প্রিয় সুখ-৩২

0
389

প্রিয় সুখ-৩২
____________
পাথরের তৈরি ফল ভর্তি ঝুড়ি। বাস্তব নয়। দেখতে অত্যন্ত সৌন্দর্য্যে ভরা। আপেল, কলা, আঙ্গুর নানা বিদ ফল গুলো গভীর ভাবে দেখছে বিমুগ্ধ। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করছে। একবার উপরে ছুড়ছে একবার ঝুড়িতে ফেলছে। নীহারিকার রুমের টেবিলের উপরে ঝুড়ির অবস্থান। সাদা পর্দা উড়ছে। ঘর অন্ধকারে ঢাকা। নিরব এই রুমে নিজের ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ঘুরছে বিমুগ্ধ। অথচ কারেন্টের উপস্থিতি তারে তারে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মশার কামড়ে তার হাত পা শিরশির করছে। কিন্তু সে নড়ছে না। টেবিলের চেয়ারে বসে আছে পাথরের মুর্তির মত। মাঝে মাঝে হাত পা ছেড়ে একদম নিশ্চুপ গম্ভির হয়ে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। মস্তিষ্ক তখন বেশ ছুটে। স্নায়ুকোষ গুলো কত কি ভাবে। আজও সে একা নিরবে নিভৃতে কিছু সময়কে নিজের নামে করে ভাবতে বসে অক্ষম হয়ে গেল। সে বার বার চাইত নীহারিকা অদ্ভুৎ ভাবে উদ্ভট হাসুক। আজ সে হাসি হঠাৎ করেই তার নজর কেড়েছে। কিন্তু বিমুগ্ধ উদ্ভাবন করল সে পৃথিবীর সব ভুলতে বসেছে। তার ব্রেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কি আশ্চর্যের বিষয় তার বুকের তীব্রতার সাথে রক্তসঞ্চারণ সে অনুভব করতে পারছে। শরীর গরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ছেলেরা মেয়েদের প্রেমে পড়ে কেন? বিপরীত সত্তা কেনো এত আকর্ষণীয়? মানুষ কেন ভালোবাসা, প্রেম, মোহ এসবে আক্রান্ত হয়? বিমুগ্ধর এসব নিয়ে ভাবার সময় কখনো হয়নি। মন নিয়ে গবেষণা করতে করতে সে শুধু রোগীদের কাছে আপন হয়েই উঠতে পেরেছে। অথচ সে এসব বুঝতে ভারী দুর্বল। সৌন্দর্য্য ভালোবাসার সূত্রপাত। একটি মানুষকে আগে ভালো লাগতে হবে। তার প্রতি একটা টান তৈরি হবে। ধীরে ধীরে তাদের আলাপ আলোচনা হবে। সম্পর্ক গভীর হবে। একটা নাম হবে। যাকে বলে প্রেম। ভালোবাসা হচ্ছে সম্পর্কের সর্বশেষ ধাপ। সবার জীবনে ভালোবাসা আসে না। মায়ায় সীমাবদ্ধ অনেকের জীবন। মায়া পেরিয়ে কেউ যদি কাউকে অসীম ভাবে অনুভব করে তাহলেই সে ভালোবাসতে পারে।
‘ মায়া ছাড়তে দেয় না। ভালোবাসা বন্দি করতে জানে না।’ দু’ টি যখন যুক্ত হয় তখন সেটি না মায়া থাকে না ভালোবাসা। সেটি হয়ে উঠে পাগলামি। ডেসপারেটনেস। অস্থিরতা। এক এমন অনুভূতি যা অসুখের মত শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। ভালোবাসাকে ভালো থাকতে দেখে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু পাগলামি, অস্থিরতা, দম বন্ধ কর অনুভূতির জন্য মৃত্যু অনিবার্য। নিঃশ্বাস বিহিন বাঁচা তো অসম্ভব তাই না! বিমুগ্ধ দীর্ঘশ্বাসে প্রচুর অনুভূতি খুঁজে বেড়াল। সে এখন সম্পর্কের কোন স্তরে রয়েছে? যখন নীহারিকাকে সে প্রথম দেখেছিল তখন ভালো লাগা কাজ করেছিল কি না বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তার মনে হয়েছে দাদুকে তো সে প্রচন্ড পছন্দ করত। তার বিশেষ কারণ একমাত্র দাদুই তাকে চিঠি লিখত। পরিবারের আর কারো সাথে যোগাযোগ না থাকলেও দাদু আর ফুফুর সাথে গভীর ভাবে ছিল। ফুফুর সাথে আব্বির খুব ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু বিমুগ্ধের নিজের পরিবারের বাহিরে যৌথ পরিবারের প্রথম এবং শেষ সদস্য তার দাদুই তাকে চিঠি লিখত। টেলিফোন করত। সেই হিসেবে এই ব্যক্তিটি তার চরম লেভেলের পছন্দের একজন মানুষ। সরাসরি একবার দেখার খুব ইচ্ছে থাকার শর্তেও কখনো দেখা হয়নি তাদের। বিমুগ্ধ যখন বাংলাদেশে ছিল তখন সে এই বাড়ি চিনত না। কেউ জানত না সে এখানে থাকে। ফলস্বরূপ তাদের দেখা হওয়ার সম্ভবানাও ছিল না। বিমুগ্ধের