#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৭
“আপনাকে চুমু খেতে চেয়েছি? এভাবে তাকানোর কী আছে? মেয়েদের এভাবে তাকাতে নেই। মেয়েদের নতুন বউয়ের মতো তাকাতে হয় সব সময়।”
অভ্রর কথায় বিস্ফোরিত চোখে তাকায় হৃদিতা। ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,“মশকরা করছেন আমার সাথে? সামনের সিটে আমার বাবা-মা আছে। সিন ক্রিয়েট করলে….”
হৃদিতাকে থামিয়ে দিয়ে গলা উঁচিয়ে সামনের দিকে আন্টি আন্টি করে ডাকতে থাকে অভ্র। নাহার বেগম মাত্রই একটু ঘুম ঘুম ভাবে এসেছিলেন। পিছনের সিট থেকে ডাক শুনে সেদিকে তাকায়।
অভ্র বলে ওঠে,“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। পানি হবে?”
নাহার বেগম একবার হৃদিতার দিকে আরেকবার অভ্রর দিকে তাকাচ্ছিল। অতঃপর ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,“নাও।”
অভ্র বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ কিছু পরিমাণ পানি খেয়ে নেয়। বোতলে ক্যাপ আটকে নাহার বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“আন্টি আমি আমার পানির বোতলটা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার মেয়ের থেকে একটু চাইলাম উনি এমনভাবে তাকালো যেন আমাকে খেয়ে ফেলবে।”
নাহার বেগম মৃদু হেসে বলে,“ ও একটু ওরকমই। তা তুমি যাচ্ছ কোথায়? তোমাকে চেনা চেনা লাগছে।”
“আমি এই তো আমার মামাবাড়ি যাচ্ছি। মামাতো ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মহেশপুর বাড়ি। আমার মামা আরজ আলী।”
হৃদিতা নাহার বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,“আম্মু, উনি খালামনিদের বাড়ি যাচ্ছে?”
অভ্র নাহার বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,“আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”
নাহার বেগম মৃদু হেসে বলে,“আমরাও একই বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি কি আসরিফের ফুফাতো ভাই?”
অভ্র ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“হ্যাঁ।”
“আমি আসরিফের খালা তোমাকে হয়তো তোমার ছোটবেলায় দেখেছিলাম। আগে তো আপার শ্বশুরবাড়ি অনেক যাওয়া আসা হতো এখন অনেকদিন আর সম্ভব হয় না।”
অভ্র হেসে বলে, “তাহলে ভালোই হলো। একসাথে কয়েকটা দিন কাটানো যাবে।”
“তুমি একা যাচ্ছ? তোমার মা-বাবা যাবে না?”
“আব্বু-আম্মু তো ছোটবোনের জিদের জন্য আজ সকালেই চলে গেছে। আমিই পরে যাচ্ছি।”
“কী করছ এখন?”
“আন্টি, আমি ঢাকাতে একটা প্রাইভেট কম্পানিতে জব করছি দুই বছর হবে।”
“বাহ ভালো তো।”
তাদের মধ্যে কথা চলতে থাকে ওদিকে হৃদিতা কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে শুরু করে দিয়েছে।
~
পরপর কয়েকটা দূর্ঘটনার খবর দেখে আশরাফ নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা দূরে কোথাও আপাতত কয়েকদিনে আর ঘুরতে যাবে না। সুরাইয়া ভয়ে ভয়ে একটা ইচ্ছে জানাতে বারবার আশরাফের কাছাকাছি থাকছে কিন্তু বলতে পারছে না।
আশরাফ একটু বন্ধুদের সাথে বের হবে জন্য তৈরি হচ্ছিল। সুরাইয়া ঘড়িটা এগিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলে,“অভয় দিলে একটা কথা বলতাম।”
আশরাফ চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,“অভয় দিলাম, জলদি বলে ফেলো।”
“মা কল করেছিল। বলল আপনাকে আর আম্মাকে নিয়ে বাড়ি যেতে কালকে। আম্মা তো অনেকদিন আমাদের বাড়িতে যায় না। ”
আশরাফ সুরাইয়ার দিকে ফিরে বলে,“হ্যাঁ, ভালো কথা। এটা বলতে এত ভয় কেন?”
“আম্মা কি যাবে?”
“বলে দেখো, যাবে হয়তো।”
“আমার ভয় লাগে। ”
“এখানে ভয়ের কী আছে?”
“যদি ধমকে চুপ করিয়ে দেয়।”
“দেবে না।”
“নিশ্চিত?”
“বলেই দেখ।”
আশরাফ রেডি হয়ে ওয়ালেট নিয়ে বের হতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে যায়। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় সুরাইয়াকে কাছে ডাকে। সুরাইয়া আশরাফের দিকে এগিয়ে যায়। আশরাফ সুরাইয়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে,“বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে না বের হলে নিজেকে বিবাহিত বিবাহিত লাগে না।”
আশরাফের কথায় ফিক করে হেসে ফেলে সুরাইয়া। আশরাফ সুরাইয়ার হাসি দেখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাহিরে চলে যায়।
আশরাফ চলে যেতেই সুরাইয়া নিজের ফোনটা নিয়ে ময়না বেগমের রুমে প্রবেশ করে। ময়না বেগম শুয়েই ছিলেন, সুরাইয়াকে দেখে উঠে বসেন।
গম্ভীরস্বরে বলেন,“কিছু বলবে?”
