#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।
গাড়িটা তাদের কাছে আসতেই পৃথা চেঁচিয়ে উঠল,
‘ঐ তো রুহা, নিলয় আর সারা। ওরা আমার বন্ধু। চলুন।’
এই বলে সে ছেলেটির হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল। ততক্ষণে গাড়ি আরো এগিয়ে গিয়েছে। পৃথা পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকল,
‘রুহা, দাঁড়া। এই নিলয়, আমি এখানে।’
তার অমন বিশাল চিৎকারের শব্দ অগ্রাহ্য করার শক্তি কারোর নেই। চলন্ত গাড়িতেই সেই শব্দ তার বন্ধুদের কানে পৌঁছে গেল। রুহা বলল,
‘আমি বোধ হয় পৃথার গলার স্বর পেয়েছি। তোরা কেউ শুনেছিস?’
সবাই তার সঙ্গে তাল মেলাল। নিলয় ড্রাইভার কে বলল, গাড়ি ব্যাক করতে, পৃথা হয়তো তাদের পেছনেই আছে। উদ্দেশ্য মোতাবেক পেছনে গিয়েই তারা পৃথাকে দেখতে পেল। তার পাশে থাকা এই জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষটাকে দেখে আরো বেশি চমকাল তারা। রুহি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এল তার কাছে। প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে বলে,
‘লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস, আর এইদিকে আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল প্রায়। এই প্রেমিক কবে জুটালি? আমাদের কাউকে কিছু বলিসনি তো।’
পৃথা বিরক্ত গলায় বলল,
‘উফফ, উনি আমার প্রেমিক কেন হতে যাবে? উনার চেহারা দেখলে কি তোর মনে হয়, উনি কোনো মেয়ের প্রেমিক হওয়ার যোগ্য? নেহাতই বিপদে পড়েছি, নয়তো আমার ঠেকা পড়েনি উনার মতো ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ানোর।’
‘এক্সকিউজ মি, একদমই বাজে বকবেন না। আপনিও কোনো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা না। আমিও দোয়া করি আপনার মতো প্রেমিকা যেন কোনো পুরুষের ভাগ্যে না জুটে। মেয়ে তো নয় যেন ধানি লংকা। কথার মাঝে যেন আগুন ঝরে।’
‘আপনার মতো ছেলেদের সাথে না এভাবেই কথা বলা উচিত, নয়তো আপনারা মেয়েদের পেয়ে বসবেন।’
ছেলেটা এবার রেগে গেল। পৃথার দিকে ঘুরে গরম গলায় বলল,
‘আপনি তো দেখছি বেশ স্বার্থপর মেয়ে। এতক্ষণ বিপদে ছিলেন বলে আমার সাথে চুম্বকের মতো লেগে ছিলেন, আর এখন বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েই সব কৃতজ্ঞতা শেষ। এই জন্যই বলি, সহজে মেয়েদের সাহায্য করতে নেই। তারা ভীষণ অকৃতজ্ঞ।’
‘আর আপনি যেমন খুব কৃতজ্ঞ। একটু সাহায্য করে একশোটা কথা শুনান। আপনার মতো ছেলেদের কাছ থেকেও সাহায্য নিতে নেই। যাকগে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওরা আমার ফ্রেন্ড, আমি ওদের সাথে ফিরছি, চাইলে আপনিও আমাদের সাথে আসতে পারেন।’
‘নো থেংক্স। এতক্ষণ অনেক উপকার করেছেন, আর কোনো উপকারের প্রয়োজন নেই।’
এই বলে ছেলেটি হাঁটা ধরলে গাড়ির ড্রাইভার বললেন,
‘এই সময় একা আপনি কোথায় যাবেন? এইদিকে পথ ঘাট ভালো না। যেকোনো সময় যেকোনো বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে আপনি বরং গাড়িতে উঠে বসুন, আমি আপনাকে আপনার রিসোর্টে পৌঁছে দিব।’
তার সাথে তাল মিলিয়ে নিলয়ও বলল,
‘হ্যাঁ, আপনি আমাদের সাথে চলুন। তাছাড়া এতক্ষণ আপনি আমাদের বন্ধুকে দেখে রেখেছেন, এখন আমাদেরও দায়িত্ব আপনাকে ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দেওয়ার। কোথায় থাকেন আপনি?’
‘আপনারা যে রিসোর্টে উঠেছেন, সেই রিসোর্টেই।’
‘কী?’
পৃথা আবারও চেঁচাল। ছেলেটি বলল,
‘জি।’
নিলয় বলল,
‘তাহলে তো ভলোই হলো, একসাথে যাওয়া যাবে।’
রিসোর্টের সামনে পৌঁছাতেই পৃথা তার বন্ধুদের নিয়ে তাদের কটেজের দিকে চলে যায়। ছেলেটি যাওয়ার আগে নিলয় আর সেই গাড়ির ড্রাইভার কে ধন্যবাদ জানায়। তারপর সেও চলে যায় তার কটেজে। সেখানে গিয়ে দেখে তার বন্ধু রনি হাত পা ছড়িয়ে বেতের চৌকিতে শুয়ে আছে। ছেলেটি কোনো শব্দ না করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গায়ের টি শার্ট টা খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। তারপর সেও গিয়ে সটান করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তখনই তার আধমরা বন্ধু পাশ থেকে বলে উঠে,
‘কোথায় গিয়েছিলি, অর্ণব?’
