প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ৫

0
118

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৫

হৃদিতা নিজের বামে তাকাতেই আবরারকে দেখে বলে ওঠে,” আপনার বন্ধুকে সামলান আবরার সাহেব। তাকে বুঝিয়ে দেন আমি তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে পারব না। ”

আবরার আন্তরিকতার সাথে বলে,” দুঃখিত৷ এশার পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি।”

মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,” কী বলছো এসব, আবরার?”
” চুপ করো। তোমার এখানে আসতে হবে কেন? আমরা তো যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে তাই না? হঠাৎ করে তোমার এখানে আসার জন্য মন কাঁদলো কেন বলো তো? এত আনহাইজেনিক খাবার কেন খেতে হবে তোমার? আসলেও যেহেতু, দেখছো একজন বসে আছে তাকে তুলে দিয়ে কেন তোমার বসতে হবে? তুমি তোমার অভ্যাস…”

হৃদিতা আবরারকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” আপনার এই নিব্বি গার্লফ্রেন্ডকে বোঝান৷ তার বুদ্ধি হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে কম আছে নইলে বুদ্ধিহীন। এখান্র আমার সামনে না বুঝিয়ে রুমে নিয়ে তোতাপাখির মতো বোঝান।”

হৃদিতা চলে যেতে লাগলে পাশে থেকে এশা হাত খপ করে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। র*ক্তিমচোখে বলে,” কাজটা একদম ঠিক করলে না। পিঁপড়ের মতো পা দিয়ে পিষে পিষে মা*র*ব।”
” তাহলে তো আজই থানায় জিডি করে রাখতে হচ্ছে কখন মা*রা পড়তে হয় বা যে মা*রতে আসবে সে মা*রা পড়ে এসবের দায়ভার তো আমি নেব না। ”
” তোকে তো আমি…. ”

আবরার ধমক দিয়ে বলে ওঠে,” উফ কী শুরু করলে এশা? চলো তো এখান থেকে৷ আমরা যেখানে যাচ্ছিলাম আমি সেখানেই যাব।”

আবরার এশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রাস্তার পাশে রাখা গাড়িতে বসিয়ে কিছু একটা ভেবে হৃদিতার দিকে ফিরে যায়। হৃদিতা রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ আবরারকে পাশে দেখে হকচকিয়ে যায় সে।

সাগ্রহে বলে ওঠে,” কিছু বলবেন?”
” জি, অনুমতি দিলে বলতাম। ”
” সমস্যা নেই বলুন। আপনি তো আপনার প্রেমিকার মতো না তাই না?”
” আপনি ওকে ভুল বুঝেছেন। একটু রাগ বেশি তবে ভালো মনের মেয়ে। ”
” উনার বাহ্যিক, অঅভ্যন্তরীণ গুণাবলি জানাতে এসেছেন?”
” না, তা কেন হবে? আপনি বোধ হয় চাকরি খুঁজছিলেন। আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারব, একটু কষ্ট হবে তবে স্যালারি ভালো পাবেন।”
” ধন্যবাদ, আমি আমার ব্যবস্থা করে নেব। ”

হৃদিতা আর এক মুহূর্ত সেখানে দেরি না করে রাস্তা পার হয়ে চলে যায়। আবরার সেদিকেই পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে বুঝতে পারে এ মেয়ের আত্মসম্মান আর আত্মনির্ভরশীলতা প্রচুর।
_____

শীতল হাওয়া বইছে। চারপাশটায় অন্ধকারে পরিপূর্ণ। কিছুটা দূরে একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে। দোকানিরা দোকানের ঝাপ ফেলে বন্ধ করে বাসায় ফেরা শুরু করেছে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল অনেকটা কমে গিয়েছে।

ছাদে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ প্রকৃতির স্তব্ধতার সাক্ষী হিসেবে খাতায় নাম লিখিয়েছে৷ সুরাইয়া সেই কখন থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না কী দেখছে কে জানে!
তবে আশরাফ পলকহীন চোখে আকাশ দেখা নারীকে দেখে যাচ্ছে।

সুরাইয়া মাথা বাঁকিয়ে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” কী দেখছো?”
আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” তোমাকে।”
” ভালোবাসো?”
” ভালো না বাসলে সংসার করছি কেন?”
” সংসার না করেও তো ভালোবাসা যায় তাই না? মানুষ সংসার করে কেন বলো তো?”
” কী সব বলছ! সংসার না করলে ভালোবাসার পূর্ণতা কোথায়? ”
” আমাদের সংসার কতদিনের? ”

আশরাফ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে,” পাঁচমাসের। ”
” চার বছরের বিবাহিত জীবনে আমাদের সংসার পাঁচ মাসের। তোমার মনে হয় না আমাদের এবার মন দিয়ে সংসারটা করা উচিৎ? বিয়ের সময় আড়াইমাস আর তারপর একবার ছুটিতে এসেছিলে। আচ্ছা ডালভাতে সংসার চালানোর মতো টাকা হয়নি আমাদের?”

