#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
অর্ণবের চেঁচানোর শব্দে পৃথা দৌড়ে রুম থেকে এসে দেখে বাসায় অনেক মানুষ ঢুকেছে। তাদের কেউই পরিচিত না। তাই পৃথা অর্ণবকে জিজ্ঞেস করল,
‘উনারা কারা, অর্ণব?’
অর্ণব তার দিকে ফিরে বলল,
‘জানি না আমি। হুট করেই বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছে।’
‘ওদের না চেনারই কথা। তবে, আমাকে চেনো কিনা দেখতো?’
কথাটা বলেই বাসার ভেতর একজন প্রবেশ করে। আর তাকে দেখেই অর্ণব আর পৃথা চমকে যায়। পৃথা ঢোক গিলে। অর্ণবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। লোকটা মুচকি হেসে পৃথার দিকে চেয়ে বলে,
‘আমাকে কি চিনতে পেরেছ, পৃথা?’
পৃথা নাক মুখ শক্ত করে বলে,
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
‘ওমা, আসব না? তুমি কার সাথে আছো, সেটা আমার জানতে হবে না? তাই খুঁজে খুঁজে চলে এলাম। তা, আমাদের বসতে বলবে না?’
অর্ণব শক্ত গলায় জবাব দেয়,
‘না, বলবে না। আপনাদের আমাদের বাসায় বসার কোনো প্রয়োজন নেই। যেই রাস্তা দিয়ে এসেছেন সেই রাস্তা দিয়েই আবার ফিরে যান।’
ফরহাদ দাঁত কেলিয়ে হাসল। বলল,
‘কী যে বলো না? এত কষ্ট করে এলাম, আর তোমরা একটু চা নাস্তা না খাইয়েই বিদায় করে দিচ্ছ? এটা কেমন দেখায়, বলো? আচ্ছা যাও, তোমাদের বলতে হবে না, আমরাই ভেতরে গিয়ে বসছি।’
এই বলে ফরহাদ তাদের বসার রুমে চলে যায়। তার পেছন পেছন তার লোকগুলোও ভেতরে যায়। অর্ণবের রাগ তরতর করে বাড়ছে কেবল। পৃথা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। অর্ণব চাচার দিকে চেয়ে বলে,
‘চাচা, আপনি বাসায় যান। উনারা আমার পরিচিত।’
চাচা চলে যাবার পর অর্ণবও বসার ঘরে যায়। ফরহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘দেখুন, আমি আর কোনো ঝামেলা চাইছি না। পৃথা এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ও আমার সাথে এখানেই থাকবে। তাই অযথা কোনো ঝামেলা না বাড়িয়ে আপনি ফিরে যান।’
ফরহাদ বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলল,
‘পৃথা তোমার কী হয় না হয় সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি? সে তোমার বউ হোক বা না হোক সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওর বাবা আমাকে ওয়াদা দিয়েছেন, ওকে আমার সাথে বিয়ে দিবেন। এখন যদি উনি উনার ওয়াদা না রাখেন, তবে আমিও আমার ওয়াদা রাখব না।’
অর্ণব ভ্রুকুটি করে বলল,
‘আপনার কিসের ওয়াদা?’
