#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_১০+১১
#মুসফিরাত_জান্নাত
বেলা প্রায় অপরাহ্ন ছুঁইছুঁই। আমি রুমের মধ্য ভাগে এসে দুই হাত কানে রেখে এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছি।খুব করে চেষ্টা চালাচ্ছি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারছি না।পারবো কিভাবে? জীবনে কতো বছর এভাবে কানে ধরা হয়নি নিজেরই মনে নেই।ছোট বেলায় দুষ্টুমি করার জন্য কুদ্দুস স্যার এমন করে কানে ধরাতেন না হয় ব্যাঙ বানাতেন।তাও কি দুষ্টুমি ছেড়েছি নাকি?তখন ব্যাপারটা দুধ ভাত ছিল।কিন্তু আজ ব্যাপারটা ভিন্ন।লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে আমার।তাই দুইয়ে মিলে তাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আজ বহুদিন পর এই খাটাশ ব্যাটার জন্য পুরাতন কার্য সম্পাদন করতে হচ্ছে।তাও সাধারণ একটা নম্বর পত্রে আঁকিবুকি করেছিলাম বলে।গতদিন কোচিং এর পরীক্ষার খাতা দিয়েছে।ষাটের মাছে ত্রিশ পেয়েছি।এটা যদি উনি দেখেন তবে রক্ষা থাকতো না আমার।তাই ষাটের ছয়কে একটু বিকৃতি করে নতুন রুপ হিসেবে তিন বানিয়ে দিয়েছি।বাংলায় নম্বর লেখায় সুবিধাও হয়েছিলো।একটু কলমের দাগ দিয়ে মাথাটা জোড়া লাগানো, ব্যস।কিন্তু এত সহজেই কি মুক্তি মিলেছে?ধরা আমাকে ঠিকই পড়তে হয়েছে।উনি উপরের মার্ক দেখেই সন্দেহ করেছেন।ত্রিশে ত্রিশ আমি কখনোই পাবো না।তাই পুরো খাতা পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখেছেন।তারপর যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন।ফলস্বরুপ এই শাস্তি পেতে হচ্ছে আমাকে।প্রায় এক ঘন্টা এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমার পা প্রায় ভেঙে যাচ্ছিলো।আমি অসহায় হয়ে ওনার দিকে তাকাই।উনি গভীর মনোযোগ দিকে ফোন স্ক্রল করছেন।আমি অস্ফুট স্বরে বলি,
“শাস্তির মেয়াদ আর কতক্ষণ? পা ফটাস করে উঠলো বলে৷”
উনি ভাবলেশহীন গলায় বললেন,
“যতক্ষণ না তুমি আমার অপর অপশনে রাজি হচ্ছো ততক্ষণ।”
আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,
“ডেট এক্সপায়ার্ড কিছু খাইছেন নাকি?এক সপ্তাহের ভিতরে কেমনে এতোগুলো পড়া গিলবো?ভাত না খেয়েও তো এত পড়া পেটে আটবে না।”
আমার কথা শুনে তিনি চোখ তুলে আমার পানে তাকালেন।অতঃপর গম্ভীর গলায় বললেন,
“ফর ইউর কাইন্ড ইনফোরমেশন, পড়া পেটে না, মাথায় জায়গা পায়।তবুও যদি দরকার পড়ে তবে ভাত না খেয়েই এসব পেটে আটকাবে।তাও এসব পড়তে হবে তোমাকে।”
আমি মুখ ফুলিয়ে প্রতিবাদ করি,
“অসম্ভব, আমি কিছুতেই এতো পড়তে পারবো না।”
এবার উনি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
“তাহলে শাস্তি ভোগ করো।রাতের খাবার গেলার আগ অবধি এটা চলবে।”
“এইটা তো রীতিমতো শিশু নির্যাতন।আপনার নামে মামলা ঠুকবো আমি।হুহ।”
কথাটা শুনে উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তা সেই নির্যাতিত শিশুটা কে?”
আমি ত্যাড়া কণ্ঠে জবাব দেই,
“এইখানে আপনি নির্যাতন করছেন টা কাকে?”
