#প্রেমময়_পিপাসা
#স্বপ্না_ফারিন
#পর্বঃ১০ (শেষ পর্ব)
সে তৈরি হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল ভালো করে। তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা। অতঃপর সে নীরবতা কাটিয়ে অশ্রু ভেজা চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি কে বিড়বিড় করে বললো,
–“অবশেষে তাহলে সে সময় চলে এলো। যে সময়ে’র জন্য অপেক্ষা করেছিলাম না। এতোক্ষণ যে সময় থেকে ও নিজের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা থেকে কতক্ষণ পালিয়ে বেড়ানো যায়? কখনো না কখনো বাস্তবতা’র মুখোমুখি হতে হয় এবং বাস্তবতা কে মেনে নিতে হয়। তারজন্য এখন সে সময় কে মেনে নিয়ে এবং সবকিছু ছেড়ে নতুন জীবনের সূচনা করতে হবে। কারণ বাস্তবতা যেমন’ই হোক’না কেন বাস্তবতা থেকে মুখ সড়িয়ে নিতে পারবো’না। তারজন্য বাস্তবতা কে মেনে নিয়ে পুরানো সম্পর্ক ও স্মৃতি গুলো কে রেখে। নতুন সম্পর্ক ও স্মৃতি গুলো কে আঁকড়ে ধরতে হবে। কিন্তু নিজের মনের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সময় পরিবর্তনে’র সাথে সবকিছু মুহুর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জীবন এমন কেন? জীবন আমাকে কোন রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেলো। যে রঙের ছোঁয়া লেগেছে আমার হৃদয়ে। সে রঙের ছোঁয়া পেতে আমি এখন প্রস্তুত ছিলাম না? কিন্তু জীবন কি কারোর কথা শুনে? সে তার নিয়মে চলে সময়ে’র সাথে সম্পর্ক গুলো কে পরিবর্তন করে। জীবন মাঝেমধ্যে নিজের সাথে ছলনা করে। সেই ছলনা থেকে সৃষ্টি করে অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক গুলো। যেই সম্পর্ক গুলো থেকে সৃষ্টি হয় নতুন জীবনের সূচনা। কিন্তু আমার এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমার কাঁধে এখন অনেক দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য। যেগুলো আমাকে পালন করতে হবে। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসবে। সে বাধা পেরিয়ে নতুন জীবনের সূচনা করতে হবে।
তখন অনু এসে দরজায় ঠকঠক করে বললো,
–“আপু আসবো?
মুগ্ধতা চোখের অশ্রু মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
–“হুম।
অনু বললো,
–“আপু চলো সকলে অপেক্ষা করছে এখন যেতে হবে।
তারপর মুগ্ধতা নতুন জীবনের উদ্দেশ্য রওনা হলো।
______________________________
খান ম্যানশনে নববধূ বরনে’র তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইজহান খানে’র স্ত্রী বলে কথা। তারপর কিছুক্ষণ পড়ে পুরো বাড়িতে হৈচৈ বেধে গেল ইজহান নববধূ নিয়ে এসেছে। তখন তাদের বরন করার জন্য ইজহানে’র মা ইরিনা বেগম যেতে। তাদের দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কারণ নববদূ’র জায়গায় ছিলো তার ছোট বোন মুগ্ধতা।
তখন ইরিনা বেগম ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
–“ইজহান?
ইজহানে’র নীরবতা। তখন ইমতিয়াজ সাহেব সবকিছু সামাল দেবার জন্য বললো,
–“কি হলো ইরিনা। এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? পুত্রবধূ কে বরন করে ভেতরে নিয়ে এসো।
ইরিনা বেগম এতো মানুষের মধ্যে কিছু বলতে পারছেনা। তখন নিজের মধ্যে কেমন অস্থিরতা অনুভব করছে ও রীতিমতো ঘামতে শুরু করছে।
তারপর এসব কিছু ইমতিয়াজ খান বুঝতে পেরে ইজহানে’র কাজিনে’র স্ত্রী অহনা কে বললো তাদের বরন করে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য। তারপর তাদের বরন করে ভেতরে নিয়ে এলো। কিন্তু এখানো ইরিনা বেগম স্তব্ধ হয়ে আছে। তারপর সে এখানে কিচ্ছু না বলে। দ্রুত চলে গেলো। তারপর ইমতিয়াজ সাহেব তার পিছু চলে গেল এবং তাকে সবকিছু খুলে বললো। ইজহান যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু বিয়ের কিছু নিয়ম আছে। যেগুলো এখানে পালন হচ্ছে। এগুলো পালন করে ইজহান তার মায়ের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বলে। বিয়েটা সে কেন করেছে। কিন্তু সে এখনো নিশ্চুপ। তখন ইজহানে’র বাবা বলে তাকে সময় দিলে সময়ের সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