মনে তার দাদুকে দেখার যে অজেয় ইচ্ছে, ব্যগ্রতা ছিল সেই আকুলতা নীহারিকার ছবি দেখে পূরণ হয়ে গেয়েছিল। কিন্তু নীহারিকাকে কাছ থেকে দেখে সে তার প্রতি মনোযোগী হলো। জানার ইচ্ছে তাকে পাকড়াও করল। তার মনে হলো সে পছন্দ করে। সত্যি সে অন্ধকারে ভয়ে সিটিয়ে যাওয়া নীহারিকাকে সত্যি পছন্দ করে ফেলল। তবুও সেটি ভালোবাসা মায়া মোহ কিছুই ছিলোনা। ছিল পছন্দ। কিন্তু বিমুগ্ধ যখন গ্রামের নীহারিকাকে দেখল সে মায়ায় জড়িয়ে গেল। আব্বির কথা মাথা থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল কিছু মায়া নেশার মত হয়। নেশা তো সহজে কাঁটে না। বিমুগ্ধ সেটিকে ভালোবাসা ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু সেটিও ভালোবাসা ছিল না। ভালোবাসা তো হঠাৎ হয়। বৃষ্টির মত এসে ভিজিয়ে দেয়। সব উজার করে অন্য একটি দুনিয়ায় নিয়ে যায়। এফোড় ওফোড় করে দেয় একটি মানুষের সত্তা, অনুভূতি, অস্তিত্ব, হৃৎযন্ত্র। সেই চোখে বিমুগ্ধ নিজেকে এক অন্যরূপে আবিষ্কার করল। সে বুঝতে পারল নীহারিকা নামক এই হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজার সময় এসে গেছে। হারিয়ে যাওয়ার প্রহর এসেছে। নতুন এক মানব মনের জন্ম হয়ে গেছে। বিমুগ্ধ ভালোবেসে ফেলেছে। চরম ভালোবাসাময় অসুখে তার সকল প্রিয় অনুভূতি উড়ে গেল কর্পূরের মত। নীহারিকা তার জীবনে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে ঠেলে সবার উপরে উঠে আসল। যাকে সে চেয়েও কখনো নামাতে পারবে না, সরাতে পারবে না। সে ধ্বংস হয়ে গেল ভালোবাসা নামক এক ভয়ংকর, আজব, আশ্চর্য শিহরনে। যা রক্তে দৌড়ে বেরাতেই বেশি পছন্দ করে। নেশা ধরানো মেয়েটি তার জীবনে ঘূর্ণিঝড় হয়ে এলো। যার সাথে থাকতে ভালো লাগছে। যার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে। যার নিঃশ্বাসের শব্দ গুনে গুনে আনন্দ পাচ্ছে। বিমুগ্ধ আরও গভীর ভাবে তাকে দেখতে শুরু করল। সে আরও তলিয়ে গেল। সমুদ্রের গভীরে তার এলোমেলো অনুভূতি উত্তাল হয়ে ঝড় তুলতে শুরু করল। বিমুগ্ধ আর বিমুগ্ধ রইল না। সে এই মেয়েটির সাথে রেগে কথা বলতে পারছে না। তাকে হাসাতে, কাঁদাতে, রাগাতে সব কিছুতে সে মারাত্মক খুশি খুঁজে পাচ্ছে। বিমুগ্ধর জীবন, মন, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড এখানেই থেমে থাকেনি। পছন্দ থেকে মায়া, মায়া থেকে মোহ, মোহ থেকে ভালোবাসা এবার সে চরম লেভেলে উঠে এসেছে। বিমুগ্ধের সব কন্ট্রোল সব আয়ত্ত, নিজস্বতা, নিজের সতেজতা সে হারিয়ে ফেলেছে। তার সকল অনুভূতি এখন পাগলামিতে রূপ নিচ্ছে। বিমুগ্ধ টেবিলের সব বই ছুড়ে ফেলে দিল। সে কখনো কারও জন্য কিছুই করেনা। যা করে শুধু নিজের জন্য। অথচ সে নীহারিকার জন্য মিতুয়ার জীবনে ইন্টারফেয়ার করেছে, নীহারিকার জন্য ওয়াদা ভঙ্গ করেছে, নীহারিকার জন্য সে রাত জেগে তাকে দেখতে গেটের বাহিরে বসে থেকেছে, নীহারিকা নীহারিকা করে তার জীবন পাল্টে গেল। এই রমণীর জন্যেই সে এই বাড়ি এসেছে। এই নারী চায় বলে সে তার বাবাকে এখানে নিয়ে এসেছে। শুধু মাত্র এই রমণীকে পাওয়ার পাগল করা আশা তাকে দুই পরিবারকে মিলিয়ে দিতে ব্যাকুল করে তুলছে। নীহারিকার জন্য বিমুগ্ধ এতো কিছু করে ফেলেছে! আশ্চর্য হয়ে গেল বিমুগ্ধ। সে যে কি না কারো জন্যে মনের বিরুদ্ধে কিছুই করে না সে নীহারিকার জন্য এতো কিছু কিভাবে করতে পারল? অথচ নীহারিকা কি জানে এসব? সে কি জানে বিমুগ্ধ সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছে। সে নেশাক্ত মানুষের মত নীহারিকার নেশায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে? বিমুগ্ধ নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল। কয়েক গাছি চুল তার তালুতে। শুধু