কথাটা বলে আমি সরু চোখে তাকাতেই উনি বললেন,
“লাইক সিরিয়াসলি! তুমি শিশু?”
“হু অবশ্যই শিশু।আপনি জানেন আমার এখনো আঠারো হতে তিন দিবস বাকি।আর আঠারো বছরের আগে সবাই শিশু।হুহ।”
উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠেন।তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলেন,
“হুম, কথা সত্যি।তবে একটু কারেকশন দরকার।তুমি শিশু, তবে শুধু শিশু না।দুগ্ধপোষ্যহীন ধামড়া শিশু।”
আমি এবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। দুই কান থেকে হাত সড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠি,
“কি বললেন আপনি এটা?”
উনি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলেন,
“নিজের পজিশন নষ্ট করলে কেনো?শাস্তি মওকুফ করেছি আমি?আমার শাস্তি ভঙ্গের ফলে যে ডাবল শাস্তি পাবে বলেছি তা মনে ছিল না?”
এবার আমি থতমত খেয়ে যাই।হায় রে! উনি তো এটা আমাকে আগেই ওয়ার্ন করেছিলেন।তবে এখন কি হবে?আমি আমতা আমতা করতে থাকি।অতপর কোনো কিছু না ভেবেই বলি,
“আমি অপর অপশনে রাজি।”
উনি এবার কিঞ্চিৎ পরিমান হাসলেন।অতপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“গুড।তবে মনে রেখো তোমাকে আর ভরসা করি না আমি।তাই এখন থেকে আমার কাছে তোমাকে পড়তে হবে।আর পড়া না পারলে শাস্তি পেতে হবে মাথায় রেখো। ”
কথাটা শুনে আমার অধর যুগল আপন শক্তিতে ফাঁকা হয়ে গেলে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,
“অ্যাহ বললেই হলো! আমি পড়বো না আপনার কাছে।”
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন,
“সেটা দেখাই যাবে।”
কথাটা বলেই তিনি প্রস্থান করলেন। আর নিজের কপালের আসন্ন শনির চিন্তায় হাঁসফাঁস করতে থাকি।
___________
সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।অন্তরীক্ষের দাপুটে সূরসূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে।তার কমলা রাঙা আলোর ছটা খেলা করছে অন্তরীক্ষের বাঁকে।দূর দূরান্ত থেকে পাখির দল উড়ে উড়ে ফিরছে তাদের নিজ নীড়ে।মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে চারিদিকে।আমি এখনো বিছানায় বেলকনিতে ঝিম মে’রে বসে আছি।মন উৎফুল্ল রাখার মতো পরিবেশ হলেও মেজাজ আমার প্রচন্ড খারাপ। সবকিছুই আজ আমার অসহ্য লাগছে।এমনকি নিজেকেই নিজের অসহ্য লাগছে। মনের মধ্যে চলছে দুনিয়ার সব আজগুবী ভাবনা। ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে দিতে৷ সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে বাবার বাড়ি।আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে যে বাবার বাড়ির গরম দেখাচ্ছি তারাই কি আজকের দিনে একবারও আমার খোজ নিয়েছে?নাহ তারা নেয়নি।সারাদিন অপেক্ষার পর একটু আগে যখন আব্বু আম্মুর নাম্বারে কল দিলাম তারা কেও কল পিকও করেনি।এমন একটা দিন কেও মনে রাখলো না?দুঃখে কষ্টে প্রচুর কান্না করতে ইচ্ছে করছে আনার। মনে চাচ্ছে ম’রা কান্না কেঁদে চোখের পানিতে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে। আবার ইচ্ছে করছে সব লন্ড ভন্ড করে দিতে।কিন্তু আফসোস কোনটার একটাও আমি করতে পাচ্ছি না। শুধু অসহ্য লাগছে। ভিতর আমার দুমড়ে মুচড়ে আসছে বারংবার।
ঘন্টা কয়েক আমি ওভাবেই বসে রইলাম।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে উনি এলেন।আমাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে তার ভ্রু যুগল এক করে ফেললেন৷কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
“এভাবে বসে আছো কেনো?সন্ধ্যার নাস্তা করবে না?”
