#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২।
পুরোটা দিন শুয়ে শুয়েই পার করে পৃথা। সন্ধ্যার পর তার বাবা অফিস থেকে ফিরেন। তিনি এসে ফ্রেশ হয়ে পৃথার রুমে যান। পৃথা তখনও ঘুমাচ্ছিল। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,
‘ঘুমাচ্ছো, মা?’
পৃথা পিটপিট করে চেয়ে বলে,
‘না, বাবা। বলো।’
তিনি বললেন,
‘বিয়ের জন্য শপিং করবে না?’
পৃথা আস্তে আস্তে উঠে বসল। বলল,
‘ইচ্ছে তো ছিল, বাবা। তবে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। তাই শুয়ে আছি।’
‘কী হয়েছে হঠাৎ? তোমার ডাক্তার আংকেলকে ডাকব?’
‘না বাবা, আংকেলকে ডাকার দরকার নেই। ঠিক হয়ে যাব। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও কিছু।’
‘হ্যাঁ, খাব। একটা কথা বলব?’
‘কী, বলো।’
‘অর্ণব, ছেলেটা কি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে?’
পৃথা স্মিত হেসে বলল,
‘হ্যাঁ বাবা, উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন।’
পৃথার বাবা হতাশ সুরে বললেন,
‘কিন্তু, আমার তো ওর ব্যবহার দেখে তা মনে হয়না। ও তো তোমার উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করে। এটা কি ঠিক? আমার তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মা।’
পৃথা বাবার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
‘তুমি নিশ্চিন্তে থাক, বাবা। উনি আমাকে ভালোবাসেন। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, উনি আমার অনেক যত্ন নেন। সারাক্ষণ আমার ভালোর কথাই ভাবেন। আমি উনার কাছে ভালো থাকব, বাবা। প্লিজ, তুমি এই নিয়ে আর ভেবো না।’
পৃথার বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে ম্লান সুরে বললেন,
‘মেয়ের সুখেই বাবার সুখ। তুমি যা বলবে তাই হবে।’
এই বলে তিনি উঠে যাচ্ছিলেন। পৃথা ডেকে উঠল,
‘বাবা!’
‘হ্যাঁ, মা?’
‘একটু বসো।’
তিনি আবার বসলেন। পৃথা জিজ্ঞেস করল,
‘বাবা, ফরহাদের সাথে কি তোমার কোনো ঝামেলা হয়েছে?’
পৃথা বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘বলো না, বাবা। ঐ লোকটার সাথে কি কোনো কথা নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়েছে?’
‘না, হয়নি।’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘হয়নি? ফরহাদ তোমাকে কিছু বলেননি?’
‘না।’
পৃথা কিঞ্চিত অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা বাবা, তোমার কম্পানির বর্তমান মালিক কে? তুমি না?’
পৃথার বাবা আমতা আমতা করে বললেন,
‘হ হ্যাঁ, আমিই তো। আর আমার পর তুমি হবে।’
পৃথা সন্দিহান সুরে বলল,
‘তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো না তো?’
পৃথা বাবা হেসে বললেন,
‘তোমার থেকে আবার আমি কী লুকাবো?’
পৃথা ভাবছে, ফরহাদের বলা কথাগুলো এখন বাবাকে বলবে কিনা? পৃথার বাবার তার দিকে চেয়ে বললেন,
‘কী ভাবছো?’
পৃথা ফিচেল স্বরে বলল,
‘বাবা, ফরহাদ বলেছেন, তোমার সব কম্পানির মালিক নাকি উনি। আর আমার সাথে উনার বিয়ে হয়নি বলে, উনি নাকি এখন এইসব কিছু কেড়ে নিবেন। এই বাড়িটাও। তোমাকে নাকি পথে বসাবে। আদৌ কি এই সবকিছু সত্যি বাবা? নাকি সবকিছুই উনি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছেন?’
পৃথা বাবার মুখটা সঙ্গে সঙ্গেই বিষন্ন হয়ে গেল। কপালের ভাঁজ সোজা হলেও চোখের দৃষ্টি ভিজে উঠল। অসহায় চোখে পৃথার দিকে চেয়ে বললেন,
‘এসব নিয়ে তুমি ভেবো না, মা। আমি সব সামলে নিব।’
পৃথার দুশ্চিন্তা বাড়ল। অস্থির গলায় বলল,
‘বাবা, প্লিজ সব বলো আমাকে। এসব কিছু তাহলে সত্যি?’
