#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৫
হৃদিতা কেবিনের দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করে বেশ কয়েকজন ডাক্তার নার্স এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করছে। আজহার সাহেব একজন নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন,“কী হয়েছে এদিকে? এমন ছুটোছুটি করছেন কেন?”
নার্স কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। বলে ওঠে,“আপনারা কোথায় ছিলেন, স্যার? এশা ম্যাডামের কেবিনে তখন কেউ ছিল না। এই সময়টুকুর মাঝেই অঘটন ঘটে গিয়েছে। পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে।”
আজহার রেজা পুনরায় জিজ্ঞেস করে,“কী হয়েছে সেটা বোধ হয় জানতে চেয়েছিলাম।”
“স্যার ওদিকে যান সব জানতে পারবেন। আবরার সাহেব নিজেই এশা ম্যাডামকে খুন করেছে, উনার অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছে আর তিনি নিজেও হাতের শিরা কে*টে সুইসাইড করেছে। ”
মাথায় যেন বাজ পড়ে হৃদিতার। এমন একটা ঘটনা ঘটবে সেটা সে কোনোভাবেই কল্পনা করেনি। নার্সের কথা যেন কিছুইতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
হৃদিতা বিষয়টা আরও বেশি পরিষ্কার হতে বলে ওঠে,“দুজনই মৃত?”
নার্স হৃদিতার চোখে চোখ রেখে বলে,“ইয়েস ম্যাম, আপনার পরিশ্রম বৃথা। তারা এখন মৃ*ত।”
আজহার সাহেব হৃদিতাকে ডেকে দ্রুত কেবিনের দিকে হাটা শুরু করে। হৃদিতা হতবিহ্বলের মতো একপা-দুপা করে ধীর গতিতে হাটছে। তার মনে একই ধরণের প্রশ্নই দানা বেধেছে,“এটা আদৌ ভালোবাসা? ভালোবাসলে কি ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়া যায়? ভালোবাসলে যেখানে ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি বুকে কালবৈশাখী ঝড় তুলে দেয় সেখানে মৃ*ত্যুর কারণ?”
নাহ, হৃদিতা আর ভাবতে পারছে না। পা থামিয়ে দেয় সে। স্থীরচোখে মেঝেতে চেয়ে থাকে। ভাবতে থাকে এ পৃথিবীতে আর কী কী দেখা বাকি তার?
হৃদিতা ফোনটা বের করে আজহার সাহেবকে একটা টেক্সট দেয়। লেখে,“স্যার, আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমি এরকম নির্মম ভালোবাসার সাক্ষী হতে চাই না। আমার পোষাবে না।”
হৃদিতা আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। এই ক’টা দিনকে জীবনের কালো অধ্যায় মনে করে সেই মুহূর্তে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনে নিজের গন্তব্যে ফিরতে থাকে সে।
দুইদিন হলো আশরাফ তার মায়ের সাথে কথা বলে না, একসাথে খাবার টেবিলে বসে খায়ও না। মাকে দেখলেই স্থান ত্যাগ করে।
জানালার পাশে বসে আশরাফ সুরাইয়ার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিল। ময়না দরজা নক করতেই আশরাফ সুরাইয়ার কাছে থেকে দূরে সরে বসে।
সুরাইয়া দরজার দিকে এগিয়ে এসে বলে,“আসুন, আম্মা।”
ময়না বেগম ঘরে প্রবেশ করতেই সুরাইয়া একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে,“বসুন।”
ময়না বেগম চেয়ার টেনে বসে। আশরাফকে উদ্দেশ্যে করে বলে,“তোদের যাওয়া,আসা আর থাকা সব মিলিয়ে কত টাকা খরচ হবে?”
আশরাফ সিরিয়াস ম্যুডেই বলে,“এখন আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমার বা আমাদের জন্য টাকা খরচ করতে হবে না, আম্মা। ওগুলো রেখে দাও।”
“আমি জানতে চেয়েছি, আশরাফ।”
“জেনে কী করবে?”
“সেটা তোর জানার প্রয়োজন নাই। আশা করব আমার মুখে মুখে কথা বলবি না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল।”
“পঁচিশ-ত্রিশ হাজার।”
“যাওয়ার ব্যবস্থা কর তবুও আমার সাথে এরকম মুখ গোমড়া করে থাকিস না।”
“আমি মুখ গোমড়া করে আছি, কথা বলছি না এজন্য তুমি যেতে বলছো?”
“সেটা তোমার ভাবতে হবে না। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো আর তোমরা ফিরে আসলে উমেদের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখব।”
সুরাইয়া এ পর্যায়ে বলে ওঠে,“এটারই অপেক্ষায় ছিলাম। উমেদ তো এখন ভালো একটা জব পেয়েছে। তাছাড়া বাড়িতে একটা সঙ্গী হলে আমারও সময় কাটবে।”
ময়না বেগম গম্ভীরস্বরে বলেন,“হুম। তুমি আমার সাথে এসো আমি টাকা বের করে দিচ্ছি। আসার সময় শুটকি মাছ বেশি করে নিয়ে আসবে, বুঝেছ?”
