আমার রিপোর্ট টা কি সত্যি নরমাল ছিল?’
অর্ণব আবারো তাকে ইশারা দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে। ডক্টর বলেন,
‘হ্যাঁ।’
পৃথা এবার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হলো। যেন বুকের উপর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গেল তার। পৃথাকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে অর্ণব ডাক্তার কে ধন্যবাদ বলে পৃথাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে যাওয়ার পর পৃথা ম্লান সুরে বলল,
‘আমি দুঃখিত, অর্ণব।’
অর্ণব হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘সমস্যা নেই।’
পৃথা বলল,
‘আসলে ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পরও শরীরের কোনো উন্নতি না দেখে আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তাই আমি আজকে আবার ডাক্তারের কাছে এসেছি, কিন্তু এখানে আসার পর উনি বললেন, উনি নাকি আমার কোন রিপোর্টই পাননি; তখন আমার দুশ্চিন্তার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সেজন্য আমি এরকম করে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।’
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাকে এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না।’
তারপর সে বলে,
‘তুমি দুশ্চিন্তা করো না। একবার আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর তোমাকে আমি আরো ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সব ধরনের টেস্ট করাব। তোমার কিছু হয়নি, পৃথা। আমি আছি তো তোমার সাথে।’
পৃথা মৃদু হেসে বলে,
‘ঠিক আছে।’
অর্ণব বলে,
‘চলো, বের যখন হয়েছি তখন একটু ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে আসি।’
পৃথাও সেই প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।
আজ বিকেলটা একটু অন্যরকম সুন্দর। চারদিকে নরম মৃদু বাতাস বইছে। সূর্যটা একটু পশ্চিম দিকে হেলে আছে। আর পাখিরা আকাশ জুড়ে বিচরণ করে চলছে। রাস্তার ধারে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষের সমাগম। সবাই কত ব্যস্ত এই শহরে। অথচ এত ব্যস্ততার ভিড়েও কেউ কেউ যেন একটু বেশিই স্তব্ধ। কেন এই স্তব্ধতা, এর কারণ তারা নিজেরাও হয়তো জানে না। এত হইচই, এত ব্যস্ততার মাঝে “স্তব্ধ” থাকাটা মানুষের ঠিক মানায় না। হাজার স্তব্ধতার মাঝেও মানুষকে বাঁচতে হবে, হইচই করতে হবে। আনন্দ না থাকলেও আনন্দকে কেড়ে আনতে হবে। জীবন তো দুঃখের সমাহার, তাই বলে কি সুখ করবে না? হ্যাঁ, সুখ করবে। যেমনটা সুখ করছে পৃথা। তার এত এত দুঃখ, তার মাঝেও আজ সে সুখ খুঁজে এনেছে। আর সেই সুখ আনতে চেয়েছে বলেই হয়তো আজ সে অর্ণবকে ফিরে পেয়েছে। যদিও তার কাছে অর্ণবকে দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে পাও না, সে তো জানেও না অর্ণব তার জীবনের সাথে আগেই মিশে ছিল; এখন শুধু নতুন অবয়বে আবার ফিরে এসেছে। সে তো বরং ভাবছে অর্ণব তার নতুন রূপ নতুন ভালোবাসা। যাক, ভাবনা যেমনই হোক না কেন ভালোবাসা তো ভালোবাসাই, প্রথম হোক বা দ্বিতীয় ভালোবাসার তো আর
নতুন রূপ নেই।
,
রুহা বাসায় আসার পর পৃথা বলল,
‘চল, আজকে একটু শপিংয়ে যাই।’
রুহাও বলল,
‘ঠিক আছে, চল।’
তারপর দুজনেই তৈরি হয়ে শপিং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। পৃথা এর মাঝে অর্ণবকেও কল দিয়ে শপিংমলে আসতে বলে।
শপিং করার মাঝেই পৃথা বায়না ধরল, সে নাকি আইসক্রিম খাবে। তাই পৃথা আর রুহাকে একটা দোকানে রেখেই অর্ণব গেল তাদের জন্য আইসক্রিম আনতে। তবে আইসক্রিম নিয়ে আসার সময় অর্ণব যেন ফরহাদকে দেখতে পেল। প্রথমে তাকে ঠিক চিনতে পারল না তাই সে কিছুক্ষণ দাঁড়াল, মানুষটাকে খেয়াল করে দেখল, সাদা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো কোর্ট গায়ে দেওয়া মানুষটা ফরহাদ ছাড়া আর কেউ না। অর্ণবের ভ্রু কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গে, মেজাজ খারাপ হলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, ফরহাদ তাদের ফলো করছে। তাই সে দ্রুত ফরহাদের কাছে যেতে নেয়। কিন্তু, তার আগেই পৃথা এসে তার হাত ধরে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
অর্ণব তার দিকে ফিরে আবার সামনে তাকাতেই লোকটাকে হারিয়ে ফেলে। পৃথা পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো, কিছু বলছেন না যে?’
