প্রেমাঙ্গনা পর্ব ১৬

0
430

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৬।

পৃথার ভয়ার্ত মুখটা দেখে অর্ণবের বেশ মজা লাগছে। তাই সে পৃথাকে আরেকটু ভয় দেখানোর জন্য তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। পৃথা তখন তার চোখ মুখ আরো কুঁচকে ফেলে। অর্ণব তার টি শার্টের বোতাম দুটো খুলতেই পৃথা চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘আরে, কী শুরু করেছেন?’

পৃথা লাফ দিয়ে উঠে বসে। ঢোক গিলে বলে,

‘আমি এখন এসবের জন্য প্রস্তুত না।’

অর্ণব মুচকি হেসে পৃথার বালিশে শুয়ে বলে,

‘তা, প্রস্তুতি নিতে কয়দিন লাগবে?’

‘অনেকদিন।’

‘উঁহু, বেশি সময় তো দেওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ দু’দিন। এর মাঝেই ভালো ভাবে প্রস্তুতি নাও।’

‘বললেই হলো নাকি, দু’দিন? আপনাকে আমি ভালো করে চিনি না, আগে কোনো সম্পর্কও ছিল না। হুট করেই আজ বিয়ে হয়ে গিয়েছে। না আমি এসবের জন্য এখন মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম, আর না শারিরীক ভাবে। দু’দিন কোনো সময় হলো নাকি? কমসে কম আমার এক মাস লাগবে।’

অর্ণব জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে,

‘এক মাস কেন, এক বছর নাও। তারপর যখন আমি বুড়ো হয়ে যাব, তারপর এসে আমাকে বলো, কেমন?’

পৃথা ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

‘আচ্ছা।’

অর্ণব সরু চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর পৃথাকে বলে,

‘তাহলে আর জেগে থেকে কী করবে? ঘুমাও এখন।’

পৃথাও মুচকি হেসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে।

,

বিয়ের পর প্রথম সকাল। সূর্য যেন তার সমস্ত তেজ তাদের শোয়ার ঘরে ঢেলে দিচ্ছে। পৃথার ঘুম ছুটে যায়। গলায় হাত দিয়ে দেখে ঘামছে সে। ফ্যান চললেও বাতাস খুব একটা লাগছে না। পাশে তাকিয়ে দেখে, অর্ণব নেই। সে আস্তে আস্তে উঠে বসল। দিনের আলোয় তাদের রুমটা যেন অন্যরকম লাগছে। মাথার পাশে যে জানলাটা সেটার সামনে দিকে একটু জায়গা আছে। সেখানে বেশ কয়টা ফুল গাছ রাখা। এই ফুলগুলো তার প্রিয়। রোদে যেন এগুলো আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কী চমৎকার হাসছে তারা! তার নিচেই রোদের আলোয় যে ছায়া তৈরি হয়েছে সেখানে গাছগুলোর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। এই বাড়ির সবকিছু এত দৃষ্টিনন্দন কেন? চারদিকে কেবল, সুন্দর আর সুন্দর।

সেসব ভাবতে ভাবতেই পৃথা ঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজে। অনেক ঘুমিয়েছে আজ সে। মনে পড়ল, বাবা নিশ্চয়ই ঐদিকে এতক্ষণে হুলস্থুল শুরু করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই দারোয়ান মামাকেও অনেক বকবেন, উনি ঠিক মতো পাহারা দিতে পারেননি বলে। খালাকেও হয়তো কথা শোনাবেন। ইশ, তার জন্য নিরহ মানুষগুলোও কত বকা শুনবেন। পৃথার খারাপ লাগে। তবে কিছু করারও নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে দু হাত দিয়ে চুলে একটা খোঁপা করে। তারপর উঠে ওয়াশরুমে যায়, ফ্রেশ হতে।

ফ্রেশ হয়ে এসে পৃথা অর্ণবকে খোঁজে। সে রুমে নেই, কোথায় গেল? রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের কাছে যেতেই দেখল, অর্ণব রান্না করছে। পৃথা চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগল, সে কী কী করছে। এক চুলায়, পরোটা ভাজছে। আর অন্যটাতে ভাত বসিয়েছে। একবার সে পরোটা উল্টাচ্ছে তো আরেকবার সে ভাতটা চামুচ দিয়ে নাড়ছে। পৃথার তো নিজেকে এখন বেশ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায় নাকি? কী সুন্দর সে ঘরের সব কাজ করতে পারে।

পৃথা তখন খুশি হয়ে পেছন থেকে অর্ণবকে ফ্লাইং-কিস দেয়। অর্ণব তৎক্ষণাৎ বলে উঠে,

‘এসব উড়ন্ত জিনিসে আমার হবে না, আমাকে কিছু দিতে হলে সরাসরি এসে দিতে হবে।’

পৃথা বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,

‘এই আপনার কি পেছনেও দুইটা চোখ আছে নাকি?’

অর্ণব হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, তুমি জানো না?’

পৃথা তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,

‘মজা করবেন না তো।’

‘মজা করব কেন? আমার সত্যিই পেছনে দুইটা চোখ আছে, আমি কিন্তু পেছনের সবকিছু দেখি।’

পৃথা ভেংচি দিয়ে বলে,

‘এএ, আমাকে বাচ্চা পেয়েছেন তো, যে যা বলবেন তাই বিশ্বাস করব।’

অর্ণব হেসে বলে,

‘হ্যাঁ তো, বুড়ো বাচ্চা।’

পৃথা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকায়। অর্ণব বলে,

‘তোমার ডিম আর ব্রেড রেডি। যাও রুমে গিয়ে বসো, আমি নিয়ে আসছি।’

‘আমি যে সকালে ডিম আর ব্রেড খাই, সেটা আপনাকে কে বলল?’