সুরাইয়া ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“বলতে চাচ্ছিলাম।”
“বলে ফেলো।”
“আসলে আমার মা কল দিয়েছিল।”
“হ্যাঁ, তারপর? তুমি মায়ের বাড়ি যাবে?”
“ আমি না, আমরা। ”
“তুমি আর আশরাফ? যাবে, যাও।”
“মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। অনেকদিন তো যান না আমাদের বাড়িতে। ”
ময়না বেগম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলেন,“তোমার মাকে বইলো আমার জন্য যেন কয়েকটা নারকেলের নাড়ু বানিয়ে রাখে।”
সুরাইয়া কিছুক্ষণ স্থিরচোখে ময়না বেগমের দিকে চেয়ে থাকে তারপর মৃদু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
__
স্টেশনে এসে ট্রেন থামে। রাসেল সাহেব সারা রাস্তা ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে। ট্রেন থামতেই উঠে দাঁড়ান তিনি। নাহার বেগম আর তিনি নিজেদের সিট থেকে উঠে দাঁড়ান। অভ্র এতক্ষণ ট্রেনের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাগ নিতে সিটের দিকে এগুতে থাকে। হৃদিতা তখনও ঘুমুচ্ছে।
রাসেল সাহেব মেয়েকে ডেকে তুলতেই অভ্র এসে দাঁড়ায়।
নাহার বেগম রাসেল সাহবকে অভ্রকে দেখিয়ে বলে,“তোমার সাথে তো পরিচয় করিয়েই দিতে পারিনি। এটা অভ্র। আসরিফের ফুফাতো ভাই।”
দুজনের মাঝে সালাম বিনিময় হলে রাসেল সাহেব ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে বলে ওঠেন,“চলো চলো বের হই। বের হয়ে কথা হবে। ট্রেন এখনই আবার ছেড়ে দেবে।”
অভ্র রাসেল সাহেবের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,“আঙ্কেল ব্যাগ আমার কাছে দিন। আমি থাকতে আপনি ব্যাগ নিয়ে এগুবেন এটা ভালো দেখা যায় না।”
রাসেল সাহেব হেসে মৃদু গলায় বলেন,“ও সমস্যা নেই। তুমি চলো।”
নাহার বেগম এবং হৃদিতা আগে আগে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে দাঁড়ায়। অভ্র রাসেল সাহেবের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে,“চলুন।”
চারজন স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে এসে একটা অটো ঠিক করে নেয়। হঠাৎ কিছু মনে হতেই অটোতে ব্যাগগুলো রেখেই ট্রেনের দিকে দৌঁড় দেয় অভ্র। হৃদিতাসহ কেউ কিছু বুঝতে না পেরে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। সোজা ট্রেনের কামরায় ঢুকে যায় অভ্র। ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। রাসেল সাহেব কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অভ্রর দিকে এগিয়ে যায়। ট্রেন যখন ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়ছে তখনই ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে অভ্র।
স্টেশনে নেমেই হাটুতে দুই হাত দিয়ে সমস্ত শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে। রাসেল সাহেব ততক্ষণে অভ্রর কাছে পৌঁছে যায়। রাসেল সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,“এটা কি গিটার? এটার জন্য এভাবে দৌঁড়াচ্ছিলে?”
অভ্র মাথা উঁচিয়ে বলে,“এটা ছাড়া আমার বিয়েতে যাওয়াই বৃথা স্যার।”
রাসেল সাহেব মৃদু হেসে বলেন,“চলো এবার।”
গাড়ি এসে একটা ব্রিজের পাশে এসে থামে। বিয়ে বাড়ি এখানে এখনো দুই মিনিটের পথ। গাড়ি এখানেই থেমে যেতে রাসেল সাহেব বলে ওঠেন,“গাড়ি এখানে থামালেন কেন ভাই? আরেকটু পথ বাকি তো।”
গাড়িচালক ফিচেল হেসে বলে ওঠে,“ভাই, গাড়ি ভেতরের দিকে যাবে না। এটুকু রাস্তা আপনাদের হেটেই যেতে হবে।”
অভ্র পাশে থেকে বলে ওঠে,“এটা কেমন কথা? গাড়িতে ওঠার সময় তো বলেই উঠলাম আমরা।”
গাড়িচালক আবার বলে,“গাড়ি আর যাবে না। আপনাদের এখানেই নামতে হবে।”
অভ্র আবার কিছু বলবে তখনই রাসেল সাহেব ইশারায় অভ্রকে থেমে যেতে বলে। অভ্র আর কিছু বলে না।
গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগগুলো নামিয়ে নিয়ে সবাই হাটা শুরু করে। রাসেল সাহেব এবং অভ্র আগে আগে গল্প করতে করতে হাটতে থাকে।
হৃদিতা এবং নাহার বেগম তাদের পিছনে হাটছে।
হৃদিতা হাত দিয়ে মাকে কিছু দেখাচ্ছিল। রাসেল সাহেবকে ডাকতে অভ্রও পিছনে ফিরে তাকায়। পিছনে একটা মাইক্রোকে দেখতে পায় সে। হৃদিতার কাছ ঘেষেই আসবে বুঝতে পেরে দৌঁড়ে গিয়ে হৃদিতাকে সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় কিন্তু নিজে সরে যাওয়ার আগেই মাইক্রো গাড়িটা অভ্রকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। রাস্তার পাশেই ছিটকে পড়ে সে।
মাটিতে থেকেই ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,“একটু দেখে হাটতে পারেন না? কী হয়ে যেত এখনই!”
চলবে…..