প্রেমাঙ্গনা পর্ব ২১

0
415

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।

‘বিয়ে যখন করেই ফেলেছ, তখন তো আর কিছু করার নেই। তবে আমারও তো একটা ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার থাকতে পারে। আমার একটা মাত্র মেয়ে, ভেবেছিলাম ধুমধাম করে তার বিয়ে দিব। কিন্তু, কিছুই তো আর হলো না। আপাতত এখন না হয়, ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান হোক। আমার পরিবারের কিছু মানুষ আর অর্ণবের পরিবারের কিছু মানুষ থাকবেন। তাছাড়া অর্ণবের মা বাবার সাথেও তো আমার কোনো কথা হয়নি। তা, তুমি এখন কী বলো, অর্ণব?’

অর্ণব জবাব দেওয়ার আগে পৃথার মুখের দিকে চাইল। বেশ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। বাবা যে তাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে, এই নিয়ে মেয়েটা প্রচন্ড খুশী। কিন্তু, অর্ণব তো জানে, পৃথা ব্যাপারটাকে যতটা সহজ চোখে দেখছে, ব্যাপারটা আদৌ এতটা সহজ না। তার সামনে বসে থাকা মানুষটা এতটাও সরল সোজা না যে, এই বিষয়টাকে তিনি এত সহজেই মেনে নিবেন।

তাও সে নিশ্বাস নিয়ে বলল,

‘অনুষ্ঠান করা যেতেই পারে। আর আমার পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো দ্বিমত পোষণ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি আপনার মতো ব্যবস্থা করতে পারেন,(একটু থেমে) বাবা।’

পৃথার বাবা স্মিত হেসে বললেন,

‘যাক তাহলে, তোমারও সম্মতি পেয়ে খুশি হলাম। ঠিক আছে তাহলে, আগামী শুক্রবার তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তার আগে তোমার মা বাবার সাথে আমি কথা বলব। উনাদের নাম্বারটা আমাকে দাও।’

অর্ণব তার মা বাবার নাম্বার পৃথার বাবাকে দেয়। আর বলে,

‘চিন্তা করবেন না, উনারা সবকিছু জানেন।’

পৃথা বাবা তার দিকে এক পলক চেয়ে বললেন,

‘তাহলে তো ব্যাপারটা আমার জন্য আরো সহজ হবে।’

সব কথাবার্তা শেস করে পৃথার বাবা বললেন,

‘যেহেতু শুক্রবারে আবার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছেই, তাহলে আপাতত এই কয়দিন পৃথা আমার কাছেই থাক। শুক্রবারেই না হয় তুমি একেবারে জামাই সেজে গিয়ে পৃথাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে গেলে?’

অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘না বাবা, আমি দুঃখিত। ওকে আমি এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করব না। শুক্রবারে সকালে ওকে আমি আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। দুপুরের মধ্যে ও তৈরি হবে। তারপর বিকেলের দিকে আমি আমার পুরো পরিবারসহিত আপনার বাড়িতে এসে ওকে নিয়ে যাব। এত আগে ওকে আমি আপনার কাছে পাঠাতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

পৃথার বাবা বেশ বিরক্ত হলেন। পৃথা নড়ে বসল। বলল,

‘কেন? বাবা যেটা বলেছেন সেটাই তো আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি এই কয়দিন বাবার কাছে থাকি। তারপর শুক্রবার এসে আমাদের পরিপূর্ণ একটা বিয়ে হবে। অন্য সবার মতো আমি বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাব। এটা না করে, আপনার কাছে থেকে কি আর সেই অনুভূতিটা পাব নাকি? মনেই তো হবে না, আমার যে বিয়ে হচ্ছে। তার চেয়ে বরং বাবা যেটা বলেছেন সেটাই করি।’