ভালোবাসা হলে বিমুগ্ধ নীহারিকা বিহিন বাঁচার চেষ্টা করত। এখন তো তা অসম্ভব। বিমুগ্ধ গভীর ভাবে চিন্তা করে খুঁজতে চাইল নীহারিকাকে সে কেন হৃদয় দিয়ে বসল। সৌন্দর্য্য! সেটা তো বিমুগ্ধের কাছে নিছক ক্ষুদ্র ব্যাপার। জীবনে সে এতো সুন্দর রমণীদের দেখেছে যে সৌন্দর্য্যের চরম ব্যাখা সে একাই বলে দিতে সক্ষম। তাহলে কি? কথাগুলো ভাবতেই বিমুগ্ধ চমকে গেল। নীহারিকা তার কাছে অসম্ভব সৌন্দর্য্যের অধিকারী কখনো ছিল না। কিন্তু আজ জীবনে প্রথমবার বিমুগ্ধের মনে হলো এই পৃথিবীর আলাদা সব রমণীদের মাঝে এর সৌন্দর্য্য সূর্যকে ছুঁয়ে চন্দ্রে বাস করছে। কি আশ্চর্য্য সেই হাসি! পৃথিবীর প্রতিটি নারীর মাঝে সৌন্দর্য্য থাকে। প্রকৃত সত্য এটিই যা গোপনীয়। যার জন্যে এই সৌন্দর্য্য তৈরি সে ঠিক সময়ে খুঁজে নিবে। তার, তাদের, তাহাদের চোখে ঠিক পড়বে। এটাই নারী রূপের গোপন তথ্য। কিছু নারী সৌন্দর্য্য প্রকাশের জন্যেই জন্মে। কিন্তু কিছু সৌন্দর্য্য অত্যন্ত গোপন হয়। যা সবাই দেখতে বা ধরতে অসমর্থ।

জাওয়াদ রুমে ঢুকল জুতোর শব্দে। বিমুগ্ধ ভিজা ফতুয়া খুলে টি-শার্ট পড়ায় ব্যস্ত। নীহারিকার ড্রয়ার খুলে সে রহস্যময় হাসল। তার ঠোঁটের বাম পাশ বেশ ঝুঁকেছে। রুমাল আর কাগজে ভর্তি সেই ড্রয়ার হাঁটু ভাঁজ করে সে দেখছে। উল্টে পাল্টে। জাওয়াদ পিছনে ছিল। বিমুগ্ধ না দেখেই বলল,’ কি করছেন আপনি এখানে?’
জাওয়াদ আড়ম্বরপূর্ণ কথারম্ভ না করে রাগ প্রকাশ করল,’ নীহারিকার রুমে তুমি কি করছ বিমুগ্ধ?’
‘ এটি এখন আমার রুম। আপনার জানা নেই মনে হচ্ছে।’ বিমুগ্ধ লাইট জালিয়েছে। বাহিরে অন্ধকার নামছে প্রায়। সন্ধ্যার লালাব সূর্য তখন সাদা পর্দার উপরে। জাওয়াদ রুমটা ভালো করে দেখল। এটি নীহারিকার রুম হওয়ায় তার আসার কোন অনুমতি ছিল না। অথচ বিমুগ্ধ সেই রুমের সদস্য হয়ে গেল? কেন? জাওয়াদের নাক লাল চোখ উত্তপ্ত। রাগে অভিমানে সে চোখ বুজে নিল। নীহারিকা কেন এমন? কেন? বিমুগ্ধ হাসল। বিছানায় সুয়ে পড়ে এক হাত মাথার নিচে রেখে বলল,’ সে এমন দেখেই আপনার খুব পছন্দ।’
জাওয়াদ তড়িৎ করে তাকিয়ে বলল,’ শুধু পছন্দ না আই মেডলি লাভ উইথ হার বিমুগ্ধ।’ বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে শুয়ে রইল। ইশারা করে চেয়ার টেনে বসতে বলল। জাওয়াদ বসল না।
‘ নীহারিকাকে পছন্দ কর? কবে থেকে চিন ওকে? তোমাদের কি রিলেশন চলে বা ছিল? নীহারিকা তোমার সাথে পালিয়েছে তাই না?’ জাওয়াদ রাগে গজগজ করছে। বিমুগ্ধের মাথা আগে থেকে গরম আগুন ছিল। জাওয়াদ তাতে ঘি এর মত কাজ করছে। সে উঠে বসল। জাওয়াদকে সময় নিয়ে দেখে বলল,’ রাগেশ্বরী আমার পছন্দ বা ভালোবাসা কিছুই না।’
জাওয়াদ অবাক হয়ে গেল। বিমুগ্ধের দিকে তার সুন্দর চোখ তাকিয়ে। বিমুগ্ধ একটি কুশন বুকে নিয়ে বলল,’ এই সব এর ঊর্ধ্বে উঠে এসেছে সে। এগুলো অনেক আগের অনুভূতি। সে আমার জীবনে ধীরে ধীরে এসেছে। ঠিক বিন্দু বিন্দু রঙ্গের সাগর তৈরির মত। এখন কিছুই সম্ভব নয় জাওয়াদ। তাই আমার সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ করুন।’
বিমুগ্ধ ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে আবার একবার ফিরে বলল,’ নীহারিকা আমার রক্তে মিশে যাচ্ছে জাওয়াদ। যা আমি চেয়েও কখনো ছিন্ন করতে পারব না, পারছি না, পারা সম্ভবও না। নেশা করেছেন কখনো? আমার সাথে বসে করবেন একবার। ইনভাইট রইল। আর হ্যা রেগেশ্বরীর থেকে দূরে থাকবেন। আপনার এই সুন্দর চেহারা সুন্দর রূপ নষ্ট করতে চাইছি না।’
জাওয়াদ খুব করে টেনে তুলল বিমুগ্ধকে। হাসল বিমুগ্ধ। সে জানত জাওয়াদ এটি করবেই। রাগে ক্ষোবে ফেঁটে পড়ে জাওয়াদ বলল,’ তুমি আমার হবু বউকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। ছেড়ে দিব ভেবেছ?’