সুরাইয়া আশরাফের দিকে তাকায়। আশরাফ ইশারায় যেতে বললে সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,“ কোন কোন মাছের শুটকি খাবেন বলেন তো, আম্মা? যেগুলো খেতে চাইবেন সে সবগুলোই নিয়ে আসব।”
ময়না বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভ্রু কুচকে বলে,“ কোন কোনগুলো খাব মানে? যেগুলো পাবে সবই নিয়ে আসবে। আমি কিছু টাকা বেশি দিয়ে দিচ্ছি একদম কিপ্টেমি করবে না খাওয়া, থাকায়। সব জায়গায় ঘুরে আসবে, মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে আসবে, বাড়ি ফিরে আমাকে সব দেখাবে।”
সুরাইয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“ঠিক আছে, আম্মা।”
“তোমার বরকে বলবে এরকম গাল ফুলিয়ে যেন না থাকে।” কথাটা বলতেই ময়না বেগমের গলা ভারি হয়ে আসে। আশরাফ এবার স্থির হয়ে বসে থাকতে ব্যর্থ হয়। বসা থেকে উঠে এসে মায়ের সামনে দাঁড়ায়।
আশরাফ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের দুই কান ধরে অসহায় ভঙ্গিতে বলে ওঠে,“ স্যরি মা, তুমিই তো অবুঝের মতো আচরণ করো। কী করব বলো? আমরা এই বয়সে ঘুরাফেরা না করলে কখন করব বলো? টাকা তো কম উপার্জন করি না। আর এমন করব না, মা। স্যরি। তোমাকে বুঝানোর জন্যই আমি এমন করেছিলাম।”
ময়না বেগম আশরাফের হাতে ক্রমাগত মারতে থাকে আর বলতে থাকে,“তুই আমার সাথে কথা বলবি না। তোর কাছে আমার কোনো মূল্যই নেই। এখন আর ভালোবাসিস না। ”
আশরাফ হাসতে হাসতে মাকে জড়িয়ে ধরে। সুরাইয়া একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে আর মায়ের কর্মকান্ড দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
ময়না বেগম ছেলের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আশরাফ কিছুতেই ছাড়ছে না।
ময়না বেগম থামাথামির নাম না নিলে আশরাফ বলে ওঠে,“সুরাইয়া, একটা রশি নিয়ে এসো তো। এমনিতে তো মা স্থির হবে না, বেধে রাখতে হবে।”
আশরাফের কথা শুনে সুরাইয়া ফিক করে হেসে ফেলে। ময়না বেগম ধমকের সুরে বলে ওঠে,“থামো, তুমি হাসছো কেন? মজা নিচ্ছ, না?”
সুরাইয়া মুখ টিপে হাসতে থাকে। আশরাফ সুরাইয়াকে বলে,“তুমি রুমেই থাকো, আমি মানি নিয়ে আসছি। আজকে আমি আমার আম্মার ব্যাংকে আগু*ন লাগিয়ে দেব। আম্মাকে ফকির বানিয়ে দেব।”
আশরাফ হাসতে হাসতে ময়না বেগমকে নিয়ে চলে যায়। ঘরে ঢুকেই ময়না বেগম আশরাফের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আলমারির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই আশরাফ মায়ের হাত ধরে সোফায় নিয়ে বসায়।
আশরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,“আম্মা, সুরাইয়ার সাথে ভালো ব্যবহার করা যায় না?”
ময়না বেগম মুহূর্ত কয়েক নিরব থেকে বলে ওঠে,“আমি সবই বুঝি। তুই আমার বড় ছেলে, সবসময় শুধু মনে হয় তুই যদি তোর বউয়ের কথা শুনে আমাকে দূরে সরিয়ে দিস তাই তো আমি…”
আশরাফ ময়না বেগমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,“মা, আমি কখনো তোমার পর হবো না। তুমি আমাকে পেটে ধরেছ আর সে আমার সারাজীবনের সঙ্গী। দুজনই দুইভাবে আমার খুব কাছের। তোমাদের কাউকেই আমি ছাড়তে পারব না। তুমি কখনো নিজেদের মধ্যে তুলনা করবে না। তোমরা দুজন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছো। তোমরা শাশুড়ি-বউমা একসাথে মিলেমিশে থাকবে, হাসিখুশি থাকবে এখানেই আমার শান্তি। তাছাড়া সুরাইয়া তার বাড়ির মানুষকে রেখে এখানে এসে থাকে। সে তো তোমার আদর ভালোবাসা চাইতেই পারে। তুমি মায়ের মতো ব্যবহার করে দেখো সুরাইয়া মেয়ের মতো ব্যবহার করবেই৷ সে যদি না করে সেটা আমি দেখব। আমার এই পরিবেশ একদম ভালো লাগে না, মা। ”
মা-ছেলের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা চলে। আশরাফ ছোটো বাচ্চার মতো মাকে ভালো-মন্দ বুঝাতে থাকে। ময়না বেগমও বিনাবাক্যে ছেলের কথা শুনতে থাকে।
সুরাইয়া রুমে অনেক্ষণ অপেক্ষা করছে আশরাফের জন্য। ভেতরে ভেতরে চিন্তা হচ্ছে। ভাবছে কী হচ্ছে ও ঘরে, এতক্ষণ কেন লাগছে! যখন দেখলো আশরাফ আসছে না তখন সে রুম থেকে বেরিয়ে শাশুড়ির রুমের সামনে এসে বলে,“আপনারা কি চা খাবেন? চা করে দেব দুজনকে দুইকাপ?
ময়না বেগম গম্ভীরস্বরে বলে ওঠে,“ দুই কাপ কেন? তিনজনের জন্য তিন কাপ নিয়ে এসো। গলা শুকিয়ে গেছে। ”
#চলবে….