আশরাফ সুরাইয়ার দুইগালে আলতো করে হাত রেখে বলে,” এই তো এবারই শেষ। আর দুইটা বছর থেকে আসি তারপর শুধু তুমি আর আমি। দেশে ফিরে তখন জমানো টাকায় কিছু একটা শুরু করে দেব।”
” আমাদের এই হাজার মাইলের দূরত্ব আমার আর ভালো লাগে না, আশরাফ। ”
” এই দুইটা বছর দেখতে দেখতে চলে যাবে দেখো তুমি।”
” সত্যিই ফিরবে তো আমার কাছে?”
” পুরুষ তার ব্যক্তিগত নারীর কাছে না ফিরে যাবে কোথায়!” বলেই সুরাইয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয় আশরাফ। সুরাইয়া শ্বাস প্রলম্বিত করে নিশ্চিন্তে আশরাফের বুকে মাথা রাখে।
____

” আবরার সাহেব আমাকে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তিনি নাকি আমার জবের বিষয়টা দেখবেন। আমার মনে হয় এই অফারটা আমার কাজে লাগানো উচিৎ। ”

হৃদিতার কথা শেষ হতেই ওপাশ থেকে কেউ অল্পশব্দে বলে ওঠে,” আপনি আজ বিকেলে আমার সাথে দেখা করুন। ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা, আবরার সাহেবের বাসাটা কোথায় জানা আছে আপনার?”

হৃদিতা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে ঘষতে ঘষতে বলে,” স্যার, উনি যেহেতু সেরকম বড়ো কোন নেতা নন তাই এই বিষয়ে কারো তেমন আগ্রহ থাকার কথা না। তবুও আমি এখানে বাসা নেওয়ার আগেই খুঁজে নিয়েছি। উনি আমার বাসার সামনে দিয়েই যাতায়াত করেন। আমি বাসা দেখতে আসার দিনই এখানেই সামনের স্টলে দেখেছিলাম।”
” ঠিক আছে নজরে রাখবেন।
” জি স্যার। বিকেলে আমি অফিসে আসছি।”
” অফিসে না। আপনি ভার্সিটির সামনের রেস্টুরেন্টে বিকেল পাঁচটায় চলে আসুন।”
” জি স্যার।”

হৃদিতা ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে নিজেও বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। কপালে দুইহাত রেখে ভাবতে থাকে পরবর্তীতে কী কী করবে? অলসতা ঘিরে ধরার আগেই চটপট করে রেডি হয়ে নেয় হৃদিতা। আজ একজনের সাথে দেখা করার কথা আছে তার।
_____

দুইদিন পরে সুরাইয়া আর আশরাফ বাড়ি ফিরেছে। দুইটা দিন এতো তাড়াতাড়ি কেটে গেল যে এখনই সুরাইয়ার শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। আধাঘণ্টা আগে ময়না বেগম আশরাফ কল দিয়ে জানালো উনার নাকি শরীর খারাপ করেছে আবার তাই তো তড়িঘড়ি করে বাড়ির সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছে আশরাফ আর সুরাইয়া।

সুরাইয়া বাড়ি ফিরেই শাশুড়ির রুমে চলে যায় আশরাফের সাথে। রুমে গিয়ে দেখতে পায় ময়না বেগম বিছানায় নেই। আশরাফ ‘মা’ বলে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে ময়না বেগমের গলা শুনতে পাওয়া যায়। দুজনই সেদিকে এগিয়ে যায়।

রান্নাঘরের বাহিরে ধোয়া দিয়ে ছেয়ে গিয়েছে। আশরাফ হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সামনের পথটুকু পরিষ্কার করে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

ময়না বেগম রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। আশরাফকে দেখে বলে ওঠেন,” এসে গেছিস, বাবা?”

আশরাফের পরপরই সুরাইয়া এসে আশরাফের পাশে এসে দাঁড়ায়। ময়না বেগমকে রান্নায় ব্যস্ত দেখে বলে, ” মা, আপনি না অসুস্থ, রান্নাঘরে কী করছেন? ”
ময়না বেগম আশরাফের গালে হাত দিয়ে বলেন,” আমার ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই আসতে বলছি। তুমি ওখানে থেকে গেলেই পারতে।”

আশরাফ এতোক্ষণে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ারলি বুঝতে পেরে বলে,” মা, সে তুমি এমনি আসতে বললেই চলে আসতাম। মিথ্যার আশ্রয় কেন নিতে হবে তোমার?”
” চুপ কর তো। এমনি এমনি আসতে বললে তোর বউ আসতে দিত নাকি?”