অর্ণব বলে,
‘না, কিছু না। তুমি আইসক্রিমগুলো নিয়ে রুহার কাছে যাও।’
‘আপনিও চলুন।’
‘হ্যাঁ, তুমি যাও। আমি আসছি।’
পৃথা আইসক্রিম নিয়ে আবার রুহার কাছে যায়। অর্ণব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে লোকটাকে খোঁজে, কিন্তু সে আর কোথাও তাকে দেখতে পায় না। তাই সেও ফিরে যায়।
অর্ণব পৃথাকে বিয়ের জন্য একটি লাল জামদানি শাড়ি কিনে দেয়। পৃথার এমনিতেই শাড়ি ভীষণ পছন্দ তার উপর লাল জামদানি। সে তো নিজেকে সেখানে বসেই লাল শাড়িতে কল্পনা করে বারবার অভিভূত হয়ে পড়ছে। মনে মনে খানিক লজ্জাও পাচ্ছে। প্রথমবার বউ সাজা না হলেও এবার বেশ আয়োজন করে তার বউ সাজা হবে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে জুতা, গহনা সবই কেনা হয়েছে তার।
সব শপিং শেষ করে পৃথা আর রুহাকে নামিয়ে দিয়ে অর্ণব তার বাসায় ফিরে যায়। রাতে বাবা অফিস থেকে ফিরলে, পৃথা তার সব শপিং বাবাকে দেখায়। বাবা খুশি হয়ে বলেন,
‘বাহ, খুব সুন্দর হয়েছে তো সবকিছু।’
বাবার বাহবা পেয়ে পৃথা যেন আরো বেশি খুশি হয়ে যায়।
বাবা অতঃপর বললেন,
‘পরশু যেহেতু শুক্রবার তাহলে তো কালই তোমাদের হলুদের আয়োজন করা উচিত। অর্ণবকে কল দিয়ে বলো, ও যেন ওর বাবা-মার সহ কাল এখানে চলে আসে। আমাদের দুই পরিবারের একসাথে হলুদ হবে।’
পৃথার খুশি আর দেখে কে। সে সঙ্গে সঙ্গে রুমে গিয়ে অর্ণবকে কল দিয়ে সবকিছু বলে। তবে অর্ণব কেন যেন সেটাতে বারণ করে দেয়।
অর্ণব বলে,
‘না, হলুদ যদি হতেই হয় তবে যার যার বাড়ি থেকেই হবে। তুমি তোমার বাড়িতে করবে আর আমি আমার বাড়িতে।’
অর্ণবের মতামত শুনে পৃথার দুঃখ হয়। সে বলে,
‘কেন, আমাদের বাড়িতে হলে কী সমস্যা?’
অর্ণব বলে,
‘সমস্যার কিছু নেই, পৃথা। কিন্তু, তাও আমি চাই যার যার বাড়ি থেকেই সব অনুষ্ঠান হোক।’
পৃথার মন খারাপ হলেও সে বলে,
‘ঠিক আছে, আপনি যা বলবেন তাই হবে।’
চলবে…