‘কেউ বলেনি, এমনিই জানি।’

‘হু জানি, রুহার থেকে সব জেনেছেন।’

অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, এবার রুমে গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

‘কিন্তু, পরোটা কার জন্য?’

‘আমার।’

‘আমি খাব না?’

‘তোমার জন্যও বানিয়েছি।’

পৃথা হেসে বলল,

‘আচ্ছা।’

,

নাস্তা শেষ করে অর্ণব বলল,

‘এখন শরীর কেমন তোমার?’

‘আগের থেকে একটু ভালো। ডাক্তার দেখিয়ে ছিলাম আমি। একটা টেস্টও করেছি। কিন্তু, রিপোর্টটা আর আনা হলো না।’

‘কোন হসপিটাল তুমি বলো, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।’

‘আমাকেও সাথে নিয়েন তাহলে।’

‘না, তোমাকে নিয়ে এখন বেরুনো সেইফ হবে না। তোমার বাবা নিশ্চয়ই এখন তোমাকে তন্য তন্য করে খুঁজছেন। এই সময় বাসায় থাকাই ভালো। বাইরে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর আপাতত তুমি অন্য একটা সিম ব্যবহার করো। পরে যদি সব ঠিকঠাক হয়, তোমার আগের সিমটা না হয় আবার আমি তুলে দিব।’

‘সিমটা তো রাখলেই পারতেন, ভেঙে ফেলার কী দরকার ছিল?’

‘না ভাঙলে, তোমার বাবা আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলতেন।’

‘ওহহ।’

‘ঠিক আছে তাহলে, তুমি চুপচাপ এখন বাসায় বসে থাক। আমি বাইরে যাচ্ছি। বেশিক্ষণ লাগবে না, চলে আসব।’

‘আচ্ছা।’

‘আর কেউ ধাক্কালে একদম দরজা খুলবে না, চাচা আসলেও না। বলবে, আমি বাসায় নেই, আমি এলে উনি যেন আসে।’

‘ঠিক আছে।’

‘আর শুনো, রান্নাঘরে যাওয়ার দরকার নেই। ভাত রান্না করে ফেলেছি, এসে তরকারি রান্না করব। চুপচাপ এই রুমে বসে থাকবে। এদিক ওদিক কোথাও যাবে না। আর সাবধানে ওয়াশরুমে যাবে। অবশ্যই সেন্ডেল ইউজ করবে। সেন্ডেলগুলো ভালো, স্লিপ কাটে না। আর হ্যাঁ, শরীর যদি একটুও খারাপ লাগে সঙ্গে সঙ্গে আমায় কল দিবে। এই যে এই বাটি টা দেখছ? বমি হলে এখানেই করবে, দৌঁড়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার নেই, স্লিপ খেয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পানির বোতলও এখানে রাখা আছে। আর ঐ ড্রয়ারে চিপস, বিস্কিট, আচার সহ বিভিন্ন শুকনো খাবার আছে, খিদে পেলে ওখান থেকে খাবে। রান্নাঘরে গিয়ে কিছু বানিয়ে খাওয়ার দরকার নেই। গ্যাস নেই, সিলিন্ডার ইউজ করতে না পারলে আরো বিপদ। তাই যা যা বলেছি তা যেন সব মনে থাকে। একটুও যেন আমার কথার নড়চড় না হয়। বুঝতে পেরেছ?’

পৃথা বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে বলে,

‘মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চাকে একা বাসায় রেখে যাচ্ছে। এত কিছু কেন বলছেন? আর এসব বল, বোতল কেন? আমি কি গিয়ে আনতে পারব না নাকি? কী যে করছেন আপনি? যেন, আমি কিছুই বুঝিনা, কিছুই জানিনা। আপনি নিশ্চিন্তে যান তো, আমি একদম ভালো ভাবে থাকতে পারব। এত ভয় পেতে হবে না, একা থেকে আমার অভ্যাস আছে।’

অর্ণব নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবে,

‘ভয় কী আর এমনি এমনি করি? এখন যে তুমি আর একা নও। তোমার ভেতর যে আমার ছোট্ট প্রাণটাও আছে। তোমাদের জন্য যে আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হয়।’

‘কী হলো? যান। আমি থাকতে পারব তো।’

‘আচ্ছা, যা যা বলেছি মনে রেখ। আমি কিছুক্ষণের মাঝেই আবার চলে আসব। দরজাটা আটকে দিয়ে যাও।’

অর্ণব বেরিয়ে যাওয়ার পর, পৃথা একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় বসে। তারপর তার ফোনে অর্ণবের দেওয়া পুরাতন সিম কার্ডটা ঢোকায়। ডায়েলে গিয়ে রুহার নাম্বার টা লিখতেই সে দেখে স্ক্রিনে রুহার নামটা শো করছে। সে অবাক হয়, এই সিমে আগে থেকেই রুহার নাম্বার কী করে সেইভ করা? সে সারার নাম্বার লিখে, দেখে সেটাও সেইভ করা। এমনকি নিলয়ের নাম্বারটাও। কিছুক্ষণের জন্য ব্যাপারটা খুব চিন্তায় ফেলে দেয় তাকে। পরে হঠাৎ মনে হয়, হয়তো অর্ণব’ই তার সুবিধার জন্য ওদের নাম্বার গুলো এই সিমে সেইভ করে দিয়ে গেছে। এটা ভেবে সে মনে মনে খুশি হয়। আর এই ভেবে মনে শান্তি লাগে যে, অর্ণবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে তার কোনো ভুল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তো, সে জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন ভালো মানুষকে পেয়েছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here