‘ আপনার বউকে আমি ভাগিয়ে নিয়ে যাইনি। তাকে নিজের নিজের করে চিৎকার করা বন্ধ করুন।’ বিমুগ্ধ ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। জাওয়াদ কেন সব সময় নীহারিকাকে নিজের বলে দাবি করে? কেন? অসহ্য যন্ত্রণা বিমুগ্ধকে আঁকড়ে ধরে তখন। রক্ত টগবগ করে দৌড়ায়।

এভাবেই তাদের এই ভয়ংকর মারামারির সূত্রপাত হয়। যা এখনও চলছে। নীহারিকা জায়গা থেকে সরে গেল। পিছনে এসে নবীন উদ্দীনকে ফিসফিস করে বলল,’ আপনার ছেলে মরে গেলে আপনার কষ্ট হবে না?’
তিনিও ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন,’ হবে না কেন? আমার রক্তের ছেলে কষ্ট তো হবেই।’
‘ তাহলে থামাচ্ছেন না কেন?’ রিনরিনে গলা নীহারিকার। নবীন উদ্দীন চোখ টিপ মেরে বলল,’ এই ছেলে আমার ছেলের কিছুই করতে পারবে না।’
‘ আপনি এদের থামাবেন না?’
‘ না।’ সোজা হয়ে গেল তিনি। একদম গম্ভীর। নীহারিকার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ছোট একটি বালতি খুঁজে বের করল। সেটিতে পানি ভর্তি করে নিয়ে আসল। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছুড়ে দিল দু’ জনের দিকে। বিমুগ্ধ জাওয়াদ এক সাথে চিৎকার করে সরে গেল। পানির কারনে তারা দেখতে পারল না কে মেরেছে। চোখের পানি মুছতে মুছতে দু’ জনে রেগে ইংরেজির গালি ঝাড়ল। নীহারিকার কট্টর চোখ। জাওয়াদ প্রথমে চুপ করল। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’ ওহ তুমি! স্যরি।’
‘ স্যরি আপনার পকেটে নিয়ে বের হয়ে যান।’
লীলাবতী নীহারিকার প্রতি চরম খুশি। তিনিও হুঙ্কার দিয়ে বললে,’ ইয়েস মাই সন বের হও।’
জাওয়াদ ব্যথায় কাঁতর চোখে তাকিয়ে বলল,’ আম্মু তুমিও? আচ্ছা একটু বসি।’
বিমুগ্ধ নিচেই বসে পড়ল। পানির উপরে। নীহারিকা ভয় পেয় গেল। তার ঠোঁট কান ফেঁটে রক্তাক্ত। কাছে এগিয়ে এসে দাড়াল। চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করল,’ কি হয়েছে? ব্যথা বেশি করছে? কে বলেছিল মারামারি করতে? বেশ হয়েছে। অসভ্য লোক একটি। দেখি উঠুন।’ ভয়ার্তক কণ্ঠ নীহারিকার। তার এই অতিযত্নের ব্যাকাংশ বিমুগ্ধের সকল ব্যথা মুহূর্তে সারিয়ে তুলল। সে তার ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে সবাইকে ভুলিয়ে দিল। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মারাত্মক ঘটনার পরেও হাসছে! জাওয়াদের শরীর আহতর সাথে অন্তরও জ্বলে গেল। নীহারিকা তাকে কেন প্রশ্ন করল না? সে ফ্লোরে বসেনি বলে? জাওয়াদ ভুলে গেল সে একজন উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার। তাও একজন সরকারী ডাক্তার। ভালোবাসা কি এমনই হয়? জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, সম্মান, উচ্চ, নিন্ম সব ভুলিয়ে দেয়। অন্য সময় হলে এসব মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। এখন যাচ্ছে না। অল্পতে কষ্ট হয়। নিজের স্থান ভুলে বাচ্চামিতে যোগ দিতে ইচ্ছে করে। জাওয়াদ নিজেকে কশতে শুরু করল। কেন সে এতো ভালোবেসে ফেলল! ওহ অসহ্য যন্ত্রণা চারদিকে। বিমুগ্ধ এখনও বসে আছে। নীহারিকা সকলের চক্ষু দেখে সরে আসল। জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’ অবস্থা তো বেশ খারাপ। আমি ফার্স্ট এইড বক্স এনে দিচ্ছি আপনি ব্যান্ডেজ করে নিন।’
আবার থেমে গিয়ে সে বলল,’ আপনারা কি পাগল? এভাবে লড়াই করছেন কেন? প্রফেশনাল দুশমি চলছে না কি? কিন্তু আপনি তো হার্টের ডাক্তার আর উনি পাগলের ডাক্তার।’ নবীন উদ্দীন চোখ রাঙ্গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’ কি বললে তুমি? পাগলের ডাক্তার?’