আমি নিজের চেহেরা অপর দিকে ঘুরিয়ে রেখে চাপা স্বরে জবাব দিলাম,
“ইচ্ছে করছে না।”
তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর কি একটা ভেবে বললেন,
“কিছু হয়েছে তোমার?”
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে আমার চোখ ভেঙে খুব কান্না পেল।এমন একটা দিন গড়িয়ে রাত এলো, আর উনি এখন জিজ্ঞেস করছেন কিছু হয়েছে কিনা আমার!অদ্ভুদ মানব।আমার প্রচুর কান্না পেলেও আমি কাঁদলাম না।আমি নিজেকে কোন মতে সামলে নিলাম আমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধীর কন্ঠে বললাম,
“কিছু হয়নি।”
নিজেকে সামলাতে চাইলেও কণ্ঠ কেপে উঠলো আমার।তিনি কিছু সময় সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।তারপর দৃঢ় গলায় বলেন,
“নাস্তা করবে, ড্রয়িং রুমে চলো।”
তার কথা শুনে বিরক্তিতে মুখ ঘুচে আসে।আমি নিজেকে বিরক্ত হয়ে বলি,
“বললাম তো নাস্তা করবো না।”
উনি আমার কথা শুনে কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থাকলেন। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,
“আচ্ছা নাস্তা করতে হবে না।তবুও ড্রয়িং রুমে এসো।দেখো বাসায় কে এসেছে!”
কথাটা বলে তিনি আমার হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসেন।সেখানে পৌছে আমি যা দেখতে পাই তা আমার অবসন্ন মন একবারও ভাবেনি।এ কারণেই হয়তো বেশি চমকে গিয়েছি আমি।স্বয়ং আব্বু আম্মু ড্রয়িং রুমে বসে আছেন।আমাকে উপস্থিত হতে দেখেই আম্মু হ্যাপি বার্থডে বলে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর আব্বুও উইশ করে একটা গিফট বক্স হাতে ধরিয়ে দিলেন।পরপর বাড়ির সবাই উইশ করলো আমাকে।নিশি পার্টি স্প্রে ছড়িয়ে প্রায় নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো আমাকে।তারপর পুরো রুমে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আমি।প্রায় অল্প সময়ের মাঝে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।বেলুন, ঝুলন্ত নেট ও নানা রঙের ফুলের সমাহারে বেশ চমকপ্রদ লাগছে ও পাশটা।তার সামনে ছোট একটা টেবিলে একটা কেক অবস্থান করছে।সবার সাথে গিয়ে কেক কা’টলাম আমি।তারপর প্রথম টুকরোটা আম্মু তুলে আমাকে খাইয়ে দিলেন।আমিও পাল্টা আম্মুর মুখে ধরতেই হৈ হৈ করে উঠলো সবাই।এটার হক নাকি এখন নিভৃতের।আম্মুও তাই বললেন।সবাই এক প্রকার জেঁকেই ধরলো ওনাকে খাইয়ে দিতে।এদিকে আমার এঁটো ওনার মুখে দিলে যদি উনি ছিটকে সড়ে যান এই ভয়ে তটস্থ আমি।ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি কেমন চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছেন।দেখেই আত্মা শুকিয়ে গেলো আমার।তবুও সবার জোড়াজুড়িতে এক প্রকার ভয় মিশিয়েই ওনার মুখে আধ খাওয়া কেকের পিছটা দিলাম।সাথে মনে মনে আল্লাহকে জপতে লাগলাম।এই বুঝি উনি ধমক দিয়ে বলেন,
