#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৪
রাসেল শেখ-এর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভ্যাস আছে। ঘুম ভেঙে গেলে তিনি হয়তো টুকিটাকি লিখতে বসেন নইলে সমস্ত রুম হেটে বেড়ান। অন্যসব দিনের মতো আজও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ডাইনিং টেবিল থেকে পানির বোতলটা নিয়ে রুমে ঢুকবেন ডানপাশে চোখ যেতেই দেখেন মেয়ের রুমের দরজা খোলা। বোতলটা রেখে হৃদিতার রুমের দিকে চলে যায় রাসেল শেখ। ভেতরে ঢুকে মেয়েকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখেন হৃদিতা বেলকনিতে রাখা সোফায় ঘুমিয়ে গিয়েছে। রাসেল শেখ আর মেয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে বিছানা থেকে পাতলা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যান।
রাসেল শেখ চলে যাওয়ার সাথে সাথে হৃদিতা উঠে বসে। হাতে থাকা ফ্রেমটায় হাত বুলিয়ে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে…
Mujhe neend aati nahi hai akele
Khwabon mein aaya karo
Nahi chal sakunga tumhare bina main
Mera tum sahaara bano
Ik tumhein chahne ke alaawa
Aur kuch humse hoga nahi
Bol do na zara
Dil mein jo hai chhipa
Main kisi se kahunga nahi
Main kisi se kahunga nahi
____
” বুঝি না বাপু, আগে দুইজন বন্ধু ছিলে। ইন্টার থেকে একসাথে অনার্স কমপ্লিট করেছ, আগে তুই করে কথা বলতে আর এখন আপনি করে তো বলোই উমেদের সামনেই আসতে চাও না।”
খাবার টেবিলে বসে ময়না বেগম রুটির টুকরো মুখে দিয়ে কথাখানা সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে বলেন। সুরাইয়া আশরাফের পাশে বসেই নাস্তা করছিল। মাথায় ওরনা কপাল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া। মাথানিচু করে নিজের প্লেটের দিকেই তাকিয়ে নাস্তা করছিল। শাশুড়ির কথায় মাথা তুলে আশরাফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার শাশুড়ির দিকে তাকায়।
উমেদ মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” মা, এখন ও আমার বড়ো ভাবি। আগের মতো আচরণ করা তো শোভা পায় না। ”
” কী জানি বাপু, এসব নিয়ে তো কোনোদিন কিছু বলিনি। ননদের সাথে যেভাবে চলে দেবরের সাথেও তো একটু বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ থাকতে হবে। কেমন গা ছাড়া ভাব।”
সুরাইয়া খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় বলে,” আম্মা, আগে কী ছিল না ছিল সেটা বাদ। এখন উমেদ আমার দেবর৷ দেবরের সাথে মাখোমাখো সম্পর্ক মেইনটেইন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের সম্পর্কটা যে খারাপ সেরকম তো না আর চার বছর হয়ে গেছে উমেদে সেরকম বাড়িতেও আসে না। দূরত্ব তো একটা সৃষ্টি হয়েছেই তাতে। আমার মনে হয় আমার ব্যবহারে উমেদের খারাপ লাগারও কিছু নেই।”
ময়না বেগম কথার পৃষ্ঠে বলে ওঠেন,” বাদ দাও। তোমার শরীর কেমন এখন?”
” জি আম্মা, ভালো। আমি আপনাকে বলেছিলাম একটু বাড়ি যাব। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার বড়ো ছেলের সাথে আমার একটু ঘুরে আসতাম। ”
” ঠিক আছে। বিকেলে চলে যেও।”
” শুকরিয়া আম্মা।”
সুরাইয়া উঠে চলে গেলে আশরাফ বলে,” মা, আমি তাহলে আর আজ ফিরব না। বিকেলে গেলে শাশুড়িও আসতে দিতে চাইবে না। তখন কল দিয়েছিল যাওয়ার কথা শুনে কতকিছুর যে আয়োজন করা শুরু করেছে!”
” দেখিস বাপ, শাশুড়ির ভালোবাসায় মাকে ভুলে যাস না আবার।”
” মা কী যে কও না! সবাই তো নিজের নিজের জায়গায় আছে কারো মতো কেউ হয় না। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তোমার ছেলে এত ভালোবাসা পাচ্ছে।”
ময়না বেগম আর কিছু না বলে প্রস্থান করেন। আশরাফ উমেদকে উদ্দেশ্য করে বলে,” সুরাইয়ার সাথে তোর কিছু হয়েছে? বিয়ের আগে ভেবেছিলাম দুজন মিলেমিশে থাকবি আর এখন দেখছি কেউ কারো মুখটাও দেখছিস না!”