‘ পাগলের ডাক্তারকে কি বলব তাহলে?’ অবুঝ প্রশ্ন করল নীহারিকা। জাওয়াদ সোফায় বসল। মিতু আপু বক্স নিয়ে আসল। নীহারিকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ এটা আমাদের বাড়ি। কোন বক্সিং প্লাটফর্ম নয়। বেশি খেলতে ইচ্ছে করলে সেখানে যুক্ত হয়ে যান।’ জাওয়াদ বক্সের দিকে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা তাকে দিচ্ছে! তার কথা চিন্তা করছে! বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট বাঁকালো। জিৎ যেন তার। এসব কেমন পাগলামী বুঝতে পারছে না মিতু আপু। এদের মাঝের হিংসার উন্মত্ত পৃথ্বী কয়েকজন মানুষ ধরতে পারল তাদের মাঝে তিনি একজন। দু’ জনকে দেখেই তিনি ঠিক করেছেন নীহারিকাকে কাউকে দিবেন না। এসব পাগল ছাগলের কারো কাছেই নীহারিকা নিরাপদ নয়। ওর জন্য অন্য পাত্র তিনি খুঁজে বের করবেন। নিজ দায়িত্বে।’

বিমুগ্ধ ফ্লোরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। নীহারিকা তাকে কেন দেখছে না? সে কতটা জখম হয়েছে সেটা কি তার চোখে পড়ছে না? বিমুগ্ধর দম বন্ধ হয়ে আসল। তার চোখ মুখ লাল। জাওয়াদ যে ঘুঁষিগুলো বুকে দিয়েছে সেগুলো বেশ লেগেছে। আচ্ছা জাওয়াদ নীহারিকার ভালোবাসায় মরিয়া হয়ে গিয়েছে। সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নীহারিকার মনে কি চলছে? নীহারিকা কাকে ভালোবাসছে? কাকে বাসবে? বিমুগ্ধ মাথার উপরে হাত রেখে ভাবল নীহারিকার ভালোবাসা কেমন হবে? সে কিভাবে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে? আনজুম, শামাখালামনি, মা, রূবাইদা ছুটে আসল। প্রিয়মও যুক্ত হয়ে বিমুগ্ধকে টেনে তুলে বসাল। উদ্বিগ্ন গলায় যানতে চাইল,’ আপনি ঠিক আছেন? উঠুন। এসব জায়গায় ঔষুধ লাগাতে হবে। ইশ কি অবস্থা।’
বিমুগ্ধ তার রাগেশ্বরীর দিকে তাকাল। যে রেগে আগুন চোখ তাকে দেখছে। বিমুগ্ধ মনে মনে বলল,’ তোর বোন ঠিক থাকতে তো দিচ্ছে না। প্রিয়ম তোর কাছে কি তোর বোনের কাছ থেকে বাঁচার কোন ঔষুধ আছে? আমি ম/রে যাচ্ছি এই নেশায়, এই ভালোবাসায়।’
____________
ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। আকাশে তারার মেলা। কাল প্রচুর রোদ উঠবে। পুকুরের পানি কালো সবুজ। দু’ পাশে দু’ টি উঁচু সিঁড়ি আছে। জঙ্গলার কারণে কেউ এদিকে আসে না তেমন। লতাপাতায় ভয়ংকর দেখায় পুকুর পাড়কে। জোনাকি পোঁকা উড়ছে। বনফুলের দেখা পাওয়া যায় এখানে অনেক। থোকায় থোকায় লেবু ঝুলছে। সাদা হলদে লেবু ফুলের ঘ্রাণে শরীর তাজা হয়ে উঠে। লতানো গাছের মাঝে হলুদ ফুল। নিচে হলুদ ফুল। এই স্থানের নাম এখন থেকে হলদীয়ার দেশ। মশার কামড় খুব উপভোগ করা যায়। নিঝুম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। কিছুই দেখা যাচ্ছে না সামনে। পিছনে তাকালেই দেখা যাচ্ছে। দূরের সেই বাড়িটি থেকে আলো এসে লেপ্টে যাচ্ছে হলদীয়ার দেশের সাথে। বিমুগ্ধ আবিষ্কার করল এই জায়গাটি বাড়ির সবচেয়ে মনোরম আর স্নিগ্ধ একটি স্থান। ঠান্ডা হাওয়া এসে শীত ধরিয়ে দিচ্ছে তার শরীরে। মনটাকেও যদি শীতল করা যেত! বিমুগ্ধ কান খাড়া করল। এই অর্ধরাতে কেউ এদিকে আসার কথা না। দিনের বেলায় আসে না। রাতে কেন আসবে? সে পিছনে তাকালো। কেউ একজন মাথায় ঘোমটা টেনে হেঁটে হেঁটে আসছে। আরও কাছে আসতেই বিমুগ্ধ শুনতে পেল কেউ তাকে বদমাইশ বেয়াদপ, অসভ্য, ইতর বলে বকা দিতে দিতে এদিকে আসছে। কণ্ঠ শুনার সাথে সাথে তার লাভায় ঝলকানো বক্ষপিঞ্জর বরফ হয়ে গেল। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইল। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বিরিয়ে আসল,’ রাগেশ্বরী তুমি!’ নীহারিকা তখন খুব নিকটে। পায়ে মশার যন্ত্রনা দায়ক কামড়ে তার সব রক্ত শুলাচ্ছে। পা ঝেঁড়ে সে এসে দাড়ালো বিমুগ্ধের সামনে। বিমুগ্ধ চমকে যাওয়া চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল,’ তুমি এখানে কি করছ এতো রাতে?’