পৃথা বাবা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন। শুকনো মুখে বললেন,
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
পৃথা মুখটা ছোট হয়ে গেল। তার অজান্তেই হয়তো তার বাবা এতসব দুশ্চিন্তা মুখ বুজে সহ্য করছেন। হয়তো, সবকিছু সমাধান করার জন্য অস্থির হয়ে একা একাই এদিক ওদিক ছুটছেন। অথচ সে মেয়ে হয়েও বাবার একটুখানি পাশে দাঁড়াতে পারছে না। এই অপরাধবোধ তো তাকে জ্বালিয়ে মারবে।
পৃথা ভেজা গলায় বলল,
‘বাবা, এখন তুমি কী করবে? কীভাবে তোমার কম্পানি আর বাড়ি বাঁচাবে?’
‘কী আর করব? কম্পানিগুলো দিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে বাড়িটা যেন ও নিতে না পারে সেই ব্যবস্থা করেছি আমি। ফরহাদের সাথে আমার কথা হয়েছে।’
‘কিন্তু বাবা, তোমার কম্পানিগুলো ফরহাদ নিয়ে গেলে তুমি কী করবে? কম্পানিগুলো না থাকলে তো তোমার চলাও তো কষ্ট হয়ে যাবে।’
‘নারে মা, কষ্ট হবে না। আমি কাজ করব। আগে যে কম্পানিতে বস হিসেবে ছিলাম, এখন না হয় সেই কম্পানিতে কর্মচারী হিসেবে কাজ করব। সমস্যা হবে না। তুমি কোনো চিন্তা করো না। তোমার বাবার যা আছে তাতে সে দিব্যি ভালো থাকতে পারবে।’
পৃথার বাবার জন্য খুব মায়া হয়। সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,
‘এসব কিছু আমার জন্য হচ্ছে, তাই না? আমি যদি ফরহাদকে বিয়ে করতাম তাহলে আর এত কিছু হতো না।’
‘থাক মা, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন আর সেসব নিয়ে মন খারাপ করো না। এখন তুমি তোমার বিয়ে নিয়ে ভাবো। আর আজকে ভালো না লাগলে, কালকে রুহা আর সারাকে নিয়ে শপিং করে এসো। আর বিয়ের বাকি আয়োজন আমি করছি, তুমি কোনো চিন্তা করো না।’
বাবা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পৃথার বড্ড মন খারাপ হয়। বাবাকে সে কত ভুল বুঝেছে। কত কিছু বলেছে। অথচ, এই বাবা’ই আজ তার খুশির জন্য সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছেন। পৃথার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইশ! সবকিছু যদি সে ঠিক করতে পারতো! আর ঐ ফরহাদকেও যদি উচিত শিক্ষা দিতে পারতো, তবেই সে শান্তি পেত।
,
খালা কফি দিয়ে গেলে পৃথা সেই কফির মগ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আকাশে কোনো চাঁদ নেই, নেই কোনো তারাও। ফাঁকা আকাশ, কেবল আছে কচকচে কালো মেঘ। আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সে গেইটের বাইরে দৃষ্টি ফেলল। চেয়ে দেখল, একটা চেনা অবয়ব। পৃথা ভ্রু কুঁচকায়। গরম গরম কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। কাউকে একটা কল লাগিয়ে বলে,
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
অপর পাশের লোকটা খুব চমৎকার হাসে। তবে সেই হাসি অমন দূর থেকে পৃথা আর দেখতে পায় না। তবে আন্দাজ করতে পারে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘হাসছেন কেন?’
‘এমনি।’
‘এমনি আবার কেউ হাসে নাকি?’
‘হাসে না?’
‘না, পাগল ব্যতিত এমনি এমনি কেউ হাসে না।’
‘ওহহ, তাহলে তো আমিও সেই পাগলের কাতারেই পড়লাম।’
‘হ্যাঁ, অবশ্য আপনাকেও পাগল বলা যায়। তা, পাগল সাহেব এমন রাত বিরেতে আপনার আমার বাড়ির সামনে কী কাজ শুনি?’