অর্ণব চোখ বুজেই জবাব দিল,
‘পাহাড়ে।’
শোয়া থেকে তার বন্ধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘দেখা হয়েছে ওর সাথে?’
অর্ণব তার দিকে তাকাল। বিষন্ন সুরে বলল,
‘শুধু দেখা না, কথাও হয়েছে।’
তার বন্ধু এবার আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
‘চিনতে পেরেছে তোকে?’
অর্ণব গভীর নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘না।’
‘একদমই চিনতে পারেনি?’
‘উঁহু।’
‘তুইও কিছু বলিসনি?’
‘না।’
রনি এবার রেগে গিয়ে অর্ণবকে বলল,
‘মানে কী? ও না হয় তোকে ভুলে গিয়েছে, কিন্তু তুই তো ওকে ভুলিসনি। তোর তো ওর সাথে কথা বলা উচিত। এভাবে আর কতদিন চলবে? এবার তো এর একটা বিহিত করা উচিত। শোন অর্ণব, তুই ওর সাথে সরাসরি কথা বল। ওকে সবকিছু খুলে বল। আমার মনে হচ্ছে ও তোর কথা বিশ্বাস করবে।’
অর্ণব মুখ ফিরিয়ে বলল,
‘আমার তো তা মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে, ও আমাকে কখনোই বিশ্বাস করবে না। আর তার উপর ডাক্তার ও বারণ করেছে ওর উপর কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করতে, পরে হিতে বিপরীত হবে।’
‘কিন্তু, তুই ও তো এইদিকে কষ্ট পাচ্ছিস। কী করবি, এভাবেই চলতে দিবি সবকিছু?’
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাকে এখন শুধু অপেক্ষা করে যেতে হবে।’
‘যদি তোর এই অপেক্ষার মাঝেই ওর জীবনে নতুন কেউ চলে আসে, তখন? তখন তুই কী করবি?’
অর্ণব প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘বাজে কথা বলা বন্ধ কর। ওর জীবনে আমি ছাড়া আর কেউই আসবে না। আমিই আসব, পুরোনো আমি নতুন হয়ে আসব। তবু অন্য কাউকে আসতে দিব না।’
অর্ণবের গলার স্বর কাঁপছে। এই ভয়টা যে তারও হচ্ছে। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়? যদি সত্যিই তার জীবনে নতুন কেউ চলে আসে? তবে সে কী করবে? কীভাবে বোঝাবে ওকে? কীভাবে বলবে, সে যে তার প্রেমাঙ্গনা, তার সহধর্মিণী।
______________________
‘ছেলেটা খুব ভালো, তাই না পৃথা?’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘একদমই না। ঐ ছেলেকে তোর কোন দিক দিয়ে ভালো লাগল? একেবারে অসভ্য আর বেয়াদব একটা ছেলে। কীভাবে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হয় সেটাও জানে না।’
নিলয় বিছানার এক পাশে গিয়ে বসে বলল,
‘ঐ খারাপ ছেলেটা ছিল বলেই কিন্তু এতক্ষন ঐ রাস্তায় তুই এত সেইফ ছিলি। নয়তো আরো বড়ো বিপদও হতে পারত। তাছাড়া ও আজকে তোর প্রাণও বাঁচিয়েছে। অন্তত একটু কৃতজ্ঞতাও তো দেখাতে পারিস।’
পৃথা নিলয়ের সেই কথায় কান না দিয়ে ফোন নিয়ে স্কাউচে গিয়ে বসল। নিলয় ব্যর্থ চোখে রুহার দিকে তাকাল। রুহার চোখে মুখেও হতাশার ছাপ। কী জানি কখন তাদের এই হতাশা কাটবে, কবে আবার একটু স্বস্তি পাবে?
রাতের খাবার শেষ করে কটেজের বারান্দায় গিয়ে সবাই বসে। নিলয় তার গিটারে তখন টুংটাং সুর তুলার চেষ্টা করছে। রুহা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। পৃথা চুপচাপ বসে ফোন দেখছে। সারা তার মাঝে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে বলল,
‘উফফ, বোরিং লাগছে। তোরা সবাই এমন মরার মতো বসে আছিস কেন?’
‘তো কি নাচব নাকি?’
পৃথার কথার উত্তরে সারা বলল,
‘হে, চল নাচি। এই নিলয়, একটা সুন্দর গান ধরতো।’
এই বলে সে পৃথার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলে,
‘আয়, আজকে তুই আমার হিরো; আর আমি তোর হিরোইন। এই নিলয়, গান ধর না।’
নিলয় ও তার গিটারে সুর তুলল। সাথে গলার স্বর মিলিয়ে গাইতে লাগল,
‘ও আমার বন্ধু গো
চির সাথী পথ চলার
তোমারই জন্য গড়েছি আমি
মঞ্জিল ভালোবাসার
এক সাথে রয়েছি দুজন
এক ডোরে বাঁধা দুটি প্রাণ
ছিঁড়বেনা কভু এই বাঁধন
আসলে আসুক তুফান’
সারা পৃথাকে নিয়ে নেচে গেয়ে অস্থির। পৃথাও বেশ মজা পাচ্ছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। তার হাসির এই তীক্ষ্ণ সুরে বরাবরই একজনের বুকে তীব্র ব্যথার সূত্রপাত হয়। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। তবে সে যে বড়ো অসহায়, বড়ো অপারগ; নিষ্পলক চোখে কেবল দেখেই যেতে পারবে। কাছে থেকেও ছুঁতে পারবে না। এর থেকে বেশি যন্ত্রণার আর কী হতে পারে?
চলবে….