উমেদ চকিতে বলে ওঠে,” তোর তো ভাগ্য ভালো ভাইয়া। তোর বউ মাহরাম, নন-মাহরাম মেনে চলার চেষ্টা করতেছে। শুধু আমার সাথে না সবার সাথেই এমন করে আর তোদের চোখে শুধু আমিই পড়ি তাই না?”
” তাই বলে তুই থেকে সোজা আপনি!”
দুপুরে খাওয়া শেষ করে একটা ঘুম দেওয়া হৃদিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন বাসায় প্রয়োজনীয় আসবাব পরশু তুলেছে সে।৷ তবে সেখানে আজ ওঠার কথা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো তার একটু বের হওয়া প্রয়োজন৷ বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা নাহার বেগমের কাছে চলে গেল সে। নাহার বেগম বসে বসে নিজের হাতের কাজ করছিলেন।
হৃদিতা পাশে বসে বলে,” আম্মু চলো বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।”
নাহার বেগম কাঁথায় সেলাই শেষ করে বলেন,” আমার আজ অনেক কাজ মা। এখন উঠে রান্না করতে হবে। ”
” ভাবলাম একটু খাওয়া দাওয়া করে আসি।”
” সুরাইয়া- আশরাফ যায় কি না দেখো।”
” কাপলের সাথে গিয়ে কী করব?”
” উমেদকে চেপে ধরে নিয়ে যা, মা। আমার হাতে সময় নেই।”
হৃদিতা সোজা আশরাফদের বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে ঢুকতেই ময়না বেগমের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। সুরাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানায় সুরাইয়া বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। বের হওয়ার আর কোনো উপায় নেই দেখে সুরাইয়ার সাথে দেখা করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় উমেদের সাথে দেখা হয়ে যায়।
উমেদ হৃদিতাকে দেখেই বলে,” কী রে কী খবর? দেখাই যায় না যে তোকে!”
” বাসায় গিয়েছিস যে দেখবি?”
” তুইও তো আসিসনি। ”
” না আসলে দেখলি কীভাবে? বিয়ে কর বিয়ের এক সপ্তাহ চোখের সামনে থেকে নাচগান করব। ”
” বিয়ে করে ম*রতে চাই না। সিঙ্গেল আছি ভালো আছি। তুই বিয়ে করছিস কবে?”
” আপাতত ওসব নিয়ে আর ভাবছি না।”
” কাকা বলল তোর নাকি জব হয়েছে?”
” হ্যাঁ, এই তো অল্পকিছু দিন।”
” কাজ কী তোদের?”
” এই যে ধর কিছু অ*ন্যায়কারী বহাল তবিয়তে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ চাইলেও কিছু করতে পারছে না তখন সেই কাজটা আমাদের কাছে চলে আসে। প্রমাণ যোগাড় করা আমাদের কাজ। পুলিশ যখন কিছু করতে পারে না তখন তাদের কাজটা আমাদের করতে হয়।”
” ভালোই হয়েছে ইথারের জবটা পেয়ে গেছিস তুই। শুনলাম বাসা নিয়েছিস।”
” ইথারের জবটা পাইনি তবে ওর জন্যই আমার এপথে আসা৷ আর হ্যাঁ আজ চলে যাব। একটা কেস এসেছে হাতে। বাসায় থেকে যাতায়াত করা মুশকিল। যখন তখন কেউ সন্দেহের বশে ফলো করলে পরিবারের জন্য বিপদ।”
দুজনের মাঝে বেশকিছুক্ষণ কথা চলে৷ উমেদ জানায় সন্ধ্যায় সে নিজে গিয়ে হৃদিতাকে শহরে রেখে আসবে। হৃদিতাও উমেদের কথায় রাজি হয়ে যায়।
____
চারদিকে অন্ধকার, আকাশে স্বল্প দৈর্ঘের একটা চাঁদ মাঝেমাঝে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে। সন্ধ্যা পর বাবা-মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে উমেদের সাথে বেরিয়েছে হৃদিতা। উমেদের বাইক একই গতিতে চলছে। তাদের বাড়ি থেকে শহর পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। উমেদের বাইকে গতি বেশি রাখা হয়েছে বিধায় আধাঘন্টার মাঝেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। হৃদিতা বাইক থেকে নামতেই বলে, ” ভাইয়া, এখানেই পাশে একটা ছোটো মাঠ আছে জানিস? দারুণ স্ট্রিটফুড পাওয়া যায়। খাবি?”
