#অনুগল্প
#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
মা বাবার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলছে মেয়েটি। তার হাঁটার তালে মাথায় বেঁধে রাখা ছোট চুলগুলোও লাফিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার ফর্সা গাল চিকচিক করছে খুশিতে। ছোট ছোট পাগুলো দিয়ে পারছে না দৌড়ে চলে যেতে।
প্রথম স্কুলে যাওয়ার অনুভূতি টা অন্যরকমের হয়। সেই ছোট ছোট হাতে গুটি গুটি লেখা। বন্ধুদের সাথে ছুটে বেড়ানো। স্কুল বন্ধের ছুটিতে আনন্দে মেতে উঠা। এইসব কিছুই মনে এক অন্যরকম আনন্দ জাগায়।
মেয়েকে প্রথম স্কুলে নিয়ে এসে পদ্ম’র তার স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে। সব মনে না পড়লেও কিছু কিছু ঘটনা তার স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে। সে তার মা’কে সেই সময় খুব জ্বালাত। সবসময় ক্লাসে তার পাশে মা’কে বসিয়ে রাখত। এক মুহূর্তের জন্যও মা’কে কোথাও নড়তে দেইনি। আজ আবার মনে পড়ছে তার মা’র কথা। সেই সময়ে মাও কত কষ্ট করতেন, খেয়ে না খেয়ে মেয়ের পেছনে পড়ে থাকতেন। এখন তারও সময়। তাকেও এভাবেই তার মেয়ের যত্ন নিতে হবে।
মেয়েকে নিয়ে পদ্ম আর আদিত ক্লাসে ঢুকে। সেখানে অনেক বাচ্চা। কেউ কেউ কান্না করছে তো, কেউ কেউ আবার এদিক ওদিক ছোটাছুটি, খেলাধুলা করছে। পদ্ম আদিতাকে একটা বেঞ্চে বসাল। তার পাশে আরেকটা মেয়ে বসা। সে আদিতাকে দেখে হেসে বলল,
‘তোমার ব্যাগটা তো খুব সুন্দর।’
আদিতাও সেই কথা শুনে খিলখিল হাসল। বলল,
‘আমার দাদু কিনে দিয়েছেন। একটা বড়ো ব্যাগের দোকান আছে, ওখানে না অনেক সুন্দর সুন্দর ব্যাগ আছে। আমার এটা পছন্দ হয়েছে, তাই দাদু আমাকে এটা কিনে দিয়েছেন। আচ্ছা, তোমার ব্যাগ কে কিনে দিয়েছে?’
মেয়েটি বলল,
‘আমার আব্বু।’
তারপর আরো কথা। বাচ্চা দু’টো গল্প জুড়ে দিল। একজন অন্যজনের কথা শুনছে আর হেসে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। পদ্ম এখন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে যেন। প্রথম থেকে খুব ভয় পাচ্ছিল, মেয়ে তার সবার সঙ্গে মিশতে পারবে কিনা। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে, না পারবে।
আদিত তাকে জিজ্ঞেস করল,
‘এবার শান্তি পেয়েছেন, ম্যাডাম? আপনার মেয়ে তো একদিনেই তার বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে। আপনি অযথাই তাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছিলেন।’
পদ্ম হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।’
এর মাঝে তাদের ক্লাসে শিক্ষক চলে আসেন। তিনি এসে সবার মা বাবাকে ক্লাস ছেড়ে যেতে বলেন। মা বাবা চলে যাচ্ছিল বলে, অনেক বাচ্চারাই কান্না আরম্ভ করে। কিন্তু, আদিতা তেমন কিছুই করেনি। সে উল্টো তার মা বাবাকে হাত নাড়িয়ে টাটা দেয়। যেন এই সবকিছু সে খুব উৎফুল্ল মনে উপভোগ করছে।
পদ্ম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আদিদ বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, তার হসপিটালে তাড়া ছিল বলে সে চলে যায়।
আদিদার ছুটি হয় বারোটার পর। বাচ্চা গুলো দৌড়ে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। এত সময় পর মা বাবাকে আবার কাছে পেয়ে তাদের যেন খুশির অন্ত নেই। পদ্ম এদিক ওদিক চেয়ে আদিতাকে খুঁজছে। কিন্তু, পাচ্ছে না। তাই সে আদিতার ক্লাসের সামনে যায়। গিয়ে দেখে মেয়েটা বসে বসে কাঁদছে। পদ্ম যেন ভয় পেয়ে যায়। সে ছুটে যায় আদিতার কাছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, আম্মু? তুমি কাঁদছ কেন? এই তো মা চলে এসেছি।’
আদিতা নাক টেনে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘মা, আমি না আমার পেন্সিলটা হারিয়ে ফেলেছি।’
‘তুমি এর জন্য কাঁদছো?’
‘হ্যাঁ, ওটাতো আমাকে রানী খালামনি দিয়েছিল। আমার তো খুব প্রিয়। আমি ওটা হারিয়ে ফেলেছি, মা। আমার তো এখন খুব কান্না পাচ্ছে।’
পদ্ম তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘থাক মা, কান্না করে না। তোমার রানী খালামনি তো তোমাকে আরো অনেকগুলো পেন্সিল দিয়েছেন, তুমি ঐগুলো দিয়ে লেখো। এখন আর কান্না করতে হবে না। উঠো, আমাদের বাসায় যেতে হবে তো। তোমার দাদু তো অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য, তোমার নতুন স্কুলের গল্প শুনবেন বলে। চলো চলো, তাড়াতাড়ি চলো।’
আদিতার ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে, অন্য হাতে আদিতাকে ধরে সিঁড়ির কাছে যেতেই দেখল, আদিদ আসছে। সে পদ্ম’কে দেখেই জিজ্ঞেস করল,
‘আপনাকে কল দিচ্ছিলাম, পদ্ম? কল ধরছিলেন না কেন?’