তারপরই সে নীহারিকার হালকা উঠে যাওয়া চাদরের নিচে হাত দেখল যা কামড়ে মশা লাল করে দিয়েছে। বিমুগ্ধ চোখ বুজে বসে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাসল। বলল,’ কাহিনী কি রাগেশ্বরী এতো রাতে প্রেম ট্রেম করতে এসেছ না কি?’
‘ হ্যা। চলুন প্রেম করি। আচ্ছা প্রেম শুরু করা হয় কিভাবে?’
বিমুগ্ধের বিস্ফারিত চোখ। চোখ খুলে সে আশ্চর্য হয়ে বলল,’ তুমি এধরণের কথা আমার সামনে বলবে না। রেগে রেগে থাকবে। বুঝতে পারছ তুমি?’
‘ না পাড়ছি না। ভালো করে বুঝিয়ে বলুন।’ নীহারিকা পাশে বসল। বিমুগ্ধ এতো ভয় পেল যে লাফিয়ে উঠে গেল। নীহারিকাকে ইদানিং তার ভয় করছে। বিমুগ্ধ আর ভয়! এ তো বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার মত কঠিন বিষয়। কিন্তু তার এই কঠিন বিষয়টি অতি সহজে হয়ে যাচ্ছে। এই যে তার হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। বিমুগ্ধ গলা গম্ভীর করে বলল,’ ওই সিঁড়িতে বসো।’
‘ ওই সিঁড়িতে বসলে তো যা করতে এসেছি তা করতে পারব না।’
‘ কি করতে এসেছ তুমি?’ কপালে ভাঁজ বিমুগ্ধের। নিম্ন কণ্ঠস্বর। নীহারিকা হেসে ফেলল। শব্দ করে। রাত কত বাজে? এতো রাতে এক জঙ্গলের পুকুরের দেশে একটি মেয়ে এমন পাগল করা হাসি দিয়ে তাকে পাগল করে দিতে এসেছে। এটা নীহারিকাই তো? প্যারানরমাল বিষয় সে বিশ্বাস করে। পৃথিবীতে এসবের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ভয় পায় না তেমন। বিমুগ্ধ একটু এগিয়ে আসল। নীহারিকার হাতে টর্চ লাইট। সে বিমুগ্ধের চোখের দিকে মেরে রেখেছে। তারপর হাসি থামিয়ে মৃদু শান্ত মোহনীয় গলায় ডাকল,’ এদিকে এসে বসুন। আমি আপনাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না।’ বিমুগ্ধ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে এগিয়ে এসে বসল। নীহারিকা জীবনে প্রথম কোন অন্য পুরুষের হাত নিজের ইচ্ছেই টেনে নিজের কাছে রাখল। বিমুগ্ধ বরফের মত জমে গেল। কত নারীর ছোঁয়াই তো সে পেরেছে। নীহারিকা কেন সবার থেকে আলাদা? এই অনুভূতি ভিন্ন। অবিশ্বাস্য। তার বুক শিরশির করছে। পায়ের তালুতে ঝিঝি ধরেছে। বিমুগ্ধের নিঃশ্বাস আটকে আসতে চাইছে। এটি রূপকথার দেশ। যেখানে সে আর তার হৃদয়ে বাস করা হরিণী ঘুরতে এসেছে। বেড়াতে এসেছে। ভালোবাসা আদান প্রদান করতে এসেছে। রাত তখন বারোটা প্রায়। নীহারিকা বক্স খুলে রাখল পাশে। হাতের পাশে ঔষুধ লাগাতেই বিমুগ্ধ ক্ষুদ্র চেঁচাল,’ কি করছ ব্যথা লাগছে।’ নীহারিকার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু হাসল না। গম্ভীর গলায় বলল, ‘ তখন ব্যথা হয়নি? এভাবে মারামারি করছিলেন কেন?’ বিমুগ্ধ তখন অনুভূতিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি তার হাত স্পর্শ করছে? তাকে সারিয়ে তুলতে চাইছে? এতো যত্ন! বিমুগ্ধ বাক্যহারিয়ে চোখে কথা বলছে। নীহারিকা হাতে ব্যান্ডেজ করল। মাথায় ঔষুধ লাগিয়ে দিল। কানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। মানুষটা এমন কেন? সন্ধ্যার পরে তাকে আর দেখা গেল না। নিজের ক্ষতস্থানে ঔষুধও লাগিয়ে নিলো না। শামাখালামনি চিন্তায় অস্থির। আর এই বান্দা ঝোপঝাড়ের ভিতরে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে বসে আছে। নীহারিকা কঠোর রাগ প্রকাশ করে বলল,’ আপনি প্রচন্ড বিরক্তি কর আপনি জানেন?’
বিমুগ্ধ প্রত্যত্তর করল না। সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার চট করে উঠে পড়ল নীহারিকা। তা দেখে বিমুগ্ধ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,’ আমার ঠোঁট কেঁটেছে।’
নীহারিকা চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সিঁড়িতে বসে পড়ল। পা ঝুলিয়ে। বিমুগ্ধ হতাশ গলায় বলল,’ ট্রিটমেন্ট সম্পূর্ণ কর। অর্ধেক করে উঠে গেলে কেন?’