‘পৃথা হয়তো জানে না, ওর বাবার সমস্ত কোম্পানির মালিক এখন আমি। ওর বাবা এই বিয়ের শর্ত দিয়েই আমার থেকে কম্পানিগুলো নিতে চেয়েছিলেন। যেহেতু এখন আর আমাদের বিয়ে হচ্ছে না, সেহেতু এখন এই কম্পানিগুলোও আমার। কাল থেকে পৃথার বাবা পথে বসবে। ব্যবসা নেই তো, খাবেন কী উনি? উনার ঐ বিশাল বাড়িও যে তখন আর বেশিদিন থাকবে না।’
পৃথা সব শুনে ভীষণ রেগে গেল। সে তেড়ে এসে বলল,
‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ। আমাকে বিয়ে করার জন্য আপনি আমার বাবাকে ব্যবহার করছেন। আপনার মতো একটা লোককে শুধু আমি কেন, কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে না।’
ফরহাদ বরাবরের মতোই মুখের হাসি বজায় রেখে বলল,
‘থাক, বিয়ে করার আর প্রয়োজন নেই। বিয়ের বদলে এত সম্পত্তি পেয়েছি, আমার তাতেই হবে। তুমি তোমার মতো সুখে সংসার করো, দোয়া রইল।’
অর্ণব তখন বলল,
‘আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন, দেশে আইন বলেও একটা জিনিস আছে। আপনি একজনের সম্পদ জোরপূর্বক দখল করতে পারেন না। আপনার বিরদ্ধে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিব।’
‘হা হা, হাসালে। শোনো, তোমাদের এসব ফালতু আইনের ভয় আমাকে দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এমন দু চারটা আইন আমি নিজেই পকেটে নিয়ে ঘুরি। নিজের আইন নিজের কাছেই রাখো। ফরহাদ কোনো আইনের পরোয়া করে না। আমি যা বলেছি তাই করব, এখন পারলে আমাকে আটকে দেখাও।’
এই বলে ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। তারপর তার লোকদের নিয়ে সে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথা রাগে গদগদ করছে। ওরা চলে যাওয়ার পর সে চেঁচিয়ে বলে,
‘দেখেছেন অর্ণব, ঐ লোকটা কতটা খারাপ! আর ওর জন্য আমি আমার বাবাকে ভুল বুঝছিলাম। ঐ লোকটা আমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে এসব করিয়েছে। তাই তো বলি, বাবা তো কখনো এমন করেন না, উনি আমার কষ্ট বুঝেন। তবে কেন হঠাৎ, আমি কষ্ট পাচ্ছি জেনেও এই বিয়েটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছেন? এখন বুঝেছি তার কারণ। আমাদের একবার বাবার সাথে কথা বলতে হবে, অর্ণব। চলুন না, আমরা কাল বাবার সাথে দেখা করি। আমার মনে হচ্ছে, আমরা বোঝালে বাবা ঠিক বুঝবেন। দেখবেন, উনি তখন মেনে নিবেন সবকিছু।’
অর্ণবের কেন যেন এত সহজেই সবকিছু বিশ্বাস হলো না। ফরহাদ যা বলেছে সত্যিই কি তেমন কিছু আদৌ ঘটেছে? নাকি, আবার তার সাথে কোনো গেইম খেলা হচ্ছে? পৃথার বাবা সত্যিই ফরহাদের ফাঁদে পড়েছে, নাকি দু’জন মিলে তাকে ফাঁদে ফালানোর চেষ্টা করছে? অর্ণব কোনোভাবেই ফরহাদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। ঐদিকে পৃথার এত অস্থিরতা দেখেও তার ভালো লাগছে না। তাই সে বলল,
‘ঠিক আছে, কাল না হয় আমরা তোমার বাবার সাথে দেখা করব। তবে, শুধু দেখা করব। উনি যদি তোমাকে সাথে নিতে চান, তাহলে কিন্তু সেটা আমি কখনোই মেনে নিব না। ‘
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। শুধু দেখাই করব।’
পরদিন সকালে পৃথা ঘুম থেকে উঠেই দেখল, অর্ণব বাসায় নেই। দরজা বাইরে দিয়ে লক করে সে কোথাও গিয়েছে। পৃথা ফ্রেশ হয়ে এসে অর্ণবের নাম্বারে কল দেয়। অর্ণব কল রিসিভ করে। জিজ্ঞেস করে, নাস্তায় সে কী খাবে? বললে সে খাবার বাইরে থেকে নিয়ে আসবে। পৃথা তাকে বারণ করে দেয়। বলে, সে বাসায় বানাবে। অর্ণব তখন বলে,
‘তবে, এখন না। আমি বাসায় আসার পর গ্যাস জ্বালাবে। এর আগে ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না।’
পৃথা তার কথা মতো রান্নাঘরে না গিয়ে রুমেই বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর অর্ণব আসে। তারপর দু’জন মিলে সকালের নাস্তা বানায়। নাস্তা খাওয়া শেষ করে পৃথা বলে,
‘আমি বাবাকে এখন কল দিয়ে বলে দিব, আমরা যে দেখা করতে চাইছি?’