‘আমি তো শুনতে পাইনি। ফোন বোধ হয় সাইলেন্টে ছিল।’
‘ওহ আচ্ছা।’
তারপর সে মেয়েকে এসে কোলে নিল। আদর করে জিজ্ঞেস করল,
‘প্রথম দিন কেমন কেটেছে, মামুনি?’
আদিতা হেসে বলল,
‘অনেক ভালো।’
‘আচ্ছা, তাই। কয়টা বন্ধু হয়েছে তোমার?’
আদিতা তার হাতের আঙুলে কিছুক্ষণ গুনে বলল,
‘দু’টো।’
‘নাম কী তাদের?’
‘একজন তুবা, আরেকজন জেমি।’
‘তাহলে তো, আমার মেয়ের এখন ক্লাস করতে খুব ভালো লাগবে। এতগুলো বন্ধু হয়েছে, এখন তো শুধু আনন্দ আর আনন্দ।’
আদিতার মুখটা কালো হয়ে গেল। সে বলল,
‘না তো। আলন্দ না। আমার তো খুব কষ্ট, পাপা।’
মেয়ের অমন কথা শুনে আদিদের বেশ হাসি পায়। পদ্ম মুখ টিপে হাসে। আদিদ জিজ্ঞেস করে,
‘ও বাবা, আমার মেয়েটার এত কিসের কষ্ট শুনি? কী হয়েছে, মামুনি? স্যার বা ম্যাম কিছু বলেছেন?’
‘না। আমি আমার পেন্সিল হারিয়ে ফেলেছি। ওটা আমার প্রিয় ছিল।’
আদিতাকে গাড়িতে বসিয়ে আদিত তার গাল টেনে আদর করে বলল,
‘আচ্ছা, পাপা আরেকটা কিনে দিব।’
আদিতা বাসায় গিয়েই দৌড়ে তার দাদুর রুমে যায়। এত গল্প জমেছে, তাকে সব বলতে হবে তো। বাচ্চা মেয়েটার চোখে মুখে নিদারুন খুশির রেশ দেখে তার দাদুও বেশ খুশি হোন। জিজ্ঞেস করেন,
‘প্রথম দিন কেমন গিয়েছে, বুবু?’
আদিতা গল্প করতে আরম্ভ করে। ক্লাসে সবার কথা সে বলে। শেষে তার পেন্সিল হারানো নিয়েও দাদুর কাছে একটু দুঃখ প্রকাশ করে। সব গল্প শেষ হলে, দাদু বলেন,
‘এবার যাও, বুবু; তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো। আজকে আমি তোমার জন্য একটা মজার জিনিস রান্না করেছি। একসাথে খাব।’
আদিতা এক গাল হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’
তারপর সে দৌড়ে তার রুমে গেল। গিয়ে দেখল বাবা তার মায়ের চুল ধরে যেন কী করছে। সে ভাবুক ভাবে চেয়ে বলল,
‘কী করছো, পাপা?’
আদিতার গলার স্বর পেয়ে আদিদ চমকে পদ্ম’র চুল ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ায়। পদ্ম বাঁকা চোখে আদিদের দিকে চাইতে সে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলে,
‘তোমার আম্মুর চুলগুলো দেখছিলাম, কত সুন্দর দেখো।’
আদিতা মা বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। পদ্ম’র চুলে সেও হাত দিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ তো, আম্মুর চুল তো খুব সুন্দর।’
আদিদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
‘বড়ো হলে তোমারও তোমার আম্মুর মতো এত সুন্দর চুল হবে।’
পদ্ম আদিতাকে বলে,
‘এখন চলো, তোমাকে গোসল করিয়ে দেই। গরমে ঘেমে গিয়েছ। আর আপনি(আদিদের দিকে চেয়ে), আবার কি এখন হসপিটালে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, যেতে হবে। পেশেন্ট আছে।’
‘আচ্ছা, যান তাহলে।’
আদিদ আদিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘মা, যাও তুমি ওয়াশরুমে যাও। তোমার আম্মু কাপড় নিয়ে আসছে।’
আদিতাও দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। পদ্ম আলমারির দিকে এগুতে নিলেই আদিদ তার শাড়ির আঁচলে টান দেয়। পদ্ম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আদিদ মুচকি হেসে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আপনি আজকাল বড্ড বেশি নিরামিষ হয়ে যাচ্ছেন, পদ্ম। বুঝেছি, এখন আমাকেই আবার ট্রেনিং দিয়ে আপনাকে আমিষ বানাতে হবে।’
এই বলে সে পদ্ম’র গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে চলে গেল। পদ্ম ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,
‘আপনি আর জীবনেও বদলাবেন না, ডাক্তারবাবু।’
সমাপ্ত।
(পদ্মফুলের স্মৃতি তাজা করতেই এই ছোট্ট অনুগল্পটি দিয়েছি। ইনশাল্লাহ, ভবিষ্যতে হয়তো আরো দিব। এটাকে অবশ্য ঈদ বোনাসও ভাবতে পারেন,,,😁)