হোয়াট রাবিশ!তোমার খাওয়া কেক আমি খাবো ভাবলে কি করে?ভরা আসরে এমন প্রত্যাখান পাওয়া লজ্জার।কিন্তু উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে পুরো টুকরোটাই নিজের মুখে পুরে নিলেন।ওনার এহেন কাণ্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি।ওনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।আমার এমন দৃষ্টি উনি দেখেও যেন না দেখার ভাণ করলেন।অন্যদের সাথে কেক ও পায়েস ভাগ করে বিতরন শুরু করলেন।তার এক পিরিচে করে এক স্লাইস কেকের টুকরো ও অপর পিরিচে পায়েস এনে আমার হাতে দিলেন।স্মিত হেসে বললেন,
“সামনে তোমার পরীক্ষা তাই লোকসমাগম করিনি।আয়োজনও বেশ কম হয়েছে।পরের পুষিয়ে নিবো দেখো।”
কথাটা বলে অন্যদের মাঝে মিশে গেলেন উনি।আজকের এই পুরো আয়োজনের উদ্যোগটা উনি করেছেন।সামলাচ্ছেনও নিজেই।আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে।মানুষটাকে এমন অপ্রত্যাশিত হতে হবে কেন? তার কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা সবই অপ্রত্যাশিত ও অপ্রকাশিত।যেন সে নিজের নামের সব গুন শুষে নিয়েছেন।অতি নিভৃতে গড়া অতি নীরব কায়া।যার আদ্যোপান্ত ব্যস্ত শুধু আমারই নীড়ে।
কথাটা ভাবতেই হঠাৎ ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে আমার।কেমন অদ্ভুত জুটি আমরা!বাহ্যিক দিকে দুজনের অগাধ দূরত্ব, অথচ অন্তরের দিকে তিনি আনার কতো নিকট!এটাই বুঝি নিভৃতের নিভৃত ভালোবাসা।
________
মাথার উপর অনবরত ফ্যান ঘুরছে।ঠান্ডা বাতাসে বেশ শান্তি অনুভুত হচ্ছে।আমি আপন মনে অংক কষছি।হটাৎ হাঁটুর এক ঘাত নিচে স্কেলের আঘাত লাগতেই চমকে উঠলাম আমি।ঘটনা বুঝতে খানিক সময় লাগে আমার।অতঃপর মুখ ফুলিয়ে বলি,
“আপনি আমাকে মা’রলেন?”
উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“হোয়াট ইজ অল দিস?”
প্রশ্নটা করে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি।ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে আমি আমতা আমতা সুরে বলি,
“মানে কি?”
উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
“একটা অতি সাধারণ ম্যাথের আনসার বের করতে এত সময় লাগে?”
এতক্ষনে আমাকে আঘাত করার মূল কারণ ঠাহর করলাম আমি।তাই তো বলি এত মনোযোগী হয়ে পড়তে বসার পরও মা’র খেতে হলো কেনো।আমি থমথমে কণ্ঠে বলি,
“আমি কি ক্যালকুলেটর নাকি, যে চাপ দিলেই ফট করে আনসার বের হবে?”
“ডু ইউ ইভেন নো?পাবলিক ভার্সিটি এডমিশন এক্সামে একটা এমসিকিউ এর জন্য এক মিনিট সময়ও ধার্য থাকে না।সেখানে আধা ঘন্টা লাগিয়ে একেকটা ম্যাথ সলভ করে পরীক্ষায় বসবে তুমি?”
আমি মিনমিনে গলায় বলি,
“আমি অল্প সময়ে এসব ম্যাথ সলভ করতে পারি না।সময় লাগলে কি করবো?”