‘এখনই বলবে?’
‘হ্যাঁ, বলে দিই। আমার বাবার জন্য খুব টেনশন হচ্ছে।’
‘আচ্ছা, বলো। উনাকে আমাদের বাসার কাছে রেস্টুরেন্ট আসতে বলো। আমরা সেখানে গিয়েই উনার সাথে কথা বলব।’
‘আচ্ছা।’
পৃথা বাবার নাম্বারে কল দেয়। প্রথম দু’বার কল রিসিভ হয়না। তৃতীয় বারের মাথায় রিসিভ হয়। পৃথা কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,
‘ব-বাবা, কেমন আছো?’
পৃথার বাবা ফুঁপিয়ে উঠেন। বলেন,
‘মনে পড়েছে বাবার কথা? আমি তো ভেবেছিলাম, বাবা বলে যে কেউ আছেন সেটাই হয়তো তুমি ভুলে গিয়েছ।’
‘এভাবে বলো না, বাবা। আমার এমনিতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, তুমি আমার সাথে রাগ করো না।’
‘আচ্ছা, রাগ করব না। তুমি ভালো আছো, মা?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমি খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘তোমাকে ছাড়া কীভাবে ভালো থাকি, বলো? শুনলাম, তুমি নাকি বিয়েও করে ফেলেছো?’
পৃথা ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘বাবাকে একবার বললেও না? তোমার পছন্দের কথা আমাকে বললে কি আমি সেটাকে প্রাধান্য দিতাম না? একবারও সেটা না বলে, তুমি এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে, আমার বুঝি এতে কষ্ট হয়নি? এমন কেন করলে, মা? বাবাকে তো একবার বলতে পারতে।’
‘চেয়েছিলাম বাবা। কিন্তু, তোমার রাগের ভয়ে কিছু আর বলতে পারিনি।’
‘আচ্ছা যাকগে যা হবার তো হয়েই গিয়েছে? তা, আমার জামাই কোথায়? তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিবে না?’
পৃথা খুশি হয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, অবশ্যই। নাও কথা বলো তুমি।’
পৃথা অর্ণবের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। অর্ণব তো থমকে যায়। সে তো বুঝতে পারছে পরিস্থিতিটা মোটেও স্বাভাবিক না। পৃথার বাবা সব জেনে বুঝে ইচ্ছে করে এসব করছেন। উনি তো অর্ণবকে আগ থেকেই চেনেন। তার প্রতি রাগটাও হয়তো আগের মতোই রয়ে গেছে। এখন মেয়েকে হাতে নেওয়ার জন্য হয়তো আবার অভিনয় করছেন।
অর্ণব ইতস্তত হয়ে পড়ে। নির্মল হেসে ফোনটা হাতে নেয়। কানে নিয়ে সালাম দেয়। পৃথা বাবা তার জবাব দিয়ে বলে উঠে,
‘আবার আমার মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়েছো? তুমি আসলেই একটা নির্লজ্জ। এতকিছু বলার পরেও আমার মেয়ের পিছ ছাড়লে না।’
পৃথা সামনে বলে, অর্ণব নিজেকে সংযত করে। শান্ত গলায় বলে,
‘জি, আপনার মেয়েকে ভালোবাসি তো। তাই আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা, ভয় বা লজ্জা নেই। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। বুঝতে পেরেছেন, শ্বশুর আব্বা?’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আরে, শ্বশুর আব্বা কী? বাবা বলো বাবা।’
চলবে…
(ঈদ মোবারক, পাঠকমহল। সকলের ঈদ কাটুক একরাশ আনন্দের ভীড়ে। ভালোবাসা)