‘ বেশ করেছি।’
‘ বেশ করতে হবে না এদিকে এসে আমার অধর ছুঁয়ে দেও।’
‘ আপনি এমন কেন? অসহ্য লাগছে আপনাকে আমার।’
‘ এতো কিছু লাগতে হবে না কাজ কমপ্লিট করে গেট লস্ট হও।’
কথার মাঝেই নীহারিকা নিজের বাম পায়ের জুতো খুলে বিমুগ্ধের বুকের উপরে ছুড়ে মারল। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে বিমুগ্ধ সেটি তুলে নিজের কাছে রাখল। বলল,’ তুমি রেগে আছো কেন?’
‘ আপনারা মারামারি করেছেন কেন?’
‘ এমনেতেই। এতো সিরিয়াস হয়ে লাভ নেই।’
‘ এমনি এমনি কেউ মারামারি করে? দেখুন বাড়িতে যতদিন থাকবেন এসব বন্ধ করে ভালো মানুষের মত থাকবেন।’
‘ আমি ভালো মানুষ নই?’ বিমুগ্ধ অবাক হওয়ার অভিনয় করল।
‘ এটা আবার নতুন করে বলার কি আছে? আপনি পৃথিবী বিখ্যাত খারাপ মানুষ। মেডিসিন নিবেন।’
বিমুগ্ধ চট করে তাকাল। কি ভালো লাগে নীহারিকার বকা শুনতে। মেয়েটি কি সত্যি এতো সৌন্দর্য্যের দাবিদার? বিমুগ্ধ হঠাৎ গম্ভীর। তার মন খুব খারাপ। নীহারিকা অবাক। বিমুগ্ধের তো কখনো মন খারাপ হয় না। এই ঝিম ধরা অল্প আলোয় সে বেশ বুঝতে পারছে বিমুগ্ধ বিষণ্ণ। কেন? নিরবতার গালিচা বিছানো এই রাতে দু’ টি নর নারী চুপ করে বসে আছে। পোকামাকড়ের ডাক দূর দূর থেকে শুনা যাচ্ছে। নিরবতা ছিন্ন করল বিমুগ্ধ। বলল,’ জাওয়াদ তোমাকে বিয়ে করতে চায়।’ বিমুগ্ধের চোখ অন্যদিকে। নীহারিকা চুপ করে আছে। বিমুগ্ধ একবার তাকিয়ে আবার বলল,’ সে আজ বিয়ের কথা বলতে এসেছে। তুমি জানতে?’
‘ না জানতাম না। এখন জানি। এই বিষয়ে কথা বলছেন কেন? আমার বিয়ে আপনার কি? আপনার বিয়ে নিয়ে আমি কিছু বলেছি? এসবের জন্য মারামারি করেছেন? আপনার সমস্যা কি?’ নীহারিকা উঠে দাড়িয়ে পড়ল। যে কাজে এসেছে তা শেষ। এখন যাওয়া উচিৎ। জাওয়াদের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। এই আহাম্মক এমন একটা আজব কাজ করতে এসেছে সে কিছুক্ষণ আগেই জেনেছে। বাড়ি শুদ্ধ সকলে রাজি। নীহারিকারও রাজি হওয়ার কথা। একটি ছেলে যাকে সে বিয়ের আসরে ফেলে পালাল। তাকে এতো এতো ইগনোর করল। তার অনুভূতি বুঝতে পেরে দূরে থাকল। অপমান করত। বিরক্তি ভাব প্রকাশ করত। রাগ দেখাত। আর সে তাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া! ছেলেটা কি আসলেই মানুষ? নীহারিকা ভেবে পাচ্ছে না।
‘ আপনার ধারণা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে না কি? আচ্ছা বলুন তো ডাঃ জাওয়াদের সাথে আমার বিয়ে হবে কি না?’ নীহারিকা আগ্রহী চোখের উপরে লাইটের অল্প অল্প আলো পড়ছে। বিমুগ্ধ তাকিয়ে বলল,’ আমি জানি না।’
‘ অবশ্যয় জানেন। এখন বলছেন না।’
‘ তুমি শুনতে চাও?’
‘ অবশ্যয়। বলুন কার সাথে হবে? আচ্ছা হাত গননা করতে পারেন? ধরুন আমার হাত দেখে একটু বলুন তো।’ নীহারিকা হাত বাড়িয়ে দিল। বিমুগ্ধ গভীর ভাবে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট নাড়িয়ে শুধু বলল,’ আমার ধারণা কাজ করছে না নীহারিকা। একদম কাজ করছে না।’
‘ কি বলেন? সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার তো। আঘাত কি মাথায় লেগেছে বেশি?’ নীহারিকার সিরিয়াস লুক। খুব চিন্তিত সে। বিমুগ্ধ হাসল না। আজ সে খুব গম্ভীর। নীহারিকার তাড়া,’ আরে দ্রুত বলুন মশা কামড়াচ্ছে।’
‘ বললাম তো কাজ করছে না।’
‘ হাত দেখে বলুন।’
‘ তোমার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ ধরতে কে বলেছে। এটার জন্যে তো অন্য কেউ আছে।’ নীহারিকা গোপনে হাসল। বিমুগ্ধের উদ্ভট চাহনী। সে দ্রুত শক্ত করে ধরল হাত। নরম তুলোর মত হাত তার গরম শক্ত হাতে ডেবে গেল। নীহারিকা ব্যথা পাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বলল,’ এভাবে কেউ ধরে?’