আমার এই কথায় যেন উনি আরও রেগে গেলেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,
“কি করবে মানে কি? ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক মোর হার্ড।চোখের পলকে আনসার বের করতে হবে।এখন এই নেক্সট এমসিকিউ এর আনসার ত্রিশ সেকেন্ডে বের করো।”
কথাটা শুনার সাথে সাথে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার। দৃষ্টি হয়ে আসলো গোলগোল।চোখের পলকে কেমনে কি ভাই?এটা কি আদৌ আমার দ্বারা সম্ভব?এমন ম্যাথ করতে যেখানে আমার দশ মিনিট সময় দরকার সেরা ত্রিশ সেকেন্ডে কেমনে সম্ভব? হাও?এতো বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখার মত। আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,
“এমন কাঠখোট্টা অংক মানুষ ত্রিশ সেকেন্ডে কেমনে সলভ করে?হাও? আমি জীবনেও পারবো না।”
“তুমি পারবে তো তোমার ঘাড়ও পারবে। আর যদি তা না পেরেছ তবে তোমার সাতদিনের খাবার বন্ধ।”
ওনার কথা শুনার সাথে সাথে আমার ঠোঁট যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।উনি এবার নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন,
“মানুষ চাইলে সবই পারে।চেষ্টা ও বারবার প্র্যাক্টিস করলে তোমার হাত ও মাথা দুটোই চালু হয়ে যাবে।তখন তুমিও পারবে।”
আমি গাল ফুলিয়ে মাথা দুলাই।অতপর ম্যাথে মন দেই।তা না হলে তো আবার শাস্তি দিবেন।সাধে কি ওনাকে খাটাশ বলি?কাটখোট্টা কোথাকার!
____
দেখতেই দেখতে আড়াই মাস চলে গেল। সাথে ঘনিয়ে এলো আমার পরীক্ষার দিন।এতদিনে উনি নিয়ম করে নিজের ডিউটি করেছেন।বিকেলে চেম্বারে রুগী দেখতে বসে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজিয়েছেন।তারপর ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রাত নয়টা থেকে শুরু করতেন আমাকে পড়ানো।যা চলতো প্রতিদিনের পড়া কমপ্লিট হওয়া অব্দি।আবার পরেরদিনের জন্য এক গাদা পড়া ঝুলিয়ে দিতেন ঘাড়ে৷ সেই সাথে পড়া না পারলে শাস্তি তো বোনাস স্বরুপ হাজির থাকতোই। মানে পড়া ছাড়া আর উপায় ছিলো না আমার।
ঠিক এভাবেই একটা সময় থেকে সকল পরীক্ষায় হায়েস্ট নাম্বার পেতাম আমি।সবার আকর্ষণ তখন আমার দিকে।কোচিং এর স্যারদেরও দৃষ্টিতে পড়লাম।তারা আমাকে বিশেষ খাতির যত্ন করতে লাগলো।আমাকে নিয়ে আশাবাদী হলো।শিক্ষাজীবনে এই প্রথম এতো সম্মান পেলাম আমি।নিজের মাঝেও এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিলো।টপার টপার ভাব এসে গিয়েছিলো আমার মাঝে।কিন্তু আজ তা হুট করেই মিলিয়ে গিয়েছে।কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা।চিন্তায় সব গুলিয়ে আসছে।আমি কি আদৌ পারবো ওনার স্বপ্ন পূরণ করতে?উনি যে এত পরিশ্রম দিলেন আমার উপর তা কি স্বার্থক হবে?এই চিন্তাই বারবার মাথা হ্যাং করে দিচ্ছিলো আমার।সবকিছু পড়া আগেই শেষ করে বার বার রিভিশন করে ফেললেও এখন মনে হচ্ছে আমার কিছুই পড়া হয়নি। আমি কিছুই পারি না। এমন এক অনুভূতি হচ্ছে যে, পরীক্ষার হলে গিয়ে হয়তো আমি কিছু লিখতে পারবো না।কি এক উদ্ভট চিন্তা।মাথা চাপ দিয়ে ব্যাথা হচ্ছে আমার।একবার ইংলিশ দেখছি তো একবার উচ্চতর গণিত, আরেকবার ফিজিক্স দেখছি তো আবার কেমিস্ট্রি। এভাবে বায়োলজি ও দেখা হয়ে গিয়েছে।এমন ভাবে উশখুশ করতে লাগছি আমি।