অর্ণব তার কথায় ক্ষুব্ধ হলো। মেয়েটা মিনিটেই উল্টে গেল। সে জানতো, এখানে আসলে এমন কিছুই হবে। মেয়েটাকে তার বাবা বুঝিয়ে ফেলবেন। আর হয়েছেও তাই। অর্ণব তাই শক্ত গলায় বলল,

‘আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, পৃথা। এখানে আর নতুন করে কোনো অনুভূতি নেওয়ার কিছু নেই। আমি যা বলেছি তাই হবে। শুক্রবারেই তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে, এর আগে না।’

পৃথা কিছুটা ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘অর্ণব, আপনি এমন কেন করছেন? আপনি তো জানেন সবকিছু। বাবার পাশেও তো এখন আমাকে থাকতে হবে, তাই না? প্লিজ, রাজি হয়ে যান।’

অর্ণব চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে রইল। পৃথার বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,

‘আমার মেয়ে আমার কাছে যেতে চাইছে, আর তুমি ওকে আটকাচ্ছো? এটা কেমন ব্যবহার, অর্ণব? তুমি কি তাহলে বিয়ের পর আমার সাথে ওর কোনো যোগাযোগ রাখতে দিবে না? এটা কি কোনো ভালো মানুষের ব্যবহার? ও কি এখন ওর বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিবে? এটাই চাও তুমি?’

অর্ণব লোকটার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে। পৃথার কাছে অর্ণবকে খারাপ প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই উনি ছাড়ছেন না। আর ঐদিকে পৃথাও হয়েছে, একইরকম। বাবা যা বলছেন, তাই বসে বসে গিলছে।

পৃথা অর্ণবের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। অর্ণব পারছে না। অনেক চেষ্টা করে, নিজের মনকে দমিয়ে অবশেষে সে বলল,

‘ঠিক আছে। আমি আটকাবোনা পৃথাকে। তবে, ঐ বাড়িতে থাকা অবস্থায়, ফরহাদ যেন ঐ বাড়ির আশে পাশেও না ঘেঁষে। আমি কিন্তু, সারাক্ষণ এই ব্যাপারটা নজরে রাখব। আর হ্যাঁ, পৃথা কিন্তু অলরেডি’ই আমার বিবাহিতা স্ত্রী, এটা যেন কেউ না ভুলে। বুঝতে পেরেছ, পৃথা?’

পৃথা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। আপনি এত টেনশন করবেন না। বাবা আছেন তো আমার খেয়াল রাখার জন্য।’

অর্ণব তখন মনে মনে বলল,

‘বাবা আছেন বলেই তো এত টেনশন।’

,

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ণব পৃথার চলে যাওয়া দেখল। যেমনটা দেখেছিল হসপিটাল থেকেও সেদিন চলে যাওয়ার সময়। আর ঐদিন চলে যাওয়ার সময় বুকটা তার তীব্র ব্যথায় মিইয়ে যাচ্ছিল। আজও তাই হচ্ছে। এত কষ্টের পর আবার পৃথাকে সে পেয়েছে। এবার আর কোনো কিছুর বিনিময়েই সে পৃথাকে হারাতে দিবে না।

পৃথার গাড়িটা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, অর্ণব ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেই সেটা দেখল। তারপর রাতে সেও আবার তার বাড়িতে ফিরে গেল।

পরদিন সকালেই অর্ণব পৃথার বাসার সামনে যায়। সেখানে গিয়ে সে পৃথাকে কল দিয়ে বলে, বারান্দায় আসতে। পৃথা এসে অর্ণবকে দেখে অবাক হয়। তাকে ডেকে বাসায় আসতে বললেও, সে বারণ করে বলে, “আসবে না”। দূর থেকে দু’জন কিছুক্ষণ দৃষ্টি বিনিময় করার পর, অর্ণব চলে যায়।