‘ আমি ধরি। শক্ত বাঁধন।’ দু’ জনের দীর্ঘশ্বাস এক সাথে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষের মত তার বিশ্রী অনুভূতি। বিমুগ্ধ হেসে উঠে বলল,’ বিয়ে তো হচ্ছে না। হার্টের ডাক্তারের বউ হওয়া তোমার কপালে নেই।’
‘ কি বলেন এটা তো হতেই পারে না।’ নীহারিকা অবিশ্বাস্য নজর। বিমুগ্ধর চারপাশে বিষণ্ণতা। নীহারিকা কেন এতো অবাক হচ্ছে? এটা কেন হতে পারে না? বিমুগ্ধের বুক শব্দ করে বেজে চলেছে। সে মিথ্যে বলেছে। ভয়ংকর মিথ্যে। বিপজ্জনক সত্য সে গোপন করেছে। আসলে তার ধারণা হচ্ছে অন্যকিছু। মনে হচ্ছে বিয়েটা হবে। জাওয়াদের হাতে নীহারিকার হাত। বিমুগ্ধ পিলে চমকে গেল। তার সব অনুভূতি ধ্বংস হয়ে গেল। হাত ছেড়ে সে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল,’ যাও এখান থেকে তুমি।’ নীহারিকার আহত নয়ন থৈ থৈ করে উঠল। সে তো বিমুগ্ধর মন ভালো করতে চেয়েছে। মানুষটা এতো বিষণ্ণ কেন আজ! মন খারাপের সাথে দেখা হয়ে গেল নীহারিকার।
পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে। যাদের সাথে হাসতে ভালো লাগে, ঝগড়া করতে ভালো লাগে, পাগলামী করতে ভালো লাগে। কিন্তু তাদের বকা খেতে, চিৎকার শুনতে বড্ড কষ্ট হয়। নীহারিকার এখন কষ্ট হচ্ছে। চরম কষ্টে চিত্তা দলছে। নীহারিকা সরে আসল। জঙ্গলের দিকে সে হাঁটছে। পিছনে ফিরে তাকালো দুই একবার। বিমুগ্ধের কি যে হলো সে ফিরলোই না। নীহারিকা কখনো বিমুগ্ধকে এমন রূপে দেখেনি। হঠাৎ মনে পড়ল হ্যা দেখেছে বিমুগ্ধের যখন প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল। আজও কি জ্বর? নীহারিকা দ্রুত পায়ে আবার বিমুগ্ধের সামনে দাড়াল। বিমুগ্ধ চোখ বুজে আছে। ডান হাত উল্টে মাথায় রাখতেই চমকে গেল। বিমুগ্ধর জ্বর এসেছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও জ্বর ছিল না। কি গরম মাথা! আগুনের মত। নীহারিকা উত্তেজিত হয়ে বলল,’ আপনার জ্বর এসেছে কেন? জখম গুলোর কারণে? বাসায় চলুন। মেডিসিন নিবেন। চলুন।’
বিমুগ্ধ শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,’ তোমার জন্য। এই জ্বরের নাম ভিন্ন। ঔষুধ ভিন্ন। কমার অনুভূতি ভিন্ন। এটিকে বলে ভালোবাসার জ্বর। আমি প্রচন্ড ভালোবাসায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই জ্বর আরও ভয়ংকর ভালোবাসার সূচনা। আমি কাউকে দিবো না। সব ধ্বংস করে দিব। তোমার জীবন শেষ করে দিব। আশেপাশের সবার সব কিছু বিধ্বস্ত করে দিব। আমার কিছু হলে আমি কাউকে ভালো থাকতে দিব না। তুমি তো জানো আমি স্বার্থপর মানুষ। চরম স্বার্থপর। তুমি বুঝতে পারছ?’
নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। চারপাশের ফিসফিস পোকার শব্দ তার কানে তীব্র ভাবে আঘাত করছে। বিমুগ্ধের চোখ লাল হয়ে গেছে। জ্বর তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। নীহারিকা শুকনো ঢোক গিলল। তার এখানে থাকতেই কেমন যেন লাগছে। সুনসান নিরব জঙ্গলে একটি জ্বরে আক্রান্ত মানুষ এমন মারাত্মক কথাবার্তা বললে তো পাগল পাগল লাগারই কথা। অথচ তার লাগছে না। সে ভয়ে ভয়ে হাসল। মৃদু সেই হাসির কোন ভূমিকা উপসংহার নেই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভালো লাগা, ভালোবাসা, প্রকাশের ধরণ ভিন্ন হয়। আলাদা হয়। নীহারিকারটা কেমন? সে কিভাবে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবে? বিমুগ্ধ মাথা ঝাকাল। তার কি সব অন্ধকার হয়ে আসছে? নীহারিকা কি সত্যি জাওয়াদকে বিয়ে করবে? নীহারিকার কোমল হাত কি সত্যি জাওয়াদ ধরবে? নীহারিকা সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছে। আধার কালো অন্ধকারে সে ডুবে যাচ্ছে। বিমুগ্ধ পিছন থেকে নেশা নেশা ঢুলু গলায় ডাকল,’ রাগেশ্বরী তুমি চলে যাচ্ছ কেন? এখানে থাক একটু। পাশে বসো। হাত রাখো কপালে। মাথা রাখো কোলে।’
নীহারিকা শুনলো। কিন্তু পিছনে তাকালো না। তার দীর্ঘশ্বাস গুনছে হলদীয়ার দেশের লতাপাতা।
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here