আমার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাণ্ড কারখানায় উনি শীতল চোখে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন আমাকে। বেশ কিছুক্ষণ আমায় সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে কোনো পা’গলা কুকুর কামড়াইছে নাকি, যে এমন উ’ন্মাদের ন্যায় আচরণ করছো।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি ওনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই।কণ্ঠ কঠিন করে বলি,
“কালকের পরীক্ষা পা’গলা কুকুরের কা’মড়ের চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার।পা’গলা কুকুরের সামনে যখন পা দিবেন তখনই কা’মড় দিবে।কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ জীবনে এই একবারই দিবে।পরে হাজারবার পা দিয়েও লাভ হবে না।”
কথাটা বলে থ মে’রে গেলাম আমি।উনিও ভ্রু কুটি করে চাইলেন।একটা সিট দখলের আশায় এত ম’রিয়া হয়েছি আমি যে কুকুরের কা’মড়ও তাচ্ছিল্য করছি।আমার মাঝের পরিবর্তনটা অনায়াসেই দৃষ্টিতে পড়লো দুজনের।যেই আমি একটা সময় পড়বো না বলে কতো ফাঁকি ঝুঁকি করেছি, সেই আমিই পড়ার জন্য এত সিনসিয়ার হয়ে গিয়েছি? জীবনের স্বাদ একবার নিতে জানলে মানুষ বার বার সেই স্বাদ পেতে তার পিছু ছোটে।পড়ালেখার কষ্টের পরের একবার পাওয়া প্রাপ্তিটাই আমাকে বারবার এদিকে টেনে এনে ফেলেছে।অথচ আমি তা খেয়ালই করিনি।উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে স্মিত হেসে দুই হাত বুকে গুঁজে বললেন,
“এইভাবে করতে থাকলে যা পড়েছ সব এমনি ভুলে যাবে। কোন স্বাভাবিক মানুষ কি এমন আচরণ করে নাকি?”
কথাটা শুনে দমে যাই আমি।সত্যি এভাবে চললে সব ভুলে যাবো আমি।কিন্তু চিন্তা যে কমছে না।আমি মিনমিনে গলায় বলি,
“তাহলে কি করবো আমি? আমার যে খুব চিন্তা হচ্ছে।আমি কি আদৌ পারবো!”
উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,
“সঠিক পরিশ্রমের পরেও অকারণে ব্যর্থ মানুষ খুব কম হয়।তুমি সঠিক পরিশ্রম দিলে তুমিও পারবে।আর পরীক্ষার আগের দিনে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম কাজ নিজের মনকে শান্ত রাখা আর টেনশন কম করা।তুমিও তাই করবে।তারপর রাতে পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে সকালে গুরুত্বপূর্ণ টপিকে চোখ বুলালেই চলবে।তাছাড়া টেনশনই অর্ধেক পড়া ভ্যানিশ করে ফেলবে।”
“হু। কিন্তু শান্ত হবো কিভাবে?”
কথাটা বলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম।এখন বিকেল।আসর নামায সম্পন্ন হয়েছে।তিনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বললেন,
“এখন তো বিকেল।ঘুরতে যাবে?”
কথাটা বলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।আমার মুখ আপন শক্তিতে বাঁধন হারা হলো।বলেন কি উনি?পরীক্ষা উপলক্ষে ছোট খালামনির বাসায় ঢাকা এসেছি দুইদিন হলো।এই দুইদিনে এক সেকেন্ডের জন্যও বই রেখে কোথাও বের হইনি।আর সেখানে কাল আমার পরীক্ষা আর আজ ঘুরবো?আমি জবাবে কিছু বলতে যাবো তখন উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“চটপট রেডি হয়ে নাও।আমিও রেডি হচ্ছি।আজ বিশেষ এক অনুভুতির সন্ধান পাবে তুমি।”
কথাটা বলে প্যান্ট ও শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন উনি।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।অতপর বিষ্মিত বদনেই উঠে দাঁড়ালাম রেডি হওয়ার জন্য। উনি যখন একবার বলেছেন ঘুরতে বের হবেন তখন তা করেই ক্ষান্ত হবেন।তাই আর দ্বিরুক্তি করলাম না।বরং বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালাম।
চলবে
(প্রচুর ব্যস্ততা শেষে টানা লিখে গিয়েছি।আজও রিচেক দেওয়া হয়নি।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।কাল থেকে রিচেক দিয়ে দিবো ইনশাআল্লাহ।)