____________________________
নববধূ সাজে নিজের বড় বোনের বাসরে বসে আছে মুগ্ধতা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। যেখানে আজকে তার বড় বোন শুভ্রতার থাকার কথা ছিলো। সেখানে মুগ্ধতা নিজেকে কিছুতে মেনে নিতে পারছেনা। কিভাবে পারবে মেনে নিতে। যেখানে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, যে সম্পর্কে বাধা পড়েছে। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক অস্বীকার করা যায়না। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক মুছে ফেলা যায়না। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক স্বীকার করা যায়না। এখন সে বুঝতে পারছে না কি করবে। কি করা উচিৎ তার। অদ্ভুত দোটানার মধ্যে পড়েছে মুগ্ধতা। তখন ইজহান রুমে এসে তার সব দোটানা কাটিয়ে দিয়ে বললো,
–“অবশেষে তাহলে আমাদের বিয়ের ড্রামা শেষ হলো। কি হলো এখনো কিসের জন্য এভাবে বসে আছেন? ঐ নিয়ম কানুন গুলো’র জন্য কি সত্যি নিজেকে আমার স্ত্রী ভাবতে শুরু করছেন? ভুল করেও এসব ধারণা ব্রেনের মধ্যে রাখবেন না। ঐ নিয়ম কানুন গুলো সবার সামনে করা জরুরি ছিল। তারজন্য করেছি।
ইজহান ফ্রেশ হতে চলে যায়। মুগ্ধতা’র এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা সে এখানে আছে। তার মনে হচ্ছে সে কোন ঘোরের মধ্যে আছে।
___________________________
অন্ধকার পেরিয়ে সকালে’র আলো ফোটে। শুভ্রতা’র ঘুম ভেঙে গেলে সে আড়মোড়া হয়ে আলতো করে চোখ খুলে বললো,
–“মুগ্ধতা?
_______________________________
রাতের অন্ধকারে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইজহান ফ্রেশ হতে গেলে। তার ফোনে কয়েক’ বার রিং হচ্ছে তখন মুগ্ধতা ফোন রিসিভ করতে। এমন কিছু শুনে যার জন্য সে প্রস্তুত ছিলোনা। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর ইজহান ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে মুগ্ধতা’র এমন অবস্থা দেখে কিছু বলতে যাবে। তার আগে মুগ্ধতা বললো,
–“সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। কেন এমন করলেন আমাদের সাথে? কি দোষ ছিলো আমাদের?
মুগ্ধতা ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। তখন ইজহান তাকে ধমক দিয়ে বললো,
–“আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবেন। সবকিছু না শুনে এভাবে কেঁদে যাচ্ছেন কেন? বোকার মতো।
মুগ্ধতা নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে ইজহানে’র দিকে তাকালো।
তারপর ইজহান বলতে শুরু করলো,
–“অপরাধী যখন কোন অপরাধ করে। তখন কোন না কোন প্রমাণ রেখে যায়। আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে আজকে আপনার জন্য শুভ্রতা’র রুমে গিয়েছিলাম। তখন ভুল করে আমার ফোন সেখানে পড়ে যায়। তারপর যখন ফোন নিতে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে নিয়াজ কে দেখি। যে আমার বন্ধু নামে’র শত্রু। যে আমার বিয়ের জন্য দেশের বাহিরে থেকে চলে আসছে বিজনেসের কাজ ফেলে। যে
কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে নিয়ে এবং শুভ্রতা কে নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো। তখন বিষয়’টা অস্বাভাবিক লেগেছিল। কিন্তু চিন্তা করতে পারেনি শেষ পর্যন্ত এতো নিচে নেমে যাবে নিয়াজ। তারপর সেখানে নিয়াজ কে ধরে ফেলি। সেখানে আমাদের মধ্যে মারামারি পর্যন্ত হয়। তারপর আমার লোকেদের ফোন দেই। কারণ এতো কিছু মধ্যে আমি থাকতে পারবো না। বিয়েতে আমার উপস্থিতি থাকতে হবে। তারপর তাদের হাতে তুলে দিতে। তারা তাকে শায়েস্তা করে সব কথা মুখ দিয়ে বেড় করে নেই তারপর যেসব কিছু দিয়ে মানুষ কে ব্ল্যাক করে সেসব প্রমাণ সব নষ্ট করে ফেলে। নিয়াজে’র কাজই ছিলো রিলেশন করে ব্ল্যাকমেইল করা। শুধু শুভ্রতা নয় আরো মানুষের সাথে এমন করেছে। দুই বছর আগে তার প্রমাণ শুভ্রতা দিয়েছিল যার কারন তাকে ভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। যে মানুষ’টা আজকে এসে শুভ্রতা ব্ল্যাকমেইল করে। তারজন্য শুভ্রতা বিয়ে থেকে পালিয়ে যায়। তারপর নিয়াজের দেওয়া ফোনের মধ্যেই দিয়ে শুভ্রতা কে আমার লোকে’রা খুঁজে বের করে। সে এখন ভালো আছে। নিয়াজ কে পুলিশ দেওয়া হয়েছে। সে তার জঘন্য অপরাধের শাস্তি পাবে।
তখন মুগ্ধতা ইজহান কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে বললো,
–“আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমার ভুল হয়েছে। প্লিজ আমার বোনের কাছে আমাকে নিয়ে চলুন।
–“ঠিক আছে আগে আমাকে ছাড়ুন।
মুগ্ধতা তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
–“ওহ্, সরি।
ইজহান বললো,
–“ঠিক আছে এতো ন্যাকামি করতে হবেনা। আমি কোন পর পুরুষ না। আমি আপনার স্বামী।
মুগ্ধতা সামান্য লজ্জা পেয়ে যায়। তারপর ইজহান বললো,
–“আজকে আমাদের বাসর রাত বুঝতে পারছেন?