‘আসলে দুঃখের কথা কী বলব বলুন; এই পাগল সাহেবের একজন ব্যক্তিগত পাগলী সাহেবা ছিলেন, যিনি বর্তমানে আপনার বাড়িতেই আটকা পড়ছেন। উনি এখন কোনো ভাবেই এই বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। আর এইদিকে উনার এই পাগল সাহেব উনার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। তাই সে সব কাজ ফেলে রেখে আপনার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। যদি একবার উনার দেখা পায়, সে আশায়।’
পৃথা মুচকি হাসে। বলে,
‘পাগল সাহেব চাইলে তার পাগলী সাহেবাকে বাসার ভেতর এসে দেখে যেতে পারেন, তার জন্য কোনো বাঁধা নেই।’
‘উঁহু, পাগল সাহেব আবার খুব ভদ্র। বিয়ের আগে এমন অভদ্রতা সে কোনোভাবেই দেখাবে না।’
পৃথা হেসে বলে,
‘তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই, পাগল সাহেব; বাড়ি ফিরে যান। আপনার পাগলী সাহেবার খেয়াল আমি রাখছি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
‘যাক, শুনে ভালো লাগল। এবার তাহলে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারব।’
‘হু, রাখছি।’
পৃথা কল কেটে দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। এই এত এত দুশ্চিন্তার মাঝেও যেন অর্ণব তার এক টুকরো প্রশান্তি।
___________________________
পরদিন সকালেই পৃথা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। রুহাকে নিত, কিন্তু সে এখন ক্লাসে থাকায় সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। তার আগের দেখানো ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখে আজকে একটু মানুষ কম। তাই সেও সিরিয়াল পেয়ে যায় তাড়াতাড়ি।
তার ডাক পড়াতে সে ভেতরে যায়। ডাক্তার তাকে দেখেই চিনে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন?’
পৃথা বলে,
‘ভালো নেই, ডক্টর। আমার শরীর এখনও ঠিক হয়নি, না পিরিয়ড রেগুলার হয়েছে। ঔষধ খাচ্ছি, তাও কাজ হচ্ছে না। তাই আজ আবার এসেছি।’
ডাক্তার খানিক চিন্তায় পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনার সাথে কেউ আসেনি?’
‘না, আমি একাই এসেছি। আচ্ছা ডক্টর, কিছুদিন আগে কি আমার রিপোর্টের জন্য কেউ একজন এসেছিলেন?’
‘আপনার রিপোর্ট? না, সেটা তো আমার কাছে আসেনি। রিপোর্ট তো আপনি যেখান থেকে টেস্ট করছেন সেখান থেকে নিবেন। সেই রিপোর্ট আমার কাছে নেই।’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কিন্তু, উনি তো বললেন, আপনার সাথে নাকি উনার কথা হয়েছে। আপনি নাকি রিপোর্ট দেখে বলেছেন, সবকিছু নরমাল।’
‘কী জানি। এমন রিপোর্ট নিয়ে তো অনেকেই আসেন। আমার হয়তো খেয়াল নেই।’
‘তাহলে আমি এখন রিপোর্ট টা কোথায় পাবো?’
‘দু’তালায় গিয়ে হাতের ডানে দেখবেন, একটা টেস্ট রুম আছে। ওখানে যে কর্মরত আছেন, উনাকে বললেই আপনি আপনার রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।’
‘আচ্ছা ডক্টর, ধন্যবাদ।’
পৃথা ডাক্তারের কথা মতো উপরে গিয়ে তার রিপোর্টের খোঁজ করল। কিন্তু সেখানের কর্মচারী বলল, তার রিপোর্ট নাকি আগেই এসে কেউ নিয়ে গিয়েছে। পৃথা ভাবল, হয়তো অর্ণব। তবে সে তো বলেছিল, রিপোর্ট ভুলে ডাক্তারের কেবিনেই ফেলে গেছে। তাহলে তো সেটা সেখানেই থাকার কথা। কিন্তু, ডাক্তার তো আবার অন্য কথা বলছেন। এখন কার কথা সে বিশ্বাস করবে? পৃথা বিরক্ত হয়ে আবার ডাক্তারের কেবিনে যায়। জিজ্ঞেস করে,
‘সত্যি করে বলুন তো ডক্টর, সত্যিই কি কেউ আমার রিপোর্ট নিয়ে আপনার কাছে আসেননি? উপরে আমি আমার রিপোর্ট পাইনি। সেটা তো আগেই কেউ এসে নিয়ে গিয়েছে। আমার জানা মতেও তাই। আমার বদলে অন্য একজন রিপোর্ট নিতে এসেছিলেন। তার সাথে আপনার কথাও হয়েছে। আপনি একটু মনে করে দেখুন।’
ডাক্তার ও পড়লেন মহা ঝামেলায়। এমন কেইস আগে ঘটেনি কখনো। কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলাকে নাকি জানানো যাবে না সে যে প্রেগন্যান্ট। ব্যাপারটা উনার কাছেও খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করতেও পারছেন না। তাই তিনি বললেন,
চলবে…