” না, আসতে দিতাম না৷ দেবই বা কেন? আপনার ছেলেকে তো আমি আঁচলে বেধে রেখেছিলাম। ” সুরাইয়া এবার বেশ কড়া গলায় বলে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
” দেখেছিস তোর বউয়ের সাহস? বুলি ফুটেছে কেমন!”
আশরাফ একবার মাকে দেখে আর একবার সুরাইয়ার যাওয়া৷ দুইটা হাত মাথায় দিয়ে বলে,” তোমরাও না!”
_____

হৃদিতা সালোয়ার-কামিজের সাথে সাদা একটা ওরনা নিয়ে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখেও নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। ঠোঁটের গাঢ় লিপস্টিক মুছে হালকা করে নেয়। আর দেরি না করে বিছানার ওপর রাখা ফোন আর পার্সব্যাগটা নিয়ে রুমটা লক করে বেরিয়ে যায়। গতকাল সে আবরারকে কল করেছিল আবরার নিজেই তাকে আজ দেখা করতে বলেছে। হৃদিতা বাসার সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে নির্দষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায় রিকশা। হৃদিতা ভাড়া দিয়ে নিজের কাছে টাকার এমাউন্টটা একবার চেক করে নেয়। এখানে কিছু খাওয়া দাওয়া করলে টাকার সমস্যায় পড়তে হবে কি না সেটাও বুঝে নেয়।

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই একদম ভেতরের দিক থেকে একজন হাত উঁচিয়ে ডাকে। হৃদিতা সেদিকে খেয়াল করতেই দেখে আবরার বসে আছে। হৃদিতাও আর দেরি না করে সেখানে গিয়ে বসে।

আবরার হাতের ফোনটা টেবিলের ওপর উলটো করে রেখে বলে,” কেমন আছেন?”
হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” জি আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
” হুম ভালো আছি।”
আবরার খাবারের মেন্যু এগিয়ে দিয়ে বলে, ” নিন দেখুন তো কী নেওয়া যায়?”
” আপনার যেটা ইচ্ছে হয় সেটা নিন। আমার সবেতেই চলবে।”
আবরার মেন্যু দেখতে দেখতে বলে,” আপনি এখানে একাই থাকেন? বাসায় কে কে আছেন আপনার? ”

নিজের আসল পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে কি না ভেবে পায় না সে। হঠাৎ বলে ওঠে,” আমার বাবা-মা নেই। চাচার বাসায় ছিলাম প্রায় চার বছর। তারা বিয়ে দিতে চাইছে তাই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। পনেরো হাজার টাকার মধ্যে কোনো জব হলেই হয়ে যাবে। ”

আবরার খাবারের অর্ডার দিয়ে হৃদিতার দিকে তাকায়। একবার পর্যবেক্ষণ করে নেয় তাকে তারপর বলে,” সিভি এনেছেন?”
” জি।”

হৃদিতা ব্যাগ থেকে সিভি বের করে আবরারের হাতে দেয়। আবরার পুরো সিভিতে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। ফিরিয়ে দিয়ে বলে,” আপনার বাবা-মা কবে মারা গিয়েছে?”

হৃদিতা চকিতে বলে দেয়,” কভিডে। দুজন একসাথে আক্রান্ত হয়েছিল।”
” আচ্ছা আচ্ছা। কম্পিউটার ইউজ করতে পারেন তো তাই না?”
” জি।”
” ঠিক আছে। আমি রাতে আপনার সাথে কথা বলে নেব। ”

হৃদিতা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে। আবরার আবার বলে,” এশার সাথে সাথে থাকতে পারবেন?”

হৃদিতা বুঝতে না পেরে বলে ওঠে,” স্যরি! বুঝতে পারিনি।”
” এশার সাথে থাকতে হবে পারবেন? যার সাথে সেদিন আপনার ঝগড়া টাইপ বেধেছিল। ”

হৃদিতা মুখ গোমড়া করে বলে,” এই বাচ্চা মেয়েটাকে সিংহীর কাছে দিবেন?”
হৃদিতার কথা শুনে আবরার হো হো করে হেসে ফেলে। হৃদিতা মাথানিচু করে ছিল। আবরারের হাসি শুনে সামনে তাকালে আবরারের হাসিমাখা মুখটা দেখে একপলকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে কী সুন্দর হাসতে পারে এই লোকটা!

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here