সেদিন দুপুরের পর থেকে পৃথার শরীরটা আবার খারাপ লাগতে শুরু করে। সে দুপুরে অল্প কিছু ভাত খেয়েছিল। সেগুলোও ব মি করে সব বের করে। কিন্তু তাও বমি তার শেষ হয় না। পরপর তিনবার বমি করে, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে তার। ওয়াশরুম থেকে বেড পর্যন্ত আসতে পারছিল না। পা ফেললেই যেন পড়ে যাবে। মাথা তার প্রচন্ড ঘুরাচ্ছে। সে পা ফেলতে গিয়ে ধপ করে ওয়াশরুমের দরজার সামনেই বসে পড়ে। তারপর আর উঠতে না পেরে “খালা” বলে চেঁচিয়ে উঠে। তার চিৎকারে খালা বাইরের রুম থেকে দৌড়ে এলেন। পৃথাকে পড়ে থাকতে থেকে তিনি দ্রুত তাকে টেনে তুললেন। ধরে নিয়ে বিছানায় বসালেন। পৃথা বসার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। খালা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হইছে, খালা? এমন করতাছেন কেন? শরীর খারাপ লাগতাছে আপনার?’

‘হ্যাঁ, খালা। বমি হয়েছে, মাথা ঘুরাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আর উঠতে পারছি না। খুব দুর্বল লাগছে।’

খালা প্রথমে ভ্রু কুঁচকান। পরক্ষণেই শাড়ির আঁচলটা মুখের কাছে নিয়ে লজ্জামাখা স্বরে বলেন,

‘আমার তো অন্যকিছু মনে হইতাছে, খালা। আবার কোনো সুখবর আইতাছে না তো?’

হুট করে “সুখবর” বলে শব্দটাকে তার মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করতে পারল না। এই সুখবরটা কী নিয়ে হতে পারে, কিছুক্ষণের জন্য সে সেটা ভুলে গেল। পরে তার মনে পড়ল, সে তো এখন বিবাহিতা। এখন তো একটু বমি আর মাথা ঘুরালেই খালার মতো মানুষরা “সুখবর” বলে চেঁচাবেন। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। তবে এই মুহুর্তে এই ব্যাপারটা পৃথার কাছে বড্ড বিরক্ত লাগল। সে তাই চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

‘কী যে বলেন, খালা। সুখবর আসবে কোথ থেকে? আমাদের বিয়ের বোধ হয় ভালো করে এক সপ্তাহও হয়নি। আর আপনি এখনই সুখবর নিয়ে পড়ে গেলেন।’

খালার মুখে সেই লজ্জামাখা হাসি কিন্তু গেল না। বরং সেটা আরো চওড়া হলো। তিনি বললেন,

‘আরে তাতে কী? এক সপ্তাহেও সুখবর অয়, আপনি টেস্ট করান, খালা।’

পৃথা মাথার উপর হাত রেখে বলল,

‘উফফ খালা, আপনাকে আর আমি বুঝিয়ে পারব না। আচ্ছা, বাদ দেন। আপনি গিয়ে বরং আমার জন্য একটা ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আসুন। আমার প্রেশার মনে হয় লো, তাই শরীরটা এত দুর্বল লাগছে।’

খালা তার কথা মতো কাজে চলে গেলেন। আর পৃথা ভাবুক মনে চিন্তা করল, এই শরীরের হঠাৎ এত খারাপ হওয়ার আসল রহস্যটা কী? এত ঔষধ খেয়েও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। শরীরের তো কোনো উন্নতি সে দেখছে না। এখন কি আবার একবার ডাক্তারের কাছে যাবে সে? আগের রিপোর্টটাও তো তার ভালো করে দেখা হয়নি। যদি অর্ণব তার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে থাকে? পৃথা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। টানা এতগুলো দিন তার শরীরটা এমন। এটা তো আর এমনি এমনি হচ্ছে না, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে। পৃথা তাই ঠিক করে, সে কালই আবার সেই ডাক্তারের কাছে যাবে। তারপর আগের রিপোর্ট টা সে নিজের চোখে দেখে, তবেই ক্ষান্ত হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here