আমাদের চোরের মতো বাসায় থেকে যেতে হবে সকলের আড়ালে। কিন্তু ড্রেস চেঞ্জ করে আসেন। এভাবে যাওয়া যাবেনা।
–“কি পড়বো? আমার লাগেজ কোথায়। সবকিছুর মধ্যে লাগেজ রুমে নিয়ে আসতে ভুলে গেছি।
তখন ইজহান দ্রুত আলমারি থেকে তার টি শার্ট এবং পেন্ট দিয়ে বললো,
–“এগুলো পড়ুন।
মুগ্ধতা ভ্রুকুঁচকে ইজহানে’র দিকে তাকিয়ে বললো,
–“মানে?
–“তাছাড়া কোন অফশন আছে আপনার কাছে? এর থেকে বেটার কিছু। দেখুন এতো রাতে এখন লাগেজ খুঁজতে যেতে পারবোনা। এগুলো দিয়ে ম্যানেজ করে নিন। চিন্তা করবেন না এগুলো একদম নতুন। ম্যানেজ করতে না পারলে অপেক্ষা করেন সকালে বোনের সাথে দেখা করবেন।
–“না ঠিক আছে। এগুলো পড়ে নিবো।
______________________________
ইজহান বাইক স্টার্ট দিচ্ছে। তখন মুগ্ধতা চোখ গোল গোল করে বললো,
–“বাইকে?
–“হ্যাঁ বাইক। জীবনে কি প্রথম বাইক দেখছেন। যাচ্ছিতো চোরের মতো এখানে কি গাড়ি কিংবা হেলিকপ্টার আসবে আপনার জন্য। উঠে বসেন তাড়াতাড়ি। ধরে বসবেন কিন্তু।
–“হুম।
__________________________
শুভ্রতা কে যখন নিয়ে আসে ইজহানের লোকে’রা তখন সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন তাকে সামলানো মুশকিল হচ্ছিলো। তখন ডাক্তার এসে তাকে দেখে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়। তারজন্য মুগ্ধতা যখন আসে তখন দেখে শুভ্রতা ঘুমে। তারজন্য তার ঘুম ভেঙে যাওয়ার অপেক্ষা করেছিল মুগ্ধতা।
তারপর সকালে তার ঘুম ভেঙে গেলে শুভ্রতা তার পাশে মুগ্ধতা কে দেখে বললো,
–“মুগ্ধতা।
–“হ্যাঁ আপু বলো। এইতো আমি।
তারপর দুই বোনের আবেগ বিনিময় হয়। মুগ্ধতা সবকিছু তাকে খুলে বলে শুভ্রতা কে। তারপর ইজহান নিজের ঘড়ির কাঁটার দিকে দেখিয়ে মুগ্ধতা কে বললো,
–“আমাদের এখন যেতে হবে মুগ্ধতা। সকাল হয়ে সবকিছু জানাননি হয়ে যাবে।
–“হ্যাঁ চলুন।
মুগ্ধতা বোনের কপালে চুম্বন করে বললো,
–“আপু তাহলে যায়। বাড়িতে সবকিছু ঠিক করে কথা বলে তারপর তোমাকে নিয়ে যাবো। তুমি কোন টেনশন করবে না।
শুভ্রতা ইশারায় হ্যাঁ বললো। ইজহান বললো,
–“নিজের খেয়াল রাখবেন শুভ্রতা। কিছুদিন এখানে থাকেন তারপর আপনার বাড়িতে সবকিছু ঠিক হলে চলে যাবেন।
শুভ্রতা বললো,
–“ইজহান আমার ভুলের শাস্তি আমার ছোট বোন’টা দয়া করে দিবেন না। বিয়েটা যেভাবেই হোক এখন সে আপনার স্ত্রী।
ইজহান মুচকি হাসি দিয়ে মুগ্ধতা’র হাতটা ধরে বললো,
–“চলেন।
মুগ্ধতা তার হাতা’টা আলতো করে আঁকড়ে ধরে বললো,
–“হ্যাঁ চলেন।
#সমাপ্ত