উমেদ বাইক থেকে নেমে হৃদিতার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে,” এখন! আমার আবার ফিরতে হবে।”
” ধুর, তুই কি মেয়ে নাকি যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে তোর? চল বাহিরে খাওয়া দাওয়া করে চলে যাবি তখন আর আটকাবো না আর এমন তো না যে তোকে এখানে প্রতিদিন পাওয়া যাবে।”
উমেদ এক দৃষ্টিতে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। চার বছর আগে একটা মেয়ে যে কি না তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল সেই মেয়েটাও ঠিক এরকমই আবদার করে বসতো। আজ তার জীবনে ওরকম আর কেউ জায়গা করে নিতে পারেনি। আগের সেই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটা কত নিরব আর জেদি হয়ে গিয়েছে ভাবতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
উমেদকে চুপ থাকতে দেখে হৃদিতা আবার বলে ওঠে,” মাঝেমাঝে এমন সাইলেন্ট হয়ে যাস কেন? যাবি নাকি এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”
উমেদ হাটা শুরু করে বল,” চল যাচ্ছি।”
মেইনরাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকেই হৃদিতার বাসা। তিনতলা বিল্ডিংয়ের বাড়িটার চিলেকোঠার পাশেই একটা ছোটরুম নিয়েছে সে। বাসায় জিনিসপত্র, ব্যাগ রেখে দুজনই আবার বেরিয়ে আসে। হৃদিতার বাড়ির সামনেই যে রাস্তাটা আছে তার বিপরীত পাশেই মাঠটা।
উমেদ আর হৃদিতা মাঠে বেশ খানিকটা সময় পার করে। দুইজন চাচাতো ভাইবোন হলেও প্রগাঢ় একটা সম্পর্ক রয়েছে তাদের মধ্যে। হৃদিতার নিজের ভাই নেই বলে উমেদকেই সে ছোটবেলা থেকে ভাই বলে জেনে এসেছে। তার সাথে ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে সে। কয়েকটা বছর হলো তাদের এই দারুণ সম্পর্কে অনেকটা দূরত্ব বেড়েছে। উমেদও ঠিকমতো বাড়ি আসে না, হৃদিতার জীবনেও কিছু অঘটন সব মিলিয়ে দুজন দুদিকে ছিটকে পড়েছিল।
দুজন খুব ভালো সময় কাটিয়ে হৃদিতার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
হৃদিতা পাশের চেয়ারের ওপর থেকে নিজের ফোন আর বাসার চাবিটা নিয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই একটা মেয়ে এসে পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে আঙুলের ইশারায় হৃদিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” জলদি চেয়ার ছাড়ো মামনি৷ এখানে লোক আছে।”
হৃদিতার কাছে কথাটা ভালো লাগে না। মেয়েটার কথা শুনেও যেন না শোনার অভিনয় করে সেখানেই আবার ঠিকঠাক করে বসে ফুসকাওয়ালাকে ডেকে বলে,” মামা, ফুসকাটা জোশ ছিল আরেক প্লেট দেন তো।”
পাশে থাকা মেয়েটা ভ্রু কুচকে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলে,” উঠতে বললাম না?”
হৃদিতা এবার তার দিকে নজর ফেলে বলে,” আমাকে বললেন?”
” হ্যাঁ, তোকে।”
” স্যরি গার্ল। এখানে আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে আছি। আপনার সমস্যা হলে অন্যকোথাও বসুন।”
” আমি উঠতে বলেছি মানে তোকে উঠতেই হবে। আমার মুখের ওপর কথা বলার দুঃসাহস দেখাস না।”
” দেখালে?”
মেয়েটা থাপ্পড় দিতে হলে হৃদিতা মেয়েটার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,” এতো রাগ ভালো না। কেউ আপনার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে বসে নেই এখানে।”
পাশে একজন পুরুষ উপস্থিত হতেই মেয়েটা বলে ওঠে,” দ্যাখো জান, মেয়েটা উঠছে না। বাজে ব্যবহার করছে আমার সাথে।”
হৃদিতা নিজের বামে তাকাতেই আবরারকে দেখে বলে ওঠে,” আপনার বন্ধুকে সামলান আবরার সাহেব। তাকে বুঝিয়ে দেন আমি তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে পারব না। ”
#চলবে……